আমিনুলের লেগ স্পিনে আশার ঝিলিক

এলেন, দেখলেন, জয় করলেন! শুধু খেলাধূলায় নয়, জীবনের বহু ক্ষেত্রে বহু জনের প্রসঙ্গে কথাটি ব্যবহৃত হয়েছে অসংখ্যবার। তারপরও যুগ যুগ ধরে এটিই কোনো বিস্ময় ছড়ানো নবীনের স্তুতিতে আদর্শ জয়গান। আমিনুল ইসলাম বিপ্লবের ক্ষেত্রেও বলা যায় একই কথা। বাংলাদেশের টি-টোয়েন্টি স্কোয়াডে তার জায়গা পাওয়া ছিল চমক জাগানিয়া। সেই চমক আমিনুল ধরে রাখলেন পারফরম্যান্সেও। অভিষেক হলো লেগ স্পিনের আলো ছড়িয়ে।

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 Sept 2019, 03:01 AM
Updated : 19 Sept 2019, 03:01 AM

৪ ওভারে ১৮ রান দিয়ে ২ উইকেট। অভিষিক্ত যে কোনো বোলারের জন্যই বেশ ভালো বোলিং ফিগার। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে বুধবার আমিনুলের এই পারফরম্যান্সের বিশেষত্ব আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে তিনি লেগ স্পিনার বলেই।

কার্যকর একজন লেগ স্পিনারের জন্য দেশের ক্রিকেটে হাহাকার অনেক দিন থেকেই। আমিনুলের এত দ্রুত জাতীয় দলে আসাও সেই হাহাকার মেটানোর তাগিদ থেকেই।

১৯ বছর বয়সী ক্রিকেটার প্রথম দিনেই ছাপ রাখলেন উজ্জ্বল ভবিষ্যতের। দারুণ শুরুর পরও হারিয়ে যাওয়ার নজির বাংলাদেশ ক্রিকেটে কম নেই। তবে আমিনুল প্রথম সুযোগে অন্তত জানিয়ে রাখলেন, তাকে নিয়ে লম্বা সময়ের বিনিয়োগ করা যায়।

বেশির ভাগ সময়ই একজন লেগ স্পিনারকে বোলিং ফিগার দিয়ে বিচার করা অন্যায়। আমিনুলের ক্ষেত্রেও সেটি সত্যি। তাকে নিয়ে মুগ্ধতা ও আশার মূল জায়গাও তার বোলিং ফিগার নয়, বোলিংয়ের ধরন।

মূলত তিনি ব্যাটসম্যান, কিন্তু বাজি ধরা হয়েছে তার লেগ স্পিনে। নার্ভাস হয়ে ওঠার জন্য যথেষ্ট। প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচে নার্ভাস থাকেন তো ঘরোয়া ক্রিকেটে অনেক পোড় খাওয়া ক্রিকেটারও। কিন্তু আমিনুলের বোলিংয়ে, তার শরীরী ভাষায় স্নায়ুর চাপের লেশ মাত্র দেখা যায়নি।

চাপ নিশ্চয়ই অনুভব করেছেন। মাঠে নামার সময় রোমাঞ্চে হাবুডুবু খেয়েছেন। স্বপ্নে আঁকা ছবিগুলোকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার তাড়না অনুভব করেছেন। দুঃস্বপ্ন উপহার পাওয়ার শঙ্কাও নিশ্চয়ই ছিল। কিন্তু ভেতরের সেই দোলাচলকে বাইরে ফুটিয়ে তুলতে দেননি। অভিষেকে আমিনুলের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব সম্ভবত সেটিই।

দেখার মতো ছিল তার নিয়ন্ত্রণ। অনেক সময়ই একজন লেগ স্পিনারের লাইন-লেংথে থিতু হতে একটু সময় লাগে। অভিষিক্ত আমিনুল শুরু থেকেই বল রেখেছেন ঠিক জায়গায়। সেটির পুরস্কারই পেয়েছেন আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের মাত্র তৃতীয় বলে উইকেট নিয়ে।

নিয়ন্ত্রণ ছিল দারুণ। আর ছিল সাহস। বল ঝুলিয়ে দিয়েছেন। ব্যাটসম্যানকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। চ্যালেঞ্জ করেছেন। আক্রমণ করেছেন।

যদিও শুরুতেই ৩ উইকেট হারিয়ে চাপে ছিল জিম্বাবুয়ে। স্কোরবোর্ডে বেশ বড় পুঁজি আর ভড়কে থাকা প্রতিপক্ষ আমিনুলের কাজ সহজ করেছে। রান বাঁচানো বোলিংয়ের ভাবনা রাখতে হয়নি। প্রতিপক্ষ সেভাবে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারেনি। তারপরও ১৯ বছর বয়সী একজন, ঘরোয়া ক্রিকেটে বোলিংয়ের অভিজ্ঞতা যার সামান্য, বোলার পরিচয়টা তার নিজের জন্যও নতুন, তিনি ভাবনা গুছিয়ে সাহসী বোলিং করেছেন, ভবিষ্যতের আশা জাগানিয়া বার্তাই দেয়। কে না জানে, লেগ স্পিনারদের জন্য সাহস অনেক বড় সম্পদ!

টার্ন উল্লেখযোগ্য কিছু ছিল না। ব্যাটসম্যান থেকে লেগ স্পিনার হয়ে ওঠার পথে থাকা একজনের কাছে এখনই বেশি টার্ন আশা করাও কঠিন। তেমন ছিল না বাড়তি বাউন্সও। তবে খানিকটা লুপ, কিছু ড্রিফট আর ফ্লাইটের বৈচিত্র্য বুঝিয়ে দিয়েছে, লেগ স্পিনারের উপকরণ কিছু তার ভেতরে আছে।

৪ ওভারে কোনো চার-ছয় হজম করেননি, প্রতিপক্ষ চাপে থাকার কথা বিবেচনায় নিয়েও বলতে হবে, একজন লেগ স্পিনারের জন্য এই নিয়ন্ত্রণ দারুণ কিছু।

বোলিংয়ের মতো আগ্রাসী ছিল মাঠে তার শরীরী ভাষাও। ফিল্ডিং, আচরণ, মাঠে বিচরণ, সব মিলিয়ে তার উপস্থিতি ছড়িয়ে দিয়েছে আত্মবিশ্বাসের সুবাতাস।

অবশ্যই এখনই অতি উচ্ছ্বাসের কিছু নেই। আমিনুলের এটি কেবলই প্রথম পদক্ষেপ। সামনের প্রতিটি পদক্ষেপে আসবে অনেক প্রতিকূলতা। ক্রমেই কঠিন হবে পথচলা।

স্কিলে আরও অনেক উন্নতির চ্যালেঞ্জ তো আছেই। পাশাপাশি আছে প্রত্যাশার ভার চাপিয়ে দেওয়ার আশঙ্কা। সেই চাপে নুইয়ে পড়ার শঙ্কা। লেগ স্পিনারের জন্য মুখিয়ে থাকা দল ও ক্রিকেট জাতির গ্রাস হয়ে ওঠার শঙ্কাও আছে।

আছে অতীতের অনেক তিক্ত উদাহরণ। হারিয়ে যাওয়া বা ফেলার স্মৃতি। সামলাতে না পারা বা সামলে উঠতে না পারার ব্যর্থতা। বাংলাদেশে লেগ স্পিনে ভালো কিছুর উদাহরণ আমিনুলের সামনে নেই।

তবু আছে আশার বেসাতি। যদি আমিনুল পথ না হারান। যদি বাংলাদেশের ক্রিকেট শিক্ষা নেয় অতীত থেকে। পরিচর্যা করা হয় ঠিকমতো। যদি গড়ে তোলা হয় যত্নে। তাহলে একটি রত্ন পেতেই পারে বাংলাদেশ।

প্রথম ম্যাচে যিনি আশার ঝিলিক দেখিয়েছেন, তিনি হয়ে উঠতে পারেন অবারিত আলোর উৎস।