আমি যুক্তি দিয়েছি, সাব্বিরকে নেওয়া নির্বাচকদের ব্যাপার: মাশরাফি

“অধিনায়ক জোরালোভাবে তাকে চেয়েছে”, নিউ জিল্যান্ড সফরের ওয়ানডে দলে সাব্বির রহমানকে নেওয়ার পেছনে এই ছিল প্রধান নির্বাচকের যুক্তি। অধিনায়ক কেন তাকে প্রবলভাবে চেয়েছেন? কতটুকু ভূমিকা ছিল তার নির্বাচনে? সাব্বিরের শাস্তি কমানো কতটা ভালো দৃষ্টান্ত? এসব নিয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে কথা বললেন ওয়ানডে অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা।

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 Jan 2019, 07:10 AM
Updated : 24 Jan 2019, 10:17 AM

সাব্বিরকে দলে নেওয়ার কারণ বলতে গিয়ে প্রধান নির্বাচক বলেছেন, “অধিনায়ক খুব জোরালোভাবে আমাদেরকে দাবি জানিয়েছে।” এটা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে অনেক। আপনার বক্তব্য কি?

মাশরাফি বিন মুর্তজা: জোরালো দাবি জানানোর এখতিয়ার কি আমার আছে? আমি কি নির্বাচক কমিটির অংশ?

আমার কাছে মত জানতে চাওয়া হয়েছে। নিজের মত দিয়েছি। মতের পক্ষে ক্রিকেটীয় যুক্তি দিয়েছি। কাউকে দলে নেওয়া, না নেওয়া তো নির্বাচকদের ব্যাপার। আমার যুক্তি হয়তো তাদের কাছে জোরালো মনে হয়েছে। যৌক্তিক মনে হয়েছে। তাদের যদি পাল্টা যুক্তি থাকত, কিংবা আমার যুক্তির সঙ্গে একমত না হতেন, তাহলে নিশ্চয়ই অন্য কিছুই দেখা যেত।

কোনো ক্রিকেটারকে নিয়ে অধিনায়কের মত জানতে চাওয়া হয়, মতামত দেই। আর যখন কোনো মতামত দেব, যুক্তিও তো দেখাতে হবে পক্ষে। সেটাও করি। কখনও তারা আমার মত রাখেন, কখনও রাখেন না। সাব্বিরকে নিতেই হবে, এটা তো আমি বলিনি। স্রেফ মতের পক্ষে যুক্তি দিয়েছি।

সাব্বিরের পক্ষে কেন মত দিয়েছিলেন? প্রধান নির্বাচক সংবাদ সম্মেলনে যখন অধিনায়কের দাবির কথা বলেছেন, আপনার যুক্তিও কি সবার সঙ্গে ভাগাভাগি করা যায়?

মাশরাফি: কোনো সমস্যা নেই, কারণ নিজের যুক্তি আমার কাছে পরিষ্কার। দেখুন, ১৫ জনের দলের ১৪ জন কোচ-নির্বাচকেরা ঠিক করেই রেখেছিলেন (জাতীয় কোচও নির্বাচক কমিটির অংশ)। ১৫ নম্বর সদস্য নিয়ে তার আমার মত জানতে চেয়েছেন।

আমাকে কয়েকটি অপশন দেওয়া হয়েছে, তাদের মধ্য থেকে কাকে নেওয়া যায়, সে ব্যাপারে আমার অভিমত চেয়েছেন। ইমরুল, মোসাদ্দেক, রনি (আবু হায়দার), অপু (নাজমুল), নাকি সাব্বির।

তামিমের সঙ্গে ওপেন করার মতো লিটন ও সৌম্য আছে। স্পিনে সাকিব ও মিরাজের সঙ্গে বাড়তি নাঈম আছে। আরেকজন স্পিনার (অপু) নিউ জিল্যান্ডে খুব জরুরি নয়। পেস বোলিংয়ে আমার সঙ্গে মুস্তাফিজ, রুবেল ও সাইফ আছে। ১৬ জনের স্কোয়াড হলে হয়তো আরেকজন পেসার রাখা যেত।

মিডল অর্ডারে সাকিব-মুশফিকদের তো বিকল্প নেই। কেবল ছয়-সাতেই বিকল্প কাউকে দরকার হতে পারে। সেখানে এই তালিকা থেকে আমার সামনে অপশন ছিল মোসাদ্দেক ও সাব্বির।

মোসাদ্দেক বিপিএলে কালকের ম্যাচের আগ পর্যন্ত সেভাবে টাচে ছিল না। তাছাড়া সাত নম্বর ওর উপযুক্ত জায়গা কিনা, এটি নিয়ে তো আপনারাই কত প্রশ্ন তুলেছেন। সেই প্রশ্ন যৌক্তিকও। এখন সাব্বির ছাড়া বিকল্প কে ছিল?

আমি আমার যুক্তি বলেছি। কিছুই চাপিয়ে দেইনি। সেই অধিকার আমার নেই। আমার মতই তো শেষ কথা নয়। আমি এটাও বলেছিলাম যে, “আমার কথা বললাম, বাকিটা আপনারা যা মনে করেন।”

এমনকি কোচও তো আমার যুক্তি শোনার পর ভাবার জন্য সময় নিয়েছেন। ১ দিন ভেবেছেন। তার পর হয়তো তার ও অন্যদের মনে হয়ে যুক্তি ঠিক। দল নির্বাচন কিন্তু একটি প্রসেস। আমাদের দেশে খুব সহজেই বলে দেওয়া হয় অমুক কেন, তমুক কেন। কিন্তু বিকল্প কে, সেটা অনেকেই ভাবেন না।

সাব্বিরকে কেন আপনার সাত নম্বরের উপযুক্ত মনে হয়?

মাশরাফি: তার সামর্থ্যের কারণে। অধিনায়ক হিসেবে আমাকে এখন ভাবতে হবে বিশ্বকাপের কথা। আমাকে স্বপ্ন দেখতে হবে বড়। পারি বা না পারি, আমাকে যেতে হবে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার লক্ষ্য নিয়ে। ভাবতে হবে সেভাবেই।

সাত নম্বরের জন্য এমন ব্যাটসম্যান চাইব আমি, যে দ্রুত কিছু রান এনে দিতে পারবে। তার কাছ থেকে তো আমি নিয়মিত ফিফটি চাইব না। ইনিংস গড়া চাইব না। সাত নম্বর ব্যাটসম্যানকে যদি ইনিংস গড়তে হয়, তাহলে বুঝতে হবে দলের ব্যাটিংয়ে ধস নেমেছে। মানে আমরা ব্যাক ফুটে।

আইডিয়ালি সাতে যে খেলবে, তার কাছে আমি চাইব ১৫ বলে ২৫। বা ২০ বলে ৩০-৩৫। সাত নম্বর যখন ব্যাটিংয়ে নামবে, শেষের দিকে তখন বোলিংয়ে থাকবে কারা, একটু চিন্তা করুন? অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে খেলা হলে স্টার্ক-কামিন্স, ভারতের সঙ্গে বুমরাহ-শামি-ভুবনেশ্বর, দক্ষিণ আফ্রিকার রাবাদা-স্টেইন, ইংল্যান্ডের ওকস-স্টোকস, নিউ জিল্যান্ডের বোল্ট-সাউদি, পাকিস্তানের সঙ্গে হাসান আলি-আমির। এই বোলারদের বলে শট খেলতে হবে। তারা বাজে বল দেবে না। রান করার পথ বের করতে হবে। এই জায়গাটায় নেমে একটু ইম্প্রোভাইজ করা, একটু পাওয়ার শট খেলা, আর কে ধারাবাহিকভাবে কাজটা করতে পারবে? একটি নাম আমাকে দেখান!

গত কিছুদিনে তো অনেকের কথাই এসেছে এই পজিশনে। খেলেছেও। কেমন করেছে, আপনারাই দেখেছেন। এই বিপিএলের কথাই বলুন, বাংলাদেশের কোন ব্যাটসম্যান এই কাজ করতে পেরেছেন? সাব্বিরের এই সামর্থ্য অন্তত আছে।

মিঠুন, মাহমুদউল্লাহ কি উপযুক্ত নন সাতে? মিঠুনকে যখন এই দফায় দলে ফেরানো হলো, এই পজিশেন কথাই বলা হয়েছিল। মাহমুদউল্লাহ তো দারুণ ফিনিশার হয়ে উঠেছেন!

মাশরাফি: মিঠুনকে নেওয়ার সময় বলা হয়েছিল এই পজিশনের কথা। কিন্তু সবসময় তো ভাবনামতো কাজ হয় না। পাঁচ-ছয়ের জন্যই ওর ব্যাটিং বেশি উপযুক্ত মনে হয়। কিংবা আরেকটু ওপরে। সাত নম্বর একটু অন্যরকম দাবি করে।

রিয়াদ অবশ্যই এই কাজটা পারে। খুব ভালো পারে। কিন্তু ওকে কি নিয়মিত সাতে খেলানো উচিত? পরিস্থিতির কারণে মাঝেমধ্যে খেলতে পারে। নিয়মিত সাতে খেলানো ওর প্রতি অবিচার নয়?

রিয়াদ কখনও অভিযোগ করে না। কিন্তু অধিনায়ক হিসেবে আমাকে তো সবার মন বোঝার চেষ্টা করতে হয়। চার-পাঁচে মুশি-সাকিব আছে। অন্তত ছয়ে রিয়াদকে জায়গা দিতেই হয়!

এরপরও, ধরে নিলাম ছয়ে মিঠুন খেলল, সাতে রিয়াদ। কিংবা ম্যাচের পরিস্থিতি বুঝে দুজনের মধ্যে ওলট-পালট হলো। একজন বিকল্প তো স্কোয়াডে রাখতে হবে? সেই বিকল্প কে?

স্রেফ ১৫ জনের দল পূর্ণ করার জন্য একজনকে নিয়ে যাওয়ার পক্ষপাতি আমি নই। ১৫ জন মানে দেশের সেরা ১৫ জন। প্রত্যেককে নেওয়ার পেছনে ভিত্তি থাকবে, শক্ত যুক্তি থাকবে। ১৫ জনের প্রত্যেকেই একাদশে খেলার যোগ্য হবেন।

কিন্তু আপনি যাকে উপযুক্ত মনে করছেন, সেই সাব্বির এই পজিশনে কতটা ভালো করেছেন? কতটা দেখাতে পেরেছেন সামর্থ্য? ছয়ে গড় ২৭.৭৬, সাতে ২১.৭৫…!

মাশরাফি: ছয়ে ওর স্ট্রাইক রেট একশর কাছাকাছি (৯৮.৯০), সাতে একশর বেশি (১০৩.৫৭)! আট নম্বরে একবারই খেলেছে, বিশ্বকাপে ফিফটি করেছে।

অবশ্যই বলছি না, সাব্বির পেরেছে। দাবি করছি না সে ভালো করেছে। তবে এই স্ট্রাইক রেট আর ওর ব্যাটিংয়ের ধরন বলে, ওর সামর্থ্যটা অন্তত আছে।

আমি আগে একটা কথা বলেছি, বিকল্প দেখতে হবে। বিকল্প কে? সাব্বির যেমন এখনও পর্যন্ত তার সামর্থ্যের পুরোপুরি দেখাতে পারেনি, অন্য কেউ তো আরও পারেনি। কেউই পারেনি। প্র্যাকটিক্যালি কেউ পারছে না, তাহলে থিওরিটিক্যালি যে পারে, তার ওপরই তো ভরসা করতে হবে!

এখানে আরিফুলকে নিলেও কথা হতো। মোসাদ্দেককে নিলেও হতো। যে কাউকে নিলেই কথা উঠত। অধিনায়ক-নিবাচকদের তো সেসব ভাবলে চলে না। নিজেদের কাছে পরিষ্কার থাকতে হয়। অধিনায়ক হিসেবে নিজের যুক্তি আমি উপস্থাপন করেছি। নির্বাচকরা ওকে নিয়েছেন।

সাব্বিরকে নেওয়ায় আলোচনা এত বেশি, কারণ সে এখনও নিষিদ্ধ এবং এমন একটা চিত্র ফুটে উঠছে, যেখানে মনে হচ্ছে, কেবল দলে নেওয়ার জন্যই তার নিষেধাজ্ঞা এক মাস কমানো হয়েছে…

মাশরাফি: নিষেধাজ্ঞা কমানো কি আমার এখতিয়ার? কিংবা নির্বাচকদের ব্যাপার? এটা বোর্ডের ব্যাপার, কমিটির ব্যাপার (ডিসিপ্লিনারি কমিটি)। ক্লিয়ারেন্স না পেলে তো নির্বাচকেরা সাব্বিরের নাম বিবেচনায় আনবেই না। সে অ্যাভেলেভেল জানার পরই নিশ্চয়ই নির্বাচকেরা বিবেচনা করেছেন।

কিন্তু অধিনায়ক ও সিনিয়র ক্রিকেটার হিসেবে ব্যক্তিগতভাবে আপনার কি মনে হয়, নিষেধাজ্ঞা কমানো কি খুব ভালো দৃষ্টান্ত হলো?

মাশরাফি: এই সিদ্ধান্ত পুরোপুরি বোর্ডের। তবে দৃষ্টান্ত আমি মনে করি, দেওয়া হয়েছে। সে কিন্তু সহজে পার পায়নি। এরপরও যদি না শোধরায়, তাহলে সেটির ফলও তাকেই ভোগ করতে হবে। পাপন ভাই (বোর্ড সভাপতি নাজমুল হাসান) তো এবার নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার সময়ই বলেছিলেন, এরপরও এমন কিছু করলে সে আজীবন নিষেধাজ্ঞা পাবে।

দেখুন, এর আগে সাকিবের মতো একজন, যে আমাদের সেরা ক্রিকেটার, তাকেও নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল বোর্ড। এর চেয়ে বড় দৃষ্টান্ত আর কি আছে? এরপরও তো সাব্বির করেছে। নিষিদ্ধও হয়েছে। ক্রিকেটাররা নিজেরা এসব না বুঝলে তো কিছু করার নেই।

একটি কথা আমি আবারও পরিষ্কার করতে চাই, দল নির্বাচনের সময় কিন্তু শুধু ক্রিকেটীয় দিক নিয়েই আলোচনা হয়েছে। মাঠের বাইরে সাব্বির কতটা শুধরেছে, বোর্ড সেসব ভেবেই নিশ্চয়ই ক্লিয়ারেন্স দিয়েছে।

আর শুধু অধিনায়ক হিসেবে নয়, বাংলাদেশের একজন মানুষ হিসেবেও আমি বলতে পারি, আমাদের সামাজিকতা মানতে হয়। পারিপার্শ্বিকতা বুঝতে হয়। আমাদের সমাজ তো ওয়েস্টার্ন কালচারে চলে না। লাগামহীন জীবন সমর্থন করে না। সেটা ওকে বুঝতে হবে। সেভাবেই চলতে হবে। ওর ক্যারিয়ার, ওর জীবন নিজেকেই সাজাতে হবে। সেটি করতে না পারলে ফল ভালো হওয়ার কারণ নেই।

এবার সুযোগ পেয়েছে, তাতেই কিন্তু তার সব পাওয়া হয়ে গেল না। নিজেকে গোছাতে পারলে ওর ভবিষ্যত ভালো। না পারলে সামনে অন্ধকার। এটা ওকেই বুঝতে হবে।