সবশেষ ম্যাচ খেলেছেন সাইফ, চার মাস হতে চলল। মাঝের সময়টায় পিঠের চোটের সঙ্গে লড়াই করতে হয়েছে, বিরক্তিকর অপেক্ষায় দিন কেটেছে, ভবিষ্যৎ নিয়ে দুর্ভাবনায় মন পুড়েছে। মাঠের ঘ্রাণ যাদের জন্য অক্সিজেন, লম্বা সময় বাইরে থাকলে তাদের দম বন্ধ হয়ে আসার কথা!
অবশেষে মিলেছে মুক্তি। চেনা আঙিনায় স্বস্তির শ্বাস নিতে শুরু করেছেন কিছুদিন ধরে। ছোট্ট রান আপে বোলিং শুরু করেছেন, নেটে ব্যাটিংয়ে ফিরলেন। একটু একটু করে তরুণ অলরাউন্ডার এগিয়ে চলেছেন পুরো ফিট হওয়ার পথে।
ফেরার কাছে
গত ২১ সেপ্টেম্বর সবশেষ ম্যাচ খেলেছেন সাইফ। সেটি ছিল দেশের মাটিতে ত্রিদেশীয় টি-টোয়েন্টি সিরিজের ম্যাচ। এরপর ভারত সফরের টি-টোয়েন্টি দলে তাকে রাখা হয়েছিল। কিন্তু স্ক্যান করিয়ে দেখা যায়, তার পিঠের অবস্থা গুরুতর। শুরু হয় বিশ্রাম পর্ব আর কাতর প্রতীক্ষায় ফেরার দিন গোনা।
সেই অপেক্ষা শেষ হয়েছে সম্প্রতি। ফিটনেস ট্রেনিং দিয়ে শুরু করেছিলেন। টুকটাক বোলিং করছেন এখন। মঙ্গলবার শের-ই-বাংলা স্টেডিয়ামের জিমে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটমের সঙ্গে আলাপচারিতায় সাইফ জানালেন তার অগ্রগতি।
“ব্যাটিংয়ের আগে ড্রিল করেছি এই কদিন। আজ নেটে পুরোপুরি ব্যাটিং করব। তবে বোলিংটাই আসল ফিট হওয়ার জন্য। এখন ৩০-৪০ ভাগ দিয়ে বোলিং করছি। ৭০-৮০ ভাগ দিয়ে বোলিং শুরু করলে বুঝতে পারব কী অবস্থা। আপাতত ভালো অনুভব করছি।”
চোট নিয়ে ঘরে বসে থাকা যতটা বিরক্তির, পুনবার্সন প্রক্রিয়া আরও বেশি কষ্টদায়ক। শরীরের সঙ্গে লড়াই, খুব সাবধানতায় সূচি মেনে চলা, একটু একটু করে নিজেকে তৈরি করা, এসব ভীষণ ক্লান্তিকরও বটে।
তবে বিশ্রাম নিতে নিতে ক্লান্ত সাইফ এখন এই কষ্টই উপোভাগ করছেন। মাঠের ফেরার তাড়নাও তাকে জোগাচ্ছে অনুপ্রেরণা। বাংলাদেশ পাকিস্তান সফরে গেলেও সাইফের ফেরা হবে না। তার চোখ আগামী মাসের জিম্বাবুয়ে সিরিজের দিকে।
“আমি সত্যিই উপভোগ করছি। অনেক কষ্টকর যদিও। ১ ঘণ্টার মতো কাজ হচ্ছে প্রতিদিন, অনেক হাই ইনটেনসিটি থাকে জুলিয়ানের (কালেফাতো) কাজে। তার পরও কষ্ট করছি পুরো ফিট হয়ে উঠতে।”
“আপাতত আমাকে সূচি দেওয়া হয়েছে, দুই সপ্তাহ পর আশা করি সবকিছু পুরোপুরি শুরু করতে পারব। জাতীয় দলের কথা বললে, জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সিরিজের আগে আশা করি পুরোপুরি ফিট হয়ে উঠতে পারব।”
হতাশার দিন-রাত্রি
পিঠের এই চোট সেই বয়সভিত্তিক পর্যায় থেকে সঙ্গী সাইফের। এটিকে বশ করেই এগিয়ে নিয়েছেন ক্যারিয়ার। কিন্তু গত বিশ্বকাপ থেকে আবার এটি মাথাচাড়া দেয় প্রবলভাবে। তারপরও কোনোরকমে সামলে খেলেছেন কিছুদিন। কখনও ব্যথা তীব্র হয়েছে, কখনও মিলিয়ে গেছে।
নানা কথাও শোনা গেছে এই সময়। অস্ত্রোপচার ছাড়া মুক্তি নেই, এরকমও বলেছিলেন চিকিৎসকেরা। তার স্ক্যান রিপোর্ট পাঠানো হয়েছিল ইংল্যান্ডে। অস্ত্রোপচার কোথায় হবে, সেটি নিয়েও চলছিল আলোচনা। শেষ পর্যন্ত অস্ত্রোপচার লাগেনি। তবে ক্যারিয়ারঘাতী চোট হতে পারে বলেই আর কোনো ঝুঁকি না নিয়ে লম্বা সময়ের বিশ্রাম দেওয়া হয়েছে তাকে।
কিন্তু সবুজের মায়ায় যাদের প্রাণ বাঁধা, চার দেয়ালের ভেতর কী আর তাদের মন টেকে! পাশাপাশি দুশ্চিন্তার মেঘও দানা বাধছিল মনে। খেলাধুলার জগতটাই এমন, শূন্যতা পূরণ করে দিতে কেউ না কেউ চলে আসেই। সাইফ ছিলেন নানা দোলাচলে।
“এই হতাশা আসলে ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। লম্বা সময় যে বাইরে থাকে, কেবল সে-ই বুঝতে পারবে। সবাই খেলছে, আমি পারছি না, প্রচণ্ড খারাপ লাগে। ইনজুরিতে থাকলে অনেক রকম চিন্তা আসেও খেলোয়াড়দের মাথায়। ফিট হয়ে ওঠার চিন্তা তো আছেই। পাশাপাশি ভাবনা আসে যে আবার জায়গা মিলবে কিনা!”
“খেলাধুলায় কারও জায়গা স্থায়ী নয়। একজনের জায়গা নেওয়ার জন্য পাঁচজন অপেক্ষা করে থাকে। এই দুর্ভাবনা, অনিশ্চয়তা কাজ করে। যেহেতু আমি জাতীয় দলে এখনও জায়গা পাকা করতে পারিনি, নানারকম ভাবনা আসেই।”
“প্রথম ২ মাস খুব খারাপ কেটেছে। মানসিকভাবে অনেক কঠিন ছিল। কিছুই করতে পারছিলাম না। মাঠে, জিমে সময় কাটাতেই আমাদের ভালো লাগে। হঠাৎ করে দিনের পর দিন বসে থাকা, কোনো কাজ নেই, খুব খারাপ লাগত।”
“বাইরে গিয়েও বেশি সময় কাটানোর উপায় ছিল না। লোকে নানা প্রশ্ন করত, ‘কবে ফিরব, কি হয়েছে, কোথায় সমস্যা…।’ অনেককেই হয়তো হেসে জবাব দিয়েছি। কিন্তু কত আর জবাব দেওয়া যায়! নিজেরই খারাপ লাগত।”
দুঃসময় মানুষকে শেখায় অনেক কিছু। ২৩ বছর বয়সী সাইফও জীবনের কঠিন বাস্তবতার আঁচ অনেকটা পেয়েছেন এই সময়ে। তবে যথারীতি তাকে আড়াল করেছে পরিবার নামক ঢাল।
“একজন ক্রিকেটার যখন খারাপ সময়ে থাকে বা ইনজুরিতে পড়ে, তখনই চারপাশের মানুষদের চেনা যায়, কে সত্যিকারের বন্ধু-শুভাকাঙ্ক্ষী, আর কে আলগা। আমিও বুঝেছি।”
“তবে পরিবারকে পাশে পেয়েছি। এমনিতে আমার পরিবার খেলা নিয়ে খুব মাথা ঘাটায় না। আমার মা খেলা বোঝেন না। ভাই খেলা বোঝেন, কিন্তু এত বেশি কথা বলেন না। ডেভিড মিলারের কাছে ৫ ছক্কা খাওয়ার পর ভাই ফোন দিয়ে বলেছেন যে, ‘আরে কিছু হয়নি, এসব হয়ই।’ আমি খেললে তারা সবাই দেখেন। এবার বিপিএলে আমি খেলিনি, ওরা কেউ সেভাবে খেলাই দেখেনি।”
পরিবারের বাইরের একজনকেও পাশে পেয়েছেন। চোট-আঘাতের যে কোনো ঘটনায় বাংলাদেশের ক্রিকেটে যিনি উদাহরণ, যিনি নিরন্তর অনুপ্রেরণা। মানসিক লড়াইয়ের দিনগুলোতে মাশরাফি বিন মুর্তজার পরামর্শ সাইফের জন্য ছিল সঞ্জীবনী সুধা।
“এসব ক্ষেত্রে তো সবার জন্যই বড় অনুপ্রেরণা মাশরাফি ভাই। এতগুলো ইনজুরি সামলে বছরের পর বছর খেলেছেন, সেই তুলনায় আমার এটি সামান্য একটা স্ট্রেস ফ্র্যাকচার। হতাশার সময় মাশরাফি ভাইয়ের কথাই মাথায় রেখেছি। বিপিএলে এবার উনার প্র্যাকটিসে আমি এসেছি কথা বলতে। শুনেছি কিভাবে এই সময়টায় নিজেকে ধরে রাখতে হয়। আমি চেষ্টা করেছি তার কথা মেনে চলতে।”
আরও সমৃদ্ধ হয়ে ফেরা
ম্যাচ খেলার মতো অবস্থায় যেতে আরও বেশ কিছুদিন সময় লাগবে। তবে যে অবস্থা পেরিয়ে এসেছেন গত কয়েক দিনে, এখনকার সময়টুকুও তার দারুণ কাটছে। মাঠের সংস্পর্শই তাকে চনমনে রাখছে নিত্য।
“এখন কষ্ট হলেও সময় ভালো কাটছে। একটা সূচি দিয়েছে, কাজ করছি। সময় পার হচ্ছে। মাঠে ফিরব শিগগিরই, এই উত্তেজনাতেই কাজ করতে ভালো লাগছে। এটার মজা অন্যরকম।”
“আমি তো প্রতিটি ম্যাচই দেখি। নিজে খেলছি না, তবু প্রতিটি খেলার সময়ই আমি অনুভব করি যে আমি মাঠে থাকলে কী করতাম। সবসময় শুধু খেলে বা প্র্যাকটিস করেই তো নয়, দেখেও অনেক কিছু শেখা যায়। গত ৩-৪ মাসে দেখে শেখার চেষ্টা করেছি। বোলিংয়ে কিভাবে বৈচিত্র বাড়ানো যায়, ব্যাটিংয়ে আরও ভালো করা যায়, ফিটনেস কিভাবে ভালো করা যায় আরও, এসব ভেবেছি।”
যে ধরনের চোটে ভুগেছেন সাইফ, পরে আবার তা ফিরে আসার শঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না পুরোপুরি। সম্ভাবনাময় অলরাউন্ডার তবু স্বপ্নাতুর চোখেই তাকিয়ে আছেন সামনে। সব ভয় জয় করে দেশের হয়ে খেলতে চান আরও অনেক দিন।
“গত ৮-৯ বছর ধরে এই ইনজুরি নিয়ে ভুগছি। জানি না আবার ফিরবে কিনা। যেভাবে কাজ করছি, আশা করি ভালোভাবেই মাঠে ফিরতে পারব। বাকিটা আল্লাহর হাতে। আরও অন্তত ১০-১২ বছর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলার ইচ্ছা আছে। নিজেকে উজাড় করে দিয়ে খেলতে চাই।”