রুদ্ধশ্বাস দিন শেষে বিষণ্ন রাত

বাংলাদেশের ক্রিকেটে দিনটির শুরু ছিল বিস্ময়, অবিশ্বাস আর হতচকিত ভাব নিয়ে। সংবাদমাধ্যমের খবর থেকে ছড়িয়ে পড়েছিল, জুয়াড়ির প্রস্তাব গোপন করে নিষিদ্ধ হতে যাচ্ছেন সাকিব আল হাসান। খবর নিশ্চিত হওয়ার জন্য এরপর দিন জুড়ে অপেক্ষা উত্তেজনা আর শঙ্কা নিয়ে। দীর্ঘ অপেক্ষার অবসান সন্ধ্যায়। জানা গেল, সত্যিই লস্বা সময় মাঠের বাইরে থাকতে হবে বিশ্ব ক্রিকেটের অন্যতম সেরা অলরাউন্ডারকে। রাতে দেখা মিলল সাকিবের। জানালেন হতাশার কথা। শোনালেন ফেরার প্রত্যয়।

ক্রীড়া প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 Oct 2019, 07:18 PM
Updated : 30 Oct 2019, 03:08 AM

গত কিছুদিন ধরেই মাঠের বাইরের নানা ঘটনায় গোটা দেশে খবরের শিরোনামে ছিল ক্রিকেট। তবে সাকিবের ঘটনা শুধু দেশ নয়, নাড়িয়ে দিয়েছে গোটা ক্রিকেট বিশ্বকে। বাংলাদেশ ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন, দেশের সবসময়ের সেরা ক্রিকেটার ও গত ১০ বছরে সম্ভবত বিশ্বের সেরা অলরাউন্ডার সাকিব নিষিদ্ধ হয়েছেন তিন দফায় জুয়াড়ির প্রস্তাব পেয়েও প্রকাশ না করায়।

এই ঝড়ের আগে গুমোট মেঘের অস্তিত্ব দেখা গিয়েছিল আগের কয়েক দিনে। ক্রিকেটারদের ধর্মঘটের পর গত শুক্রবার থেকে শুরু হয় ভারত সফরের প্রস্তুতি। ধারণা করা হয়, টালমাটাল হয়ে পড়া দেশের ক্রিকেট স্বাভাবিক হবে। কিন্তু প্রথম দিনই অস্বাভাবিকতার ছোঁয়া, অনুশীলনে নেই সাকিব!

পর দিন অনুশীলনে হালকা নক করা ছাড়া আর কিছু করেননি তখনকার অধিনায়ক। পরের দুই দিন দলের দুটি প্রস্তুতি ম্যাচ, সেখানেও নেই সাকিব! বিসিবির ব্যাখ্যাও ছিল অস্পষ্ট।

সেটি স্পষ্ট হতে শুরু করে মঙ্গলবার সংবাদমাধ্যমে নিষেধাজ্ঞার আশঙ্কা নিয়ে খবর প্রকাশের পর। সকাল থেকেই মিরপুর শের-ই-বাংলা স্টেডিয়ামে ভিড় করতে থাকেন সংবাদকর্মীরা। এমনিতেই প্রতিদিন বিসিবি আঙিনায় সংবাদকর্মী থাকেন অনেক। এ দিন সেখানে সাংবাদিকদের দিয়েই প্রায় জনারণ্য।

আগের দিন বিসিবির ক্রিকেট পরিচালনা বিভাগের প্রধান আকরাম খান বলেছিলেন, মঙ্গলবার দুপুর ১২টা নাগাদ জানা যেতে পারে ভারত সফরের পরিবর্তিত টি-টোয়েন্টি দল। অপেক্ষা ছিল সেই সময়টার, দল দিলেই তো বোঝা যাবে সাকিব যাচ্ছেন কিনা!

কিন্তু ঘড়ির কাঁটা ১২টা পেরিয়ে গেলেও জানা গেল না কোনো কিছু। বিসিবির কেউ নন, বিস্ময়করভাবে সাকিবকে নিয়ে দিনের প্রথম আনুষ্ঠানিক কথা শোনা গেল যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেলের কণ্ঠে। সচিবালয়ে সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে তিনি বললেন, “…যেটাই হোক, আমরা অবশ্যই সাকিবের পাশে থাকব।” তার কথা থেকে ঘটনা কিছু আছে, সেই ইঙ্গিত অন্তত মিলল।

এরপর আবার অপেক্ষার প্রহর গোনার পালা। দুপুরের দিকে বিসিবিতে এলেন বোর্ড সভাপতি নাজমুল হাসান। একে একে আসতে দেখা গেল বোর্ড পরিচালকদের আরও কয়েক জনকে। অপেক্ষমান সংবাদকর্মীদের ধারণা, এবার হয়তো দ্রুতই জানা যাবে কিছু। কিন্তু সেই সময় আর আসে না!

 

ততক্ষণে অবশ্য নানা মাধ্যম থেকে পাওয়া খবরে একটি ব্যাপার অনেকটা নিশ্চিত হয়ে যায়, সাকিব নিষিদ্ধ হচ্ছেনই। জানার ছিল কেবল অপরাধের মাত্রা ও নিষেধাজ্ঞার ব্যপ্তি।

ন্যাম শীর্ষ সম্মেলনের অভিজ্ঞতা জানাতে মঙ্গলবার বিকেলে গণভবনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক প্রশ্নের উত্তরে জানান, সাকিব ভুল করেছে।

একসময় দিনের আলো মিলিয়ে যেতে থাকল। শের-ই-বাংলা স্টেডিয়ামের ফ্লাড লাইটগুলো জ্বলে না উঠলেও বিসিবি প্রাঙ্গন ছিল সরগরম। সংবাদকর্মীদের পক্ষ থেকে আইসিসিকে বারবার মেইল করেও পাওয়া যাচ্ছিল না কোনো উত্তর।

সাংবাদিকদের মতো অপেক্ষায় ছিলেন বোর্ড কর্তারাও। আইসিসি আনুষ্ঠানিক সংবাদ বিজ্ঞপ্তি না দেওয়া পর্যন্ত তো কিছু বলার উপায় নেই তাদেরও!

অবশেষে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার পরপর পাওয়া গেল আইসিসির আনুষ্ঠানিক ঘোষণা। সারাদিনের অপেক্ষা শেষে, নিষেধাজ্ঞা হচ্ছে জানার পরও অনেকের জন্য বিস্ময় হয়ে এলো আইসিসির মেইল। ২ বছরের নিষেধাজ্ঞা!

যদিও দুই বছরের মধ্যে এক বছরের নিষেধাজ্ঞা স্থগিত, অর্থাৎ আবার একই কাজ না করলে বা কোনো বিধি না ভাঙলে এক বছর পরই মাঠে নামতে পারবেন সাকিব। তবু প্রশ্নের ওড়াউড়ি, একটু বেশিই কি হয়ে গেল শাস্তি? 

আইসিসির বিস্তারিত ব্যাখ্যা অবশ্য অনেক প্রশ্নের উত্তর দিল। তিনবার প্রস্তাব পেয়েও সংশ্লিষ্ট কোনো কর্তৃপক্ষকে জানাননি সাকিব। এবার নতুন করে বিস্ময় ছড়ানোর পালা।

বিসিবির আনুষ্ঠানিক বক্তব্য অবশ্য তখনও পাওয়া গেল না। জানা গেল, স্বয়ং সাকিবই আসবেন বিসিবিতে। যৌথ সংবাদ সম্মেলন হবে বিসিবি প্রধানের সঙ্গে। আবার অপেক্ষার পালা শুরু।

জুয়াড়ির প্রস্তাব গোপন করায় আইসিসির নিষেধাজ্ঞা পাওয়ার পর মঙ্গলবার রাতে বিসিবিতে আসেন বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের টেস্ট ও টি-টোয়েন্টি অধিনায়ক সাকিব আল হাসান।

অবশেষে রাত ৮টায় বিসিবিতে এলেন সাকিব। ক্যামেরায় ধারণ করতে, ভালো একটি ছবি পেতে সংবাদকর্মীদের ছুটোছুটি আর হট্টগোলের মধ্যেই তিনি উঠে গেলেন দোতলায় বিসিবি কার্যালয়ে। ১৫ মিনিটের মতো আলোচনা হলো বিসিবি কর্তাদের সঙ্গে। এরপর মুখোমুখি হলেন সংবাদ মাধ্যমের।

সাকিবের চোখেমুখে দেখা গেল বিষন্নতার ছায়া। চোখের কোনে চিকচিক করছিল পানি। অবশ্য সামলে নিয়ে ঠিকভাবেই পড়ে শোনালেন লিখিত বক্তব্য। জানালেন নিজের ভুলের কথা। বললেন, ফিরতে চান আরও ভালোভাবে। সংবাদকর্মীদের প্রশ্ন ছিল অনেক, কিন্তু প্রশ্নোত্তর পর্বই হলো না এদিন।

ছোট্ট বক্তব্যে বিসিবি সভাপতি সাকিবের প্রতি রাগ-ক্ষোভের কথা যেমন বললেন, পাশে থাকার অঙ্গীকারও করলেন। জোগালেন সাহস। শেষ হলো দিনের যাবতীয় আনুষ্ঠানিকতার।

দীর্ঘ ও ক্লান্তিকর দিনশেষেও অবশ্য সংবাদকর্মীদের দম ফেলার ফুরসত ছিল না। পাঠক-দর্শকদের তো জানাতে হবে সাকিবের কথা, বিসিবির বক্তব্য!

তবে সবচেয়ে বেশি ক্লান্তি তখন বুঝি দেশের ক্রিকেটের। সাকিবের মতো একজনকে লম্বা সময়ের জন্য হারানোর ধাক্কা! এতটা কঠিন, এতটা হতাশার দিন কি বাংলাদেশের ক্রিকেটে আর এসেছে? এই ক্লান্তি ঝেরে চাঙা হতে দেশের ক্রিকেট ও ক্রিকেটারদের হয়তো দিতে হবে কঠিন পরীক্ষা।