ভারতের ঘরোয়া ক্রিকেটকে অনুসরণ করতে পারে বাংলাদেশ: ওয়াসিম জাফর

বয়স পেরিয়ে গেছে ৪১। তবু থামছে না ওয়াসিম জাফরের ব্যাটে রানের জোয়ার। এবারও রঞ্জি ট্রফিতে করেছেন হাজারের বেশি রান। আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার ৩১ টেস্টেই থেমে গেছে এক যুগ আগে। কিন্তু ভারতের ঘরোয়া ক্রিকেটে তিনি কিংবদন্তি। রঞ্জি ট্রফিতে ম্যাচ, রান, সেঞ্চুরি, সব রেকর্ডই তার। এখন আবাহনীর হয়ে খেলছেন ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে ভারতীয় ব্যাটসম্যান কথা বললেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের অপূর্ণতা, ঘরোয়া ক্রিকেটে অসাধারণ সাফল্য, দেশের ক্রিকেটে ঘরোয়া ক্রিকেটের অবদান ও প্রাসঙ্গিক আরও অনেক কিছু নিয়ে।

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 March 2019, 03:34 PM
Updated : 25 March 2019, 07:58 AM

একটু অস্বস্তিকর প্রশ্ন দিয়ে শুরু করা যাক। ২০০৭ সালে বাংলাদেশের বিপক্ষে চট্টগ্রাম টেস্ট, প্রথম দিনের প্রথম বল মাশরাফির, আপনি ছেড়ে দিয়ে বোল্ড… সেই স্মৃতির কতটুকু মনে পড়ে?

ওয়াসিম জাফর: সবটাই মনে পড়ে। এসব ব্যাপারই এমন, কখনোই ভোলা যায় না। খুব সুখের স্মৃতি যেমন মনে থাকে, হতাশার ঘটনাও মনে গেঁথে থাকে। ম্যাচের প্রথম দিনে প্রথম বলে বোল্ড খুব বেশি ব্যাটসম্যান হয়নি। তবে খেলায় এসব হয়ই। সুনিল গাভাস্কারের মতো কিংবদন্তিও তিনবার এই আউট হয়েছেন। লজ্জার কিছু নেই। প্রথম বলটি খেললে প্রথম বলে আউট হওয়ার শঙ্কা থাকেই। দারুণ ডেলিভারি ছিল, আমি বুঝতে ভুল করেছিলাম। এই তো।

ওই টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসেও শূন্য করেছিলেন। পরের টেস্টে অবশ্য করেছিলেন সেঞ্চুরি!

ওয়াসিম: ‘পেয়ার’ পাওয়ার পরের টেস্টেই সেঞ্চুরি করে ফেরার ঘটনাও কিন্তু খুব বেশি নেই! আমি সেই অভিজাত তালিকায় আছি, তবে দুর্ভাগ্যজনকভাবে...হাহাহাহা।

ক্রিকেট খেলাটাই এমন। ব্যর্থতা-সাফল্য পিঠাপিঠি আসতে পারে। জোড়া শূন্যের পর চাপে ছিলাম বলেই পরের ইনিংসের সেঞ্চুরিটি ছিল স্পেশাল ও তৃপ্তিদায়ক।

সেই মাশরাফি এখনও আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলে যাচ্ছেন, বিশ্বকাপে দলকে নেতৃত্বও দেবেন, বিস্মিত হননি?

ওয়াসিম: ১২ বছর হতে চলেছে সেই ম্যাচের, বিস্ময়কর তো বটেই। এমনিতে ওর বয়সের কথা ভাবলে খুব অবাক করার মতো নয়। তবে যত ইনজুরি ও সার্জারি পেরিয়ে এসেছে, ফাস্ট বোলার হয়ে এখনও খেলছে, আমরা ক্রিকেটাররা জানি কাজটা কতটা কঠিন। এখনও ক্লাব ক্রিকেটও খেলছে, সত্যিই দারুণ কিছু।

সম্প্রতি শুনলাম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছে। জাতীয় দলকে নেতৃত্ব দিচ্ছে। সবকিছু সামলানো সহজ ব্যাপার না। ওকে কুর্নিশ জানাতেই হয়।

আপনার গল্পও কম বিস্ময় জাগানিয়া নয়। ৪১ বছর বয়সেও খেলছেন, এই মৌসুমেও হাজারের বেশি রান, দলকে চ্যাম্পিয়ন করানো, রেকর্ড গড়া, এত কিছুর অনুপ্রেরণা এখনও কিভাবে পান?

ওয়াসিম: এই জীবনে আমি শুধু ক্রিকেটই খেলেছি। আর কিছু করিনি। হ্যাঁ, পড়াশোনা অবশ্যই করেছি। কিন্তু পেশা হিসেবে, ছেলেবেলা থেকে ক্রিকেটার হতে চেয়েছি, জীবনভর ক্রিকেটেই ডুবে থেকেছি। ক্রিকেট খেলতে, রান করতে এখনও এত ভালো লাগে, এত তৃপ্তি পাই যে এই কাজটা ছেড়ে দেওয়া আমার জন্য কঠিন। যে কাজটি করতে আপনার ভালো লাগছে এবং ভালো করছেন, সেটি কেন ছাড়বেন!

আমি এখনও ভেতরে তাগিদ অনুভব করি। ফিটনেস ট্রেনিং করি, ব্যাটিংয়ে এখনও শেখার চেষ্টা করি। খেলাটাকে এত ভালোবাসি যে এখনই বন্ধন ছিন্ন করা কঠিন। জানি, আর কখনও জাতীয় দলে খেলব না। এক যুগ ধরেই খেলছি না। কিন্তু এখনও রঞ্জি ট্রফি খেলতে, ইংল্যান্ডে গিয়ে ক্লাব ক্রিকেট খেলতে বা এখন আবাহনীর হয়ে খেলছি, বোলারদের সঙ্গে লড়াই, রান করা, জয় পাওয়া, এসবে এত রোমাঞ্চ অনুভব করি যে ছাড়ার কথা ভাবতে পারি না। যখন এই তৃপ্তি বা তাগিদ অনুভব করব না, সেদিন ছেড়ে দেব। 

কখনও কি ক্লান্তি পেয়ে বসেনি? একঘেঁয়ে লাগে না!

ওয়াসিম: ক্লান্তি আসে মাঝে মধ্যে। বয়সের একটি ব্যাপার তো আছেই। শরীর অনেক সময় সাড়া দিতে চায় না। বয়স ৩০ ছাড়িয়ে গেলেই সত্যি বলতে শরীর অবাধ্য হতে শুরু করে। কিন্তু নিজের ভেতরে তাগিদ আছে বলেই মনের শক্তিতে শারীরিক বাধা দূর করার চেষ্টা করি। আরও বেশি পরিশ্রম করি, ফিট থাকার চেষ্টা করি।

গত দুই মৌসুম আমার দুর্দান্ত কেটেছে। বিদর্ভ (তার দল) গত দুই মৌসুমে টানা রঞ্জি ও ইরানি ট্রফি জিতেছে, আমার তাতে অবদান ছিল, এগুলো আরও বেশি অনুপ্রেরণা জোগায়। বিদর্ভের মতো ছোট দল দুই মৌসুমে চারটি ট্রফি জিতবে, ভারতীয় ক্রিকেটে এটা অকল্পনীয় ছিল। কেউ ভাবতে পারেনি। আমরা সেটি সম্ভব করেছি। এই আবহ, এই উত্তেজনাও আমার বড় চালিকাশক্তি। তরুণদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পারফর্ম করা, তাদের সঙ্গে কাজ করা, পথ দেখানো, এসবে প্রাণশক্তি খুঁজে পাই। অন্য কোনো দলে হলে হয়তো খেলা চালিয়ে যেতে পারতাম না।

দীর্ঘদিনের দল মুম্বাই ছেড়ে বিদর্ভে পাড়ি জমানো তাহলে টনিক হিসেবে কাজ করেছে?

ওয়াসিম: মুম্বাই ছেড়ে যাওয়া কঠিন ছিল। ছেলেবেলা থেকে শুরু করে বয়সভিত্তিক দল হয়ে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলেছি মুম্বাইয়ে। এখানে খেলেই ভারতের হয়ে খেলার সুযোগ পেয়েছি। তবে একটা সময় মুম্বাই ছাড়তেই হলো।

আমি এমন একটি দল খুঁজছিলাম যারা নতুন কিছু করতে চায়, যেখানকার তরুণরা শিখতে উদগ্রীব, নিজেও ক্যারিয়ারে নতুন গতি খুঁজে পাব। অনেক রাজ্য দলই আমাকে প্রস্তাব দিয়েছিল। আমি অনেক ভেবে বিদর্ভকে বেছে নিয়েছি। যা চেয়েছি, সবই এখানে পেয়েছি। এখানে প্রথম মৌসুম ভালো কাটেনি, পরের মৌসুমে ছিল ইনজুরি। গত দুই মৌসুম কেটেছে রূপকথার মতো। একটি আড়ালে পড়ে থাকা অঞ্চলকে ক্রিকেট সাফল্যে ভাসাতে অবদান রাখতে পেরেছি, এটা আমার বড় প্রাপ্তি।

এই বয়সে তো দীর্ঘ মেয়াদী লক্ষ্য ঠিক করার কিছু নেই। আপাতত আগামী রঞ্জি মৌসুমের অপেক্ষায় আছি। তার পর চিন্তা করে দেখব।

প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে আপনার রেকর্ড তো অসাধারণ। রঞ্জি ট্রফিতে প্রায় ১২ হাজার রান করেছেন, ১০ হাজারও নেই আর কারও। রঞ্জিতে সবচেয়ে বেশি ম্যাচ, সবচেয়ে বেশি সেঞ্চুরি, দুই মৌসুমে হাজারের বেশি রান করা একমাত্র ব্যাটসম্যান। কিন্তু আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের স্বাদ পাওয়া একজনের কাছে এসব রেকর্ডের তৃপ্তি কতটা?

ওয়াসিম: দেখুন, একটা সময় প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলার মূল লক্ষ্য থাকে জাতীয় দলে জায়গা করে নেওয়া। সেটি আমি পেরেছিলাম। টেস্ট দলে এসেছি, বাদ পড়েছি। আবার এসেছি, বাদ পড়েছি। পরে ফিরে মোটামুটি সময় খেলেছি।

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের ব্যাপার অবশ্যই আলাদা। দেশের হয়ে ভালো খেলার মতো তৃপ্তি তো কিছুতে নেই। সেটি যদিও আমি খুব বেশি পাইনি। অস্ট্রেলিয়ায় (২০০৮ সালে) ব্যর্থ হওয়ার পর বাদ পড়ে যাই। তবে আমি সেসব ভাগ্যের ওপরই ছেড়ে দেই। আমি বিশ্বাস করি, যে যেটা পায়, সেটিই তার প্রাপ্য। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটেও কষ্ট করে রান করতে হয়। এটিও ক্রিকেটের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এখানে যা অর্জন করতে পেরেছি, এটাও কম নয়। আমার ভাগ্যে হয়তো এটাই লেখা ছিল।

শচিন টেন্ডুলকারের মতো আপনিও ছিলেন মুম্বাইয়ে স্কুল ক্রিকেটের বিস্ময়, রানের জোয়ার বইয়ে দিয়েছেন স্কুল ক্রিকেটে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার সমৃদ্ধ হয়নি। আক্ষেপ হয়?

ওয়াসিম: অবশ্যই আরও বেশি খেলতে পারলে ভালো লাগত। অস্ট্রেলিয়ায় ওই সিরিজের ব্যর্থতা বড় কারণ ছিল আমার বাদ পড়ায়। পরে গৌতম গম্ভীর এলো, বিরেন্দর শেবাগ তো ছিলই। ওদের পর মুরালি বিজয়, শিখর ধাওয়ান এলো। সবাই সুযোগ লুফে নিয়েছে। আমার সুযোগ আর হয়নি।

তবে যেটা বললাম, আমি ভাগ্যে বিশ্বাস করি। এটাই হয়তো ভাগ্যে ছিল। খুব বেশি আক্ষেপ নেই। ঘরোয়া ক্রিকেটে অনেক দুর্দান্ত ক্রিকেটার দেখেছি আমি, যারা কখনোই জাতীয় দলে খেলতে পারেনি। আমি অন্তত দেশকে প্রতিনিধিত্ব করেছি, ৩১টি টেস্ট খেলেছি, ৫টি সেঞ্চুরি, দুটি ডাবল সেঞ্চুরি করতে পেরেছি। আমার বাবা, আমার পরিবার, যারা অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছে, তাদের মুখে হাসি ফোটাতে পেরেছি। লোকে আমাকে চেনে, এখনও বলে যে আমার আরেকটু বেশি সুযোগ প্রাপ্য ছিল। এসবই আমার প্রাপ্তি।

৩১ টেস্টের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে সেরা মূহুর্ত?

ওয়াসিম: ভারতের হয়ে খেলতে পারাই ছিল সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। সবাই জানে, একজন ব্যাটসম্যান হয়ে ভারতীয় দলে ঢোকা কতটা কঠিন। অসংখ্য ভালো ব্যাটসম্যান এখানে। শচিন, কুম্বলে, দ্রাবিড়, সৌরভদের সঙ্গে খেলতে পারা, তাদের সঙ্গে ড্রেসিং রুমে কাটানো সময়গুলো অমূল্য।

৩৫ বছর পর ওয়েস্ট ইন্ডিজে সিরিজ জয় (২০০৬), ২১ বছর পর ইংল্যান্ডে সিরিজ জয় (২০০৭ সালে) স্মরণীয় ছিল। পাকিস্তানের বিপক্ষে ইডেন গার্ডেনসে ডাবল সেঞ্চুরি ভোলার নয়। অ্যান্টিগায় ডাবল সেঞ্চুরি, দক্ষিণ আফ্রিকায় সেঞ্চুরিও ছিল তৃপ্তিদায়ক।

ঘরোয়া ক্রিকেটে পারফর্ম করার পাশাপাশি তরুণ ক্রিকেটারদের ‘মেন্টর’ হিসেবেও কাজ করছেন। অভিজ্ঞ ও সিনিয়র ক্রিকেটারদের ঘরোয়া ক্রিকেটে খেলা কতটা গুরুত্বপূর্ণ?

ওয়াসিম: দারুণ গুরুত্বপূর্ণ। তরুণ ক্রিকেটারদের পথ দেখানো খুবই জরুরি। সিনিয়রদের অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করা, দেখে শেখা, এভাবেই তরুণরা বেশি উন্নতি করে। মাশরাফি যেমন এখন দেখছি এই ভূমিকা পালন করছে, দলের অনেকেই ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। আমি তরুণ থাকতে সঞ্জয় মাঞ্জরেকারকে দেখে অনেক শিখেছি। শচিন যদিও অতটা সিনিয়র নন, কিন্তু আন্তর্জাতিক ক্রিকেট অনেক আগে থেকে খেলছিল। তাকে দেখে শিখেছি।

সিনিয়রদের মাধ্যমেই ক্রিকেটের শিক্ষাটা পরবর্তী প্রজন্মগুলোয় ছড়িয়ে দিতে হয়। আমি সেভাবেই শিখেছি। এখন সেভাবেই শেখানোর চেষ্টা করি।

রঞ্জি ট্রফিতে আপনার নেতৃত্বে খেলেছেন শচিন টেন্ডুলকার। তার মতো কিংবদন্তি ঘরোয়া ক্রিকেটে কেমন থাকতেন?

ওয়াসিম: ভারত ও মুম্বাই, দুই দলে তাকে কাছ থেকে দেখেছি। খুব বেশি পার্থক্য খুঁজে পাইনি। এটা তার গ্রেটনেসের বড় উদাহরণ। আচরণ, মানসিকতা বদলাত না। একই রকম গুরুত্ব দিতেন। রঞ্জি ট্রফি বা টেস্ট ক্রিকেটের প্রস্তুতি প্রায় একই থাকত তার। পিচ নিয়ে ভাবা, দল নির্বাচন, প্রতিপক্ষ নিয়ে কাঁটাছেড়া, মাঠে বোলিং পরিবর্তন থেকে শুরু করে সবকিছু, তার দৃষ্টিভঙ্গি, নিবেদন ও সম্পৃক্ততা একইরকম থাকত। আমি সৌভাগ্যবান যে তার সঙ্গে খেলেছি, তার অধিনায়ক হওয়ার সম্মান পেয়েছি। এর বেশি কিছু চাইতে পারতাম না। আমাদের প্রজন্মের সেরা ছিল শচিনই।

এই প্রজন্মের সেরা বিরাট কোহলির সঙ্গে শচিনের তুলনা এখন বেশ নিয়মিতই হচ্ছে!

ওয়াসিম: এক প্রজন্মের সঙ্গে আরেক প্রজন্মের তুলনাটা অন্যায়। প্রতিপক্ষ, বোলিং ইউনিট, পারিপার্শ্বিক বাস্তবতা, অনেক কিছুই আলাদা। এটা বলতে পারি, শচিন তার প্রজন্মের যা ছিল, বিরাট এই প্রজন্মের সেটা।

শচিনকে দেখে ক্রিকেটে এসেছে অসংখ্য শিশু-কিশোর, এখন বিরাটকে দেখেও আসছে নিশ্চয়ই। শচিন যেমন করেছিল, বিরাটও তেমনি নিত্য নতুন মানদণ্ড বেঁধে দিচ্ছে। বিরাটের ফিটনেস, তার নিবেদন, একাগ্রতা, মনোযোগ, শরীরী ভাষা, যেভাবে সে নিজেকে বদলেছে, এসব অসাধারণ। তবে একটা কথা মনে রাখতে হবে, শচিনের ওপর যে চাপ ছিল, অকল্পনীয়। দীর্ঘদিন দলকে বয়ে নিয়েছে সে। বিরাটকে অতটা চাপ সইতে হচ্ছে না।

আপনি যে ঘরানার ওপেনার ছিলেন, আঁটসাঁট ডিফেন্স, উইকেট আঁকড়ে রাখা, বলের পর বল ছেড়ে দেওয়া, সময় কাটিয়ে বোলারকে ক্লান্ত করা... আপনার কি মনে হয়, টি-টোয়েন্টির আবির্ভাবের পর এই ধরনের ওপেনাররা হারিয়ে যাচ্ছে?

ওয়াসিম: এখন এই ধরনের ওপেনার পাওয়ার প্রশ্নই আর আসে না। এটাই বাস্তবতা। এটাই সময়ের দাবি। সময়ের সঙ্গে বদলাতে হয়। ক্রিকেট খেলাটাই তো বদলে গেছে! বাস্তবতা হলো, আমার বা আমাদের ঘরানার ব্যাটসম্যান এখনকার ক্রিকেটের জন্য মানানসই নয়। আমাদের মতো খেললে খেলার সুযোগ খুব বেশি পাবে না। কেন ওরা এই ধরনের ব্যাটসম্যান হতে চাইবে?

এই প্রজন্মের ব্যাটসম্যানদের তিন সংস্করণেই মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা থাকতে হবে। তাদের সেভাবেই খেলা শিখতে হবে। আগ্রাসী খেলতে হবে। এছাড়া টিকে থাকার উপায় নেই। আমরা আগের প্রজন্মের, আমরাই চেষ্টা করছি এখনকার ক্রিকেটে মানিয়ে নিতে। এটাই সময়ের বাস্তবতা। আমাদের সময়ের মতো ব্যাটসম্যান নেই বলে হাহুতাশ করার কিছু নেই।

গত কয়েক বছরে ভারতীয় ক্রিকেটের সাফল্যে ঘরোয়া ক্রিকেটের অবদান আছে বলে শোনা যায়। আসলে কতটা অবদান আছে?

ওয়াসিম: আগের চেয়ে আমাদের ঘরোয়া ক্রিকেট বদলে গেছে। এখন বেশ ভালো। যারা দায়িত্বে আছেন, তারা ভালো কিছু উদ্যোগ নিয়েছেন। সবচেয়ে বড় বদল ছিল আমার মতে, নিরপেক্ষ কিউরেটর নিয়োগ দেওয়া। স্বাগতিক দল তাই চাইলেই ইচ্ছে মতো পিচ বানাতে পারছে না। বেশিরভাগ সময়ই পিচ থাকে স্পোর্টিং।

আম্পায়ারিংয়ের মানে অনেক উন্নতি হয়েছে। প্লেয়িং কন্ডিশন অনেক ভালো ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ। এখন যদিও খেলা বেড়েছে, তাতে ক্রিকেট ও ফিটনেসের উন্নতিও হয়েছে। বিসিসিআই যথেষ্টই চেষ্টা করছে। ঘরোয়া ক্রিকেটে অর্থ বেড়েছে। এটাও অনেক গুরুত্বপূর্ণ।

ভারতীয় দলে পেস বিপ্লবে ঘরোয়া ক্রিকেটের কতটা অবদান আছে?

ওয়াসিম: কিছুটা তো আছেই। একটা ব্যাপার হলো, আগের চেয়ে ফিটনেস নিয়ে সচেতনতা অনেক বেড়েছে। ঘরোয়া ক্রিকেটেও তরুণ পেসাররা এখন ফিটনেস নিয়ে অনেক ভাবে ও খাটে। স্পোর্টিং উইকেটের কারণে পেসারদের প্রতি দলগুলির দৃষ্টিভঙ্গি বদলেছে। পেসারদের মানসিকতাও বদলেছে। এখন সবাই ১৪০ কিলোমিটারের বেশি গতিতে বল করতে চায়। নজর কাড়তে চায়।

বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রিকেট কোন ক্ষেত্রে ভারতের ঘরোয়া ক্রিকেটকে অনুসরণ করতে পারে?

ওয়াসিম: একটি-দুটি নয়, অনেক ক্ষেত্রেই ভারতকে অনুসরণ করতে পারে বাংলাদেশ। প্রথমত, কোচিংয়ের দিক থেকে। ভারতের ঘরোয়া ক্রিকেটে কোচিংয়ের মান অনেক ভালো। অনেক ক্রিকেটার আছে, ঘরোয়া মৌসুমে একটি-দুটি ভালো স্কোর আর কিছু গড়পড়তা ইনিংস খেলে তৃপ্ত থাকে। কোচদের দায়িত্ব, ক্রিকেটারদের ওই কমফোর্ট জোন থেকে বের করে আনা।

পিচ নিয়ে বোর্ডের অনেক কিছু করার আছে। যত বেশি সম্ভব, স্পোর্টিং উইকেটে ম্যাচ হওয়া উচিত। প্লেয়িং কন্ডিশন ভালো হওয়া উচিত। এমন পয়েন্ট সিস্টেম থাকা উচিত, যা ঘরোয়া ক্রিকেটকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করবে। দলগুলি যেন সরাসরি জয়ের জন্য খেলে।

ঘরোয়া ক্রিকেটেও দলে জায়গা পাওয়া নিয়ে যেন অনেক লড়াই হয়, সেটি নিশ্চিত করা উচিত। আর্থিক দিক থেকে শুরু করে সবদিকেই এতটা গুরুত্ব দেওয়া উচিত যেন ক্রিকেটাররা খেলতে মুখিয়ে থাকে। এখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ক্রিকেট হলেই জাতীয় দলের জন্য ভালো ক্রিকেটার পাওয়া যাবে।

ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে কয়েকটি ম্যাচ খেললেন, এই টুর্নামেন্ট কেমন মনে হচ্ছে?

ওয়াসিম: খারাপ নয়, বেশ ভালো লড়াই হচ্ছে। জাতীয় দলের অনেকেই খেলছে না, এরপরও বেশ ভালো ভালো ম্যাচ হচ্ছে। প্রতিভাবান ক্রিকেটার দেখা যাচ্ছে। সেদিন প্রাইম ব্যাংক আমাদের আবাহনীকে হারিয়ে দিয়েছে। জাতীয় দলের এত ক্রিকেটার নিয়ে গড়া দলকে আরেকটি দল হারাচ্ছে, তার মানে ওদের মানও যথেষ্ট ভালো। ওয়ানডে ক্রিকেট বাংলাদেশ কেন ভালো খেলে, এই টুর্নামেন্টে খেলে কিছুটা বোঝা যাচ্ছে।

আপনার দলে শান্ত, মোসাদ্দেকের মতো তরুণরা আছেন, যারা জাতীয় দল থেকে বাদ পড়েছেন। ওদের সঙ্গে কি কথা হয়? কতটা শিখতে আগ্রহী ওরা?

ওয়াসিম: যতটা কথা হয়েছে, আমি ফোকাস রাখার কথা বলি। রান করা একটা অভ্যাসের ব্যাপার। ওদেরকে ধারাবাহিকভাবে রান করতে হবে। অনেক সময়ই ঘরোয়া ক্রিকেটকে অনেকে যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে নেয় না। যেটি আগে বললাম, একটি-দুটি ভালো ইনিংসেই সন্তুষ্ট থাকে। এই মানসিকতা বদলাতে হবে। এই পর্যায়ের ক্রিকেটে প্রচুর রান করতে হবে। ম্যাচের পর ম্যাচ, মৌসুমের পর মৌসুম রান করতে হবে। সেই ক্ষুধা থাকতে হবে।

আপনি যাদের কথা বললেন, শুধু ওরা নয়, জাতীয় দলের অনেকেও, যেমন মুমিনুল হক, আমি দেখেছি, দারুণ প্রতিভাবান। কিন্তু তামিম ইকবালের মতো ধারাবাহিক নয়। ওদেরকে ঘরোয়া ক্রিকেট থেকেই স্রোতের মতো রান করতে হবে। ঘরোয়া ক্রিকেটে কেউ টানা কয়েক মৌসুম ধারাবাহিক না হলে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সে কিভাবে ধারাবাহিক হবে?

ঘরোয়া ক্রিকেটে পঞ্চাশের বেশি গড় থাকলে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আপনি ৪০ গড়ের আশা করতে পারেন। কিন্তু কজন ক্রিকেটারের আছে ঘরোয়া ক্রিকেটে এমন গড়? এটা নিশ্চিত করতে হবে। এখানে সেঞ্চুরির পর সেঞ্চুরি, অনেক অনেক রান করলে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ধারাবাহিকতার অভ্যাস গড়ে উঠবে। পুরোটাই মানসিকতার ব্যাপার। সঠিক মানসিকতায় থেকে কঠোর পরিশ্রম করে গেলে সাফল্য আসবেই।