ক্যারিয়ার নিয়ে আমি অনেক সচেতন: মিঠুন

এশিয়া কাপে গুরুত্বপূর্ণ দুটি ফিফটি। নিউ জিল্যান্ড সফরে বিপর্যয়ের মধ্যে দুটি। তাতে বিশ্বকাপ স্কোয়াডে জায়গা অনেকটাই নিশ্চিত করে ফেলেছেন মোহাম্মদ মিঠুন। সব ঠিক থাকলে, বিশ্বকাপে বাংলাদেশের ব্যাটিং অর্ডারের ৫ নম্বর জায়গা সামলাবেন তিনি। ক্যারিয়ারকে এই পর্যায়ে আনতে লড়তে হয়েছে অনেক। চোটের কারণে আপাতত ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে খেলছেন না। তবে অনুশীলন করছেন। রোববার মিরপুরে তার দল আবাহনীর অনুশীলন শেষে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে শোনালেন একসময় পথচ্যুত হয়ে পড়া ক্যারিয়ারকে পথে ফিরিয়ে গুছিয়ে নেওয়া গল্প।

ক্রীড়া প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 31 March 2019, 02:35 PM
Updated : 31 March 2019, 04:27 PM

চোটের কি অবস্থা?

মোহাম্মদ মিঠুন: নিউ জিল্যান্ডে হ্যামস্ট্রিংয়ের যে ইনজুরি ছিল, সেটিই আবার একটু মাথাচাড়া দিয়েছে। তাই বিরতি নিয়েছি। ঠিক করেছি যে, পুরো ভালো হলেই আবার খেলতে নামব। একটু-আধটু সমস্যা নিয়েও খেলে গেলে ওটা আবার ফিরে আসবে।

বিশ্বকাপ সামনে বলেই এত সতর্কতা?

মিঠুন: বলতে পারেন। আবাহনী দল, সুজন ভাইয়ের (কোচ খালেদ মাহমুদ) কাছে আমি কৃতজ্ঞ যে আমাকে সমর্থনটুকু দিয়েছেন। এমনিতে প্র্যাকটিসে ব্যাটিং, জিম সবই করছি। শুধু ম্যাচ এখনই খেলছি না। বৃহস্পতিবারের ম্যাচ থেকে (ফতুল্লায় প্রাইম দোলেশ্বরের বিপক্ষে) খেলতে পারি।

বাংলাদেশের নিউ জিল্যান্ড সফর যেভাবে শেষ হলো (ক্রাইস্টচার্চের মসজিদে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায়), সেটি তো বড় একটি মানসিক ধাক্কা ছিল। কতটুকু সামলে নিতে পেরেছেন?

মিঠুন: প্রায় পুরোপুরি। নিজের দেশে ফিরলে, পরিবারের সঙ্গে সময় কাটালে এমনিতেই সবকিছু ভালো লাগে। আমার বাবা-মা, স্ত্রী, ওরাই বেশি টেনশনে ছিল। আসার পর আস্তে আস্তে সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে গেছে।

সফরের শুরুটা তো আপনার বেশ ভালো ছিল। চোট পাওয়ার আগে দুই ওয়ানডেতে দুটি ফিফটি করেছেন, যা হয়তো বিশ্বকাপ দলে জায়গা নিশ্চিত করে দিয়েছে। একদম সময় মতোই এসেছে ইনিংস দুটি!

মিঠুন:
ভালো খেলাটা সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ। নিউ জিল্যান্ড সফর বা বিশ্বকাপ বলে নয়। ক্যারিয়ার বড় করতে চাইলে প্রতিটি মূহুর্ত, প্রতিটি ম্যাচই গুরুত্বপূর্ণ। হয়তো ইনিংস দুটি আমাকে বিশ্বকাপ দলে জায়গা পেতে সাহায্য করবে। তবে আমি ওভাবে দেখি না। আমি চেষ্টা করি, যখন যেটা করি, সেটিই মন দিয়ে করার। নিউ জিল্যান্ড সফরে বিশ্বকাপ নিয়ে ভাবনাই ছিল না।

এখন আমি দূরের কিছু ভাবা বাদ দিয়েছি। একটা সিম্পল উদাহরণ দেই, সেদিন যদি মিনিট পাঁচেক আগে আমরা মসজিদে যেতাম, মরেও যেতে পারতাম। বিশ্বকাপ কোথায় থাকত!

এই ব্যাপারগুলো আগে এভাবে ভাবতাম না। একটা সময় ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেক ভাবতাম যে এই করব, ওই করব। কিন্তু পরে দেখেছি, অত দূরেরটা ভাবলে বর্তমানে ফোকাস থাকে না।

এই ভাবনায় মাশরাফি ভাই অনেক সাহায্য করেছেন আমাকে। আগে টুকটাক কথা হতো। কিন্তু গত দুই মৌসুমে ঢাকা লিগে ও বিপিএলে এক দলে খেলেছি। অনেক সময় কাটিয়েছে ভাইয়ের সঙ্গে। অনেক কথা হয়েছে জীবন ও ক্যারিয়ার নিয়ে।

কোনো কিছু সুন্দর করে না বোঝালে, যত ভালো কথাই হোক, মাথায় ঢোকে না। মাশরাফি ভাই এমন ভাবে বুঝিয়েছেন, আমার হৃদয়ে গেঁথে গেছে। বর্তমান-ভবিষ্যতের ভাবনার ব্যাপারগুলো উনি যেভাবে বুঝিয়েছেন, তা আমার ভাবনা বদলে দিয়েছে। ক্যারিয়ারে কাজে লেগেছে। কারও সঙ্গে কথা বলার পর ভুলে গেলে লাভ নেই। আমি পরে চিন্তা করেছি উনার কথাগুলি। ভেবে দেখেছি, শুধু ক্রিকেট নয়, তার কথাগুলি গোটা জীবনেরই বাস্তবতা। উনি বলেছেন, জীবন গোছানো ও ভালো মানুষ হওয়া জরুরি। তাহলে ক্রিকেটও ভালো হবে। তার পর থেকে আমি আর শুধু ক্রিকেট কেন্দ্রীক ভাবি না।

এশিয়া কাপে গুরুত্বপূর্ণ দুটি ফিফটি করেছিলেন। নিউ জিল্যান্ড সফরে এই দুটি। এখন কি দলের মূল গ্রুপের অংশ বা গুরুত্বপূর্ণ সদস্য, কিংবা নিজেকে আরও বেশি সম্পৃক্ত মনে হচ্ছে?

মিঠুন: দলের অংশ তো বটেই। যখন খেলব, বা স্কোয়াডে থাকব, তখনই তো অংশ। এটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ যে, কতদিন দলের অংশ হয়ে থাকতে পারব। দুটি ফিফটির পর আপনারা বলছেন যে বিশ্বকাপ দলে থাকতে পারি। এভাবে যত পারফর্ম করব, ততই এরকম সিরিজ বা টুর্নামেন্ট খেলব।

তবে এটা ঠিক, আত্মবিশ্বাস এখন বেড়েছে। আগে সবসময় নড়বড়ে থাকতাম। কোনো ম্যাচ বা সিরিজে খোলা মন নিয়ে যেতে পারতাম না। খারাপ করলেই বাদ পড়ব, এই ভয় থাকত। এখন ওই জায়গাটা কাটিয়ে উঠতে পেরেছি। এমন নয় দলে জায়গা পাকা করে ফেলেছি। তবে এখন জায়গা পাকা করা নিয়ে ভাবিই না। যেদিন যে ম্যাচে নামি, সেদিন দল যা চায়, সেটাই শুধু ভাবি। হ্যাঁ, মানসিকভাবে বললে, এটা অনুভব করি যে আমি এই দলের একটি অংশ এখন।

যদিও ক্যারিয়ার খুব বড় নয় আপনার, কেবল ১৫ ওয়ানডে খেলেছেন, এখনই কাঠগড়ায় তোলা কঠিন। তার পরও কয়েকটি ম্যাচে ইনিংস বড় করার সুযোগ থাকলেও করতে পারেননি। ঘাটতি কোথায় ছিল?

মিঠুন: সুযোগ হাতছাড়া করেছি, আমিও জানি। সব ব্যাটসম্যানের লক্ষ্য থাকে সেঞ্চুরি। চেষ্টা যে করি না, তা নয়। হয়নি। ছোট ক্যারিয়ার হলেও বেশ কয়েকবার হয়ে গেছে। বারবার হলে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। হয়তো খারাপ অবস্থা থেকে দলকে মোটামুটি জায়গায় নিয়ে গেলাম, কিন্তু পুরোপুরি কাজ শেষ না করলে তো দায়িত্ব শেষ হচ্ছে না। বেশ কিছু ইনিংসেই এমন দায়িত্ব অর্ধেক পালন করে চলে এসেছি। আমিও এটা অনেক চিন্তা করেছি। কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করেছি।

সমস্যাটা কি টেম্পারামেন্টের? নাকি মনস্তাত্বিক কিছু? ফিফটির পর তৃপ্তি চলে আসে অনেকের...!

মিঠুন: বিশ্বাস করুন, আমিও নিজেকে এই প্রশ্ন করেছি। ইনিংসগুলো শেষে চিন্তা করেছি, আমি নিজে কি সন্তুষ্ট হয়ে গিয়েছিলাম? ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলাম? নাকি অন্য কিছু! কিছু একটা সমস্যা তো হচ্ছেই।

আমার কাছে মনে হয়নি যে তৃপ্ত হয়ে আউট হয়েছি। কারণ প্রথম বল যে ইনটেনসিটি নিয়ে খেলেছি, আউট হওয়া বলটিও একই মনোযোগ দিয়ে খেলেছি। হতে পারে ডিসিশন মেকিংয়ে ভুল করেছি। তবে সেটার পেছনেও কারণ থাকে।

একটা লম্বা সময় উইকেটে কাটালে ব্যাটসম্যান স্কোরিং শট বেশি খেলতে চায়। রান বাড়াতে চায়। আমি তো খেলি দলের জন্য। ভাবতে থাকি যে এই উইকেটে কত রান লাগবে দলের। কখনও ২৬০, কখনও ৩০০। সেই রান করতে গেলে আমার মতো সেট ব্যাটসম্যানকেই অগ্রণী হতে হবে।

আমার মনে হয়েছে, বেশিরভাগ সময়ই আমি এটিই ভেবেছি। মনে হয়েছে, দলের যত রান প্রয়োজন, তা থেকে একটু পিছিয়ে আছে। রান বাড়াতে গিয়ে আউট হয়ে গেছি। নিজের কথা কখনোই ভাবিনি। কেবল মাথায় এসেছে দলের কত রান লাগবে।

তবে এসব না পারার কারণ হতে পারে, সমাধান নয়। দলের জন্য রান করতে হবে, দলের জন্য আউট হওয়াও যাবে না। আমার ধরনে হয়তো ভুল ছিল। সেসব শোধরাতে হবে।

আপনাকে নিয়ে এই কথাটি অবশ্য দল সংশ্লিষ্ট সবাই বলেন যে আপনি দারুণ ‘টিমম্যান’। বরাবরই এমন ছিলেন না সময়ের সঙ্গে হয়ে উঠেছেন?

মিঠুন: একদম ছোট থেকেই এমন। কখনোই নিজের জন্য খেলিনি। হেরে যাওয়া ম্যাচে আমি একশ করতে পারি, কিন্তু কোনো তৃপ্তি আসে না। ওই একশর কোনো মূল্য নেই। আমি যখন খেলছি, দলের ১১ জনের দায়িত্ব আমার। এভাবেই সবসময় ভাবি।

ছবি: নিউ জিল্যান্ড ক্রিকেট

আপনার চার ফিফটিই দেশের বাইরে। ক্যারিয়ারের শুরুর পর্যায়ে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের জন্য যেটি বিরল। কিভাবে মানিয়ে নিলেন?

মিঠুন: ব্যাপারটা মানসিক। ফিফটি চারটিই গত কয়েক মাসে। এখন আমার মানসিকতা আগের চেয়ে বদলেছে। ভাবিইনি যে দেশের ভেতরে খেলছি না বাইরে। উইকেটে গিয়েছি, আচরণ বোঝার চেষ্টা করেছি, সে অনুযায়ী খেলেছি। খুব বেশি চিন্তা করিনি। কারণ বেশি চিন্তা করলে ব্যাটিংয়ে প্রভাব পড়বে।

সিনিয়র ব্যাটসম্যান যারা আছেন, কোচরা আছেন, তাদের সঙ্গে কথা বলেছি। চেষ্টা করেছি তাদের সঙ্গে কথা বলে ছোট ছোট জিনিসগুলো কাজে লাগাতে। নিউ জিল্যান্ড সফরের আগে যেমন, নিল ম্যাকেঞ্জির (ব্যাটিং কোচ) সঙ্গে কথা বলেছিলাম, আগে কখনও ওখানে যাইনি। নিল বলেছিল, নিউ জিল্যান্ডে যতটা সম্ভব লেটে খেলতে হবে। বলের দিকে একদম শেষ পর্যন্ত চোখ রাখতে হবে। দেশে শরীর থেকে দূরে খেলে অনেক সময় পার পাওয়া সম্ভব, ওখানে টিকে থাকা যাবে না। আরেকটা কথা বলেছিলেন তিনি, উপমহাদেশে আমরা যেমন সোজা বা কাভারে যে ড্রাইভ খেলি, ওখানে শতভাগ নিশ্চিত না হয়ে সেসব খেলা যাবে না। কারণ সবাই সুইং করায়। যতটা সম্ভব স্কয়ারে খেলতে হবে। আমি সেভাবেই চেষ্টা করেছি।

ঘরোয়া ক্রিকেটে বরাবরই আপনি ইতিবাচক ব্যাটিং করতেন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট তো অনেক কঠিন। কিন্তু সেখানেও আপনার ব্যাটিং, শরীরী ভাষা অনেক ইতিবাচক। এটা কি দলের চাওয়ায় নাকি নিজেরই ভাবনা?

মিঠুন: আমি বরাবরই ইতিবাচক। এভাবে খেলেই ঘরোয়া ক্রিকেটে রান করেছি। জাতীয় দলে ঢুকেছি। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সেটা বদলাতে চাইনি। আমি এভাবেই খেলতে পারি। এভাবেই খেলতে চেয়েছি। এই পর্যায়ে এসে বদলানোর চেষ্টা করাই বরং ঝুঁকির হতো।

সাফল্যের ফর্মুলা পেতে অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে। ২০০৮ অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে খেলেছিলেন, এতদিনে জাতীয় দলে থিতু হতে শুরু করেছেন!

মিঠুন: আমি আসলে ঠেকতে ঠেকতে শিখেছি। কখনোই মসৃণ ছিল না ক্যারিয়ার। ২০০৯ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ দলে ছিলাম। খেলার আগেই বাদ। একটা সময় হতাশ হয়ে পড়েছিলাম। পরে ভাবলাম, ক্রিকেট ছাড়া তো আর কিছু পারি না। গ্র্যাজুয়েশন করিনি যে অন্য চাকরি করব। পরিবারের সেই অবস্থা নেই যে ব্যবসা করব। ভাবলাম যে, তাহলে ভালো করেই খেলি!

ব্যবসা করলে সেখানে অনেক পয়সা লাগত, অনেক সময় দিতে হতো। ক্রিকেটে আমার অর্থ লাগছে না। শুধু শ্রম দিলেই হবে। চিন্তা করলাম, এই বিনিয়োগ করি, দেখি ফল মেলে কিনা।

এখানে আমার স্ত্রীর বড় ভূমিকা আছে। ২০১৩ সালে বিয়ের পর থেকেই মূলত আমার জগত বদলে যাওয়ার শুরু। তার আগে আমি ক্রিকেট বা জীবন, কিছুতেই সিরিয়াস ছিলাম না। ক্রিকেট মৌসুমে কুষ্টিয়া থেকে এসে ঢাকায় খেলে আবার ফিরে যেতাম। শুয়ে, বসে, ঘুরে-বেরিয়ে, আড্ডা দিয়ে কাটিয়ে দিতাম।

বিয়ের পর স্ত্রী আমাকে কিছুদিন দেখল। একদিন জিজ্ঞেস করল, “তুমি কি কর?” আমি আকাশ থেকে পড়লাম, “কেন? ক্রিকেট খেলি!” সে তখন বলল, “আমি খেলা-টেলা বুঝি না। তবে এটা বুঝি যে সবকিছুর জন্য একটা রুটিন লাগে। কষ্ট করতে হয়। আমি যেমন পড়াশোনা করি, ক্লাস করি, রুটিন মানি। তোমার জীবনে তো সেসবের কোনো বালাই দেখছি না। খাও-দাও, ঘুরে বেড়াও, আলসেমি করো। এরকম হলে ক্রিকেট কেন, কোনো জায়গায়ই তো সফল হবে না!”

এরপরই আমি সিরিয়াসলি ভাবলাম। এটাও মনে হলো যে, আমি এখন একা নই। সংসার হয়েছে। দায়িত্বটার কথাও মনে হলো। এরপর থেকেই নিয়মিত প্র্যাকটিস শুরু করি। রান করি। পরের বছরই জাতীয় দলে ডাক পাই।

আজকের মিঠুনের পেছনে তাহলে স্ত্রীর বড় অবদান!

মিঠুন: বলতে পারেন। ওই কথাগুলো না বললে হয়তো আমার ক্যারিয়ার ঠিক পথে থাকত না। এখনও অনেক সাহায্য করে। একসময় প্র্যাকটিসই করতাম না। এখন এমন অবস্থা, মাঠে না আসলে আমার ভালো লাগে না। লম্বা সময় প্র্যাকটিস করি, কোনোদিন বাসা থেকে ওর একটা ফোনও পাইনি যে এটা লাগবে বা ওটা করতে হবে। ও সব সামলায়, আমাকে নিশ্চিতে ক্রিকেট খেলার সুযোগ করে দেয়। অনেকের হয়তো অনেকরকম চাহিদা থাকে, ওর কিচ্ছু নেই। আমার ক্রিকেটের জন্য শতভাগ ত্যাগ স্বীকার করে।

পরিবারে আর কে কে আছেন?

মিঠুন: বাবা-মা, দুই ভাই, দুই বোন। স্ত্রী নিগার সুলতানা। আর আড়াই বছর বয়সী ছেলে। এই তো।

আরও পেছনে যদি ফিরে যাওয়া হয়, বিকেএসপি বা অনূর্ধ্ব-১৯ দলে আপনার খেলার কথা অনেকেরই জানা। কিন্তু ছেলেবেলায়, ক্রিকেটের শুরুটা কিভাবে?

মিঠুন: কুষ্টিয়ায় আমার বাসার সামনে মাঠ ছিল। সেখানে খেলতে খেলতেই শুরু। বড় ভাই ইখতিয়ার হোসেন মিলনের অনেক অবদান ছিল। ক্রিকেট-ফুটবল দুটিতেই বড় ভাইয়ের অনেক পরিচিতি ছিল কুষ্টিয়ায়। আমিও তার সঙ্গে দুটিই খেলতাম।

একদিন বড় ভাই বললেন যে, “তোর খেলাধুলা করার ইচ্ছে আছে?” বললাম, “অবশ্যই।” তিনি তখন আমাকে সরকারী কলেজ মাঠে নিয়ে গেলেন, ওখানে ক্রিকেট বলে প্র্যাকটিস হতো। তরুণ কাকু একাডেমি চালাতেন, সেখানে ভর্তি করিয়ে দিলেন। বন্ধু আলমের সঙ্গে সাইকেলে করে প্র্যাকটিসে যেতাম।

একদিন বড় ভাই বললেন, “তোর যদি ক্রিকেট খেলতে ভালো লাগে, তাহলে বিকেএসপিতে ভর্তি করিয়ে দেই।” আমি তো খুব খুশি। প্রতিদিনই তাকে জিজ্ঞেস করতাম, কবে নিয়ে যাবে। একদিন বলল, “বিকেএসপিতে পরীক্ষা দিয়ে লাভ নেই। ওখানে বড় কারও সুপারিশ ছাড়া বা অনেক টাকা ছাড়া নেয় না। আমাদের তো কোনোটাই নেই।”

আমি জেদ ধরলাম তবু। কান্নাকাটি করলাম। এক সময় জানতে পারলাম, বন্ধু আলমও যাবে বিকেএসপিতে ট্রায়াল দিতে। তার সঙ্গে অভিভাবক যাবে। অনেক আলোচনা করে ওদের সঙ্গে আমাকে পাঠাল। সুযোগ পাব, বিশ্বাস ছিল না। স্রেফ শখ মেটাতে গিয়েছিলাম।

প্রথম ক্যাম্পে সুযোগ পেলাম। এক-দেড় মাস পর চিঠি গেল বাসায়, দ্বিতীয় ক্যাম্পেও মনোনীত হয়েছি। ক্যাম্প করলাম। আরও কিছুদিন পরে চিঠি এলো, চূড়ান্ত সুযোগ পেয়েছি। তার পরও বাসায় বলল যে খেলাধুলা করে কী হবে, ক্রিকেটার হতে পারবে কিনা, এতগুলো টাকা খরচ করে লাভ কি.. এসব। আমার জেদের কারণে শেষ পর্যন্ত রাজি হলো। তার পর তো অনূর্ধ্ব-১৫, ১৭, ১৯ হয়ে এগিয়েছি। আপনারা জানেনই সব।

বেড়ে ওঠার দিনগুলোয় নায়ক ছিল কে?

মিঠুন: বিকেএসপিতে টিভি দেখা বা খেলা দেখার অত সুযোগ ছিল না। আমাদের মাঠে ঢাকা লিগের বা জাতীয় লিগের খেলা হতো। কলেজের ফাঁকে সেসব দেখতাম। সুমন ভাই (হাবিবুল বাশার) তো আমাদের কুষ্টিয়ার। দেশের সেরা ব্যাটসম্যান তখন। এলাকার হিসেবে তাকে নিয়ে গর্ব করতাম। নায়ক বলতে কেবল সুমন ভাই-ই ছিলেন।

যতটুকু খেললেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট, নিশ্চয়ই বুঝেছেন আরও কতটা উন্নতি করতে হবে। কোনটায় উন্নতি বেশি জরুরি মনে করছেন, টেকনিক নাকি মানসিকতায়?

মিঠুন: মনস্তাত্বিক উন্নতিই বেশি জরুরি। টেকনিক তো লম্বা সময় নিয়ে কাজ করার ব্যাপার। বড় পরিবর্তনও করা যাবে না। তাহলে হিতে বিপরীত হবে। প্রয়োজনে ছোটখাটো ফাইন টিউন করতে হবে। টেকনিক নিখুঁত কারও নয়। অ্যাডজাস্ট করা শিখতে হয়। আমি যতটা বুঝেছি, ক্রিকেট খেলাটা মাথার খেলা। যতটা সুন্দরভাবে, গুছিয়ে চিন্তা করা যায় ক্রিকেট নিয়ে, তত বেশি সফল হওয়া যায়।

৫টি টেস্ট খেলেছেন। ফিফটি কেবল একটি। অনেকেরই সংশয়, আপনি এখনও টেস্ট ক্রিকেটের জন্য প্রস্তুত কিনা। বা টেস্টের সঙ্গে আপনার ব্যাটিং মানানসই কিনা। আপনি নিজে কিভাবে দেখেন?

মিঠুন: সত্যি বলতে, টেস্ট ক্রিকেট অনেক কঠিন। তবে আমি পারব না, তা বিশ্বাস করি না। বরং আমি মনে করি, একবার খেলাটা ধরে ফেলতে পারলে, এখানেই সবচেয়ে বেশি সফল হতে পারি। কারণ, এখানে লম্বা সময় ব্যাট করা যায়। তাড়া নেই।

আমি যে কয়টা টেস্ট খেলেছি, কাজটা কঠিন ছিল। নিউ জিল্যান্ডে তো কন্ডিশন-উইকেট প্রতিকূল। তবে আমি মনে করি, নিউ জিল্যান্ডে টেস্টে আমরা হেরে গেছি স্রেফ নিল ওয়েগনারের কাছে। ওর যে পরিকল্পনা ছিল, সেটির জবাবে আমরা পরিষ্কার কোনো উপায় বের করতে পারিনি। একেকজন নিজের মতো করে অনেকভাবে চেষ্টা করেছে। কাজ হয়নি। শেষ ইনিংসটায় ঠিক করেছিলাম, যত শর্ট বলই দিক, সব ছাড়ব। একশর বেশি বল খেলেছি। প্রায় তিন ঘণ্টা থেকেছি। এরপর ওর বলেই আউট হয়ে গেছি। ওর বাউন্সারেও অনেক বৈচিত্র। 

আবার দেশের মাটিতে যখন খেলেছি, খুবই টার্নিং উইকেট ছিল। আড়াই-তিন দিনে ম্যাচ শেষ। আমার মনে হয়, ভালো কোনো উইকেটে ভালো একটি ইনিংস হয়ে গেলেই আত্মবিশ্বাস পেয়ে যাব। তার পর টেস্টেও ভালো করব, আমি প্রবলভাবেই বিশ্বাস করি।

সব ঠিকঠাক থাকলে, প্রথমবার হয়তো বিশ্বকাপে খেলবেন। কতটা রোমাঞ্চিত?

মিঠুন: বিশ্বকাপ খেলার স্বপ্ন তো সব ক্রিকেটারেরই থাকে। আমারও আছে। তবে রোমাঞ্চ সত্যি বলতে, এখনও আসেনি। জানি না কেন। হয়তো আরও কাছাকাছি গেলে টের পাব। তবে বিশ্বকাপের জন্য যে প্রস্তুত হতে হবে, সেটি মাথায় আছে। সেভাবেই আলাদা কাজ করার চেষ্টা করছি।

ক্যারিয়ার লম্বা করার কথা বলছিলেন আলোচনার শুরুতে। দলের ৫ সিনিয়র ক্রিকেটারকে কাছ থেকে দেখছেন। একদিন যদি তাদের মতো হতে চান বা সেই জায়গায় যেতে চান, কি করতে হবে বলে মনে হয়?

মিঠুন: আগেই বলেছি, আমি খুব দূর ভবিষ্যৎ ভাবি না। তবে নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে আমি অনেক সচেতন। যথেষ্ট পরিশ্রম করি বলেই মনে করি। অবশ্যই চেষ্টার শেষ নেই। আরও অনেক কষ্ট করতে হবে। দিন দিন আরও জানব, শিখব। কাজ বাড়াব। আরও সুন্দরভাবে গুছিয়ে কাজ করব।

সিনিয়ররা তো আরও বেশ কয়েক বছর অন্তত আছেন। আমি যদি তাদের সঙ্গে খেলতে পারি অতদিন, আরও পরিণত হব, পারফরম্যান্স ভালো হবে। সেক্ষেত্রে তারা যখন বিদায় নেবেন, যে ভূমিকা তারা পালন করতেন, সেই ভূমিকা হয়তো আমি পালন করতে পারব। সেই বিশ্বাস আমার আছে। তবে অবশ্যই ততদিন খেলতে হবে আমাকে।