উদ্ভাসিত সেঞ্চুরিতে ইমরুলের বার্তা

‘ইমরুল কায়েস শো’ তখন শেষ। কিন্তু শেষ হচ্ছিল না রেশ। প্রায় ১৮ হাজার দর্শকে ভরা গ্যালারি দাঁড়িয়ে জানাচ্ছে অভিবাদন। ড্রেসিং রুমে, ডাগ আউটে সতীর্থদের তালি শেষই হচ্ছিল না। মাঠের নানা প্রান্ত থেকে ছুটে এলেন জিম্বাবুয়ের ফিল্ডাররা। চলল অভিনন্দনের পালা। ইনিংসটিই এমন, মন্ত্রমুগ্ধ চারপাশ। মোহাবিষ্ট প্রতিপক্ষও।

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 Oct 2018, 03:03 PM
Updated : 21 Oct 2018, 08:24 PM

১৪০ বলে ১৪৪, ১৩ চার ও ৬ ছক্কা। সংখ্যাগুলোয় ফুটে উঠছে দাপট, তবে বোঝাতে পারছে না গল্পের পুরোটা। শুরুতে আস্থা হয়ে থাকা, বিপর্যয় থেকে টেনে তোলা, শেষ দিকে ঝড়, ইমরুলের ব্যাট এ দিন মিটিয়েছে সবকিছুর দাবি। ম্যাচের প্রেক্ষাপটে মহামূল্য ইনিংস। ভবিষ্যতের পথচলায় গুরুত্বপূর্ণ, তার ক্যারিয়ারের জন্য যেমন, তেমনি দলের জন্যও। ইনিংসটা দিয়েছে স্বস্তি, দিয়েছে বার্তা।

এশিয়া কাপ ফাইনালে লিটন দাসের অসাধারণ সেঞ্চুরিটি যেমন বাংলাদেশ ক্রিকেটে এসেছিল স্বস্তির একটি বার্তা হয়ে। তামিম ইকবালের সঙ্গী খুঁজে ফেরার দীর্ঘ অনুসন্ধান শেষ হওয়ার একটি প্রাথমিক ইঙ্গিত ছিল সেই ইনিংস। লিটন সত্যিই জায়গা পাকা করতে পারবেন না কিনা, সেটি বলে দেবে সময়। আপাতত লড়াইয়ে নতুন মাত্রা যোগ করলেন ইমরুল।

তামিমের উদ্বোধনী জুটির সঙ্গী ছিলেন তিনি দীর্ঘদিন। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে প্রথম ওয়ানডের অসাধারণ ইনিংসে জানিয়ে দিলেন, জায়গাটি আবার নিজের করে নিতে প্রস্তুত তিনিও।

তামিমের সঙ্গী হওয়ার লড়াই যদি সত্যিই জমিয়ে তুলতে পারেন লিটন ও ইমরুল, বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্য সেটি হবে বড় সুখবর। তামিম যখন ফিরবেন, শুধু থিতু একজন সঙ্গীই পাবেন না, প্রস্তুত থাকবে বিকল্পও।

ইমরুলের পোড় খাওয়া আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের জন্যও এই ইনিংস হতে পারে উজ্জীবনী কিছু। তার চড়াই-উৎরাইয়ে ভরা ক্যারিয়ারের নতুন অধ্যায় শুরু হয়েছে গত এশিয়া কাপ থেকে। টুর্নামেন্টের মাঝপথে ডেকে নেওয়া হয়েছিল জরুরিভাবে। যাওয়ার পরই আফগানিস্তানের স্পিন সামলানোর চ্যালেঞ্জ নিয়ে ব্যাটিংয়ে পাঠানো হয়েছিল নতুন পজিশনে। ক্যারিয়ারে প্রথমবার ছয়ে ব্যাট করে ইমরুল খেললেন অপরাজিত ৭২ রানের ইনিংস, দলকে যা গড়ে দিল জয়ের ভিত্তি। তার ক্যারিয়ার পেল নতুন প্রাণ।

পরের ম্যাচ ছয়ে খেলে ফাইনালে ব্যাট করলেন তিন নম্বরে। খুব বেশি ভালো করতে পারেননি এই দুই ইনিংসে। তবে আফগানদের বিপক্ষে ইনিংসটিই দলে তার জায়গা টিকিয়ে রাখে এই জিম্বাবুয়ে সিরিজে।

প্রথম ওয়ানডেতে অবশ্য তার খেলা নিশ্চিত ছিল না। এশিয়া কাপ ফাইনালের পর লিটনের ওপেন করা নিশ্চিতই ছিল। ওপেনিংয়ে আরেকটি জায়গায় খেলতে পারতেন নাজমুল হোসেন শান্তও। এই তরুণ প্রতিভাবান ক্রিকেটারের আত্মবিশ্বাস ফেরানোর বড় মঞ্চ হতে পারত এই সিরিজ। কিন্তু সামনে বিশ্বকাপের দিকে চোখ রেখেই হোক বা অন্য কোনো কারণে, দল ভরসা রাখে ইমরুলের অভিজ্ঞ ব্যাটে। আবার ফিরে পান নিজের প্রিয় জায়গা, ওপেনিং।

এশিয়া কাপের ইনিংসটি তার ক্যারিয়ারে নতুন দম দিয়েছে বটে, তবে দীর্ঘমেয়াদের পথচলায় মিডল অর্ডার তো ইমরুলের জায়গা নয় কখনোই। দল তাকে তাই সুযোগ দিয়েছে আপন জায়গায় মেলে ধরার। প্রথম সুযোগটিই কাজে লাগালেন দারুণভাবে।

এই ম্যাচের প্রেক্ষাপটে ১৪৪ রানের ইনিংসটি ছিল আদর্শ এক ইনিংস। ছিল সবকিছুই। যখন উইকেট আগলে রেখেছেন, কখনোই খুব মন্থর হতে দেননি রানের গতি। প্রান্ত বদল করেছেন, বাজে বল পেলে বুঝিয়ে দিয়েছেন প্রাপ্য। দলকে শক্ত ভিতে দাঁড় করানোর পর শেষ দিকে তুলেছেন ঝড়।

তার শরীরী ভাষা, ব্যাটিংয়ে আরেকটু অভিপ্রায়ের ছাপ রাখা, এসব প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে নানা সময়ে। এ দিন তার ব্যাট দিয়েছে শুধু উত্তর। নিজেকে চিনিয়েছেন নতুনভাবে। ক্যারিয়ারে অনেকবারই তিনি এক প্রান্ত আগলে রেখেছেন। কিন্তু শেষ করতে পারেননি কাজ। অনেকবারই দারুণ শুরু করেছেন। বড় করতে পারেননি ইনিংস। অনেকবারই দলকে আশা দেখিয়েছেন। পূরণ করতে পারেননি পুরোটা। এই ইনিংসে সবকিছু মিলিয়েছেন এক বিন্দুতে।

নিজের প্রিয় শটগুলো যেমন খেলেছেন, ইনিংসটির পথে উদ্ভাবনী কিছু শটও দেখিয়েছেন ইমরুল। পেসারকে মাথার ওপর দিয়ে যেমন উড়িয়েছেন, তেমনি শাফল করে সুইপের মতো খেলে পাঠিয়েছেন বাউন্ডারিতে, জায়গা বানিয়ে গুলির বেগে চার মেরেছেন এক্সট্রা কাভার দিয়ে। স্পিনারদের স্লগ সুইপে উড়িয়েছেন, আবার রিভার্স সুইপে গুঁড়িয়েছেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, মাঝপথে ফিরে আসেননি। খেলেছেন ওয়ানডে ক্রিকেটে বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ইনিংস।

জাতীয় নির্বাচক, টিম ম্যানেজমেন্ট বা দল সংশ্লিষ্টদের কারও যদি তাকে নিয়ে কোনো রক্ষণশীল মনোভাব বা অস্বস্তি থাকে, এই ইনিংস নিশ্চিতভাবে দূর করবে সেসব। দল তার ওপর রাখতে পারবে আরও ভরসা। শুধু সঙ্গ দেওয়া নয়, ইমরুল হতে পারেন নায়ক। জয় করতে পারেন উপলক্ষ্য।

তিনি নিজেও সামর্থ্যের সীমানাটা জানবেন নতুন করে। আত্মবিশ্বাস স্পর্শ করতে পারে চূড়া। সাহস পাবেন আরও বড় স্বপ্ন দেখার, আরও উচ্চতায় ওঠার। ইমরুলের দোদুল্যমান ক্যারিয়ারকে থিতু করে আলোকিত অধ্যায়ে নিতে পারে এই ইনিংস।