এক পেসারের তিমিরেই বাংলাদেশ

দীর্ঘদেহী পেসার চাই। গতিময় পেসার চাই। পেস বোলিং নিয়ে দৃষ্টিভঙ্গিতে বদল চাই। গত কিছুদিনে বারবার এই কথাগুলো উচ্চারিত হয়েছে বাংলাদেশ কোচ স্টিভ রোডসের কণ্ঠে। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে স্কোয়াডে রাখা হলো চার জন পেসার। হাওয়ায় শোনা যাচ্ছিল মনোভাব পরিবর্তনের সুর। কিন্তু সব আয়োজনের পর প্রসব হলো অশ্বডিম্ব। আবারও বাংলাদেশের একাদশে এক পেসার!

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 Nov 2018, 01:53 PM
Updated : 3 Nov 2018, 03:36 PM

জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সিলেট টেস্টে বাংলাদেশ একাদশ সাজিয়েছে একজন বিশেষজ্ঞ পেসার ও তিন স্পিনার নিয়ে। চার বোলার আর মাত্র এক পেসার নিয়ে খেলার সিদ্ধান্ত আবারও জাগিয়ে তুলেছে পুরোনো প্রসঙ্গ। টেস্টে বাংলাদেশের রক্ষণশীল মনোভাব ও পেস বোলিং নিয়ে দৃষ্টিভঙ্গি।

একাধিক পেসার নিয়েই খেলতে হবে, এমন কথা অবশ্যই নেই। বিশেষ করে গত বছর দুয়েক দেশের মাটিতে টেস্টে এমন কিছু উইকেটে খেলেছে বাংলাদেশ, যেখানে এক পেসারকেও কখনও কখনও মনে হয়েছে বাহুল্য। তবে সিলেটের এই উইকেট ইংল্যান্ড কিংবা অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টেস্টের মতো অতটা টার্নিং, অতটা নিচু বাউন্সের উইকেট নয়। স্কিল থাকলে পেসাররা এই ২২ গজে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করতে পারেন। একাদশের একমাত্র পেসারের বোলিংয়ে এটি ফুটে উঠেছে আরও স্পষ্ট হয়ে।

বোলিং ফিগার দেখে হয়তো খুব আন্দাজ করা যাচ্ছে না, কিন্তু দিন জুড়েই দারুণ বোলিং করেছেন আবু জায়েদ চৌধুরী। সুইং করিয়েছেন দুই দিকেই। মাঝেমধ্যে বাউন্সারে নাড়িয়ে দিয়েছেন। বেশ কয়েকবারই অস্বস্তিতে ফেলেছেন জিম্বাবুয়ের ব্যাটসম্যানদের। আরেকজন পেসার থাকলে নিশ্চিতভাবেই চাপটা ধরে রাখা যেত আরও প্রবলভাবে।

টিম ম্যানেজমেন্টের হাতে বিকল্পও ছিল যথেষ্ট। টেস্টের আগে প্রতিদিনের অনুশীলনে দুর্দান্ত বোলিং করেছেন শফিউল ইসলাম। নেটে কিংবা সেন্টার উইকেটের অনুশীলনে, লিটন-মুশফিকদের ভুগিয়েছেন অনেক।

চোটপ্রবণ মুস্তাফিজুর রহমানকে ২০১৯ বিশ্বকাপের আগে টেস্ট খেলানো উচিত কিনা, চলমান সেই প্রশ্নের স্রোতের প্রতিকূলেই তাকে রাখা হয় টেস্ট স্কোয়াডে। স্কোয়াডে রাখা মানে ম্যাচেও খেলানো হবে, এটি ইঙ্গিত পাওয়া ছিল স্বাভাবিক। এই উইকেটে তার কাটার, তার বৈচিত্র বেশ কার্যকরও হতে পারত।

এই দুইজনের একজনও পরিকল্পনায় ঠাঁই না হলে সৈয়দ খালেদ আহমেদ তো ছিলেনই। এই মাঠে অনেক ম্যাচ খেলার অভিজ্ঞতা আছে তার। কোচের চাওয়া মতোই দীর্ঘদেহী পেসার, বাংলাদেশের বাস্তবতায় গতি খারাপ নয়। পিচে বল ঠোকেন বেশ জোরে। এই উইকেটেও হয়তো প্রাণ প্রতিষ্ঠা করতে পারতেন। কিন্তু সেই সুযোগই পেলেন না। খালেদ, মুস্তাফিজ, শফিউলরা এই টেস্টে কেবলই দর্শক।

সময়ের সঙ্গে উইকেট আরও মন্থর হবে। তৃতীয় দিন থেকে টার্নও করার কথা বেশ। জিম্বাবুয়ে স্পিনে বরাবরের দুর্বল। সবকিছু বিবেচনায়ও তিন স্পিনার নিয়ে প্রশ্ন খুব একটা নেই। একজন ব্যাটসম্যানের বদলে আরেকজন পেসার না রাখার সিদ্ধান্তই বিস্ময়কর। জিম্বাবুয়ের মতো দলের বিপক্ষেও দেশের মাটিতে একজন বাড়তি ব্যাটসম্যান খেলানোর সিদ্ধান্তে ফুটে ওঠে দলের শঙ্কার জায়গাটি। হয়তো আগ্রাসী খেলে জয় কিংবা দাপুটে জয়ের ভাবনার চেয়ে হার এড়ানোর মানসিকতাই দলে কাজ করেছে বেশি।

আরিফুল হককে বেছে নেওয়ায় এই মানসিকতার ভূমিকাই ছিল বেশি, এটি বলে দেওয়ায় খুব একটা ঝুঁকি নেই। এমনিতে ঘরোয়া ক্রিকেটে বড় দৈর্ঘ্যের ম্যাচেই তার ব্যাটিং রেকর্ড সবচেয়ে ভালো। কিন্তু যদি বোলিংয়ের ভাবনাকে দেওয়া হয় প্রাধান্য, গোলমালটা সেখানেই। বোলিং কখনোই তার শক্তির জায়গা নয়। মূলত তিনি ব্যাটসম্যান, যিনি খানিকটা বোলিং পারেন। সাত নম্বরে তাকে খেলানো মানে সেটি দলের আত্মরক্ষার কবচ। যদি বিপর্যয় নামে ব্যাটিংয়ে! অথচ জিম্বাবুয়ের সঙ্গে এমন একজনের জায়গা হওয়া উচিত ছিল, মূলত যিনি বোলার।

একাদশ নির্বাচনে কোচের কতটুকু ভূমিকা ছিল, সেটি বলা মুশকিল। তবে গত কিছুদিনে তার বলা কথা বা ভাবনার প্রতিফলন পড়েনি এই ম্যাচের একাদশে। টেস্ট শুরুর একদিন আগেও জোর গলায় বলেছিলেন, দেশের বাইরে ভালো করতে হলে, বিদেশে পেসারদের কাছ থেকে ভালো পেতে হলে, দেশের মাটিতে তাদের উৎসাহ জোগাতে হবে। এই টেস্টের একাদশে অন্তত সেই অনুপ্রেরণা জোগানোর প্রমাণ নেই।

সিদ্ধান্তের পেছনে দলের যুক্তিও জানা যায়নি। দিনশেষে দলের প্রতিনিধি সংবাদ সম্মেলনে এলেন আবু জায়েদ। এক পেসারের প্রসঙ্গে তিনি বারবারই বিব্রত হলেন। সেটিই স্বাভাবিক। দলের নবীন সদস্য তিনি, টিম ম্যানেজমেন্টের অংশও নন। বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নিয়ে তার মুখ খোলা মানে বিপদকে আমন্ত্রণ জানানো। তিনি তাই বারবার এড়িয়ে গেলেন ‘ম্যানেজমেন্টের ব্যাপার, তারা ভালো জানে’, এসব কথা বলে।

বারংবার প্রশ্নে অবশ্য সিলেটের উইকেটের বদলে যাওয়া চরিত্রের কথা তুলে ধরলেন আবু জায়েদ। সিলেটের সন্তান তিনি। এই মাঠে খেলেছেন অনেকবার। সাম্প্রতিক সময়ে উইকেট দ্বিধায় ফেলে দেয় তাকেও।

“ম্যানেজমেন্ট হয়তো বুঝতে পেরেছে যে এই উইকেটে পেস বোলিং ভালো হবে না। বেশি কিছুদিন ধরেই সিলেটের উইকেট আমাদের দ্বিধায় ফেলে দিচ্ছে যে কি হবে না হবে। ২০১৩-১৪ সময়টাতে উইকেট অনেক বাউন্সি ছিল। কিন্তু গত বছর দুয়েক ধরে এমন হয়ে গেছে। এবার জাতীয় লিগে আমরা তিন পেসার নিয়ে খেলেছি, দুই পেসার সাত-সাত করে চৌদ্দ ওভার বল করেছে। তো টিম ম্যানেজমেন্ট যা ভালো মনে করেছে, সেটিই করেছে।”

নিজের জায়গা থেকে আবু জায়েদের হয়তো এরকম বলা ছাড়া উপায় ছিল না। কিন্তু আসলেই যে স্কিল থাকলে পেসারদের কত কিছু করা সম্ভব, সেটির বড় প্রমাণ তো তার বোলিংই!

ম্যানেজমেন্টের ভাবনাটা আনুষ্ঠানিকভাবে জানা না গেলেও অনুমান করে নিতে কষ্ট হয় না। প্রথমবার তো নয়, বছরের পর বছর এমনটা হয়ে আসছে। দলের ভাবনা রয়ে গেছে সেই তিমিরেই। নতুন করে তাই অবাক হয়ত করছে না। তবু জিম্বাবুয়ে বলেই আক্ষেপটা জাগছে তীব্র হয়ে। এই দলের বিপক্ষেও যদি আরেকটু সাহস না দেখায় টিম ম্যানেজমেন্ট, যদি আস্থার হাত না রাখে পেসারদের কাঁধে, যদি আরেকটু রোমাঞ্চ পিয়াসী না হয়, তাহলে আর কবে!