অনেক শঙ্কা আর কিছুটা সম্ভাবনার বিপিএল

মিরপুর একাডেমি মাঠে মঙ্গলবার দুপুরে চলছিল কুমিল্লা ওয়ারিয়র্স দলের অনুশীলন। ফিল্ডিংয়ের ফাঁকে দলের এক ক্রিকেটার সাংবাদিকদের কাছে জানতে চাইলেন, “ভাই, আমাদের অধিনায়ক কে জানেন?” তার প্রশ্ন শুনে উত্তর জানতে পাশ থেকে আগ্রহ নিয়ে তাকালেন আরও দুই ক্রিকেটার। তখনও অধিনায়কের নাম জানানো হয়নি আনুষ্ঠানিকভাবে। সংবাদকর্মীদের তাই জানার কারণ নেই। কিন্তু পরদিন যে দলের ম্যাচ, সেই দলের ক্রিকেটাররাও জানেন না, অধিনায়ক কে! বিপিএল শুরুর আগের ভজকট অবস্থা খানিকটা বুঝিয়ে দিচ্ছে এই ঘটনা।

ক্রীড়া প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 10 Dec 2019, 04:10 PM
Updated : 10 Dec 2019, 08:10 PM

এই ঘটনার ঘণ্টা দুয়েক আগে আরেক নাটক হয়ে গেছে শের-ই-বাংলা স্টেডিয়ামের প্রেস কনফারেন্স রুমে। রংপুর রেঞ্জার্সের জার্সি উন্মোচন অনুষ্ঠানে টিম ডিরেক্টর হিসেবে এলেন বিসিবি পরিচালক এনায়েত হোসেন সিরাজ। অথচ এই দলের টিম ডিরেক্টর ছিলেন আকরাম খান, এনায়েত হোসেন সিরাজ ছিলেন রাজশাহী রয়্যালসের!

সিরাজ নিজেই জানালেন, রংপুর দলের স্পন্সর ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস, তিনি নিজে এই কোম্পানির কর্ণধারদের একজন, তাই তিনি এই দলের টিম ডিরেক্টর হিসেবেই কাজ করবেন এখন থেকে। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, আগের টিম ডিরেক্টর আকরাম খান এসবের কিছু জানেন না তখনও। রংপুরের স্কোয়াড গোছানোয় সম্পৃক্ত ছিলেন বলে তিনিও এই দল থেকে সরতে নারাজ। শেষে একই দলে রেখে দেওয়া হয়েছে দুই বিসিবি পরিচালককে।

কুমিল্লার ক্রিকেটাররা অনুশীলনের জার্সি পেলেন টুর্নামেন্ট শুরুর আগের দিন। ছোট এক মাঠে অনুশীলন একসঙ্গে অনেক ক্রিকেটারের। বিদেশি ক্রিকেটার কে কবে এসেছেন বা আসছেন, সেসব নিয়ে নেই স্পষ্ট বার্তা। মূল মাঠে উদ্বোধনী কনসার্টের রেখে যাওয়া ক্ষত সারাতে মাঠ কর্মীদের চেষ্টা। কয়েক দিনের খণ্ড চিত্র জোড়া দিলে ফুটে ওঠে না খুব একটা আশার ছবি। আয়োজনের সমন্বয়হীনতা, বিতর্ক আর সমালোচনা বরাবরই বিপিএলের সঙ্গী। এবারও থাকছে সেই সব শঙ্কা। মাঠের ক্রিকেটের সম্ভাব্য মান নিয়ে প্রশ্ন তো থাকছেই।

মাঠের ক্রিকেটের প্রথম দিনে বুধবার প্রথম ম্যাচে মুখোমুখি হবে চট্টগ্রাম চ্যালেঞ্জার্স ও সিলেট থান্ডার। দ্বিতীয় ম্যাচে লড়বে কুমিল্লা ওয়ারিয়র্স ও রংপুর রেঞ্জার্স।

এবার বিতর্কের শুরু ছিল টুর্নামেন্ট শুরুর অনেক আগে থেকেই। গত আসরের ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলোর সঙ্গে মতবিরোধে নবায়ন করা হয়নি কারও চুক্তি। অনেকটা আচমকাই একদিন জানানো হলো, বঙ্গবন্ধুর জন্ম শতবার্ষিকীকে সামনে রেখে এবার আয়োজন করা হবে বিশেষ বিপিএল। সবকিছু পরিচালনা করবে বিসিবি নিজেই।

প্রশ্ন আর শঙ্কা তখনই জেগেছে অনেক। যে টুর্নামেন্ট বরাবরই আলোচিত নানা বিতর্কের কারণে, সেই টুর্নামেন্টের সঙ্গে জাতির জনকের নাম জুড়ে দেওয়া কতটা যৌক্তিক! সময়ের সঙ্গে সংশয়গুলো কেবল পোক্তই হয়েছে।

উদ্বোধনী আয়োজনে বঙ্গবন্ধু, ক্রিকেট বা দেশ, কোনো কিছুর অস্তিত্বই ছিল না খুব একটা। যদিও এটিকে বলা হয়েছিল স্রেফ উদ্বোধনী কনসার্ট, তবু বঙ্গবন্ধুর সম্মানে আয়োজিত টুর্নামেন্ট, যেটির উদ্বোধন করছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা, সেখানে বঙ্গবন্ধুর জীবনী, তার বিশালত্ব কিছুটা ফুটিয়ে তোলার কোনো প্রয়াস দেখা যায়নি। সালমান খানদের মুখ দিয়ে বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণ করানোই তো জাতির পিতাকে সম্মান জানানো নয়!

মূল মাঠেই করা হয়েছিল মঞ্চ, গ্রিন রুম। ছিল দর্শকের বসার ব্যবস্থা। সেসব ফেলেছিল ছাপ। মাঠকর্মীরা চেষ্টা করছেন সেই ছাপ মুছে মাঠ খেলার উপযোগী করতে।

সব ফ্র্যাঞ্চাইজি বিসিবির ব্যবস্থাপনায় চলবে বলা হলেও পরে ৬টি দল পেয়েছে স্পন্সর। দল গঠন থেকে শুরু করে সবকিছুতে তাদের মতামতকে দেওয়া হয়েছে প্রাধান্য। বোর্ড আর স্পন্সর পক্ষের সমন্বয়হীনতা ফুটে উঠেছে নানা জায়গায়।

টুর্নামেন্ট শুরুর আগেই এক দফায় পরিবর্তন করা হয়েছে ম্যাচ শুরুর সময়। টুর্নামেন্ট শুরুর পর আবার বদলানো যে হবে না, নিশ্চয়তা নেই।

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নিজেদের দুর্বলতা কাটাতে প্রতিটি দলে ১৪০ কিলোমিটার গতিসম্পন্ন পেসার ও লেগ স্পিনার খেলানো বাধ্যতামূলক করা হয়েছে বলে কিছুদিন আগে জানিয়েছিল বিসিবি। লেগ স্পিনারকে ৪ ওভার বোলিং করাতেই হবে, বলা হয়েছিল এমনটিও। সেসব নিয়েও পরে তৈরি হয় অনেক জটিলতা। সময়ের পরিক্রমায় এখন হারিয়ে গেছে ‘বাধ্যবাধকতা’, টিকে আছে কেবল গতিময় পেসার ও লেগ স্পিনারদের প্রাধান্য দেওয়ার পরামর্শ।

বিপিএল এলেই প্রতিবছর ক্রিকেটারদের মেলা বসে মিরপুর একাডেমি মাঠে। একইসঙ্গে থাকে দুটি দলের অনুশীলন। তাদের দুই ঘণ্টার সেশন শেষ হওয়ার আগেই মাঠে চলে আসে আরও দুই দল। আগে অনুশীলনে যারা এসেছেন, তাদের মাঠ ছাড়তে দেরি হয় নানা কারণে। মাঠের দুই পাশে ও মাঝে বেশ কটি নেটে চলে ব্যাটিং-বোলিং অনুশীলন। অন্যান্য জায়গায় হয় স্ট্রেচিং, রানিং ফিল্ডিং সেশন। গিজগিজ করতে থাকে ক্রিকেটার। নানা প্রান্ত থেকে উড়ে আসে বল। চোটের শঙ্কা থাকে সবসময়ই। রংপুর রেঞ্জার্সের কোচ হয়ে আসা মার্ক ও’ডনেল তো এসব দেখে বলেই ফেললেন, জীবনে এমন কিছু দেখেননি!

এত ছোট মাঠে এতগুলি দলের অনুশীলন, একসঙ্গে এত ক্রিকেটারের আনাগোনা নিশ্চিতভাবেই নেই বিশ্বের কোথাও। কয়েকদিন আগে সংস্কারের জন্য দুই দিন বন্ধ ছিল একাডেমি মাঠ। সেই দুই দিন ইনডোরে ছাড়া অনুশীলন করতে পারেননি ক্রিকেটাররা। টেস্ট মর্যাদা পাওয়ার ১৯ বছর পরও দেশের শীর্ষ ক্রিকেট চর্চার কেন্দ্রে অনুশীলনের ব্যবস্থা এত নাজুক। গত ৭ বছরে বিপিএল থেকে অনেক আয় হলেও হয়নি অনুশীলনের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা।

ঢাকার বাইরে বিপিএল আরও বেশি ভেন্যুতে ছড়িয়ে দেওয়ার উপযুক্ত ব্যবস্থা গড়ে তোলা যায়নি এত বছরেও। অতি ভোজনে অতৃপ্তির রেশ শের-ই-বাংলা স্টেডিয়ামে দেখা যায় প্রায়ই। গ্যালারি থেকে যায় ফাঁকা।

টিকেটের উচ্চমূল্য নিয়ে আগেও সমালোচনা হয়েছে অনেক। নানা দফায় কমানো হয়েছে টিকেটের মূল্য। অতীত থেকে শিক্ষা না নিয়ে এবারও টিকেটের সর্বনিম্ন মূল্য রাখা হয়েছে ২০০ টাকা। গ্যালারি ফাঁকা থাকার শঙ্কা তাই এবারও তীব্র।

বিশেষ বিপিএল আয়োজনের ঘোষণার আগে এবি ডি ভিলিয়ার্স, শেন ওয়াটসনের মতো তারকারা বিপিএলে খেলবেন বলে জানা গিয়েছিল। কিন্তু পরে টুর্নামেন্ট নিয়ে অনিশ্চয়তা ও ভবিষ্যৎ ধারাবাহিকতার শঙ্কায় মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন তারা। ডি ভিলিয়ার্স তো বিগ ব্যাশে চুক্তি করেছেন দুই বছরের জন্য। আগামী বিপিএলেও তাই এই মহাতারকাকে পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। ক্রিস গেইল এবার খেলবেন কেবল শেষ ভাগে।

শঙ্কা ও দুর্ভাবনার পাশাপাশি সম্ভাবনার জায়গাও কিছুটা আছে। আগামী বছর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। সেই আসরের জন্য এই আসর থেকেই শুরু করা যায় দল গুছিয়ে তোলার কাজ। মূল ক্রিকেটারদের বাইরে যারা ফর্মের কারণে ছিটকে গেছেন, যারা দলের বাইরে আছেন অনেকদিন থেকে, যারা আছেন দলের পাশেপাশে, কিংবা যারা নতুন করে জানাতে চান দাবি, সবার জন্যই দারুণ মঞ্চ এটি। আয়োজনগত নানা ত্রুটির মাঝেও ২২ গজে যদি তারা মেলে ধরতে পারেন নিজেদের, বাংলাদেশ পেতে পারে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে এগিয়ে চলার পথরেখা।

মাঠের ক্রিকেট কি পারবে নানা অব্যবস্থাপনা ও সমন্বয়হীনতাকে ঢেকে দিতে? বাস্তবতা বলছে, নানা সীমাবদ্ধতায় সেই সম্ভাবনার কুঠুরি বেশ সরু।