এভাবে অবসরে যাওয়া অবশ্যই হতাশার: মাসাকাদজা

তার আবির্ভাব ছিল ক্রিকেট বিশ্বে সাড়া জাগিয়ে। ২০০১ সালে টেস্ট অভিষেকেই রেকর্ড গড়েছিলেন সবচেয়ে কম বয়সে সেঞ্চুরি করে। জিম্বাবুয়ের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ ব্যাটসম্যান হিসেবে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে প্রথম সেঞ্চুরি করেছিলেন তার আগেই। তবে শুরুর সেই প্রতিশ্রুতির পূর্ণতা দিতে পারেননি সুদীর্ঘ ক্যারিয়ারে। জিম্বাবুয়ের ক্রিকেটও হেঁটেছে কেবল পেছন পানে। বিরুদ্ধ সেই সময়ের সঙ্গে দেড় যুগের বেশি লড়াই করে অবশেষে থামার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন হ্যামিল্টন মাসাকাদজা।

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 Sept 2019, 04:32 AM
Updated : 16 Sept 2019, 08:19 AM

চাওয়া ছিল আরও বছরখানেক খেলা চালিয়ে যাওয়া। কিন্তু আইসিসির নিষেধাজ্ঞার পর ভাবনা বদলে জানিয়ে দিয়েছেন, বাংলাদেশ সফরই তার শেষ। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে দেওয়া দীর্ঘ একান্ত সাক্ষাৎকারে জিম্বাবুয়ের বিদায়ী অধিনায়ক কথা বললেন তার অবসর, ক্যারিয়ারের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি আর জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটের নানা বাস্তবতা নিয়ে।

অনেকেই হুট করে অবসর নিয়ে ফেলে। অনেকেই অনেক ভেবে সিদ্ধান্ত নেয়। আপনার ক্ষেত্রে কোনটি?

হ্যামিল্টন মাসাকাদজা: লম্বা সময় নিয়ে ভেবেছি। অনেক দিন ধরে ক্রিকেট খেলছি। ক্যারিয়ারের এই পর্যায়ে আসার পর মনের কোণে একটি ভাবনা সবসময়ই থাকে যে কতদিন খেলব, কখন বিদায় নেব। বয়স ৩৬ হয়ে গেছে। গত কিছুদিন থেকে একটু গুরুত্ব দিয়েই ভাবছিলাম।

আমরা ভাবনা ছিল যে, আগামী বছর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ খেলে অবসরে যাব। সামনেই বাছাইপর্ব। কিন্তু আইসিসির নিষেধাজ্ঞায় আমরা বাছাই খেলতে পারছি না। পরের বড় টুর্নামেন্ট বলতে গেলে ২০২৩ ওয়ানডে বিশ্বকাপ। ততদিন পর্যন্ত আমার থাকার কারণ নেই। তাই আর জায়গা আটকে রাখতে চাইনি। নতুন কেউ এসে পরের বিশ্বকাপের জন্য প্রস্তুত হোক। সব মিলিয়েই এখন বিদায় জানানোর উপযুক্ত সময় মনে হয়েছে।

তার মানে, আইসিসির নিষেধাজ্ঞা আপনার অবসরের সিদ্ধান্তে বড় ভূমিকা রেখেছে?

মাসাকাদজা: অবশ্যই। ভাবছিলাম তো অনেক দিন থেকেই। কিন্তু যেটা বলেছি যে, টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ পর্যন্ত খেলতে চেয়েছিলাম। সেই সুযোগ না থাকার পর আর চালিয়ে যাওয়ার মানে দেখিনি।

এভাবে নিজের চাওয়ার আগেই অবসরে যেতে বাধ্য হওয়াটা হতাশার?

মাসাকাদজা: ভীষণ হতাশার। মাঠের বাইরের কোনো ইস্যু মাঠের সিদ্ধান্তে ভূমিকা রাখবে, ক্রিকেটকে প্রভাবিত করবে, এটা কখনোই কাম্য নয়। খুবই হতাশার, খুবই দুঃখজনক। কিন্তু এটা আমার বা ক্রিকেটারদের হাতে নেই। কিছু করার নেই। পর্দার আড়ালে অনেক কিছুই হয়।

তবে এটাই কিছুটা সান্ত্বনার যে, তারা অন্তত চেষ্টা করছে সমস্যা সমাধানের। আমরা এখানে খেলতে এসেছি, এটিও একটি প্রমাণ যে সব ইতিবাচক দিকে এগোচ্ছে। অর্ধেকের বেশি সমাধান হয়ে গেছে বলেই আমি। এটি আশার ব্যাপার। এখন অন্তত আমরা জানি, টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ হাতছাড়া হয়ে গেলেও আর কোনো টুর্নামেন্ট হয়তো মিস করতে হবে না।

পেছন ফিরে তাকালে, নিজের ক্যারিয়ারকে কিভাবে দেখেন?

মাসাকাদজা: অনেক লম্বা ক্যারিয়ার। অসংখ্য ওঠা-নামা ছিল। অনেক সাফল্য-ব্যর্থতা এসেছে। আবার সুযোগ পেলে হয়তো অনেক কিছুই অন্যভাবে করতাম। আরও অনেক কিছু পাওয়ার ছিল। তবে সব মিলিয়ে ভাবলে, প্রাপ্তির পাল্লাই বেশি ভারি মনে হয়।

এতো লম্বা সময় দেশকে প্রতিনিধিত্ব করা অনেক সৌভাগ্যের ও সম্মানের। বিশেষ করে আমি যে জায়গা ও যে অবস্থান থেকে উঠে এসেছি। আমাদের এলাকায় একসময় ক্রিকেটের লেশ মাত্র ছিল না। হারারের ছোট্ট একটা অনুন্নত এলাকায় থাকতাম আমরা। বোর্ডের একটি ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রামের মাধ্যমে প্রথমবার ক্রিকেট শুরু হয় আমাদের ওখানে। আমরা এক দল ছেলে ওই সময়ই ক্রিকেট শুরু করি।

সেখান থেকে উঠে এসে এতোদিন দেশের হয়ে খেলা, নেতৃত্ব দেওয়া অনেক বড় ব্যাপার। সবচেয়ে বড় কথা, অনেক মানুষের অনুপ্রেরণা হতে পেরেছি। আমাদের গ্রুপের অনেককে দেখে অনেক বাচ্চারা ক্রিকেটে এসেছে, এটা অনেক বড় প্রাপ্তি।  

চারপাশের অনেক বাস্তবতা বিবেচনায় রাখলে, আমার ক্যারিয়ার যথেষ্টই সমৃদ্ধ। আবার যদি আমাকে ১৬ বছর বয়সে ফিরে যাওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়, আবারও ক্রিকেটারই হতে চাইব। ব্যাটসম্যান হতে চাইব।

রান, উইকেট বা পরিসংখ্যানের বাইরে, অনুপ্রেরণা হতে পারাটাই কি সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি?

মাসাকাদজা:
অবশ্যই। এটিই আমার ক্যারিয়ারের শেষ সফর। আসার আগে ছোট্ট আয়োজনে আমাকে সম্মান জানিয়েছে। বিদায় জানিয়েছে। আমার ক্যারিয়ারটাকে উদযাপন করেছে ওরা। এটিই তো আসল প্রাপ্তি। ক্রিকেটার হিসেবে পরিসংখ্যান নিয়ে আমাদের ভাবনা থাকে সামান্যই। আমাদের চাওয়া থাকে দলের হয়ে অবদান রাখা, প্রয়োজনে মেলে ধরা, সবটা উজার করে দেওয়া। এসব দেখেই সতীর্থরা সম্মান করে, পরবর্তী প্রজন্ম অনুপ্রাণিত হয়।

এখানে আসার আগে ওই আয়োজনে ওরা এসবই বলছিল। নানা যুগের, বিভিন্ন প্রজন্মের অনেকে ছিলেন সেখানে। ওদের কথা শুনে নিজেকেও যেন নতুন করে চিনতে পেরেছি আমি। মনে হয়েছে, যতটা ভেবেছিলাম, আসলে হয়তো তার চেয়ে বেশি কিছুই করেছি আমি!

১৬ বছর বয়সে ফিরে যাওয়ার কথা বলছিলেন একটু আগে। ১৬ বছর বয়সেই আপনি প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে প্রথম সেঞ্চুরি করেছিলেন, জিম্বাবুয়ের সর্বকনিষ্ঠ ব্যাটসম্যান হিসেবে। ১৭ বছর বয়সে করেছিলেন সর্বকনিষ্ঠ টেস্ট সেঞ্চুরিয়ানের বিশ্বরেকর্ড (যে রেকর্ড পরে ভেঙেছিলেন মোহাম্মদ আশরাফুল)। অনেক স্বপ্ন ছিল নিশ্চয়ই, লক্ষ্য ছিল। কেমন ছিল সেই সময়টা?

মাসাকাদজা: তখন সময়টা অন্যরকম ছিল। এতো লোকে তখন ক্রিকেট খেলত না, এতো এতো ক্লাব ছিল না। বাইরের অনেকের কাছে অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে, কারণ জিম্বাবুয়ের জাতীয় দল তখন দারুণ ছিল। কিন্তু মাত্র হাতে গোণা কয়েকটি ক্লাব ছিল তখন। কিছু মানুষ কেবল ক্রিকেট খেলত।

এতে যা হয়েছে, জাতীয় ক্রিকেটাররাও ক্লাবে খেলতেন। আমি যখন ক্লাবে এসেছি, আমার নায়কদের সঙ্গে খেলেছি। রাজ্য বা ফ্র্যাঞ্চাইজি পর্যায়ে যাওয়ার আগে, ক্লাব পর্যায়েও সর্বোচ্চ পর্যায়ের ক্রিকেটের স্বাদ পেয়েছি আমরা। এত কম বয়সে ওই মানের ক্রিকেটে খেলা ছিল অনেক বড় অভিজ্ঞতা।

আমার ক্লাবে কিছুদিন অ্যান্ডি ফ্লাওয়ারের সঙ্গে খেলার সুযোগ পেয়েছিলাম। তাকে কাছ থেকে দেখা, তার কথা শোনা, ওয়ার্ক এথিকস দেখা, আমার জন্য ছিল অন্যরকম অভিজ্ঞতা।

এখন অনেক বেশি ছেলে ক্রিকেট খেলছে, অনেক ক্লাব আছে। ওই সময় আমার জন্য কাজ সহজ ছিল না। সবচেয়ে কম বয়সে সেঞ্চুরি বলেই নয়, প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ ব্যাটসম্যান হিসেবে প্রথম শ্রেণির ম্যাচে সেঞ্চুরি করা, অভাবনীয় অর্জন ছিল সেই সময়টায়।

আর টেস্ট অভিষেকে রেকর্ড গড়া সেঞ্চুরির মুহূর্তটা (২০০১ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে)?

মাসাকাদজা: স্বপ্নের মতো ছিল। তখনও আমি স্কুল ছাত্র। মনে আছে, এক পর্যায়ে গ্যালারিতে তাকিয়ে দেখি, বেগুনি রঙের ছড়াছড়ি। আমাদের স্কুলের পোশাক ছিল বেগুনি রঙয়ের। ছেলেরা সবাই আমার খেলা দেখতে চলে এসেছিল। তখন স্কুলের ক্লাস চলার কথা, ওরা ফাঁকি দিয়ে এসেছিল। ওদের দেখে তখন দারুণ রোমাঞ্চিত হয়েছিলাম।

এছাড়াও, আমার বাবা ছিলেন গ্যালারিতে। ক্রিকেট সম্পর্কে আগে তার কোনো ধারণাই ছিল না। কিন্তু ছেলের ব্যাটিং দেখতে এসেছিলেন।

দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাটিংয়ে নামার সময় আমরা বেশ চাপে ছিলাম (প্রথম ইনিংসে ২১৬ রানের লিড পেয়েছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ)। সময়ের অভাব ছিল না। আমি শুধু চেয়েছি উইকেটে সময় কাটাতে। কে বোলিং করছে, কাদের বিপক্ষে খেলছি, কত রান হয়েছে আমার, কিছুই মাথায় ছিল না। রেকর্ড-টেকর্ড তো ছিলই না। চেয়েছি শুধু উইকেটে পড়ে থাকতে। অনেকটাই পেরেছিলাম, সাড়ে ৬ ঘণ্টা ব্যাট করে ম্যাচ বাঁচাতে পেরেছিলাম (৩৮৮ মিনিট ব্যাট করে ৩১৬ বলে ১১৯ রান)।

অ্যান্ডি ও গ্রান্ট ফ্লাওয়ার তখনও খেলছেন, হিথ স্ট্রিক, অ্যালেস্টার ক্যাম্পবেল, গাই হুইটাল, অ্যান্ডি ব্লিগনটরা খেলছেন। এত অল্প বয়সে তাদের সঙ্গে খেলে ইতিহাস গড়া, স্বপ্নেও নিশ্চয়ই অমন কিছু ভাবেননি!

মাসাকাদজা:
মোটেও না। তখন তো আসলে ক্রিকেটের অতকিছু বুঝতামও না। শুধু বুঝতাম ব্যাট করতে হবে, উইকেটে থাকতে হবে। রেকর্ড বা সেঞ্চুরির মাহাত্মও সেভাবে জানতাম না।

যাদেরকে নায়ক মেনে বড় হয়েছি, তাদের সঙ্গে খেলতে পারা, এক ড্রেসিং রুমে থাকতে পারাই তখন আমার কাছে স্বপ্নের মতো। সবচেয়ে মজা লেগেছে, তাদেরকে যেরকম ভাবতাম, কাছ থেকে দেখলাম, পুরো অন্যরকম। দলে যে কতজন জোকার ছিল, লোকে ধারণাও করতে পারত না! অ্যালেস্টার ক্যাম্পবেল একজন, সবসময় মজা করতেন।

তাদের সঙ্গে অনুশীলন করা, কাছ থেকে দেখে অনেক কিছু শিখেছিলাম।হেনরি ওলোঙ্গার কথা মনে পড়ে। হাতে ধরে আমাকে অনেক কিছু শিখিয়েছেন।

দ্বিতীয় টেস্টেও দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ৮৫ রানের দুর্দান্ত ইনিংস খেলেছিলেন। কিন্তু অমন সম্ভাবনাময় ক্যারিয়ার রেখে বছরখানেক পরই পড়াশোনা করতে চলে গেলেন দক্ষিণ আফ্রিকায়!

মাসাকাদজা:  স্কুল শেষ করার পরই মার্কেটিং ডিগ্রি নিতে যাই দক্ষিণ আফ্রিকার ব্লুমফন্টেইনে ফ্রি স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ে। সিদ্ধান্তটি কঠিন ছিল, ক্রিকেট ক্যারিয়ার তখন সম্ভাবনাময়। কিন্তু পরিবারের সঙ্গে কথা বলে, ভবিষ্যতের জন্য ভিন্ন পথ খোলার রাখার ভাবনাও এলো। শুধু ক্রিকেটে থেকে জিম্বাবুয়েতে ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত মনে হচ্ছিল তখন।

তখন প্রায় তিন বছর ক্যারিয়ারের বিরতি ছিল। এখন ও সেই সিদ্ধান্ত নিয়ে অনেকের কৌতূহলের জবাব দিতে হয় আমাকে। আমার ক্যারিয়ারের দৈর্ঘ্য নিয়ে আলোচনায়ও অনেকে এটা ভুলে যান যে, ২০০১ সালে অভিষেক হলেও পরে তিন বছর ছিলাম না।

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ও ক্রিকেট অনুশীলন চালিয়ে গেছি। খেলাটার অনেক কিছু শিখেছি। বিশেষ করে ফাস্ট বোলিং, সিম বোলিং খেলায় অনেক উন্নতি হয়েছিল তখন। পড়াশোনা আর খেলা মিলিয়ে সময় ভালেই কেটেছে।

আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের যেরকম শুরু আপনার হয়েছিল, যতটা সম্ভাবনা ছিল, এখন হিসাব মিলিয়ে, কতটুকু পূর্ণতা দিতে পেরেছেন বলে মনে হয়?

মাসাকাদজা: এটা বলা কঠিন। হ্যাঁ-না মিলিয়ে। কোথাও অনেকটুকুই পেরেছি, কোথাও পারিনি। অপ্রত্যাশিত অনেক কিছুই অর্জন করেছি। আবার মনে হয়, আরও অনেক কিছু পেতে পারতাম। করা উচিত ছিল। তবে সব মিলিয়ে, এত দীর্ঘ সময় খেলেছি, এটিই সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি মনে করি। খেলা শুরুর সময় মাথায়ও ছিল না যে, এতো লম্বা সময় খেলতে পারব। ক্যারিয়ারের বেশির ভাগ জুড়ে দলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলাম, অনেকগুলো ম্যাচে নেতৃত্ব দিয়েছিল, সব মিলিয়ে খারাপ মনে হয় না।

নিজের মতে, ক্যারিয়ারের স্মরণীয়তম মুহূর্ত?

মাসাকাদজা: অনেক মুহূর্ত আছে বলার মতো। কোনো একটি বলা কঠিন। তবু যদি বলতে হয়, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে জিম্বাবুয়ের হয়ে সবচেয়ে বেশি ম্যাচ খেলার রেকর্ড গড়ার দিনটি। পাকিস্তানের সঙ্গে ছিল ম্যাচটি, ওদের ব্যাটিং কোচ তখন গ্রান্ট ফ্লাওয়ার। আমার ছেলেবেলার নায়কদের একজন। আমাকে বিশেষ একটি ক্যাপ দেওয়া হয়েছিল, যেটি পরিয়ে দিয়েছিলেন গ্রান্ট। আমার জন্য খুবই স্পেশাল ছিল।

সবচেয়ে হতাশার স্মৃতি?

মাসাকাদজা: এটা নিয়ে কোনো সংশয় নেই। ২০০৭ ও ২০১১, পরপর দুটি বিশ্বকাপের দলে জায়গা না পাওয়া। দুইবারই সম্ভবত সবচেয়ে বাজে সময়েই ফর্ম খারাপ হয়ে গিয়েছিল আমার। তাই সুযোগ মেলেনি। দুইবারই পরে আবার জায়গা আদায় করে নিয়েছি, খেলে গেছি। কিন্তু বিশ্বকাপ দুটি বড় দুঃখ হয়েই থেকে গেছে।

২০১৫ বিশ্বকাপ দিয়ে অবশেষে প্রথম বিশ্বকাপ খেলার স্বাদ পেয়েছি। কিন্তু এত লম্বা ক্যারিয়ারে মাত্র একটি বিশ্বকাপ, অবশ্যই আমার ক্যারিয়ারের দুঃখজনক দিক।

ক্যারিয়ারে আপনার খেলা কঠিনতম বোলার?

মাসাকাদজা: এমন একজনের নাম বলব, বোলার হিসেবে হয়তো খুব বড় বা বিখ্যাত কেউ নন। তবে আমার খেলতে ভীষণ অসুবিধা হয়েছে। সোহেল তানভির। ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে অনেক সুইং করাতেন এই বাঁহাতি পেসার। ওভার দা উইকেটে বল করে ডানহাতি ব্যাটসম্যানের জন্য বল বাইরে নিয়ে যেতেন। আমি তখন মূলত লেগ সাইডেড ব্যাটসম্যান। সহজেই বুঝতে পারছেন, আমার অবস্থা কেমন ছিল! ব্যাটসম্যানের কাজ আরও কঠিন করে তুলত তার বোলিং অ্যাকশন ও রং ফুটেড ডেলিভারি। সব মিলিয়ে আমার জন্য তানভির ছিলেন বিভীষিকা।

যাদের সঙ্গে বা বিপক্ষে খেলেছেন, তাদের মধ্যে সেরা ব্যাটসম্যান?

মাসাকাদজা: অবশ্যই ক্রিস গেইল। সবসময়ই আমি তার ব্যাটিংয়ের ভক্ত। আমাদের বিপক্ষে সবসময়ই রান করেছে। আমার ক্যারিয়ারের শুরু যখন, তার ক্যারিয়রও তখন শুরুর দিকেই। তারপরও তার ব্যাটিং মুগ্ধ হয়ে দেখতাম। অনেক কিছু শেখার চেষ্টা করতাম।

এখন লোকে কেবল তার টি-টোয়েন্টি ব্যাটিং নিয়েই কথা বলে। অথচ টেস্টে তার দুটি ট্রিপল সেঞ্চুরি। ওয়ানডেতেও কিংবদন্তি।

বেড়ে ওঠার দিনগুলোতে আমার নায়ক ছিলেন অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার। জিম্বাবুয়ের মতো দেশ থেকে একজন টেস্ট র‍্যাঙ্কিংয়ের এক নম্বর ব্যাটসম্যান হয়েছিলেন, আমাদের জন্য সেটি ছিল অনেক বড় ব্যাপার। স্পেশাল একজন ক্রিকেটার ছিলেন, স্পেশাল মানুষও।

ঢাকা লিগ থেকে বিপিএল, জাতীয় দলের হয়ে অনেকবারের সফর, বাংলাদেশে অনেক বার এসেছেন, অনেক ম্যাচ খেলেছেন। বাংলাদেশ কতটা জুড়ে আছে আপনার ক্যারিয়ারে, আপনার কাছে?

মাসাকাদজা:  এত এত সময় এই দেশে কাটিয়েছছি। জিম্বাবুয়ের বাইরে দক্ষিণ আফ্রিকা ও বাংলাদেশেই আমি সম্ভবত সবচেয়ে বেশি সময় কাটিয়েছি। অনেক স্মৃতি বাংলাদেশে। এই দেশ আমার দ্বিতীয় ঘরের মতো। এখানকার আবহাওয়ার সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছি। এত এত লোকের সঙ্গে পরিচয়, অনেক বন্ধু… বাংলাদেশে আমি সবসময়ই উপভোগ করেছি। আমাদের থেকে পুরো ভিন্ন একটি সংস্কৃতিকে এত কাছ থেকে দেখা ও জানতে পারাও ছিল উপভোগ্য। এত ঘন ঘন এখানে এসেছি, আমার ক্যারিয়ারের বড় অংশ জুড়ে এই দেশ। যেটা বললাম, বাংলাদেশ আসলেই আমার দ্বিতীয় বাড়ির মতো।

বাংলাদেশে এত স্মৃতি বলছেন, এই মুহূর্তে উল্লেখযোগ্য কিছু মনে পড়ছে, যেটি খুব দাগ কেটেছে আপনার মনে?

মাসাকাদজা: (একটু ভেবে) আমার জন্য ইন্টারেস্টিং অভিজ্ঞতা ছিল মাশরাফির সঙ্গে খেলা। কলাবাগানে একসঙ্গে খেলেছিলাম আমরা (২০১৬ ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে)। কাছ থেকে দেখে অনেক কিছু জানতে পেরেছিলাম। আমরা সবাই তার সম্পর্কে টুকটাক জানতাম। তবে অন্য ড্রেসিং রুমে থেকে আসলে বোঝা যায় সামান্যই। সে যে ধরনের মানুষ, যে ধরনের ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠেছে, এটা কাছ থেকে জানতে পারা ছিল দারুণ কিছু।

ড্রেসিং রুমে যে ধরনের সম্মান সে পায়, যে প্রভাব দেখেছি, আবার এতটা মজাপ্রিয়, তার সঙ্গে কাটানো সময় ছিল সত্যিই আমার প্রিয় স্মৃতি। কতকিছু সামলে সে খেলেছে, তারপরও তার যে স্কিল লেভেল, আমার আগের অনেক ধারনাই পাল্টে গেছে।

তবে সবকিছুর ওপরে, এত প্রতিবন্ধকতা পেরিয়েও সে যেভাবে নিজের মতো করে বাংলাদেশের পেস বোলিংকে সামনে এগিয়ে নিয়েছে, কাছ থেকে দেখে আমার চোখ খুলে গেছে। আমার বাংলাদেশ অধ্যায়ের বড় পাওয়া মনে করি তার সঙ্গে একই ড্রেসিং রুমে কাটানো সময়।

আপনি যখন শুরু করেছিলেন, জিম্বাবুয়ে তখন বিশ্ব ক্রিকেটে ছিল সমীহ জাগানিয়া শক্তি। নিশ্চয়ই দল নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল আপনার। এরপর মাঠের বাইরের নানা বাস্তবতায় জিম্বাবুয়ের ক্রিকেটে যেভাবে পতনের দিকে গিয়েছে, এখন সামনে এত অনিশ্চয়তা, যাওয়ার সময় আপনাকে কতটা পোড়াচ্ছে এসব?

মাসাকাদজা: জীবনে খারাপ-ভালো সবকিছুই আসে। যা হয়েছে, অনেক কিছুই ছিল আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। ২০০১ থেকে ২০০৩ সময়টায় আমাদের ক্রিকেটে যা হয়েছে, সেসবই আমাদের ক্রিকেটকে পেছনের দিকে ঠেলে দিয়েছে। এরপর আর আগের অবস্থায় যায়নি। খারাপ লেগেছে, অনেকেই চেষ্টা করেছে।

আমাদের হাতে যেটা ছিল, ভালো ক্রিকেট খেলা, আমরা চেষ্টা করেছি। কিন্তু জীবনে সবকিছু ভাবনামতো হয় না।

সেই ওলোঙ্গা-ফ্লাওয়ারদের দিয়ে অকাল অবসর শুরু। অনেক প্রতিভাবান ক্রিকেটার এরপর সরে পড়েছেন। ব্রেন্ডন টেইলর, কাইল জার্ভিসরা ইংল্যান্ডে গিয়ে আবার ফিরেছেন। এখন আপনাকে যেতে হচ্ছে প্রত্যাশার আগেই। সম্প্রতি সলোমন মিরে অবসর নিয়ে ফেলেছেন। সামনের পথচলায়ও অনিশ্চয়তা। জিম্বাবুয়ের ক্রিকেট কি কেনিয়ার পথে এগোচ্ছে?

মাসাকাদজা: আশা করি, না। যেটা বলছিলাম যে বর্তমান সঙ্কট কেটে যাচ্ছে। অর্ধেকের বেশি সমাধান হয়ে গেছে। অবশ্যই গত এক–দেড় যুগে অনেক ভুগতে হয়েছে জিম্বাবুয়ের ক্রিকেটকে। অনেক কিছুই আদর্শ ছিল না। কিন্তু আগেও বলেছি, আগের চেয়ে অনেক বেশি ক্রিকেটার আছে এখন আমাদের, অনেক ক্লাব আছে। শুধু গুছিয়ে উঠে সবাই মিলে এক লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার ব্যাপার।

এখন আর অতীতে মন দিয়ে লাভ নেই। সামনে তাকাতে হবে। গুছিয়ে উঠতে হবে। এগিয়ে যেতে হবে। সবার জায়গা থেকে নিজের চেষ্টা করতে হবে। অনেক সময় এই ধরনের বিপদ থেকে ভালো কিছু হয়। জিম্বাবুয়ের ক্রিকেটকে নিয়েও সেই আশা করছি।

খেলা ছাড়ার পরের ক্যারিয়ার নিয়ে ভেবেছেন? মার্কেটিং ডিগ্রি যেহেতু আছে, সেদিকে যাবেন নাকি ক্রিকেটে থাকবেন?

মাসাকাদজা: এখনও ভাবছি। নিশ্চিত নই কোনদিকে যাব। সব পথই খোলা আছে। কর্পোরেট জগতে যেতে পারি কিংবা ক্রিকেটেও থাকতে পারি। জিম্বাবুয়ে ক্রিকেট থেকে যা পেয়েছি, যদি সেই অভিজ্ঞতা থেকে কিছু ফিরিয়ে দিতে আমাকে ডাকা হয়, যে কোনোভাবে যদি কোনো সাহায্য চাওয়া হয়, অবশ্যই করার চেষ্টা করব। এই সিরিজ শেষে কিছুটা সময় বিরতি নিয়ে তার পর হয়তো নতুন জীবন নিয়ে আরও গুরুত্ব দিয়ে ভাবব।