ঘরোয়া ক্রিকেটে কেমন পারিশ্রমিক ক্রিকেটারদের

মঙ্গলবার সুদীর্ঘ সংবাদ সম্মেলনে বিসিবি প্রধান নাজমুল হাসান দাবি করেছেন, ক্রিকেটারদের পারিশ্রমিক ও সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো হয়েছে। বারবার বলেছেন, ক্রিকেটারদের জন্য কতকিছু করেছেন তিনি। কিন্তু তার সব কথাই ছিল জাতীয় দল ও আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলা ক্রিকেটারদের ঘিরে। অথচ ঘরোয়া ক্রিকেটে বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের পারিশ্রমিক, অনুশীলনের সুযোগ-সুবিধা ও অবকাঠামোর চিত্র ভীষণ নাজুক।

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 Oct 2019, 06:23 AM
Updated : 23 Oct 2019, 06:34 AM

ক্রিকেটারদের ১১ দফা দাবির একটি ছিল জাতীয় দলের জন্য চুক্তিবদ্ধ ক্রিকেটারের সংখ্যা ও বেতন বাড়ানো। সেই দাবিটির কথা এসেছে ৬ নম্বরে। ক্রিকেটারদের দাবির বড় অংশ জুড়ে আছে ঘরোয়া ক্রিকেটে পারিশ্রমিক ও অনুশীলন সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো, অবকাঠামোর উন্নয়ন ও সর্বোপরি দেশের ক্রিকেট সংস্কৃতি বদলের তাগিদ।

গত ১০ অক্টোবর শুরু হয়েছে এই মৌসুমের জাতীয় লিগ। টুর্নামেন্ট শুরুর ঠিক আগে জানানো হয়, এবার পারিশ্রমিক বাড়ানো হচ্ছে না। অথচ কিছু দিন আগেই বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান বলেছিলেন, “ঘরোয়া ক্রিকেটের জন্য টাকা-পয়সা কোনো সমস্যা নয়।”

প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটের এই টুর্নামেন্টে খেলা হয় দুটি স্তরে। প্রথম স্তরের ক্রিকেটারদের পারিশ্রমিক ৩৫ হাজার। দ্বিতীয় স্তরে ২৫ হাজার। তুমুল সমালোচনার পর সেটি বাড়িয়ে যথাক্রমে ৪০ ও ৩০ হাজার করা হয়েছে বলে সংবাদ সম্মেলনে জানালেন বিসিবি প্রধান। কিন্তু এই অঙ্কও কি যথেষ্ট?

আরেকটি প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট টুর্নামেন্ট আছে দেশে, বাংলাদেশ ক্রিকেট লিগ (বিসিএল)। ম্যাচ ফি সেখানে ৪০ হাজার টাকা। যথারীতি সমালোচনার পর সেটি বাড়িয়ে ৫০ হাজার করা হবে বলে শোনা যাচ্ছে।  ফ্র্যাঞ্চাইজি ভিত্তিক একটি টুর্নামেন্টের ম্যাচ ফি এত কম কেন, সেই প্রশ্নও উঠে আসছে প্রতি বছরই।

জাতীয় লিগে সব ম্যাচে একাদশে থাকলেও একজন ক্রিকেটার সর্বোচ্চ খেলতে পারেন ৬ ম্যাচ। বিসিএলে কখনও সর্বোচ্চ ৩ ম্যাচ, কখনও ৬ ম্যাচ। সব ম্যাচ খেলা ক্রিকেটারের আয়ও তাই খুব বেশি হয় না। ঘরোয়া ক্রিকেটের শীর্ষ ক্রিকেটারদের বাইরে বড় অংশের একটা ক্রিকেটার সব ম্যাচ খেলতেও পারেন না। উল্লেখ্য, আয় থেকে আবার ২০ শতাংশ হারে আয়কর দিতে হয় ক্রিকেটারদের।

দেশের প্রথম ও প্রধান প্রথম শ্রেণির টুর্নামেন্টে চার দিনের ম্যাচের জন্য এই পারিশ্রমিক যথেষ্ট অপ্রতুল বলেই মনে করেন ক্রিকেটাররা। তাদের দাবি, ঘরোয়া প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ম্যাচ ফি ১ লাখ টাকা করার।

বিসিবি প্রধান বলেছেন, “যথেষ্ট দিচ্ছি, আর কত দেব?”

২০১২ সালে সেই সময়ের বিসিবি প্রধান আ হ ম মুস্তফা কামাল প্রথমবারের মতো দেশের প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটারদের চুক্তির আওতায় আনেন। ঘরোয়া ক্রিকেটে অভিজ্ঞতা অনুযায়ী তিনটি গ্রেডে চুক্তিতে রাখা হয় ক্রিকেটারদের। ‘এ’ গ্রেডের মাসিক বেতন ছিল তখন ২৫ হাজার টাকা, ‘বি’ গ্রেডে ২০ হাজার টাকা ও ‘সি’ গ্রেডে ১৫ হাজার টাকা।

শুরুতে চুক্তিবদ্ধ ক্রিকেটার ছিলেন ১০৫ জন। নাজমুল হাসানের নেতৃত্বাধীন বোর্ড সেই সংখ্যা নামিয়ে এনেছে ৭৯ জনে। আর এই লম্বা সময়ে পারিশ্রমিক বেড়েছে নামমাত্র। ‘এ’ গ্রেডের ক্রিকেটাররা এখন পান ২৮ হাজার ৭৫০ টাকা, ‘বি’ গ্রেডে ২৩ হাজার টাকা ও ‘সি’ গ্রেডে ১৭ হাজার ২৫০ টাকা।

ঘরোয়া প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট থেকে ক্রিকেটারদের আয় সাকুল্যে এই।

আরও দুটি খাত অবশ্য আছে। তবে সেখানে আয়ের চেয়ে ব্যয় অনেক সময়ই বেশি!

জাতীয় লিগে ক্রিকেটারদের দৈনিক ভাতা ১৫০০ টাকা। ১১ দফায় ক্রিকেটারদের দাবি, “যে ফিটনেস দাবি করছে বোর্ড, তাতে অনেক স্বাস্থ্যকর খাবার খেতে হবে। ভালো হোটেলে থাকতে হবে। যেখানে খাবার ও যে কোনো জিনিসের দাম বেশি। সেটা বিবেচনা করে যে পরিমাণ ভাতা ঠিক করলে ভালো হয়, সেটি যেন করা হয়।”

ভ্রমণ ভাতা কেবল ২ হাজার ৫০০ টাকা। এটি নিয়ে ক্রিকেটারদের দাবি, “যে রাজশাহী থেকে কক্সবাজার যাবে খেলতে, তার তো বাসে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই! এটা নিশ্চিত করতে হবে যেন ক্রিকেটাররা বিমান ভাড়া পায়। আর কোনো ভ্রমণ ভাতা দরকার নেই। বিমানের টিকেট বিভাগ করুক বা যে করুক, আমাদের আপত্তি নেই।”

বাসে দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে যেতে অনেকটা সময় চলে যায়। অথচ জাতীয় লিগের ম্যাচগুলির মাঝে বিরতি কেবল তিন দিন। অনেকটা সময় চলে যায় রিকভারি করতে, অনুশীলনের সময় মেলে অল্পই। সামর্থ্য আছে যাদের, তাদের অনেকে নিজ খরচে বিমানে ভ্রমণ করেন।

প্রথম শ্রেণিতে চুক্তিবদ্ধ ক্রিকেটারদের সংখ্যা কমানো, অপ্রতুল টাকা-পয়সা নিয়ে বোর্ড সভাপতি সংবাদ সম্মেলনে বেশ দৃষ্টিকটু ভঙ্গিমায় বলেছেন, “২০০-৩০০ ক্রিকেটারকে বেতন দেব নাকি!” প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটারদের নিয়ে আরেকটি প্রশ্নে বলেছেন, “খেলা পারে না… বাজে খেলে, দেব না টাকা।”

যদিও ক্রিকেট বোর্ডের টাকা বোর্ড সভাপতি বা কারও ব্যক্তিগত তহবিল থেকে আসে না। বাংলাদেশ সরকার থেকেও কোনো সাহায্য প্রয়োজন হয় না। জনগণের আয়করের টাকায় ক্রিকেটারদের বেতন হয় বা বোর্ড চলে, এই ধরনের ভুল কথা অনেকেই বলে থাকেন অনেক সময়। ক্রিকেট বোর্ড স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান, সব আয় ক্রিকেট ও ক্রিকেটারদের মাধ্যমেই।

বোর্ডের আয়ের বড় একটি অংশ আসে আইসিসি রাজস্ব থেকে। আইসিসির বর্তমান চক্রে বিসিবি পাচ্ছে ১২ কোটি ৮০ লাখ ডলার। এছাড়াও বিভিন্ন ইভেন্টের লাভ থেকে আসে অর্থ।

বিসিবির আয়ের আরেকটি বড় খাত, টিভি সত্ত্ব। ২০১৪ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত টিভি সত্ত্ব পেয়েছে গাজী টিভি। এই খাতের আয় আনুষ্ঠানিকভাবে না জানালেও এই ৬ বছরের জন্য সেটি ২০ মিলিয়ন ডলারের বেশি নিশ্চিতভাবেই।

এছাড়াও ডিজিটাল রাইটস, টিম স্পন্সর, বিভিন্ন টুর্নামেন্টের স্পন্সর, স্টেডিয়ামের ভেতরে দেয়ালে-গ্যালারিতে-সাইটস্ক্রিন-বাউন্ডারি সীমানায় বিজ্ঞাপন, সবকিছু থেকে আসে মোটা অঙ্কের অর্থ। সব আয়ই তাই ক্রিকেটের মাধ্যমেই আসে।

ক্রিকেট বোর্ড ও ক্রিকেটাররা প্রতি বছর মোটা অঙ্কের আয়কর দেয়। বেতন-ভাতা থেকে আয়কর কেটে রাখা হয় আগেই। ক্রিকেটারদের ব্যক্তিগত এন্ডোর্সমেন্ট থেকে আয়কর দেওয়াও নিশ্চিত করে ক্রিকেট বোর্ড।

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নিয়মিতদের আয় স্বাভাবিকভাবেই ঘরোয়া ক্রিকেটারদের চেয়ে বেশি। তবে সেটিও অন্য অনেক দেশের তুলনায় কম।

বিসিবির বর্তমান কেন্দ্রীয় চুক্তি অনুযায়ী শীর্ষ গ্রেডের ক্রিকেটারদের মাসিক বেতন ৪ লাখ টাকা। এই গ্রেডে আছেন কেবল দেশের ৫ সিনিয়র ক্রিকেটার, মাশরাফি বিন মুর্তজা, সাকিব আল হাসান, মুশফিকুর রহিম, তামিম ইকবাল ও মাহমুদউল্লাহ।

‘এ’ গ্রেডে বেতন তিন লাখ টাকা। এখানে আছে কেবল তিন জন, ইমরুল কায়েস, মুস্তাফিজুর রহমান ও রুবেল হোসেন।

২ লাখ টাকা পারিশ্রমিকের ‘বি’ ক্যাটেগরিতে আছেন মুমিনুল হক, মেহেদি হাসান মিরাজ, লিটন দাস ও তাইজুল ইসলাম। আর ‘রুকি’ ক্যাটেগরিতে আছে ৫ জন, যেখানে পারিশ্রমিক ১ লাখ টাকা।

ভারত, ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া তো বহুদূর, শ্রীলঙ্কা-পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় চুক্তিতে থাকা ক্রিকেটারদের তুলনায়ও এই পারিশ্রমিক খুবই সামান্য।

তাছাড়া দেশের মোট ক্রিকেটারের সামান্য একটি অংশই এই চুক্তিতে আছে। বাকিদের আর্থির সুরক্ষার অবস্থা তাই নাজুক। এই কেন্দ্রীয় চুক্তিও স্থায়ী কিছু নয়। নবায়ন হয় প্রতি বছর। অনেকেই বাদ পড়েন বা ঢোকেন বা ক্যাটেগরিতে উন্নতি-অবনতি হয়। ক্যারিয়ার তাই ঝুঁকিতে থাকে সবসময়।

এই ঝুঁকিরও একটি মূল্যের কথা ক্রীড়া বা পারফর্মিং আর্টে সবসময় বলা হয়। একজন খুব ভালো ক্রিকেটারের ক্যারিয়ার হয়তো ১০-১৫ বছর লম্বা হয়। ক্যারিয়ার শেষে জীবনের নিরাপত্তার কথা তাদের ভাবতে হয়। ক্রিকেট ক্যারিয়ারেও চোট-আঘাত আসে, বাজে ফর্ম আসে প্রকৃতির নিয়মে। তখন চুক্তির বাইরে যেতে হয় অনেকের, মাঠের বাইরে থাকতে হয়। আয়ও কমতে থাকে। সবকিছু মিলিয়েই তাদের আর্থিক নিরাপত্তার ব্যাপারটি উঠে আসে।

সংবাদ সম্মেলনে বোর্ড প্রধান বলেছেন, ২৪ কোটি টাকা বোনাস দেওয়া হয়েছে জাতীয় ক্রিকেটারদের। এখানেও আছে অর্ধসত্য। ভালো পারফরম্যান্সের জন্য পারফরম্যান্স বোনাসের একটি সুনির্দিষ্ট অঙ্ক চুক্তিতেই উল্লেখ আছে। আর বোনাসের একটি বড় অঙ্ক এসেছে আইসিসির টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ করার ফি, ভালো খেলার পুরস্কার হিসেবে পাওয়া প্রাইজমানি থেকে। যেটি সব দেশে ক্রিকেটারদের পাওয়াই রীতি। তাছাড়াও শুধু ক্রিকেটারদের নয়, সেই বোনাস পেয়েছেন দলের কোচ থেকে শুরু করে সাপোর্ট স্টাফের সবাই মিলে। ব্যক্তিগত প্রাপ্তির অঙ্কটা তাই খুব বড় নয়।

আর এটিও যথারীতি সেই জাতীয় ক্রিকেটাররাই পেয়েছেন। ঘরোয়া ক্রিকেটারদের অবস্থা তথৈবচ। ক্রিকেটারদের ১১ দফা দাবির অনেকটাই সেই ঘরোয়া ক্রিকেট ও ক্রিকেটারদের নিয়ে।

অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটে ক্রিকেটারদের বাৎসরিক বেতন সুনির্দিষ্ট নয়। যেহেতু ক্রিকেট ও ক্রিকেটারদের মাধ্যমেই বোর্ডের আয়, এজন্য তারা বোর্ডের মোট আয়ের রাজস্বের ভাগ দাবি করে এবং পেয়েও থাকে। মজার ব্যাপার হলো, সেটি শুধু জাতীয় দলের ক্রিকেটাররাই নন, নির্দিষ্ট হারে রাজস্বের ভাগ পান প্রথম শ্রেণির চুক্তিতে থাকা ক্রিকেটাররাও।

বাংলাদেশেও এবারের আন্দোলনর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক, এই প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটারদের অধিকার আদায়।