ধর্মঘটের অবসান: স্বস্তির সঙ্গে আছে শঙ্কাও

সাকিব আল হাসান বললেন বটে, আলোচনার ফলে তারা অনেক খুশি। তবে সভা থেকে বেরোনোর পর ক্রিকেটারদের অনেকের মুখেই দেখা গেল না হাসি। মুখায়বে অবশ্যই সবসময় মনের ছবি ফুটে ওঠে না। কিন্তু শুধু চেহারায় নয়, অনিশ্চয়তার ছোঁয়া অনেক ক্রিকেটারের কণ্ঠেও। দাবি পূরণের আশ্বাস তো মিলল, বাস্তবায়ন কতটা হবে!

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 Oct 2019, 02:09 AM
Updated : 24 Oct 2019, 08:48 AM

বুধবার রাত ১১ টার পরপর ধর্মঘট প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়ে শেষ হয়েছে বাংলাদেশ ক্রিকেটের অচলাবস্থার। উত্তেজনায় ঠাসা টানা তিনটি দিনে ছিল ঘটনার ঘনঘটা। নাটকের সমাপ্তি আপাত মধুর হলেও তাতে হতাশার চোরাস্রোতও মিশে থাকল কিছুটা।

সংকটের শুরু গত সোমবার। আচমকাই সেদিন দুপুরে সংবাদ সম্মেলনের ঘোষণা দেন ক্রিকেটাররা। সংবাদ কর্মীদের জন্য সেটি বড় চমক ছিল তো বটেই, ক্রিকেটারদের সংগঠন কোয়াবও ছিল বিস্মিত। তাতেই নিশ্চিত হয়ে যায়, কোনো সংগঠনের অধীনে না থেকেই সংগঠিত হয়ে আসছেন ক্রিকেটাররা।

সেই সংবাদ সম্মেলনে ছিলেন ৬০ জনের মতো ক্রিকেটাররা। তাদের মধ্যে ১০ জন আলাদা করে জানান ১১ টি দাবি। ঘরোয়া ও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পারিশ্রমিক বাড়ানো, প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অনুশীলন সুযোগ সুবিধা বাড়ানো, ঘরোয়া ক্রিকেটে কাঠামো বদলসহ দেশের সার্বিক ক্রিকেট সংস্কৃতির বদল চান ক্রিকেটাররা। সর্বোপরি দাবি করেন,    প্রাপ্য সম্মানটুকু যেন ক্রিকেটারদের দেয় বোর্ড।

সব দাবি জানানোর পর টেস্ট ও টি-টোয়েন্টি অধিনায়ক সাকিব আল হাসান জানান, দাবি না মানা পর্যন্ত ওই মুহূর্ত থেকেই সব ধরনের ক্রিকেট কার্যক্রম বন্ধ করে করে দিচ্ছেন ক্রিকেটারা। অনিশ্চয়তায় পড়ে যায় জাতীয় লিগের খেলা ও বাংলাদেশ দলের ভারত সফর।

একাডেমি মাঠে যখন ক্রিকেটাররা সংবাদ সম্মেলন করছেন, তখন একাডেমি ভবনের সামনেই ছিলেন বিসিবির প্রধান নির্বাহী নিজাম উদ্দিন চৌধুরী। বিদায় জানাচ্ছিলেন পাকিস্তান সফরগামী অনূর্ধ্ব-১৬ দলকে। সেখানেই প্রধান নির্বাহী সংবাদমাধ্যমকে বলেন, তারা আনুষ্ঠানিকভাবে জানার পর দ্রুত ব্যবস্থা নেবেন।

আনুষ্ঠানিকভাবে জানানোর অবশ্য প্রয়োজন পড়েনি। ক্রিকেটাঙ্গনের উত্তাপ স্পর্শ করে চারপাশকে। গোটা দেশের সবচেয়ে আলোচিত বিষয়গুলোর একটি হয়ে ওঠে তাদের দাবি দাওয়া ও ধর্মঘটের ঘোষণা। ২০০০ সালে টেস্ট মর্যাদা পাওয়ার পর বাংলাদেশের ক্রিকেটে ধর্মঘট এটিই প্রথম।

চারপাশের সেই আঁচেই হয়তো ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। মঙ্গলবার বিসিবি পরিচালকদের সঙ্গে জরুরী সভায় বসেন বিসিবি সভাপতি। এরপর মুখোমুখি হন সংবাদ মাধ্যমের। শুরুতেই নিজের সুদীর্ঘ বক্তব্যে উগড়ে দেন ক্ষোভ। ছুঁড়ে দেন পাল্টা অভিযোগ। ক্রিকেটারদের ধর্মঘটের পেছনে খুঁজে পান চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র।

দাবি মানার আশ্বাসও অবশ্য দেন বিসিবি প্রধান। জানিয়ে দেন আলোচনার দুয়ার খোলার রাখার কথা। কিন্তু এটাও আবার বলেন, “ক্রিকেটাররা খেলতে চাইলে খেলবে। না চাইলে খেলবে না, আমাদের কিছু করার নেই।”

পাশাপাশি বারবার চক্রান্তের কথা বলে, ক্রিকেটারদের প্রতি নানাভাবে উষ্মা প্রকাশ করে, ব্যক্তিগত আক্রমণ করে ও দৃষ্টিকটুভাবে যেভাবে কথা বলেন ক্যামেরা-মাইক্রোফোনোর সামনে, তাতে ক্রিকেটারদের প্রতি বোর্ডের দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বয়ে যায় সমালোচনার ঝড়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ধুয়ে দেওয়া হয় বিসিবি প্রধানসহ বোর্ড কর্তাদের।

বোর্ড সভাপতির সংবাদ সম্মেলনের পর এ দিন আর কোনো পাল্টা প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি ক্রিকেটারদের থেকে।

বুধবার ধর্মঘট গড়ায় তৃতীয় দিনে। ততক্ষণে নিশ্চিত হয়ে গেছে, বৃহস্পতিবার থেকে জাতীয় লিগের তৃতীয় রাউন্ড শুরু হচ্ছে না।

আগের দিন বিসিবি কর্তাদের রুদ্র রূপ থোকলেও এ দিন সকাল থেকেই বিসিবি কর্তাদের দেখা যায় অনেকটাই নমনীয়। প্রধান নির্বাহী নিজাম উদ্দিন সকালে জানান, ক্রিকেটারদের সঙ্গে বিকেলেই আলোচনায় বসতে চান তারা।

ওদিকে তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করেন বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান এবং কোয়াবের সভাপতি ও বিসিবি পরিচালক নাঈমুর রহমান। সেখানে আলোচনা থেকে বেরিয়ে নাজমুল হাসান সংবাদমাধ্যমকে জানান, ক্রিকেটারদের দাবি মানতে তারা প্রস্তুত।

এরপর থেকে অপেক্ষা ক্রিকেটারদের অবস্থান জানার। বোর্ডের আহবানে সাড়া দিয়ে ক্রিকেটাররা আলোচনায় বসবেন কিনা, এই নিয়ে চলতে থাকে জল্পনা। জানা যায়, রাজধানীর একটি হোটেলে একত্রিত হচ্ছেন ক্রিকেটাররা।

ঘরোয়া ক্রিকেটে পারিশ্রমিক বাড়ানোসহ ১১ দফা দাবিতে ধর্মঘটের ঘোষণা দেন সাকিব আল হাসান। সোমবার মিরপুর বিসিবি একাডেমি মাঠে এসময় তার সঙ্গে ছিলেন অন্য ক্রিকেটাররা।

সেই হোটেলেই সন্ধ্যায় সংবাদ সম্মেলন ডাকেন ক্রিকেটাররা। গিয়ে দেখা যায়, হোটেলের হল রুমে উপস্থিত একশর বেশি ক্রিকেটার। তাদের মুখপাত্র হয়ে কথা বলেন সুপ্রীম কোর্টের একজন আইনজীবী। তিনি জানান, শুরুর ১১ দফার সঙ্গে আরও দুটি দফা যোগ করে ক্রিকেটারদের দাবির কথা চিঠি ও ই-মেইলে জানানো হয়েছে ক্রিকেট বোর্ডকে।

নতুন যোগ করা এই দুই দফাও ছিল চমকপ্রদ। বোর্ডের রাজস্ব আয়ের ভাগ দাবি করে ক্রিকেটাররা। পাশাপাশি লিঙ্গ সমতায় নিজেদের বিশ্বাসের কথা জানিয়ে দাবি করা হয় মেয়েদের ক্রিকেটকেও একইরকম সুবিধার আওতায় আনার।

বোর্ড কর্তারা তখনও বিসিবিতে অপেক্ষায় ক্রিকেটারদের সঙ্গে আলোচনায় বসার জন্য। ক্রিকেটাররা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেন, রাতেই বিসিবিতে গিয়ে আলোচনায় বসার। সেই সভার পরই আসে অচলাবস্থা অবসানের ঘোষণা।

তবে ধর্মঘট প্রত্যাহারের পরও শঙ্কা বেশ কিছু কারণে। সংকট সমাধানের সভাতেও শুরুতে ক্রিকেটারদের বেশ এক হাত নিয়েছেন নাজমুল হাসান। পরে অবশ্য স্বাভাবিক আলোচনা করেছেন। ক্রিকেটারদের প্রতি বোর্ডের দৃষ্টিভঙ্গি বদল তাই আদৌ কতটা হবে, সেই প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।

অতীতেও নানা সময়ে নানা কিছু আশ্বাস দিয়ে পরে বাস্তবায়ন করেনি বোর্ড। এবার এত ডামাডোলের পর হয়তো কিছু উদ্যোগ দেখা যাবে, কিন্তু পুরোপুরি বাস্তবায়ন কতটা হবে?

প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ম্যাচ ফি বাড়িয়ে ১ লাখ টাকা করা ও মাসিক বেতন ৫০ শতাংশ বাড়ানোর দাবি ছিল। আগের চেয়ে পারিশ্রমিক বাড়োনোর আশ্বাস দিয়েছেন বিসিবি সভাপতি, কিন্তু কতটা বাড়বে?

দাবি মতো ১ লাখ টাকা ম্যাচ ফি বোর্ড দেবে কিনা, এটি নিয়ে সাকিবকে প্রশ্ন করেও উত্তর মেলেনি। এই জায়গায় তাই প্রবল সংশয় আছে দাবি পুরোপুরি বাস্তবায়ন নিয়ে। ঘরোয়া ক্রিকেটারদের অনেকেই কণ্ঠে তাই হতাশার সুরও থাকল।

এক ক্রিকেটার হনহন করে সভা থেকে বেরিয়ে গেলেন ‘টাইম কিলিং’ বলে। ঘরোয়া ক্রিকেটের অভিজ্ঞ আরেক ক্রিকেটার বললেন, “মনে হয় না আমাদের টাকা খুব একটা বাড়াবে।” কারও কারও আবার শঙ্কা, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে ওঠার পর তাদের ক্রিকেট জীবন না আবার অস্বাভাবিক করে তোলা হয়!

ঘরোয়া ক্রিকেট ও ক্রিকেটারদের নানা দাবিই ছিল বেশি আলোচিত। সেগুলো বাস্তবায়ন নিয়ে সংশয়ও বেশি দেখা গেল ক্রিকেটারদের মাঝে।

সব মিলিয়ে দীর্ঘদিনের দূরত্ব আর অবিশ্বাস জন্ম দিয়েছে যে আস্থাহীনতার, সেটিরই ছাপ অনেকের কণ্ঠে। সেই ছাপ যেদিন মুছে যাবে, এবারের আন্দোলন পরিপূর্ণ সফল বলা যাবে হয়তো সেদিনই।