তামিমের স্বপ্নের ইনিংস, স্বপ্নময় দিন

আলো ঝলমলে মঞ্চ। কোটি জোড়া কৌতুহলি চোখ। রোমাঞ্চের অনেক উপকরণে ঠাসা উপলক্ষ্য। হাতছানি বড় প্রাপ্তির। সেই মঞ্চেই নায়কোচিত নৈপূণ্য। ঔজ্জ্বল্যে ধাঁধিয়ে দেওয়া চারপাশ। সাফল্যের রঙে মাখামাখি। কত দিন-রাত এমন স্বপ্নে বিভোর হয়েছেন তামিম ইকবাল! বিপিএলের ফাইনাল ছিল তার সেই স্বপ্ন পূরণের একটি দিন।

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 Feb 2019, 08:03 AM
Updated : 9 Feb 2019, 10:14 AM

নিজের পারফরম্যান্স নিয়ে কল্পনার আবিরে রঙিন হন প্রায় সব পারফরমারই। অনেকেরই থাকে অনেক রকম ‘ফ্যান্টাসি’ বা খোশখেয়াল। কারও কম, কারও বেশি। তামিম বেশিদের দলে।

নিজের পারফরম্যান্স তাকে খুব ভাবায়। স্বপ্ন দেখায়। বড় মঞ্চে নায়ক হবেন, ধরা দেবে অভাবনীয় সাফল্য, বীরোচিত প্রদর্শনীতে একাই গুঁড়িয়ে দেবেন প্রতিপক্ষকে, এসব ভাবনা তাকে দোলা দেয় অনেক সময়ই। কল্পনার জগতের সেই টুকরো ছবিগুলো জীবনের আঙিনায় সত্যি হয়ে ফুটে ওঠার দিন ছিল শুক্রবার। তামিম যেখানে ফ্যান্টাসির নয়, বাস্তবের নায়ক!

বিপিএলের ফাইনালে বলতে গেলে তামিমের কাছেই হেরে গেছে ঢাকা ডায়নামাইটস। অসাধারণ ইনিংস খেলে তামিম নিজেকে উপহার দিয়েছেন প্রথম বিপিএল শিরোপা। তার সাফল্যেই দ্বিতীয় ট্রফিতে উদ্ভাসিত হয়েছে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্স।

নিজে করেছেন ৬১ বলে অপরাজিত ১৪১, দলের অন্যরা মিলে করেছেন ৫৯ বলে ৪৭। অতিরিক্ত থেকে এসেছে ১১ রান।

তার স্ট্রাইক রেট ২৩১.১৪, বাকিদের কারও স্ট্রাইক রেট এমনকি ৮৬ ছুঁতেও পারেনি।

তার ব্যাট থেকে এসেছে ১০টি চার, ১১টি ছক্কা। দলের অন্য চার ব্যাটসম্যান মিলে বাউন্ডারি ৩টি, ছক্কা ১টি।

শেষ ১০ ওভারে কুমিল্লা তুলেছে ১২৬ রান, তামিমের ব্যাট থেকেই এসেছে তার ১০৩ রান। শেষ ৬ ওভারে দল করেছে ৮৫, তার ৭১ রানই তামিমের।

দলের প্রায় ৭১ শতাংশ রান করেছেন একাই। শেষ ১০ ওভারে একাই করেছেন দলের প্রায়  ৮২ শতাংশ রান!

ওপরের এই পরিসংখ্যানগুলো অবিশ্বাস্য নয়। কিন্তু বাংলাদেশের কোনো ব্যাটসম্যানের জন্য একরকম ছিল অভাবনীয়। তার ব্যাটিং দেখে কখনও মনে হয়েছে ‘হাইলাইটস।’ কখনও ছড়িয়েছে বিস্ময়, ভিডিও গেমস নয় তো!

শের-ই-বাংলার ২২ গজে যে ইন্দ্রজাল বিছিয়েছিলেন তামিম, সেই ঘোরে আটকা পড়েছিলেন স্বয়ং তিনিও।

“সত্যি বলতে, আমি এখনও স্বপ্নে আছি। এখনও বুঝতে পারছি না, কিভাবে ব্যাট করলাম। সত্যিই জানি না। ঘরে গিয়ে হাইলাইটস দেখার পর হয়তো ভালো করে বুঝতে পারব। একটা সময়, বিজয় (এনামুল) আউট হওয়ার পর আমি খুবই বিরক্ত হয়ে গিয়েছিলাম। নিজেকে শান্ত করে আবার শুরু করতে হয়েছে।”

এই ম্যাচের আগেও টি-টোয়েন্টিতে একাধিক সেঞ্চুরি করা বাংলাদেশের একমাত্র ব্যাটসম্যান ছিলেন তিনি। কিন্তু দুটি সেঞ্চুরির একটিও ছিল না বিপিএলে। তার মানের একজন ব্যাটসম্যানের জন্য যথেষ্টই বিব্রতকর। ভেতরে তাড়নাও ছিল তীব্র।

শেষ পর্যন্ত কাঙ্ক্ষিত সেই মাইলফলক এলো ফাইনালে, অপেক্ষার ফল তাই মধুরই মনে হচ্ছে তামিমের।

“সেঞ্চুরির সুযোগ আমার আগে ছিল। গত মৌসুমেও দুয়েকবার ছিল। কোনোভাবে হয়ে ওঠেনি। ৭০-৮০ রানে বেশ কবার আউট হয়েছি, তখনও হয়তো ৫-৬ ওভার ছিল। এবার ফাইনালে হলো, এর চেয়ে ভালো কিছু আর হতে পারত না।”

ইনিংসের বিশালত্ব, এটির ধ্বংসাত্মক রূপ, রেকর্ডের ছড়াছড়ি, এসবের পাশাপাশি নজর কাড়ার মতো ব্যাপার ছিল আরেকটি, ইনিংসটি যেভোবে গড়ে তুলেছেন। শুরুতে সময় নিয়েছেন কিছুটা। প্রথম চার ওভারে কোনো বাউন্ডারিই মারেননি। পঞ্চম ওভারে সুনিল নারাইনকে ছক্কা মেরেছেন, তার পরও ওভার শেষে তার রান ছিল ১৩ বলে ১১।

এরপর আস্তে আস্তে বাড়াতে থাকেন রানের গতি। ১০ ওভার শেষে নামের পাশে ২৭ বলে ৩৮। একাদশ ওভারে শুভাগত হোমের টানা দুই বলে চার ও ছক্কা, ফিফটি করেন ৩১ বলে।

উইকেটে তখন জমে গেছেন পুরোপুরি। বেরিয়ে এসে ছক্কায় ওড়ান সাকিবকে। ওই ওভারেই বিদায় নেন এনামুল হক। পরের ওভারে রান আউট শামসুর রহমান। তামিম দমে যেতে পারতেন। কিন্তু ততক্ষণে হয়ে উঠেছেন অপ্রতিরোধ্য।

ঝড়টা তখনও ছিল যেন কেবল দমকা হাওয়া। পরে তা রূপ নেয় টর্নেডোতে। গোটা টুর্নামেন্টে দারুণ বোলিং করা রুবেল হোসেনের এক ওভারে দুটি করে চার ও ছক্কা আসে, জোড়া চার ও ছক্কা আসে আন্দ্রে রাসেলের ওভারেও। সাকিবের ওভারে দুই ছক্কা, এক চার। ৫০ বলে সেঞ্চুরি। শেষ দিকে ঢাকার ওপর আরও তাণ্ডবলীলা চালিয়ে অপরাজিত থেকেই ইনিংস শেষ।

ইনিংসজুড়ে প্রতিটি মুহূর্তের চাহিদা পড়তে পেরেছেন নিখুঁতভাবে, দাবি মিটিয়েছেন সুনিপুণভাবে। বল উড়েছে মাঠের নানা প্রান্তে, আছড়ে পড়েছে নানা সীমানায়। রাসেলের ১৫ বলে নিয়েছেন ৩২ রান, রুবেলের ১৩ বলে ৩৭, সাকিবের ১০ বলে ৩০। আবার এ দিন ঢাকার সেরা বোলার নারাইনকে একটি ছক্কা মারলেও তার ৯ বলে নিয়েছেন কেবল ১২ রান। নিরাপদে খেলে পার করেছেন নারাইনের স্পেল।

এভাবে পরিকল্পনা মতো ইনিংস গড়তে পারা বাড়তি তৃপ্তি দিচ্ছে তামিমকে।

“অবশ্যই ভাবিনি এমন ইনিংস খেলতে পারব। তবে ইনিংসটি আমি গুছিয়েছি খুব ভালোভাবে। আমার সঙ্গে উইকেটে যখন যে ছিল, আমি একটি কথা বলেছি যে সাকিব ও নারাইনকে উইকেট দেওয়া যাবে না। নারাইনকে একটি ছক্কা মারলেও আমি কোনো ঝুঁকিই নেই। এটি ছিল গুরুত্বপূর্ণ।

“উইকেট অবিশ্বাস্যরকম ভালো ছিল (ব্যাটিংয়ের জন্য)। দিনটিও আমার ছিল। যেভাবে চেয়েছি, লেগেছে। ঠিক মতো লাগেনি যে দু-একটা, সেসবেও চার-ছক্কা পেয়েছি।”

ঢাকার ধারাল বোলিং আক্রমণের বিপক্ষেও এমন একটি ইনিংস খেলতে পারায় তামিম অনুপ্রেরণা পেয়েছেন আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টির জন্যও।

“ইনিংসটি আমাকে একটা শিক্ষাও দিল, আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে আমি কিভাবে কাজে লাগাতে পারি। ঢাকার বোলিং আক্রমণ যেমন ছিল, অনেক আন্তর্জাতিক দলের বোলিং আক্রমণও এত ভালো থাকে না। এখানে এভাবে ব্যাট করতে পারলে আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতেও না পারার কারণ নেই। অনেক শিখেছি।”

স্বপ্নের এই ইনিংসটি স্বপ্নময় দিনের পূর্ণতা পেয়েছে দলের শিরোপা জয়ে। তার প্রথম বিপিএল ট্রফি। দিনশেষে যে প্রাপ্তিতে মিলেমিশে একাকার স্বস্তি ও তৃপ্তি।

“আমার খুব ইচ্ছে ছিল ট্রফি জয়ের। সবসময়ই চেয়েছি বিপিএল জিততে। ভারটা এখন নেমে গেছে।”