সাকিবকে হারানোর ধাক্কায় টালমাটাল বাংলাদেশের ক্রিকেট সামনের পথচলায় কতটা সোজা হয়ে এগোতে পারবে, সেই সংশয় আছে যথেষ্টই। এমনিতেই গত কিছুদিনে মাঠের পারফরম্যান্স ছিল পড়তির দিকে। দলের নিয়মিতদের বেশির ভাগই ধারাবাহিক নন পারফরম্যান্সে। পাইপলাইনে মানসম্পন্ন ক্রিকেটার কতটা আছে, সেই প্রশ্ন সাম্প্রতিক সময়ে উঠেছে বারবার। সেসব টানাপোড়েনের মধ্যেই হারাতে হলো দেশের সর্বকালের সেরা পারফরমারকে। আর সাকিব না থাকা মানে তো বরাবরই একসঙ্গে দুজনকে হারানো, একজন ব্যাটসম্যান ও একজন বোলার!
পারফরমার সাকিবের ঘাটতি
আগামী এক বছরে বাংলাদেশ খেলবে ১৩টি টেস্ট! একটি ছাড়া সবকটি ম্যাচ আইসিসি টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের অংশ। দেশের বাইরেই এর ৯ টি। আগামী বছর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ বলে সংক্ষিপ্ত এই সংস্করণের ম্যাচ খেলবে ১৭টি।
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেও প্রথম পর্বের তিন ম্যাচে বাংলাদেশ সাকিবকে পাচ্ছে না। পরের পর্বে উঠতে পারলেও কমপক্ষে একটি ও সর্বোচ্চ দুটি ম্যাচ থাকবে সাকিবের নিষেধাজ্ঞার সময়ে। তাই ৪-৫টি ম্যাচ খেলতে পারবেন না, এমন ক্রিকেটারকে স্কোয়াডে রাখার সম্ভাবনা সামান্যই।
এতগুলো ম্যাচ, এত এত লড়াইয়ের জন্য বাংলাদেশকে এখন পরিকল্পনা করতে হবে নিজেদের ইতিহাসের সবচেয়ে কার্যকর ক্রিকেটারকে বিবেচনার বাইরে রেখে।
“এই দেখুন, ভারত সফরে আমাদের ১৫ জনের স্কোয়াড গড়ার কথা ছিল। কিন্তু সাকিব নেই বলে ২ টেস্টের জন্যও ১৬ জনের দল পাঠাতে হলো। সাকিব না থাকলেই এই সঙ্কটে পড়তে হয় আমাদের। আগামী এক বছর যে কোনো সিরিজের আগে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ এটি।”
হাবিবুল যে টেস্ট সিরিজের কথা বললেন, সাকিববিহীন এক বছরে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় পরীক্ষার জায়গা এটিই। এই ভারত সফর দিয়েই আইসিসি টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপে যাত্রা শুরু করছে বাংলাদেশ। অথচ টেস্ট ইতিহাসের অন্যতম সেরা অলরাউন্ডারকে ছাড়াই এই কঠিন লড়াইয়ের প্রথম এক বছর লড়তে হবে বাংলাদেশকে।
এমনিতে টেস্ট ম্যাচ খেলার সুযোগ পাওয়ার জন্য হাহাকার করতে হলেও সাকিব না থাকার এই এক বছরে বাংলাদেশ খেলবে ১৩টি টেস্ট! একটি ছাড়া সবকটি ম্যাচ আইসিসি টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের অংশ। দেশের বাইরেই আছে ৯ টেস্ট।
আগামী বছর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ বলে সব দলই এই সময়টায় ওয়ানডে খেলবে তুলনামূলক কম। আইসিসির ভবিষ্যৎ সফর সূচি অনুযায়ী এই এক বছরে বাংলাদেশের ওয়ানডে আছে কেবল তিনটি। তবে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আগে সংক্ষিপ্ত এই সংস্করণের ম্যাচ খেলবে বাংলাদেশ ১৭টি।
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেও প্রথম পর্বের তিন ম্যাচে বাংলাদেশ সাকিবকে পাচ্ছে না। পরের পর্বে উঠতে পারলেও কমপক্ষে একটি ও সর্বোচ্চ দুটি ম্যাচ থাকবে সাকিবের নিষেধাজ্ঞার সময়ে। তাই ৪-৫টি ম্যাচ খেলতে পারবেন না, এমন ক্রিকেটারকে স্কোয়াডে রাখার সম্ভাবনা সামান্যই।
এতগুলো ম্যাচ, এত এত লড়াইয়ের জন্য বাংলাদেশকে এখন পরিকল্পনা করতে হবে নিজেদের ইতিহাসের সবচেয়ে কার্যকর ক্রিকেটারকে বিবেচনার বাইরে রেখে।
ক্রিকেটারদের চুক্তি, দলের সূচি, মাঠের ক্রিকেট সংক্রান্ত ব্যাপারগুলো সরাসরি তত্ত্বাবধান করে বিসিবির ক্রিকেট পরিচালনা বিভাগ। এই বিভাগের প্রধান ও সাবেক অধিনায়ক আকরাম খান স্বাভাবিকভাবেই হতাশ সাকিবের ঘটনায়। তবে অতীত থেকেই তিনি খুঁজে নিচ্ছেন ভবিষ্যতের অনুপ্রেরণা।
“সাকিবের মতো একজনের শূন্যতা এত দ্রুত কখনোই পূরণ করা সম্ভব নয়। ওই চিন্তা বাদ দিয়ে তাই আমাদের ভাবতে হবে দলের ব্যালান্স ঠিক করা নিয়ে। কার্যকর হতে পারে, এমন কাউকে সুযোগ দেওয়া। শুধু হতাশা নিয়ে পড়ে থাকলে চলবে না। আমি বরং মনে করি, সাকিবের ওপর দলের যে অতি নির্ভরতা ছিল, সেটি কাটিয়ে ওঠার সুযোগ হিসেবেও নেওয়া যেতে পারে এটিকে।”
“এর আগেও কিন্তু সাকিবকে ছাড়া আমরা জিতেছি। ২০১৩ সালে নিউ জিল্যান্ডকে হোয়াইটওয়াশ করেছি। তখন দলে পারফরমার এখনকার চেয়ে কম ছিল। তবু পেরেছি। সব ক্রিকেটারের পারফরম্যান্স গুরুত্বপূর্ণ, এটি বুঝতে হবে ছেলেদের।”
বিকল্প খুঁজে বের করার কাজটি যারা করবেন, সেই নির্বাচকদের একজন হাবিবুলও আগে স্পষ্ট করে দিতে চাইলেন, রাতারাতি ঘাটতি পূরণের কোনো সুযোগ নেই।
“একটা কথা সবাইকে বুঝতে হবে, সাকিবের মতো পারফরমারের শূন্যতা পূরণ করা অসম্ভব। একজন সাকিব বা শচিন-কোহলির মতো পারফরমার তৈরি করা যায় না, অনেক কিছু মিলিয়ে ওরা হয়ে যায়। এই ব্যাপারটি আমাদের ক্রিকেট সংশ্লিষ্ট সবার, বিশেষ করে ক্রিকেট সমর্থকদের বুঝতে হবে।”
“প্রথম কথা হলো, আতঙ্কিত হওয়া যাবে না। একটি কঠিন বাস্তবতা এসেছে, এটিকে মেনে নিয়ে চ্যালেঞ্জটা সামলানো নিয়ে ভাবতে হবে। যাকে আমরা নিচ্ছি, তাকে পর্যাপ্ত সুযোগ দিতে চাইব আমরা। সেই পরিস্থিতি যেন থাকে। আতঙ্কিত হয়ে গেলে যেটা হবে, কেউ দুয়েকটি ম্যাচ খারাপ খেললেই বাদ দেওয়ার তাগিদ উঠবে। তখন অস্থিরতা আরও বাড়বে।”
“আমাদের পাইপলাইনে ক্রিকেটার আছে ভালোই। আমরা হয়তো ৩-৪ জনকে নিয়ে কাজ করব। তবে তাদেরকে সময় দিতে হবে। সাকিবও কিন্তু শুরুতে টপ পারফরমার ছিল না। আস্তে আস্তে হয়েছে। সম্ভবত ২০০৮ সালের শেষ বা ২০০৯ সাল থেকে অসাধারণ পারফর্ম করতে শুরু করেছে। ওর জায়গায় যে বা যারা এখন খেলবে, এখনই তাদের কাছ থেকে সাকিবের মতো পারফরম্যান্স চাইলে হবে না। সময় লাগবে। সেই সময়টা আমরা দিতে চাই।”
সম্ভাব্য কয়েক জন উঠতি ক্রিকেটারের নামও বললেন হাবিবুল। তবে অন্য কারও উঠে আসার পথও খোলা রেখে দিলেন।
“আফিফকে নিয়ে আমাদের অনেক আশা আছে, সেটা সবাই জানেও। লেগ স্পিনে ভালো শুরু করলেও আমিনুল ইসলাম বিপ্লব অলরাউন্ডার হিসেবে ভালো করতে পারে। ব্যাটিংয়ে নাজমুল হোসেন শান্ত, ইয়াসির আলি রাব্বি আছে। ওদের প্রতি নজর আছে আমাদের।”
“এখন এইচপি বা ‘এ’ দলের ম্যাচ প্রচুর হচ্ছে। অনেককে আমরা দেখেছি, এখনও দেখছি। তবে একটা কথা আবার মনে করিয়ে দিতে চাই। ঘরোয়া ক্রিকেটের সঙ্গে ‘এ’ দলের যেমন পার্থক্য আছে, ‘এ’ দলের সিরিজের সঙ্গে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের পার্থক্য আছে। কাজেই সময় লাগবে টিকতে। যাদেরকে ভাবনায় রেখেছি, তাদের সবাই হয়তো টিকবেও না। সব কিছু মিলিয়েই বুঝতে হবে যে এটা সময়ের ব্যাপার।”
নেতৃত্বের সঙ্কট
ব্যাটসম্যান ও বোলার হিসেবে সাকিবের ঘাটতি পূরণ নিয়ে হাহুতাশ বেশি। কিন্তু অধিনায়ক সাকিব? বাংলাদেশ আসলে হারিয়েছে একসঙ্গে তিনজনকে।
নিষেধাজ্ঞার এই সময়ে বাংলাদেশ যে দুই সংস্করণ বেশি খেলবে, সেই দুটিতেই অধিনায়ক ছিলেন সাকিব। তাকে ঘিরে আগামী দুটি টি-টোয়ন্টি বিশ্বকাপ, টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের পরিকল্পনা করছিল বাংলাদেশ। কিছুটা হলেও ভাঙা-গড়ার মধ্য দিয়ে দল গুছিয়ে তোলা হচ্ছিল তাকে ঘিরেই। সেই ছক এলোমেলো করে দিল সাকিবের নিষেধাজ্ঞা।
এমনিতে স্কোয়াড গড়ার দায়িত্ব নির্বাচকদের হলেও অধিনায়ক ঠিক করে বোর্ড। টি-টোয়েন্টিতে মাহমুদউল্লাহ ও টেস্টে মুমিনুল হককে অধিনায়ক করা হয়েছে শুধু ভারত সফরের জন্য। বোর্ডের প্রধান নির্বাহী নিজাম উদ্দিন চৌধুরী জানালেন, সামনের নেতৃত্ব নিয়ে ভাবা হবে এই সিরিজের পর।
নিয়মিত অধিনায়কের চোট-বিশ্রাম মিলিয়ে এর মধ্যেই ৬টি টেস্ট ও ৫টি টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দিয়েছেন মাহমুদউল্লাহ। টেস্টে তিনি সাকিবের ডেপুটিও ছিলেন। তারপরও কেন টেস্ট অধিনায়ক মুমিনুল?
ক্রিকেট পরিচালনা বিভাগের প্রধান আকরাম খানের কথায় ইঙ্গিত মিলল, শুধু এই সিরিজ নয়, ভবিষ্যতের ভাবনাও আছে মুমিনুলকে নিয়ে।
“সিনিয়র ক্রিকেটাররা হয়তো বাড়তি চাপ নিতে চাচ্ছে না। আমরাও এটিকে সুযোগ হিসেবে দেখছি। মুমিনুলকে কিন্তু অনেক দিন থেকেই ‘এ’ দলে ও অন্যান্য ক্রিকেটে অধিনায়ক হিসেবে দেখা হচ্ছে। যথেষ্ট ভালোও করছে। ওর ওপর আপাতত ভরসা রাখছি আমরা। ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়েছি। আশা করি, সে ভালো করবে।”
অধিনায়ক বাছাই করা নির্বাচকদের দায়িত্ব না হলেও হাবিবুলের ভাবনার সীমানায় এটিও আছে। নিজেও ছিলেন বাংলাদেশের সফল অধিনায়কদের একজন। ৮৭টি আন্তর্জাতিক ম্যাচে নেতৃত্ব দিয়েছেন দলকে। নেতৃত্বের ব্যাপারটি তিনি ব্যাখ্যা করলেন আরও বিশদভাবে।
“নেতৃত্বের সঙ্কট তো একটু সৃষ্টি হয়েছেই। তবে যে কোনো সঙ্কট মানেই সমাধানের নতুন পথ বের হওয়া। কেউ নেতৃত্ব না পাওয়া পর্যন্ত কিন্তু বলা কঠিন, সে কেমন করবে অধিনায়ক হিসেবে। ক্রিকেটে অনেক সময়ই হয়, বয়সভিত্তিক পর্যায়ে বা ঘরোয়া ক্রিকেটে কেউ খুব ভালো অধিনায়কের রেপুটেশন নিয়ে জাতীয় দলে এসেছে, ভবিষ্যতের অধিনায়ক ভাবা হয়েছে, কিন্তু মোটেও ভালো করেনি।”
“আবার মাশরাফির উদাহরণ আমাদের সামনেই আছে। ওকে তো শুরু থেকেই দেখছি, একটা সময় পর্যন্ত কখনোই মনে হয়নি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অধিনায়কত্বের উপকরণ আছে। কিন্তু আপনারাই দেখেছেন কেমন করেছে। দায়িত্ব না পাওয়া পর্যন্ত আমরা অনেকের অনেক দিক জানতে পারি না। এবারও কেউ নিজেকে মেলে ধরবেন, সেই আশায় আছি।”