লড়াই করতেও পারল না বাংলাদেশ

সুইং বোলিংয়ে নাকাল টপ অর্ডার। ধারহীন বোলিংয়ে প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যানদের নিশ্চিন্ত পথচলা। কন্ডিশনে মানিয়ে নিতে না পারার ছাপ পারফরম্যান্সে। সাকিব আল হাসান না থাকায় গণ্ডগোল কম্বিনেশনে। সিরিজ শুরুর আগে শঙ্কার জায়গা ছিল যা কিছু, প্রথম ম্যাচে সত্যি হলো তার প্রায় সবকটি। অনুজ্জ্বল পারফরম্যান্সে বাংলাদেশের নিউ জিল্যান্ড সফর শুরু হলো বড় হারে।

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 Feb 2019, 05:19 AM
Updated : 13 Feb 2019, 11:33 AM

প্রথম ওয়ানডেতে বাংলাদেশকে ৮ উইকেটে হারিয়েছে নিউ জিল্যান্ড। এগিয়ে গেছে তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজে।

নেপিয়ারে বুধবার কিউইদের দারুণ বোলিংয়ে শুরু থেকেই ধুঁকেছে বাংলাদেশ। পাঁচে নামা মোহাম্মদ মিঠুনের ফিফটি ও অষ্টম উইকেটে রেকর্ড জুটির সৌজন্যে তবু ২৩২ রান করতে পারে দল। কিন্তু ব্যাটিং উইকেটে ও ছোটো মাঠে লড়াই করাও যায়নি সেই পুঁজিতে। মার্টিন গাপটিলের অপরাজিত সেঞ্চুরিতে কিউইরা জিতেছে ৩৩ বল বাকি রেখে।

এই নিয়ে নিউ জিল্যান্ডে স্বাগতিকদের বিপক্ষে ২২টি আন্তর্জাতিক ম্যাচের সবকটিতে হারল বাংলাদেশ।

প্রথম অধিনায়ক হিসেবে বাংলাদেশকে শততম আন্তর্জাতিক ম্যাচে নেতৃত্ব দেওয়া ম্যাচে মাশরাফি পেলেন হারের স্বাদ।

ম্যাকলিন পার্কে দিন-রাতের ম্যাচে টসকে পক্ষে পেয়েছিল বাংলাদেশ। কিন্তু ব্যাটিংয়ের শুরুটাতেই ফিকে হয়ে যায় প্রত্যাশার অনেক ছবি। ট্রেন্ট বোল্ট, ম্যাট হেনরির সুইং ও লকি ফার্গুসনের গতির সামনে ভেঙে পড়ে টপ অর্ডার।

ম্যাচের শুরু ছিল প্রথম বলে বাউন্ডারিতে। ম্যাট হেনরির লেগ স্টাস্পে থাকা বলে ব্যাট ছুঁইয়ে দেন তামিম ইকবাল। পরের ওভারেই তামিমকে থমকে দেন ট্রেন্ট বোল্ট।

ছবি: নিউ জিল্যান্ড ক্রিকেট

বলটি দুর্দান্ত ছিল। দায় ছিল তামিমেরও। অফ স্টাম্পে পিচ করে একটু দেরিতে সুইং করে বেরিয়ে যাওয়া বলে সোজা না খেলে তামিম খেলতে চাইলেন মিড উইকেটের দিকে। ব্যাটের কানায় লেগে বল কিপারের গ্লাভসে।

লিটন দাস ধুঁকছিলেন শুরু থেকেই। হেনরির ভেতরে ঢোকা বলে ব্যাট-প্যাডের ফাঁক গলে বোল্ড হন দৃষ্টিকটুভাবে।

তবে তিনে নামা সৌম্য সরকার যেন ছিলেন অন্য এক ভুবনে। কন্ডিশন, প্রতিপক্ষের বোলিং বা পরিস্থিতির চাপ, তার ব্যাটিংয়ে ছিল না কোনো কিছুর ছাপ। দুর্দান্ত টাইমিংয়ে খেলেছেন দারুণ কয়েকটি ড্রাইভ, ফ্লিক, পুল। হেনরিকে গ্যালারিতে আছড়ে ফেলেছেন চোখধাঁধানো শটে।

শেষ পর্যন্ত রোমাঞ্চপ্রিয়তাই কাল হয়েছে তার। হেনরির অফ স্টাম্পের বাইরে করা বাউন্সারে হুক করতে গিয়ে শেষ হয়েছে ২২ বলে ৩০ রানের সম্ভাবনাময় ইনিংস।

ছবি: আইসিসি

বাংলাদেশ আরও বড় ধাক্কা খায় সৌম্যর বিদায়ের আগেই। বোল্টের বাউন্সার হেলমেটে ছোবল দিয়ে নাড়িয়ে দিয়েছিল মুশফিককে। ওই ওভারেই শরীরের কাছের বল কাট করতে গিয়ে সমাপ্তি বাংলাদেশের বড় ভরসার।

৪২ রানে ৪ উইকেট হারিয়ে বাংলাদেশ ছিল দিশাহারা। এমন বিপর্যয় থেকে অনেকবারই দলকে টেনে তুলেছেন মাহমুদউল্লাহ। এ দিন ব্যর্থ তিনিও। লকি ফার্গুসনের গতির সামনে তাকে মনে হচ্ছিল নড়বড়ে। উইকেটও দিয়েছেন গতির ঝড় তোলা এই ফাস্ট বোলারকে।

ছবি: আইসিসি

নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফেরা সাব্বির রহমান দৃষ্টিনন্দন দুটি চার মেরেছিলেন ফার্গুসনকে। খানিক পরই বাঁহাতি স্পিনার মিচেল স্যান্টনারের প্রথম ওভারে সুইপ করতে গিয়ে স্টাম্পড হয়ে যান উইকেটে ভূপাতিত হয়ে।

৯৪ রানে ৬ উইকেট হারানোর পর শুরু প্রতিরোধ পর্ব। মিঠুনের সঙ্গী মেহেদী হাসান মিরাজ।

পরিস্থিতির পরোয়া ছিল না মিরাজের ব্যাটে। উইকেটে গিয়েই স্যান্টনারকে মেরেছেন টানা দুটি চার। তাকেই ছক্কা মেরেছেন স্লগ সুইপে।

৩৭ রানের জুটির পর মিরাজ আউট হয়েছেন স্যান্টনারের বলেই বাজে এক শটে। অফ স্টাম্পের অনেক বাইরের বল সুইপ করতে গিয়ে তুলেছেন আকাশে।

সেখান থেকেই মিঠুন ও মোহাম্মদ সাইফ উদ্দিনের রেকর্ড জুটি। শুরুতে নড়বড়ে ছিলেন সাইফও। তবে টিকে যান, সময়ের সঙ্গে পান আত্মবিশ্বাস। ভরসা পেয়ে মিঠুনও এগোতে থাকেন স্বচ্ছন্দে।

শুধু উইকেট ধরে রাখাই নয়, বল প্রতি রান তোলারও চেষ্টা করেছেন দুজন। দেড়শর নিচে গুটিয়ে যাওয়ার শঙ্কায় থাকা দল এই জুটিতেই ছাড়িয়ে গেছে দুইশ।

ছবি: আইসিসি

টানা দ্বিতীয় ফিফটির সম্ভাবনা জাগালেও শেষ পর্যন্ত পারেননি সাইফ। স্যান্টনারকে উড়িয়ে মারতে গিয়ে সীমানায় ধরা পড়েন ৫৮ বলে ৪১ করে।

দুজনের ৮৪ রানের জুটি ভেঙেছে বেশ পুরোনো এক রেকর্ড। অষ্টম উইকেটে বাংলাদেশের আগের সর্বোচ্চ ছিল নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষেই, ২০০৩ বিশ্বকাপে খালেদ মাসুদ ও মোহাম্মদ রফিকের ৭০।

এই জুটি ভাঙার পর শেষ দিকে আর বেশি রান আসেনি। ৭৩ বলে মিঠুন ছুঁয়েছেন ১৪ ওয়ানডেতে তৃতীয় ফিফটি। আক্রমণে ফেরা ফার্গুসনের আরেকটি গোলায় বোল্ড হয়েছেন ৯০ বলে ৬২ করে। ততক্ষণে বাংলাদেশ পেয়ে যায় ভদ্রস্থ পুঁজি।

তবে রান রেটের চাপ ছিল না বলেই শেষ পর্যন্ত লড়াই করা যায়নি বোলিংয়ে। নিউ জিল্যান্ড বেছে নেয় নিরাপদে হাঁটার পথ। কোনো ঝুঁকি, কোনো তাড়া ছিল না দুই ওপেনার গাপটিল ও হেনরি নিকোলসের ব্যাটে।

মাশরাফি বিন মুর্তজা ও মুস্তাফিজুর রহমানের বলে সতর্ক ছিলেন দুই ব্যাটসম্যানই। তারা উইকেট এনে দিতে পারেননি দলকে। পারেননি অন্যরাও। দু্ই ব্যাটসম্যান তাই গড়ে ফেলে শতরানের জুটি। বাংলাদেশ ম্যাচ থেকে অনেকটা ছিটকে পড়ে তাতেই।

সাকিবের জায়গায় বাংলাদেশ খেলিয়েছে বাড়তি ব্যাটসম্যান, বোলিংয়ে তাই বিকল্প ছিল কম। শুরুতে উইকেট না আসায় পরেও সৃষ্টি করা যায়নি চাপ।

৫৩ রান করা নিকোলসকে ফিরিয়ে ১০৩ রানের জুটি ভাঙেন মিরাজ। মিরাজের বলেই ৪৭ রানে গাপটিলের ক্যাচ ছাড়েন মুশফিক। গাপটিল আর সুযোগ দেননি। বাংলাদেশও পেরে ওঠেনি।

দারুণ এক ডেলিভারিতে কেন উইলিয়ামসনকে অল্পতে থামান মাহমুদউল্লাহ। কিন্তু রস টেইলরকে নিয়ে ৯৬ রানের অবিচ্ছিন্ন জুটিতে দলকে জয় এনে দেন গাপটিল।

ভারতের বিপক্ষে সিরিজে চার ম্যাচে মোটে ৪৭ রান করেছিলেন গাপটিল। এরপর চোট নিয়ে ছিলেন মাঠের বাইরে। এই ম্যাচে ফিরলেন ফর্মে। ৮ চার ও ৪ ছক্কায় ১১৬ বলে অপরাজিত ১১৬। তার ১৫তম ওয়ানডে সেঞ্চুরি, বাংলাদেশের বিপক্ষে দ্বিতীয়।

পরের ম্যাচ শনিবার ক্রাইস্টচার্চে, কন্ডিশন যেখানে হতে পারে আরেকটু বিরুদ্ধ। পরীক্ষা তাই হবে আরও কঠিন।

সংক্ষিপ্ত স্কোর:

বাংলাদেশ : ৪৮.৫ ওভারে ২৩২ (তামিম ৫, লিটন ১, সৌম্য ৩০, মুশফিক ৫, মিঠুন ৬২, মাহমুদউল্লাহ ১৩, সাব্বির ১৩, মিরাজ ২৬, সাইফ ৪১, মাশরাফি ৯*, মুস্তাফিজ ০; হেনরি ৯-১-৪৮-২, বোল্ট ৯.৫-০-৪০-৩, ডি গ্র্যান্ডহোম ৫-০-১৯-০, ফার্গুসন ১০-১-৪৪-২, স্যান্টনার ৮-০-৪৫-৩, নিশাম ৭-০-২৬-০)।

নিউ জিল্যান্ড : ৪৪.৩ ওভারে ২৩৩/২ (গাপটিল ১১৭*, নিকোলস ৫৩, উইলিয়ামসন ১১, টেইলর ৪৫*; মাশরাফি ৮.৩-০-৩৩-০, সাইফ ৭-০-৪৩-০, মুস্তাফিজ ৮-০-৩৬-০, মিরাজ ৮-১-৪২-১, সাব্বির ৭-০-৪৭-১, মাহমুদউল্লাহ ৫-০-২৭-১, সৌম্য ১-০-৮-০)।

ফল: নিউ জিল্যান্ড ৮ উইকেটে জয়ী

সিরিজ: ৩ ম্যাচ সিরিজে নিউ জিল্যান্ড ১-০তে এগিয়ে

ম্যান অব দা ম্যাচ: মার্টিন গাপটিল