আপনার ছাত্ররা অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে এলো, কোচ হিসেবে অনুভূতি কেমন?
মন্টু দত্ত: যে কোনো কিছুর চ্যাম্পিয়ন হওয়ার অনুভূতি আসলে গর্বের। আর এসব টুর্নামেন্টে যদি আট জন ছেলে আমাদের থাকে, এটা অবশ্যই অনেক গর্বের বিষয়।
বিশ্বকাপ জিতে আসার পরই তারা বিকেএসপিতে এসে খেলল, একটা টেস্ট খেলুড়ে দলের বিপক্ষে, বিষয়টা কীভাবে দেখছেন?
মন্টু: আমি মনে করি এটা ওদের প্রাপ্য। আমি চাই না ওরা জাতীয় দলে এত তাড়াতাড়ি ঢুকে যাক। ওরা একটা করে ধাপ পার করেই আসুক। যেহেতু এটা একটা প্রস্তুতি ম্যাচ। এখান থেকে খেলে আরেকটা ধাপে যাবে। এভাবে ধাপে ধাপে যেন ওরা ওপরে ওঠে।
তাদের গড়ে তোলার প্রক্রিয়াটা কেমন ছিল, কোন কোন বিষয় নিয়ে বেশি কাজ করা হতো?
মন্টু: আমরা ওদের স্কিল নিয়ে বেশি কাজ করেছি। স্কিল এবং ম্যাচ পারফরম্যান্স। দিনের পর দিন আমরা ওদের নিয়ে কাজ করেছি। আমরা ওদের স্কিলের যত উন্নতি করে দিতে পারব, যখন ওরা আরও ওপরে যাবে তখন তাদের (কোচ) দায়িত্ব থাকবে ওই স্কিল থেকে কৌশলগতভাবে ওদের আরও কীভাবে উন্নতি করা যায়। এটা শুধু বিকেএসপির না। পাশাপাশি বিসিবিরও দায়িত্ব আছে। যে ছেলেগুলো বিকেএসপি থেকে বের হয়ে যাচ্ছে, তাদেরকে ধরে রাখতে হবে।
চ্যাম্পিয়ন হয়ে আসার পর তাদের নিয়ে সবার প্রত্যাশা অনেক বেশি থাকবে। এটা তাদের জন্য চাপের হয়ে যাবে কি না?
মন্টু: এই চাপটা যারা নিতে পারবে তারা ভালো করবে। অনেকে কিন্তু মিডিয়ার চাপে গা ভাসিয়ে দেয়। আমি আকবরকেও বলেছি যে, ‘আকবর, এখনো কিছুই হয়নি, একটা ধাপ পার হয়েছো শুধু। এটা তোমার আসল জায়গা না। তোমার জায়গা হলো জাতীয় দলে। এজন্য এত ভেসে যেও না, তোমার কাজ তুমি করবে।’ ও অবশ্য জবাবটা খুব সুন্দর দিয়েছে, ‘না স্যার, আমি এখনো পর্যন্ত ভেসে যাইনি। আমি চাই আমার আসল লক্ষ্য যেটা, সেখানে পৌঁছাতে।’
বিকেএসপির যে ৮ জন বিশ্বকাপে ছিল, তাদের মধ্যে কার কার লম্বা পথ পাড়ি দেওয়ার ভালো সম্ভাবনা দেখছেন?
মন্টু: আমি এর মধ্যে মাহমুদুল হাসান জয়কে এগিয়ে রাখব, ওর ভবিষ্যৎ অনেক ভালো। আকবরকেও এগিয়ে রাখব। আসলে সবাই থাকবে, তানজিম হাসান সাকিব, পারভেজ হোসেন ইমন, প্রান্তিক নওরোজ নাবিল। হাসান মুরাদকেও আমি কম বলব না,ও অনেক ভালো বোলিং করে। শাহিন আলম, ভালো পেস আছে। এখন ওর যদি নিয়ন্ত্রণটা চলে আসে, সেও ভালো করবে।
শামীম হোসেনের কথা যদি বলি, ও অনেক ভালো খেলোয়াড়। হয়তো সে বিশ্বকাপে বোলার হিসেবে বোলিং করেছে। কিন্তু ওকে ব্যাটসম্যান হিসেবে আমি অনেক এগিয়ে রাখি। আশা করি একটা সময় ও জাতীয় দলে আসবে। বোলিংয়ের চেয়ে ওর ব্যাটিং ও ফিল্ডিংটা অনেক ভালো। যদিও বিশ্বকাপে অত ভালো পারফরম্যান্স করতে পারেনি। সত্যি বলতে সে মূলত বোলার না, পার্ট-টাইম বোলার হিসেবে যতটুকু করেছে। ব্যাটিংয়ের দিকে যেন সবাই একটু দৃষ্টি রাখে। ও একজন ভালো ব্যাটসম্যান হিসেবে বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করার ক্ষমতা রাখে।
আকবরকে কীভাবে দেখেছেন?
মন্টু: আকবরের যে ব্যাপারটা, অনেক সময় ওর মাথা গরম হয়ে যেত। কিন্তু এই বিশ্বকাপে আমি দেখলাম যে, ও অনেক শান্ত। এর আগে আপনার মনে আছে কি না, ভারতের বিপক্ষে একটা ম্যাচ (২০১৯ অনূর্ধ্ব-১৯ এশিয়া কাপ ফাইনাল) আমরা খুব কাছাকাছি গিয়ে হেরেছি। এই আকবর আর শামীমই ছিল, ওরা মনে করেছিল আমাদের পরে তো ব্যাটসম্যান আছে। এটা ধরলে তো হবে না। ধরতে হবে যে, আমরা দুজন আজ দায়িত্ব নিয়েছি, আমরা শেষ করে আসব।
যেমন, জয় যেদিন সেঞ্চুরি করল (সেমিফাইনালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে), আমি কিন্তু ওকে বকা দিয়েছি। রাতের বেলা ফোন করে জানিয়েছি, ‘তুমি সেঞ্চুরি করলে, তার পরের বলেই আউট, এটা কেন হলো?’ আমি বললাম, ‘অতি উৎসাহী হওয়া ভালো নয়, আর ৯-১০ রান আছে। নট আউট থাকতে।’ ও বলল, ‘ঠিক আছে স্যার, এবার থেকে দেখব।’
পুরনো ছাত্রদের জন্য কী পরামর্শ থাকবে আপনার?
মন্টু: আমার পরামর্শ থাকবে অনুশীলনের দিকে যেন ওরা সব সময় খেয়াল রাখে। পাশাপাশি কিছু ভালো বই পড়তে হবে, যে বইগুলো তাদের কাজে লাগবে। যেমন টেন্ডুলকারের ইতিহাস কিছু জানা দরকার। বড় বড় খেলোয়াড়ের জীবনী জানা দরকার, এগুলো কিন্তু খেলার ক্ষেত্রে অনেক কাজে লাগে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, কিছু জিনিস আমরা বলছি ওরা বুঝতে পারছে না। কিন্তু একটা বড় খেলোয়াড়ের জীবনী পড়ে বা বড় খেলোয়াড়ের সান্নিধ্যে গেলে ওই ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে যায়।
বিকেএসপির কেউ সেঞ্চুরি করলে কিংবা পাঁচ উইকেট পেলে তাকে আপনি নিজের স্বাক্ষর করা ১০০ টাকা দেন। বিশ্বকাপে সেঞ্চুরির জন্য গতকাল মাহমুদুলকে দিলেন। টাকা দেওয়ার এই ভাবনাটা কোথা থেকে এলো আপনার?
মন্টু: যখন আমি এখানে চাকরি শুরু করি, তখন মনে হলো কিছু একটা দিয়ে উৎসাহ দেওয়া দরকার। তখন বেতন অনেক কম ছিল। তখন আমি তাদের একটা সেঞ্চুরি করলে বা পাঁচ উইকেট পেলে ১০০ টাকা করে দিতাম। পরে অনেক ছেলে বলেছিল, ‘স্যার এটাকে ৫০০ টাকা করেন।’ আমি বলেছি, ‘না, যেটা ধরে রেখেছি আমি, ওই ১০০ টাকাই পাবা। কিন্তু এটাকে তোমরা টাকা হিসেবে নিও না। এটাকে তোমরা উৎসাহ হিসেবে নাও- একজন সেঞ্চুরি করেছে, আমাকেও করতে হবে।’
মূল কথা হলো এই উৎসাহ দেওয়ার জন্যই আমি এটা করি। প্রস্তুতি ম্যাচ, বয়স ভিত্তিক ম্যাচ; যেখানেই পাঁচ উইকেট পাক, সেঞ্চুরি করুক; বিকেএসপির যে ছেলেই হোক, আমি টাকা দিই।
একবার জয় ৯৯ করেছিল (নিউজিল্যান্ড সফরে)। পরে আমাকে ম্যাসেঞ্জারে লিখেছে, ‘স্যার ১ রান তো হলো না, আমি কি ১০০ টাকা পাব না?’ আমিও হেসে বলেছি, ‘১ রান কিন্তু অনেক। ওই ১ রানের জন্য একটা জায়গায় লেখা হয় না, তুমি সেঞ্চুরি করেছো। তাহলে কি তোমার পাওয়া উচিত।’ এর পরের ম্যাচেই ও সেঞ্চুরি করেছে।
বিকেএসপি থেকে এবার বিশ্বকাপে আট জন ছিল, পরের আসরে কজন থাকার সম্ভাবনা দেখছেন?
মন্টু: আমরা চেষ্টা করব আট জনের বেশি দিতে। আমাদের চেষ্টাটা যদি সফল হয় তাহলে মনে করব যে, আমরা কাজ করছি। আর যদি এর নিচে নেমে যায়, দেখা গেল আট জনের জায়গায় ছয় জন, তাহলে বুঝতে হবে আমাদের কোনো না কোনো জায়গায় ব্যর্থতা আছে। এবং ওই ব্যর্থতার ফাঁকটা খুঁজেই আমাদের আরও এগিয়ে যাওয়ার জন্য কাজ করতে হবে। আমরা চেষ্টা করব আর আট বা এর বেশি খেলোয়াড় যাতে দিতে পারি।
অনূর্ধ্ব-১৯ পার হয়ে আসার পর অতীতে অনেক ক্রিকেটার হারিয়ে গেছে। এই ক্রিকেটারদের ধরে রাখতে অনূর্ধ্ব-২১ দল শুরু করতে যাচ্ছে বিসিবি। আকবর-মাহমুদুলদের দিয়েই যেটার শুরু হচ্ছে। এটাকে কীভাবে দেখছেন?
মন্টু: আমি বোর্ডকে ধন্যবাদ জানাই, এবার চ্যাম্পিয়ন হয়ে আসার পর উনারা এমন একটা প্রক্রিয়া চালু করতে যাচ্ছে। উনিশের পরে দেখা যায় এই ছেলেদের হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এই যে উনিশ থেকে অনূর্ধ্ব-২১ পর্যন্ত চুক্তি করে ওদেরকে বেতনভুক্ত অনুশীলন করাবে, এটা তাদের জন্য অনেক বড় পাওয়া।
আগে অনূর্ধ্ব-১৯ খেলার পর অনেক খেলোয়াড় হারিয়ে যেত। আপনারা দেখে থাকবেন, আশিকুর রহমান বাঁধন; অনূর্ধ্ব-১৯ দলের অধিনায়ক ছিল (দেশের মাটিতে ২০০৪ সালের আসরে)। সেই ছেলেটাকে এখন খুঁজে পাওয়া যায় না। কেন হারিয়েছে? ওই যে উনিশ থেকে ২১-এ যাওয়ার কোনো স্টেজ ছিল না। অর্থাৎ বোর্ড যদি এই ব্যাপারটা দেখে, তাহলে যে যে ছেলেই হোক, তারা ওপরে যাবে।