ডিফেন্স নিয়ে পরিশ্রমের ফলের আশায় সাদমান

বয়সভিত্তিক ক্রিকেটের নানা ধাপ পেরিয়ে দেশের শীর্ষ ঘরোয়া ক্রিকেটে পথচলা পাঁচ বছরের। নিজেকে এখন তাই বেশ পরিণত মনে করেন সাদমান ইসলাম। মাত্রই ডাক পেয়েছেন টেস্ট দলে, তার নিজের কাছে সময়টা উপযুক্ত। বরাবরই তার বাটিংয়ের বড় শক্তি ডিফেন্স। অনেক ঘাম ঝরিয়ে সেখানে উন্নতি করেছেন আরও। তরুণ ওপেনারের বিশ্বাস, ডিফেন্স নিয়ে কঠোর পরিশ্রমের ফল পাবেন টেস্ট ক্রিকেটে।

অনীক মিশকাতঅনীক মিশকাতবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 Nov 2018, 03:12 PM
Updated : 20 Nov 2018, 03:46 PM

জাতীয় লিগের সদ্য সমাপ্ত আসরের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক সাদমান। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে প্রস্তুতি ম্যাচে নিজেকে মেলে ধরে জায়গা করে নিয়েছেন চট্টগ্রাম টেস্টের দলে। তবে প্রথমবার স্কোয়াডে জায়গা পেলেও উচ্ছ্বাসে ভেসে যাচ্ছেন না এই তরুণ। শৈশব থেকে আদর্শ মেনেছেন তামিম ইকবালকে, টেস্ট দলে জায়গা পাকা করে সাদমান হতে চান তামিমের লম্বা সময়ের সঙ্গী।

এটিই সেরা সময়

২০১৪ অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের বাংলাদেশ স্কোয়াডের অর্ধেকের বেশি এরই মধ্যে খেলেছেন জাতীয় দলে। দেশের হয়ে অন্তত এক সংস্করণের স্বাদ পেয়েছেন মেহেদী হাসান মিরাজ, আবু হায়দার, জুবায়ের হোসেন, লিটন দাস, মোসাদ্দেক হোসেন, মুস্তাফিজুর রহমান, নাজমুল হোসেন শান্ত ও জাকির হাসান। 

সেই আসরে ১০১.৫০ গড়ে ৪০৬ রান করে সাদমান হয়েছিলেন সর্বোচ্চ রান সংগ্রহকারী। টুর্নামেন্টে রানের তালিকায় দুই ও তিনে থাকা ইমাম-উল-হক ও এইডেন মারক্রাম এখন পাকিস্তান ও দক্ষিণ আফ্রিকা দলের নিয়মিত মুখ।

তাদের চেয়ে একটু দেরিতেই সুযোগ এসেছে সাদমানের সামনে। তবে ২৩ বছর বয়সী এই বাঁহাতি ওপেনার মনে করেন, জাতীয় দলে খেলার এটিই সেরা সময়।

“প্রায় পাঁচ বছর ধরে খেলছি প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে। যেমন পারফরম্যান্স করেছি, তা হয়তো ঠিক আছে। আমি মনে করি, জাতীয় দলে আসার আগে একজন ব্যাটসম্যানের পরিণত হয়ে আসা উচিত। আমার মনে হয়, আমি ঠিক সময়ে জাতীয় দলে সুযোগ পেয়েছি।”

ঘরোয়া ক্রিকেটের সঙ্গে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের পার্থক্যটা জানেন তিনি। তবে আত্মবিশ্বাসে কমতি নেই।

“প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট আর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পার্থক্য অনেক। আপনি যদি অনেক প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলেন, তাহলে জানবেন কি করে বড় ইনিংস খেলতে হয়। আমি ঘরোয়া ক্রিকেট থেকে এই ব্যাপারে যতটা সম্ভব অভিজ্ঞতা নেওয়ার চেষ্টা করেছি। কারণ আমি মনে করি, কিভাবে বড় ইনিংস খেলতে হয়, কিভাবে কঠিন একটা সেশন পার করে দিতে হয়, সেটা জানা থাকলে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ভালো করার সুযোগ থাকে।”

“অনেক বছর ঘরোয়া ক্রিকেটে এখন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে খেলার আত্মবিশ্বাস জন্মেছে। নিজেও উপলব্ধি করতে পারছি, এই পর্যায়ে খেলাটা কেমন হবে। আমি কেমন খেলতে পারব তার সবটাই নির্ভর করে আমার মানসিকতার ওপর। আমি মনে করি, ইতিবাচক ক্রিকেট খেলতে পারলে এই পর্যায়েও ভালো করা সম্ভব।”

ডিফেন্স নিয়ে কাঁটাছেড়া

প্রস্তুতি ম্যাচে ৭৩ রানের চমৎকার ইনিংস খেলেন সাদমান। শুরু থেকেই সফরকারীদের পেস-স্পিনে ছিলেন সাবলীল। ডিফেন্স ছিল আঁটসাঁট। ব্যাকফুট পাঞ্চগুলো ছিল দুর্দান্ত। বাঁহাতি এই ওপেনার জানালেন, অনেক পরিশ্রম ফসল ছিল তার এই শটগুলো।

“ডিফেন্স নিয়ে আমি সব সময়ই কাজ করি। গত কিছু দিনে যে বড় ইনিংসগুলো খেলেছি, তার পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান ডিফেন্স নিয়ে বাড়তি পরিশ্রমের। ব্যাক ফুট পাঞ্চ নিয়ে আলাদা কাজ করি সব সময়। সে কারণেই ম্যাচে এতো আস্থা নিয়ে ওই শট খেলতে পেরেছি।”

তবে উন্নতির অবকাশ আছে আরও। প্রস্ততি ম্যাচে সাদমানের ব্যাটিং দেখে জাতীয় দলের কোচ স্টিভ রোডস তাকে বলেছেন, ডিফেন্স নিয়ে কিছু কাজ এখনও প্রয়োজন।

“কোচ বলেছিলেন যে, ‘ভালো ব্যাটিং করেছ, তবে আরেকটু লম্বা করতে পারতে ইনিংসটা। ডিফেন্স নিয়ে একটু কাজ করতে হবে আর ব্যাটিংয়ের টেকনিক্যাল কিছু ব্যাপার নিয়ে টুকটাক করজ করতে হবে।’ এর বাইরে আর তেমন কিছু বলেননি।”

“কোচের সঙ্গে আগেও আমার ডিফেন্স নিয়ে কথা বলেছিলাম। কালকে উনি ম্যাচে আমার ডিফেন্স দেখেছেন। উনি ডিফেন্সের ব্যাপারে যা বলেছেন, তা যদি করতে পারি তাহলে আরও বেশিক্ষণ টিকে থাকতে পারব আর স্পিনটা আরও ভালো খেলতে পারব।”

পারফরম্যান্সে আশার উপাদান

সদ্য সমাপ্ত জাতীয় লিগে সর্বোচ্চ রান স্কোরার সাদমান, ৬৪.৮০ গড়ে করেছেন ৬৪৮ রান। দুইয়ে থাকা তুষার ইমরানের চেয়ে করেছেন ১৩০ রান বেশি। লিগে এবার ১ হাজার ১১৫ বল খেলেছেন, ১ হাজার বলও খেলতে পারেনি আর কেউ।

এবার লিগের প্রথম ম্যাচে স্বাদ পেয়েছিলেন ক্যারিয়ারের প্রথম দেড়শ রানের। সেই ১৫৭ রান ছাড়িয়ে পরের ম্যাচেই করেছিলেন ১৮৯। দারুণ একটি আসর কাটানোর পর সাদমানের মনের গভীরে ছিল জাতীয় দলে ডাক পাওয়ার আশা।  

“শুরুতে ১৩ জনের স্কোয়াড ঘোষণা করা হয়েছিল। তখন আমার মনে হয়েছিল যে, প্রস্তুতি ম্যাচে যদি ভালো করতে পারি তাহলে হয়তো আমি সুযোগ পেতে পারি। সেভাবেই নিজেকে প্রস্তুত করে আমি ম্যাচটি খেলেছি।”

“আগের দিন কোচ (রোডস) এসে বলেছিলেন তিনি সবার ব্যাটিং দেখবেন। তবে উনার থাকাটা আমার মধ্যে বাড়তি কিছু এনে দেয়নি। আমি যেমন খেলি, সেটাই চেষ্টা করছিলাম। ঘরোয়া ক্রিকেটেও উইকেট থাকার চেষ্টা করি, প্রস্তুতি ম্যাচেও সেই চেষ্টা করেছি। কোচকে দেখে বাড়তি কিছু করার চেষ্টা করিনি।”

গ্যাব্রিয়েল-রোচকে আবার সামলাতে প্রস্তুত

ওয়েস্ট ইন্ডিজের দুই পেসার শ্যানন গ্যাব্রিয়েল ও কেমার রোচকে প্রস্তুতি ম্যাচে খুব ভালোভাবে সামাল দেন সাদমান। গতিময় পেসারদের বাউন্সার, শর্ট বল ভোগাতে পারেনি তাকে। অফ স্টাম্পের বাইরের চ্যানেল ধরে করা অসংখ্য বল না খেলে ছাড়েন এই তরুণ।

“গ্যাব্রিয়েল-রোচকে খেলা নিয়ে তেমন কিছু চিন্তা করিনি আমি। আমাদেরও তো অনেক জোরে বল করার মত পেসার আছে। আমি শুধু ভেবেছি যে, নাম নিয়ে চিন্তা করলে হয়তো খারাপ হবে। আমার চিন্তা ছিল যে, শুধু বল আসবে আর আমি খেলব। ছাড়ার মতো হলে ছাড়ব, মারার মতো হলে মারব। এছাড়া আর কিছু চিন্তা করিনি।”

“প্রস্তুতি ম্যাচে ওদের খেলে আমার আত্মবিশ্বাস বেড়েছে। খুব স্বাভাবিকভাবেই তাদের বিপক্ষে ভালো করতে পারলে যে কোনো ব্যাটসম্যানেরই আত্মবিশ্বাস বাড়বে। আমাদের ঘরোয়া ক্রিকেটে এমন পেসার আছে। পার্থক্য কেবল এদের নাম আছে, আমাদের ওদের নেই। আমি স্বাভাবিক ব্যাটিং করেছি, হয়ে গেছে। আমার পরিকল্পনা ছিল বলে চোখ রেখে খেলার, সেই পরিকল্পনাতে আমি সফল হয়েছি।”

এবার নতুন স্বপ্ন ছোঁয়ার তাড়না

জাতীয় দলে ডাক পেয়ে পূরণ হয়েছে একটি লক্ষ্য। এবার তার লক্ষ্য আরও বড়। একবার সুযোগ পেলে জাতীয় দলে জায়গা পাকা করা। চট্টগ্রাম টেস্টের দলে আছেন আরও দুই ওপেনার- ইমরুল কায়েস ও সৌম্য সরকার। অভিষেকের সুযোগ এবার হবে কি না, নিশ্চিত নন সাদমান। তবে নিজেকে প্রস্তুত রাখতে চান যে কোনো পরিস্থিতির জন্য।

“আমি তো অবশ্যই নিজেকে তৈরি করে রাখব। সুযোগ যদি আসে তাহলে সবসময় যেভাবে খেলে আসছি সেভাবেই খেলব। কিভাবে নিজেকে গুছিয়ে নিতে হবে, পারফর্ম করতে হবে এবং কিভাবে বড় রান করা যায়, তার প্রক্রিয়া ঠিক রাখতে হবে। অন্য সময় নিজেকে যেভাবে প্রস্তুত করি এবারও সেভাবেই প্রস্তুত হচ্ছি।”

“আমি আমার মতো করে চেষ্টা করে গেছি আর ভেবেছি কোনো একদিন সুযোগ আসবে। আমার বিশ্বাস ছিল, পারফর্ম করে গেলে সুযোগ আসবেই। আমি সব সময় চেষ্টা করি লম্বা সময় ধরে ব্যাটিং করার। বড় দৈর্ঘ্যের ক্রিকেটের জন্য বাড়তি যে পরিশ্রম দরকার সেটিও আমি করি।”

ওয়েস্ট ইন্ডিজের মতো দলের বিপক্ষে ডাক পাওয়ায় কোনো চাপ অনুভব করছেন না সাদমান। তবে নির্বাচকদের আস্থার প্রতিদান দেওয়ার একটা তাগিদ ভেতরে অনুভব করছেন তিনি। 

“কোন চাপ অনুভব করছি না। সুযোগ পেয়েছি, এবার নিজেকে প্রমাণ করতে হবে। পারফরম্যান্স করেছি বলে নির্বাচকরা সুযোগ দিয়েছেন। এখন আমাকে কিছু তো করে দেখাতে হবেই। সুযোগ পেলে আমি মনে রাখার মতোই কিছু করতে চাই। এত দিন কষ্ট করেছি, এই কষ্টের ফল পাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করব। এর বাইরে কিছু ভাবছি না।”

“সবার স্বপ্ন থাকে জাতীয় দলে খেলার। সেই স্বপ্ন এখনও আমার পূরণ হয়নি। হলে এই অর্জন আমাদের পরিবারের জন্য অনেক বড় অর্জন হবে। আমি সেটা করতে চাই, একজন টেস্ট খেলোয়াড় হতে চাই। হুট করে এসে হুট করে চলে যেতে চাই না। জাতীয় দলে নিয়মিত হওয়ার জন্য পারফরম্যান্স করতে চাই। আমার পায়ের নিচের মাটি যেন শক্ত থাকে, এমন কিছু করেই সুযোগটা কাজে লাগাতে চাই। এখনই এত খুশি হয়ে লাভ নেই, সুযোগ পাওয়ার পর পারফরম্যান্স করে খুশিটা বাড়িয়ে নিতে চাই।”