জাতীয় দলের আশে পাশে ছিলেন বেশ কিছুদিন থেকেই। এই সফরেই ডাক পাবেন, এমন আশা ছিল?
সাইফ হাসান : মানসিক একটা প্রস্তুতি ছিল কিছুদিন থেকেই। যেহেতু সাম্প্রতিক সময়ে পারফরম্যান্স ভালো হচ্ছিল, জানতাম যেকোনো সময় ডাক আসতে পারে। যেখানেই খেলেছি, রান করেছি। সব মিলিয়ে আশা বাড়ছিল সময়ের সঙ্গে।
বেশ কিছুদিন থেকেই শুনছিলাম যে সুযোগ পেতে পারি। আফগানিস্তানের বিপক্ষে টেস্টের আগেও কথা হয়েছে। হয়নি সেবার। তবে তখন থেকেই মাথায় ছিল যে কাছাকাছি আছি। শিগগিরই হয়তো সুযোগ আসবে।
অগাস্টে শ্রীলঙ্কা ইমার্জিংয়ের বিপক্ষে সেঞ্চুরি করেছিলেন একদিনের ম্যাচে। কিন্তু চারদিনের সিরিজ ভালো কাটেনি। অনূর্ধ্ব-২৩ দলের হয়ে ভারত সফরও ভালো কাটেনি। নির্বাচকরা বলেছিলেন, আপনার কাছ থেকে তাদের প্রত্যাশা আরও বেশি। এরপর শ্রীলঙ্কায় ‘এ’ দলের হয়ে সেঞ্চুরি করলেন, জাতীয় লিগে ডাবল সেঞ্চুরি…
সাইফ : আমি ইতিবাচক ছিলাম। গত প্রিমিয়ার লিগে ভালো খেলেছি (লিগের সর্বোচ্চ ৮১৪ রান), প্রিমিয়ার লিগ টি-টোয়েন্টিতেও। চেষ্টা করেছি ধারাবাহিক হতে। সবসময় সমান সাফল্য আসেনি, যেখানেই সুযোগ এসেছে, চেষ্টা করেছি ভালো করার।
বয়সভিত্তিক পর্যায় থেকেই আপনাকে ভবিষ্যতের টেস্ট ব্যাটসম্যান ভাবা হতো। টেস্ট দল দিয়েই জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়াটা কি তাই বাড়তি তৃপ্তির?
সাইফ : অনেকেই এরকম ভাবতে পারে। তবে সত্যি বলতে, আমার তেমন কিছু নেই। যে কোনো একটি দিয়ে সুযোগ পেলেই চলত।
৫০ ওভারের ফরম্যাটে তো নিয়মিতই পারফর্ম করছি। ঢাকা লিগে ভালো করেছি, ‘এ’ দলে করলাম। টি-টোয়েন্টিতে শুরুই করলাম এই বছর (প্রিমিয়ার লিগ টি-টোয়েন্টি দিয়ে)। প্রথম টুর্নামেন্টে খারাপ করিনি। এখন টেস্ট দিয়ে সুযোগ মিলেছে জাতীয় দলে, টেস্টের মতোই খেলার চেষ্টা করব।
এই সফরের জন্য আপনার প্রস্তুতি কেমন ? ভারতের বোলিং লাইন আপ দুর্দান্ত। আপনি টপ অর্ডার, ওদের পেস আক্রমণ তো দারুণ!
সাইফ: একটা বড় ব্যাপার হবে, আমরা সাধারণত যে গতির বোলিং খেলি, ওদের পেসারদের গতি তার চেয়ে একটু বেশি। সঙ্গে সুইং তো আছেই। ওদের স্কিল অনেক। আমাকে মানিয়ে নিতে হবে। যত দ্রুত পারি, মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করব।
গত বেশ কয়েক মাস থেকে ম্যাচের পর ম্যাচ খেলেছি। বিভিন্ন পর্যায়ে খেলে আসছি। একটি ধারাবাহিকতার মধ্যে আছি। এটি কাজে দেবে বলে আশা করি। ওদের বিপক্ষে না খেললে তো বুঝতে পারব না ওই মানের বোলিংয়ের বিপক্ষে কোথায় আছি।
মানসিকভাবে কি মনে হয়, টেস্ট খেলার জন্য আপনি প্রস্তুত?
সাইফ: নিজে তো প্রস্তুত বলেই মনে করি। তবে যেটা বললাম, সুযোগ পেলে এবং খেলার পর বুঝতে পারব কতটা প্রস্তুত। ওখানে গিয়ে যত দ্রুত সম্ভব মানিয়ে নিতে হবে।
যতটা সম্ভব, রান করেছি সব জায়গায়। ঘরোয়া ক্রিকেটে, ইমার্জিং দল, ‘এ’ দল… এরপর পরের ধাপের আশা করতেই পারি। এখন চেষ্টা করে যেতে হবে।
বয়সভিত্তিক পর্যায়ের সঙ্গে তুলনা করলেন, গত বছর দুয়েকে আপনার ব্যাটিংয়ে উন্নতি দৃশ্যমান। শটের পরিধি বেশ বেড়েছে। ব্যাটসম্যানশিপের ক্ষেত্রে কোন জায়গায় আছেন বলে আপনি নিজে মনে করেন?
সাইফ: অনেক জায়গাতেই উন্নতি হয়েছে বলে মনে করি। ৩ বছর আগে যখন লিস্ট ‘এ’ খেলতে শুরু করি ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে, তখন মূল সমস্যা ছিল স্ট্রাইক রোটেট করা নিয়ে। আস্তে আস্তে উন্নতি করেছি। গত ২ বছরে তাই রানও করতে পেরেছি বেশ। বড় স্কোরও করতে পেরেছি এজন্য। বড় শটও খেলতে পেরেছি। বিশেষ করে, গত প্রিমিয়ার লিগে বড় শট অনেক খেলতে পেরেছি। আগের বছর লিগে (২০১৭-১৮) ১টি সেঞ্চুরি ও ৩টি ফিফটি ছিল, এবার (২০১৮-১৯) করেছি ৩ সেঞ্চুরি, ৪ ফিফটি।
গত ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে আপনি ২৭টি ছক্কা মেরেছিলেন, লিগের সর্বোচ্চ। কিছুদিন আগে শ্রীলঙ্কা ইমাজিঙয়ের সঙ্গে সেঞ্চুরিতে ছক্কা ছিল ৭টি। বয়সভিত্তিক পর্যায়ের তুলনায়, এই জায়গায় আপনার উন্নতি বিস্ময়কর। কিভাবে সম্ভব হলো?
সাইফ: সবার ভেতরেই কিছু না কিছু থাকে। আমারও নিশ্চয়ই ছিল। অনূর্ধ্ব-১৯ দলে ব্যাপার ছিল, আমাকে যে ভূমিকা দিয়েছিল দল, সেটি করার চেষ্টা করেছি।
ছক্কার ক্ষেত্রে শট নির্বাচন এখানে অনেক গুরুত্বপূর্ণ, সঠিক বলটি নির্বাচন করা। এসব আগের চেয়ে ভালো হয়েছে। ব্যাটিং নিয়ে কাজ তো করতে হয়েছেই। আরেকটি বড় ব্যাপার হলো, মানসিকতা। সাহস বেড়েছে। এটি অভিজ্ঞতা থেকে হয়েছে। যত ম্যাচ খেলেছি, তত সাহস বেড়েছে। বিসিবি এখন অনেক বেশি ম্যাচ আয়োজন করছে আমাদের জন্য। এটি দারুণ কাজে লেগেছে।
বাবুল স্যারের কথা (কোচ মিজানুর রহমান বাবুল) সবসময় বলি আমি। অনূর্ধ্ব-১৯ থেকে তিনি আমার ব্যাটিং নিয়ে কাজ করছেন। প্রিমিয়ার লিগে করেছেন। আমি উপকৃত হয়েছি অনেক।
আপনার মধ্যে এমন একটি ব্যাপার আছে, যা বাংলাদেশের তরুণ ক্রিকেটারদের বিরল, ‘টেম্পারামেন্ট।’ এটি কি সহজাত ছিল, নাকি সময়ের সঙ্গে হয়েছে?
সাইফ: ছোট বেলা থেকেই এটি শুনে আসছি। আমার মনে হয়, সহজাতভাবেই কিছু পেয়েছি। একদম ছোট থেকেই সবাই বলতেন, ‘টেম্পারামেন্ট সবার ভালো থাকে না। তোমার ভালো, কাজে লাগাও।’
আমি আসলে জানি না কিভাবে হয়েছে। নামাজ পড়ি। শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবন কাটানোর চেষ্টা করি। এসব কারণে হতে পারে। নিজেকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করি যতটুকু সম্ভব। পরিবারের ভূমিকাও আছে।
পরিবারের প্রসঙ্গ যখন এলোই, আপনার ছেলেবেলা তো কেটেছে দেশের বাইরে। ক্রিকেটার হয়ে ওঠার পেছনে পরিবারের ভূমিকা কতটুকু ছিল?
সাইফ: পরিবারের ভূমিকা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। তারা ভালোভাবে দিকনিদের্শনা দিতে পারলে, জীবন গোছানো হয়।
আমার জন্ম ঢাকাতেই। বাবা তখন চাকরির জন্য সৌদি আরবে থাকতেন, আমরাও সেখানে চলে যাই। বছর দশেক ছিলাম সেখানে। পরে আম্মুর সঙ্গে ঢাকায় চলে এসেছি। তবে ক্রিকেট শুরু সৌদি আরবেই। টেপ টেনিসে খেলতাম তখন। ওখানে যার কাছে পড়তাম, বাংলাদেশের একজন, তার কাছে ব্যাট-বল ছিল। সেখানে খেলতাম। অনেক বাংলাদেশী ছিল। সবার সঙ্গে খেলা হতো।
চলে আসার পর ধানমণ্ডি ৪ নম্বর মাঠে অনুশীলন শুরু করি। এরপর আবাহনী মাঠে। ১২ বছর বয়সে সম্ভবত ক্রিকেট বলে খেলা শুরু করি। পরে অনূর্ধ্ব-১৪, অনূর্ধ্ব-১৫ জাতীয় ক্যাম্পে ডাক পাই। অনূর্ধ্ব-১৭ দলের অধিনায়ক হয়ে গেলাম ভারতে। তার পর অনূর্ধ্ব-১৯ দলে খেললাম।
টেস্ট দলে ডাক পাওয়ার পর তারা কি বললেন?
সাইফ: সবাই অনেক খুশি। জানার পরই আমি সবার আগে আব্বুকে ফোন দিয়েছি। অফিসে ছিলেন উনি। দারুণ খুশি ছিলেন। পাশাপাশি বলেছেন, “তোমার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে, এবার চেষ্টা করো ধরে রাখার।”
ইদানিং অফ স্পিনও খুব ভালো করছেন। ‘এ’ দলের হয়ে, জাতীয় লিগে দারুণ বোলিং করলেন!
সাইফ: ছোটবেলা থেকেই বোলিং করতাম। অনূর্ধ্ব-১৯ দলে আসার পর সবাই বলতেন যে ব্যাটিংয়ে বেশি মনোযোগ দাও। বোলিং করলেও ব্যাটিংয়ে ঘাটতি থাকতে পারে। তখন বোলিং অনুশীলন কম করেছি। পরে ঘরোয়া ক্রিকেট যখন নিয়মিত খেলছি, মনে হলো, বোলিংটাও থাকলে তো ভালো। বাড়তি একটা কিছু থাকল। যদি কাজে লাগে। পার্ট টাইম করতে করতে এখন দেখি ভালোই হচ্ছে বোলিং। নিয়মিতই করছি।
ক্রিকেটার হিসেবে বেড়ে ওঠার সময়ে নায়ক ছিল কেউ?
সাইফ: ছেলেবেলা থেকে আশরাফুল ভাইকে ভালো লাগত। পরে তামিম ভাই, সাকিব ভাইকে তো অবশ্যই ভালো লাগতে শুরু করে। দেশের বাইরে তখন তেমন কেউ ছিল না। বাংলাদেশের খেলা ছাড়া আমি সেভাবে খেলা দেখতামই না। এখন রোহিত শর্মাকে ভালো লাগে।
আমি যেহেতু ওপেনার, বাংলাদেশের যে কোনো উঠতি ক্রিকেটার স্বপ্ন দেখে তামিম ভাইয়ের সঙ্গে ওপেন করার। তামিম ভাই বাংলাদেশের নায়ক। রোল মডেল। ওপেনার হিসেবে আমারও স্বপ্ন আছে উনার সঙ্গে জুটি বাঁধার। ইনশাল্লাহ সেই সুযোগ আসবে।
তাদের সঙ্গে কথা বলার বা মেশার সুযোগ হয়েছে? কারও কোনো কথা গেঁথে আছে মনে?
সাইফ : সেভাবে কিছু নেই। তবে যখনই সুযোগ হয়েছে, সবাই ভালো ভালো কথা বলেছেন। রিয়াদ ভাই যখনই দেখেন, তখনই উৎসাহ দেন। মুশফিক ভাই উৎসাহ দিয়েছেন। আবাহনীতে যখন ছিলাম, মাশরাফি ভাই ছিলেন। অনেক কথা বলেছেন। সবাই সমর্থন করেছেন।
স্কোয়াডে সুযোগ তো হলো, এরপর?
সাইফ: মাত্র তো এলাম জাতীয় দলে। খুব বেশি দূর ভাবছি না। বর্তমানেই থাকতে চাই। এখন সামনে যে সিরিজ আছে, এটিই আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিরিজ। সুযোগ পেলে কাজে লাগাতে চাই। সুযোগ না পেলেও সমস্যা নেই। সামনে অনেক খেলা আছে। যে সিরিজই খেলব, সেটিই আমার জন্য গুরুত্বপূর্ণ হবে। আমি জানি, এটি কেবল স্বপ্ন পূরণের প্রথম ধাপ। এখান থেকে এগিয়ে যেতে হবে।
ক্যারিয়ার নিয়ে ভবিষ্যৎ ভাবনা?
সাইফ : এখন স্বপ্ন বাংলাদেশের টেস্ট ক্যাপ পাওয়া। সেটি যদি হয়, জাতীয় দলের হয়ে অনেক দিন খেলতে চাই। আরেকটা স্বপ্ন আছে, বাংলাদেশের হয়ে বিশ্বকাপ খেলা। নিজেকে সেভাবেই প্রস্তুত করার চেষ্টা করছি যেন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে টিকতে পারি।
যখন থেকে বুঝতে শিখেছি ভবিষ্যৎ নিয়ে, ক্রিকেটারই হতে চেয়েছি। যখন থেকে সিরিয়াসলি ক্রিকেট খেলছি, একটাই স্বপ্ন ছিল জাতীয় দলে খেলা। আরও পরে সুযোগ এলেও আমি হাল ছাড়তাম না। যত পরেই হোক, জাতীয় দলে খেলাই ছিল লক্ষ্য। আমি ভাগ্যবান, এখন সুযোগ পেয়েছি। এখন ধরে রাখার চেষ্টা করব। অনেক দিন খেলতে চাই।