লিটন-আফিফ ও শান্ত-মিরাজ, সফল দুই জুটির দ্বৈরথ

মিরপুর একাডেমি মাঠে ফিল্ডিং অনুশীলন করছিলেন নাজমুল হোসেন শান্ত ও মেহেদী হাসান মিরাজ। খুলনা টাইগার্সের অনুশীলনে দুজনকে দেখা গেল দারুণ প্রাণবন্ত। রাজশাহী রয়্যালসের অনুশীলন ছিল না। নিজের তাগিদে তবু ব্যাটিং করতে এসেছিলেন লিটন দাস। একাডেমি মাঠে দেখা হলো তাদের, একচোট আড্ডাও জমল তিন জনের। স্রেফ আফিফ হোসেন থাকলেই পেত পূর্ণতা। এই বিপিএলের চার আলোচিত চরিত্রকে পাওয়া যেত এক ফ্রেমে!

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 Jan 2020, 02:10 PM
Updated : 16 Jan 2020, 02:10 PM

চার জনই দারুণ সম্ভাবনাময় ক্রিকেটার। তাদের ব্যাটিং নিয়ে আছে কম-বেশি হতাশার জায়গাও। তবে বঙ্গবন্ধু বিপিএলে মিলেছে তাদেরকে নিয়ে নতুন করে স্বপ্ন দেখার সাহস। জুটি বেঁধে তাদের ব্যাটিং উপহার দিয়েছে আনন্দময় বিস্ময়। এবারের আসর থেকে দেশের ক্রিকেটের বড় প্রাপ্তি সম্ভবত খুলনা ও রাজশাহীর শুরুর জুটিতে এই চার জনের পারফরম্যান্স।

লিটন ও আফিফের যুগলবন্দী নিঃসন্দেহে এবারের বিপিএলের সেরা উদ্বোধনী জুটি। ধারাবাহিকতা, ব্যাটিংয়ের ধরন, দলের পারফরম্যান্সে প্রভাব, সবকিছু মিলিয়ে রাজশাহীর ফাইনালের পথে এগিয়ে যাওয়ায় বড় ভূমিকা এই উদ্বোধনী জুটির।

আসরের দ্বিতীয় ভাগে কোনো অংশে কম যায়নি শান্ত ও মিরাজ জুটিও। এই জুটির সূচনা টুর্নামেন্টের মাঝামাঝি থেকে। ফাইনালের পথে খুলনার এগিয়ে চলা মসৃণ হয়েছে চমক জাগানিয়া এই জুটির সৌজন্যে। চমকের কারণ, দুজনের পারফরম্যান্স ও প্রেক্ষাপট।

বয়সভিত্তিক পর্যায়ে যিনি ছিলেন ‘জেনুইন’ অলরাউন্ডার, ব্যাটিং-বোলিংয়ে দক্ষতা ছিল সমান, জাতীয় দলে আসার পর সেই মিরাজ অনেকটাই হয়ে গিয়েছিলেন বোলার। ব্যাটিংয়ে ঝলক মাঝেমধ্যে দেখিয়েছেন বটে, তবে ছিল ধারাবাহিকতার অভাব।

এবার সেই মিরাজের রান এখন পর্যন্ত ২৮৮, গড় ৩৬। সবচেয়ে নজরকাড়া তার স্ট্রাইক রেট, ১৩২.১১! তবে এই পরিসংখ্যানের চেয়েও বিস্ময়কর তার ব্যাটিং পজিশন। টি-টোয়েন্টিতে ওপেনিংয়ে নেমে মিরাজ কার্যকর হতে পারেন, এই বিপিএলের আগে কে ভাবতে পেরেছিল! অনূর্ধ্ব-১৯ পর্যায়ে বাংলাদেশের অধিনায়ক ও সহ-অধিনায়ক, দুই কাছের বন্ধু মিরাজ ও শান্ত মিলে গড়ে তুলেছেন দারুণ কার্যকর উদ্বোধনী জুটি।

দীর্ঘ হতাশার খোলস ভেঙে শান্ত অবশেষে বেরিয়ে এসেছেন এই বিপিএলের শেষ দিকে। এবারও শুরুটা তার ছিল যথারীতি ব্যর্থতায় মোড়ানো। প্রথম চার ম্যাচ মিলিয়ে করতে পেরেছিলেন কেবল ৬ রান। একবার বাদ পড়েছেন, একবার বাইরে গেছেন চোটের কারণে। এরপর ধীরে ধীরে খুঁজে পেয়েছেন নিজেকে। সবশেষ দুই ম্যাচে জ্বলে উঠেছেন চোখধাঁধানো ব্যাটিংয়ে।

এবারের আসরে বাংলাদেশের প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে করেছেন সেঞ্চুরি। সেই ম্যাচে ৫৭ বলে অপরাজিত ১১৫ রানের ইনিংসের পর কোয়ালিফায়ারে ৫৭ বলে অপরাজিত ৭৮ রান করেন শান্ত।

খুলনা এবার শুরু করেছিল শান্তর সঙ্গে রহমানউল্লাহ গুরবাজের উদ্বোধনী জুটি দিয়ে। শান্ত ব্যর্থ ছিলেন সেই ম্যাচে, গুরবাজ করেছিলেন ঝড়ো ফিফটি। পরের দুই ম্যাচেও সফল হয়নি দুজনের জুটি। চতুর্থ ম্যাচে জায়গা হারান শান্ত, গুরবাজের সঙ্গে ইনিংস শুরু করেন সাইফ হাসান। ব্যর্থ এই দুজনও।

গুরবাজ সুযোগ পান আরেকটি ম্যাচে। এবার তার সঙ্গী মিরাজ। কিন্তু প্রথমবার ইনিংস শুরু করে মিরাজ ফেরেন শূন্য রানে। গুরবাজের ব্যাটেও ছিল না বড় রান। খুলনার ষষ্ঠ ম্যাচে প্রথমবার একসঙ্গে ইনিংস শুরু করেন শান্ত ও মিরাজ। ১.৫ ওভারের উদ্বোধনী জুটিতে আসে ২৩ রান।

সেদিন যা ছিল ইঙ্গিত, পরের ম্যাচে তা পায় পূর্ণতা। ১১৫ রানের উদ্বোধনী জুটিতে অবাক করে দেন দুজন। এরপর চলতে থাকে ধারা। আরও তিন ম্যাচে এই দুজনের উদ্বোধনী জুটি ছাড়িয়েছে ৭০। দুজন রানও তুলেছেন যথেষ্ট দ্রুততায়। রাইলি রুশো, মুশফিকুর রহিমদের জন্য গড়ে দিয়েছেন মঞ্চ।

ফাইনালের আগের দিন দুজনের পারফরম্যান্স নিয়ে উচ্ছ্বসিত প্রতিক্রিয়া জানালেন খুলনা কোচ জেমস ফস্টার।

“মনে করতে পারছি না (কিভাবে মিরাজকে ওপেনিংয়ে তুলে আনা হয়েছিল)…আমরা দেখতে চেয়েছিলাম মিরাজ কেমন করে। যেভাবে ওরা দুজন খেলেছে, আমরা খুবই খুশি। ওদের আত্মবিশ্বাস এখন তুঙ্গে, খুবই ভালো অবস্থায় আছে ওরা।”

বিপিএলের শুরুতে দেখা যায়নি লিটন ও আফিফের জুটিও। সেটি হওয়ারও কথা নয়, আফিফ তো নিয়মিত ওপেনার নন! প্রথম ম্যাচে লিটন ও হজরতউল্লাহ জাজাইয়ের জুটি রাজশাহীকে এনে দিয়েছিল দুর্দান্ত শুরু।

তবে পরের দুই ম্যাচে ব্যর্থ হন জাজাই। চতুর্থ ম্যাচে লিটনের সঙ্গে ওপেনিংয়ে পাঠানো হয় আফিফকে। বাকিটা, লোকে যেমন বলে থাকেন, ‘ইতিহাস!’ এই দুজনই গড়ে তুলেছেন আসরের সফলতম উদ্বোধনী জুটি।

দুজনের প্রথম জুটিতে আসে ৭৫ রান। পরের ম্যাচে জুটি ৬০ রানের, এর পরেরটিতে ৫৬! সব মিলিয়ে ছয় ম্যাচে এই জুটি দলকে এনে দিয়েছে অর্ধশত রানের শুরু।

রানের চেয়েও বেশি নজরকাড়া ছিল দুজনের রসায়ন। শট খেলতে ভালোবাসেন দুজনই, কয়েকটি ম্যাচে শুরুতেই গুঁড়িয়ে দিয়েছেন প্রতিপক্ষ বোলারদের মনোবল। কোনো ম্যাচে আবার একজন শট খেললে, আরেকজন দিয়ে গেছেন সঙ্গ। লিটনের সমৃদ্ধ শটের ভান্ডার, আফিফের ভয়ডরহীন মানসিকতা মিলিয়ে জুটি হয়ে উঠেছে দারুণ কার্যকর ও দর্শনীয়।

দুজনের বোঝাপড়া, রানিং বিটুইন দা উইকেট ছিল দুর্দান্ত। এমনকি জাতীয় দলের জন্যও সম্ভাবনার ঝিলিক মিলেছে এবারের আসরে দুজনের জুটি থেকে।

লিটনের ব্যাটিংয়ে ধারাবাহিকতার অভাব নিয়ে দেশের ক্রিকেটে এত হাহুতাশ। বদলে যাওয়ার ইঙ্গিত দিয়ে তিনিই আসরের সফলতম ওপেনার। জুটির পাশাপাশি ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সেও খুব পিছিয়ে নেই আফিফ।

সবশেষ দুই ম্যাচে যদিও জুটি হিসেবে দলকে ভালো শুরু এনে দিতে পারেননি তারা, কিন্তু আগের পারফরম্যান্স তো ভুলে যাওয়ার মতো নয়। ফাইনালের আগের দিন রাজশাহী অধিনায়ক আন্দ্রে রাসলের কণ্ঠে উঠে এলো এই জুটির গুরুত্ব।

“যে কোনো দলের, শুরুতে যদি ভালো দুজন ব্যাটসম্যান থাকে, প্রথম ছয় ওভারে ভালো স্কোরের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। আমাদের হয়ে আফিফ ও লিটন যেটি দারুণভাবে করেছে। শেষ দুই ম্যাচে ওরা ভালো করতে পারেনি, তবে তাদেরকে হিসেবের বাইরে রাখার কোনো কারণ নেই। আমি নিশ্চিত, ফাইনালে ওরা ভালো শুরু এনে দেবে।”

শুক্রবার টুর্নামেন্টের ফাইনালের ভাগ্যও হয়তো অনেকটা নির্ভর করবে দুই দলের উদ্বোধনী জুটির ওপর। শান্ত-মিরাজ আর আফিফ-লিটন জুটির লড়াইয়ে জিতবে যে জুটি, ট্রফি জয়ের দিকেও অনেকটা এগিয়ে যাবে তাদের দল।