কোণঠাসা বাঘের গর্জন

তিন বছর আগে ৩ বলে ২ রানের সহজ সমীকরণ মেলাতে না পারা মুশফিকুর রহিম ও মাহমুদউল্লাহ এবার চ্যালেঞ্জিং কন্ডিশনে মিলিয়ে দিলেন ৩ ওভারে ৩৫ রানের সমীকরণ। সবার সম্মিলিত অবদানে দিল্লিতে শোনা গেল বাঘের গর্জন। বাংলাদেশ পেল এক অনির্বচনীয় স্বাদ। পরাক্রমশালী ভারতের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টিতে প্রথম জয়। সেটাও এলো ভারতের মাটিতে। 

অনীক মিশকাতঅনীক মিশকাতদিল্লি থেকে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 Nov 2019, 05:41 PM
Updated : 4 Nov 2019, 05:27 AM

প্রথম টি-টোয়েন্টিতে ৭ উইকেটে জিতেছে বাংলাদেশ। ১৪৯ রানের লক্ষ্য স্পর্শ করেছে ৩ বল বাকি থাকতে।

এক জন বোলার কম নিয়ে খেলেও ভারতকে ১৪৮ রানে থামিয়ে মূল কাজটা করেছিলেন বোলাররা। স্পিনারদের জন্য সুবিধা আছে এমন উইকেটে লক্ষ্যটা সহজ ছিল না। তবে মুশফিক, সৌম্য সরকার, মোহাম্মদ নাঈম শেখদের দৃঢ়তায় রোমাঞ্চকর ম্যাচে বাংলাদেশ তুলে নেয় দারুণ জয়।   

দিন শুরু হয়েছিল দুসংবাদ দিয়ে। বায়ু দূষণ মাত্রা এতটাই বেড়ে গিয়েছিল যে, ম্যাচ হবে কি না তা নিয়ে জেগেছিল শঙ্কা। শেষ পর্যন্ত নাটকীয় উন্নতি হয় পরিস্থিতির। মাঠে গড়ায় বল।

আবহাওয়ার মতোই নাটকীয় ঘটনা ঘটে মাঠে। প্রায় অসাধ্য সাধন করে বাংলাদেশ। চোট পাওয়া মনোবল আর দলের সেরা দুই ক্রিকেটারকে ছাড়াই ভারতকে হারিয়ে দিয়েছে তাদের মাটিতে।

হারানোর কিছু নেই, পাওয়ার ছিল অনেক কিছু। তা পেতে প্রয়োজন ছিল ভাগ্যের ছোঁয়া আর প্রতিপক্ষের বাজে দিনের। টস জিতে ফিল্ডিং নিয়েছিলেন মাহমুদউল্লাহ। ভারত এলবিডব্লিউর রিভিউ নিলে শুরুতেই ফিরতে পারতেন মুশফিক। পরে সীমানায় ক্যাচ দিয়েও বেঁচে যান ক্রুনাল পান্ডিয়ার ব্যর্থতায়। ম্যাচ শেষে জয়ের নায়ক সেই মুশফিকই।

মুশফিকুর রহিমের দুর্দান্ত এক ফিফটিতে প্রথমবারের মতো টি-টোয়েন্টিতে ভারতকে হারাল বাংলাদেশ। সিরিজের প্রথম ম্যাচে ৮ চার ও ১ ছক্কায় ৪৩ বলে ৬০ রানে অপরাজিত থাকেন উইকেটকিপার-ব্যাটসম্যান। ছবি আইসিসি

ম্যাচের প্রথম বলে চার। পঞ্চম বলে আরেক বাউন্ডারিতে টি-টোয়েন্টিতে বিরাট কোহলিকে ছাড়িয়ে সর্বোচ্চ রানের মালিক বনে যান রোহিত শর্মা। পরের বলেই ভারত অধিনায়ককে এলবিডব্লিউ করে দেন শফিউল ইসলাম। বাংলাদেশ পেয়ে যায় কাঙ্ক্ষিত শুরু।

তিন বছর পর নিজের প্রথম টি-টোয়েন্টি খেলতে নেমে প্রথম স্পেলে দুর্দান্ত বোলিং করলেন আল আমিন হোসেন। উইকেট না পেলেও বেঁধে রাখলেন ব্যাটসম্যানদের।

পাওয়ার প্লেতে ভারত ১ উইকেটে করে ৩৫ রান। পাওয়ার প্লে শেষ হতেই আক্রমণে আসেন আমিনুল ইসলাম। তরুণ লেগ স্পিনার নিজের প্রথম ওভারেই ফিরিয়ে দেন লোকেশ রাহুলকে।

ক্রিজে গিয়েই শট খেলতে শুরু করেছিলেন শ্রেয়াস আয়ার। আমিনুলকে পরপর দুই ওভারে হাঁকিয়েছিলেন দুই ছক্কা। শেষ পর্যন্ত শ্রেয়াসকে ফেরান আমিনুলই। 

লম্বা সময় ক্রিজে থাকলেও ডানা মেলতে পারেননি শিখর ধাওয়ান। মাহমুদউল্লাহর দারুণ ফিল্ডিংয়ে রান আউট হয়ে ফিরেন বাঁহাতি এই ওপেনার। ৪২ বলে তিনি করেন ৪১ রান।

বাংলাদেশের ফিল্ডারদের শরীরী ভাষায় ছিল বারুদ। রান বাঁচাতে বলের পেছনে ছুটছিলেন দুই-তিন কখনও চার ফিল্ডার।

ভারতের শক্তিশালী ব্যাটিং লাইনআপের বিপক্ষে এক বোলার কম নিয়ে খেলে বড় ঝুঁকি নিয়েছিল বাংলাদেশ। আস্থা ছিল মাহমুদউল্লাহ, মোসাদ্দেক হোসেন, সৌম্য সরকার ও আফিফ হোসেনের ওপর। প্রতিদান দিয়েছেন সবাই।

সবাইকে ছাড়িয়ে গেছেন আফিফ। ৩ ওভারে মাত্র ১১ রান দিয়ে নিয়েছেন একটি উইকেট। সেটি অভিষিক্ত অলরাউন্ডার শিবাম দুবের। ফিরতি ক্যাচ নিতে গিয়ে যেন আকাশ স্পর্শ করেন আফিফ। রিশাব পান্তকে ঝড় তুলতে দেননি শফিউল।

ম্যাচের প্রথম ওভারে রোহিত শর্মাকে ফিরিয়ে বাংলাদেশকে দারুণ শুরু এনে দেন শফিউল ইসলাম। তিন ম্যাচ সিরিজের প্রথম টি-টোয়েন্টিতে ভারতকে ৭ উইকেটে হারায় মাহমুদউল্লাহর দল। ছবি: বিসিবি

শেষের দিকে ক্রুনাল পান্ডিয়া ও ওয়াশিংটন সুন্দরের ঝড়ো ব্যাটিংয়ে দেড়শ রানের কাছে যায় ভারতের সংগ্রহ। শেষ ২ ওভারে ৩০ রান নেয় স্বাগতিকরা।

চ্যালেঞ্জিং লক্ষ্য তাড়ায় বাংলাদেশ প্রথম ওভারেই হারায় লিটন দাসকে। দীপক চাহারের বল দ্বিধা নিয়ে খেলতে গিয়ে কাভারে ক্যাচ দেন ডানহাতি এই ব্যাটসম্যান।

দলকে এগিয়ে নেন অভিষিক্ত মোহাম্মদ নাঈম শেখ ও সৌম্য সরকার। শুরুতে সাবধানী ছিলেন দুই বাঁহাতি ব্যাটসম্যান। পরে বাড়ান রানের গতি। পঞ্চম ওভারে চাহারের ওভারে ছক্কা-চার হাঁকান নাঈম, পরের ওভারে ওয়াশিংটন সুন্দরকে রিভার্স সুইপ করে ছক্কা হাঁকান সৌম্য। পাওয়ার প্লেতে বাংলাদেশ ১ উইকেটে করে ৪৫ রান।

সাবলীলভাবে এগিয়ে যাওয়া বাংলাদেশকে থমকে দেন যুজবেন্দ্র চেহেল। নিজের প্রথম ওভারে দেন মাত্র এক রান। ডট বলের চাপে তাকে ওড়ানোর চেষ্টায় ক্যাচ দিয়ে ফিরেন নাঈম। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নিজের প্রথম ইনিংসে এই ওপেনার করেন ২৬ রান।

ক্রিজে যাওয়ার পরপরই রিভার্স সুইপ করে ক্রুনাল পান্ডিয়াকে বাউন্ডারি হাঁকান মুশফিক। তাকেও ভুগিয়েছেন চেহেল। পরে অবশ্য এই লেগ স্পিনারকে সুইপ করে চার হাঁকান বাংলাদেশের কিপার-ব্যাটসম্যান।

ধীরে ধীরে জমে ওঠে সৌম্য-মুশফিকের জুটি। তবে রানের গতিতে দম দিতে পারেননি তারা। তাদের জুটির রান পঞ্চাশ স্পর্শ করে ৪৮ বলে। খলীল আহমেদের স্টাম্পের বল কাট করতে গিয়ে সৌম্য বোল্ড হলে ভাঙে ৫৫ বল স্থায়ী ৬০ রানের জুটি। সৌম্য ৩৫ বলে করেন ৩৯।

মাহমুদউল্লাহ ক্রিজে যাওয়ার সময় বাংলাদেশের প্রয়োজন ছিল ৩ ওভারে ৩৫ রান। মুশফিককে নিয়ে সেই লক্ষ্য ছুঁয়ে বিজয়ীর বেশে ফিরেন সাকিব আল হাসানের অনুপস্থিতিতে দলকে নেতৃত্ব দেওয়া এই অফ স্পিনিং অলরাউন্ডার।

১৯তম ওভারে খলীলকে টানা চার বাউন্ডারি হাঁকিয়ে দলকে জয়ের কাছে নিয়ে যান মুশফিক। ৪৩ বলে ৮ চার ও ১ ছক্কায় ৬০ রানে অপরাজিত থাকেন বাংলাদেশের ব্যাটিং ভরসা।

২০১৬ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ছক্কায় ম্যাচ শেষ করতে গিয়ে আউট হয়েছিলেন। সেই ম্যাচে শেষ পর্যন্ত ১ রানে হেরে গিয়েছিল দল। এবার ছক্কাতেই ম্যাচ শেষ করেছেন মাহমুদউল্লাহ।

ম্যাচ শেষে তেমন একটা উদযাপনও করেনি বাংলাদেশ। নবম চেষ্টায় ভারতের বিপক্ষে প্রথম জয়ের খুশির চেয়েও বেশি ছিল স্বস্তি। গত কিছু দিন বিতর্ক পিছু ছাড়ছিল না বাংলাদেশকে। টি-টোয়েন্টির হাজারতম ম্যাচে দারুণ জয়ে সেটা পেছনে ফেলার স্বস্তিই যেন ফুটে উঠেছিল মাহমুদউল্লাহ-মুশফিকের উদযাপনে।

সংক্ষিপ্ত স্কোর:

ভারত: ২০ ওভারে ১৪৮/৬ (ধাওয়ান ৪১, রোহিত ৯, রাহুল ১৫, শ্রেয়াস ২২, পান্ত ২৭, দুবে ১, পান্ডিয়া ১৫*, সুন্দর ১৪*; শফিউল ৪-০-৩৬-২, আল আমিন ৪-০-২৭-০, মুস্তাফিজ ২-০-১৫-০, আমিনুল ৩-০-২২-২, সৌম্য ২-০-১৬-০, আফিফ ৩-০-১১-১, মোসাদ্দেক ১-০-৮-০, মাহমুদউল্লাহ ১-০-১০-০)

বাংলাদেশ: ১৯.৩ ওভারে ১৫৪/৩ (লিটন ৭, নাঈম ২৬, সৌম্য ৩৯, মুশফিক ৬০*, মাহমুদউল্লাহ ১৫*; চাহার ৩-০-২৪-১, সুন্দর ৪-০-২৫-০, খলিল ৪-০-৩৭-১, চেহেল ৪-০-২৪-১ , পান্ডিয়া ৪-০-৩২-০, দুবে ০.৩-০-৯-০ )।

ম্যাচ সেরা: মুশফিকুর রহিম

ফল: বাংলাদেশ ৭ উইকেটে জয়ী