অতি আবেগ নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করছি: মুশফিক

বিপর্যয়ে তার ব্যাট দলের ত্রাতা হয়েছে অনেকবার। এমন মানসিক জোরের অধিকারী ব্যাটসম্যানই আবার বেশ কয়েকবার শেষ সময়ে তীরে ভেড়াতে পারেননি তরী। মুশফিকুর রহিমের মনোজগৎ তাই কৌতুহল জাগায় বরাবরই। বাংলাদেশের ক্রিকেটকে পরের স্তরে নিয়ে যাওয়ার অন্যতম নায়ক তিনি, আবার সমালোচনার শূলে বিদ্ধ হতে হয়েছে অনেকবার। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশের সফলতম টেস্ট অধিনায়ক কথা বললেন তার ক্রিকেট, তার মনোজগৎ, সাফল্য-ব্যর্থতার নানা অধ্যায় নিয়ে।

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 Oct 2018, 04:35 PM
Updated : 14 Oct 2018, 05:27 PM

পাঁজরের চোটের কি অবস্থা?

মুশফিকুর রহিম: আগের চেয়ে অনেক ভালো। ৯০-৯৫ শতাংশ রিকভারি হয়ে গেছে। কাল-পরশু আরেকটা স্ক্যান করাতে হবে স্রেফ দেখার জন্য যে পুরোপুরি সেরে উঠেছে কিনা। এমনিতে রানিং, জিম, ব্যাটিং, এসবে সমস্যা তেমন হচ্ছে না। কিপিং শুরু করব কালকে থেকে। তার পর দেখা যাক কেমন অনুভব করি।

এরপরও আরেকটু সময় নেওয়া যেত কিনা, জিম্বাবুয়ে সিরিজ খেলা কি জরুরি খুব?

মুশফিক: (একটু ভেবে) দেখুন, সামনে অনেক খেলা আছে বটে। তবে আমি সব সিরিজে ফিট থাকতে পারব কিনা, সেটার নিশ্চয়তা কিন্তু নেই। এই সিরিজে না খেলে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজ খেললাম, দেখা গেল প্রথম ম্যাচেই ইনজুরড হয়ে গেলাম। ইনজুরির কথা কেউ বলতে পারে না। যেহেতু সব করতে পারছি, খেলতে সমস্যা দেখি না। এমন নয় যে আমি ৪০-৫০ ভাগ ফিট। এখন যে অবস্থায় আছি, তাতে আমি খুব ভালো বোধ করছি।

অনেকে বলতে পারেন, সামনে বিশ্বকাপ, নিজেকে বাঁচিয়ে খেলতে। কিন্তু আমি সবসময় বর্তমানে থাকতে পছন্দ করি। বিশ্বকাপ পর্যন্ত বাঁচি কিনা কে জানে! কিংবা যে কোনো সময় সিরিয়াস ইনজুরি হতে পারে। সুপার ফিট একজনেরও যে কোনো সময় বাজে ইনজুরি হতে পারে। ওসব নিয়ে ভেবে লাভ নেই। মূল ব্যাপার হলো, আমি কোন অবস্থায় আছি। আপাতত আমি ঝুঁকি দেখছি না।

আর সত্যি বলতে, আমি চাচ্ছি না বড় কোনো বিরতি পড়ুক। তাহলে ছন্দটা নষ্ট হয়ে যেতে পারে। ছন্দটা ধরে রাখতে চাই।

এশিয়া কাপের ম্যাচগুলো তো ঝুঁকি নিয়েই খেলেছিলেন?

মুশফিক: প্রথম ম্যাচের আগের দিন আমি ৩০ ভাগ ফিটও ছিলাম না। চোটটা পেয়েছিলাম ১২ সেপ্টেম্বর, প্র্যাকটিসে ডাইভ দিয়ে হাতের কবজির হাড় লাগে পাঁজরে। তার পর থেকে ব্যথা আস্তে আস্তে বাড়ছিল। তবে ম্যাচের আগের দিন যে এতটা তীব্র হবে ব্যথা, সেটা ভাবতে পারিনি।

সেদিন প্র্যাকটিসে নেটে আমি ব্যাট ধরে দাঁড়াতে পারছিলাম না। ফিজিওকে বলার পর এক্সরে করা হয় তাৎক্ষনিক, দেখা যায় চিড় আছে। ব্যাট হাতে নিয়ে আমি পুশ করতেই পারছিলাম না। রাতটা খুব হতাশায় কেটেছে। এত দারুণ প্রস্তুতি ছিল আমার, এত কষ্ট করেছি, তার পর খেলতে না পারা বড় একটা ধাক্কা ছিল আমার জন্য। মানতে কষ্ট হচ্ছিল।

সকালে উঠে একটু ভালো বোধ করলাম। ব্যথা ছিল। তবে যেসব ফিজিও পেইনকিলার দিয়েছিল, সেসব ভালো কাজ করেছিল। ম্যাচের বেশ আগে, ১২টার দিকে মাঠে চলে যাই দেখতে যে ব্যাটিং করলে কেমন লাগে। ব্যথা লাগছিল তখনও। তবে মনে হলো যে হয়ত ডাইভ দেওয়া ছাড়া বাকি সব ম্যানেজ করা সম্ভব।

সত্যি বলতে ৩৫-৪০ শতাংশও হয়তো ফিট ছিলাম না, তবু খেলতে চেয়েছি। কারণ প্রথম ম্যাচটা আমাদের জন্য খুব জরুরি ছিল সুপার ফোরে উঠতে। সাকিব ইনজুরি নিয়ে খেলছিল, তামিম খেলছিল। আমার মনে হলো, দলের এমন প্রয়োজনের ম্যাচে আমি কেন পারব না!

একটা ঝুঁকি নিয়েছিলাম। কারণ ওই ম্যাচ হারলে আমাদের কাজটা কঠিন হয়ে যেত। আর ভেবেছি, ম্যাচটা পার করে দিতে পারলে পরের ম্যাচ চারদিন পর, বিশ্রাম পাব। আল্লাহর রহমতে সব খুব ভালোভাবে হয়েছিল সেদিন।

পরের ম্যাচগুলোতে অবস্থা এতটা খারাপ ছিল না। শতভাগ ছিলাম না অবশ্যই। তবে চেষ্টা করেছি কষ্ট করে হলেও দেশের জন্য কিছু করার।

গত বছর নিউ জিল্যান্ডে ওয়েলিংটনে টেস্টে আপনার হেলমেটে বল লাগল। মাঠ থেকে অ্যাম্বুলেন্সে করে হাসপাতালে নেওয়া হলো, বেশ ভীতি জাগানিয়া অবস্থা। অথচ আপনি হাসপাতালে একটু ধাতস্ত হওয়ার পরই ডাক্তারকে বলেছিলেন যে ব্যাটিং করতে চান!

মুশফিক: তখন মনে হয় লাঞ্চ বা লাঞ্চের পরপর ছিল। আমি ডাক্তারকে বলেছিলাম যে এরকম করা যায় কিনা। ওরা শুনে অবাক হয়েছিল। মাথায় চোটের ক্ষেত্রে নরম্যালি ৪৮ ঘণ্টা পর্যবেক্ষণে থাকতে হয়। এর পর আরেকটি পরীক্ষা করে তার পর কিছু না পেলে ক্লিয়ারেন্স দেওয়া হয়।

(টিম সাউদির) বলটা যখন হেলমেটে লেগেছিল, তখন আমার মাথা ঘুরছিল। মনে হচ্ছিল বমি হয়ে যাবে। মাথায় আঘাতের ক্ষেত্রে বমি হওয়া খারাপ। সত্যি বলতে জীবনে সেই প্রথম, ক্রিকেট মাঠে ভয় পেয়েছিলাম। হাসপাতালে যাওয়ার পর ডাক্তার এটাই জিজ্ঞেস করেছিলেন যে মাথা ঘুরছে কিনা ও বমি বমি ভাব কিনা। দুটিই ছিল আমার। তবে পরে আল্লাহর রহমতে বমি হয়নি। পরীক্ষা করে বাজে কিছু ধরা পড়েনি।

এই যে চোটকে পাত্তা না দেওয়া, এটা কি জেদ থেকে আসে, নাকি মানসিক শক্তি?

মুশফিক: জানি না। ভাবিও না। আমি স্রেফ চেষ্টা করি শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত কিছু করার। ক্রিকেট এমন একটা খেলা, শারীরিকভাবে খুব ফিট বা মানসিক ভাবে দারুণ শক্ত থাকার পরও অনেক সময় আপনি খারাপ করবেন। খুব বাজে সময় আসবে। দারুণ ফিট, দারুণ ফর্মে থাকার পরও প্রথম বলে আউট হতে পারেন। আমি তাই আমার হাতে থাকা প্রতিটি সুযোগই কাজে লাগাতে চাই। অনেক সময় দেখা যায়, এ রকম খারাপ অবস্থায় বাড়তি কিছু করার অনুপ্রেরণা কাজ করে। কিছু করে দেখানোর তাগিদ থেকে ভালো পারফরম্যান্স বের হয়ে আসে।

আমি কিন্তু একদম শুরু থেকেই চেষ্টা করেছি ব্যাপারগুলো নিজের ভেতরে গড়ে তোলার। সেটা করতে করতে এখন ব্যাপারটা ন্যাচারাল হয়ে গেছে। ভেতর থেকেই আসে।

এই যে বারবার দলকে বিপর্যয় থেকে উদ্ধার করা, ম্যাচের মোড় বদলে দেওয়া একেকটি ইনিংস খেলা, এটা তো স্কিল আর মানসিক জোরের ব্যাপার?

মুশফিক: অবশ্যই দুটিই থাকতে হবে। ক্রিকেট তো মানসিক জোরের খেলা। আবার শুধু সাহস থাকলেই হবে না। সেটাকে সাপোর্ট দেওয়ার মতো স্কিলও থাকতে হবে। স্কিলটা মাঠে বাস্তবায়ন করেও দেখাতে হয়।

আমার কাছে ব্যাপারটা সিম্পল। এই পরিস্থিতিগুলো আমার জন্য চ্যালেঞ্জিং, আর মাঠে যে কোনো চ্যালেঞ্জই আমি জিততে চাই। এই ধরনের চ্যালেঞ্জ জিতলে ভেতরে ভালো লাগা কাজ করে। পরের চ্যালেঞ্জের জন্য আরও অনুপ্রেরণা পাওয়া যায়।

এর উল্টোটাও আবার দেখা গেছে। বিপর্যয়ের মধ্যে এতবার ভালো খেলা বলে দেয় আপনার মানসিক জোর প্রবল। তো শেষ দিকে যখন রান-বলের টানাপোড়েন, রোমাঞ্চকর কোনো জয়ের হাতছানি, তখন আপনারই সবচেয়ে ভালো পারার কথা। কিন্তু বেশ কবারই আপনি শেষ করতে পারেননি। এটা কি চাপে ভেঙে পড়া নাকি স্রেফ ক্রিকেটীয় ব্যাপার?

মুশফিক: দেখুন, এজন্যই তো আমি মানুষ। মানুষ ভুল করবে, এটাই স্বাভাবিক। যে মুহূর্তগুলোর কথা বললেন, সেসব কিন্তু খুব সহজ নয়। আমি ব্যাপারটিকে দেখি কতবার পারলাম বা পারলাম না। ১০ বারের মধ্যে হয়ত ২-৩ বার পারিনি। বেশির ভাগ সময়ই পেরেছি, বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে।

গড়ে আমি কতবার সফল হচ্ছি, সেটাই আমার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। অবশ্যই চাওয়া থাকে সব সময় সফল হওয়ার। অপরাজিত থেকে ম্যাচ শেষ করে আসতে পারলে কার না ভালো লাগে! এমনকি নিজের রেকর্ডেরও জন্যও তো ভালো, গড় ভালো হয়, কৃতিত্ব পাওয়া যায়। কিন্তু ১০ বারের মধ্যে ১০ বারই পারা অসম্ভব, কেউই পারবে না। ৭০-৮০ ভাগ সময় পারলেই আমি মনে করি দারুণ।

হ্যাঁ, অনেক সময় হয়ত আমি আরেকটু কুল থাকতে পারতাম, যেটা হয়নি। যেটা হয় যে, আমি যেভাবে খেলতে থাকি, সেই একই গতিতে ছুটতে থাকায় হয়তো আউট হয়ে যাই। ওই সময় আরেকটু মাথা ঠাণ্ডা রাখতে পারলে হয়ত ভালো হয়।

ওই সময়ে আসলে কি চলে একজন ব্যাটসম্যানের মাথার ভেতর?

মুশফিক: সবার কথা তো বলতে পারব না, নিজের কথা বলি। আমার ক্ষেত্রে অনেক সময়ই দেখা গেছে অন্য প্রান্তে নতুন ব্যাটসম্যান। নতুন কাউকে স্ট্রাইক দিলে দেখা যায় একটা-দুইটা বল ডট খেললেও তখন চাপ বেড়ে যায়। আমি চেষ্টা করি সেই চাপটা নিজে নিয়ে নিতে, রান বেশির ভাগটা নিজে করতে, অন্য প্রান্তের ব্যাটসম্যানকে খোলা মনে খেলতে দিতে। সেই ঝুঁকি নিতে গিয়ে অনেক সময় হয়ত আউট হয়ে গেছি।

চাইলে অনায়াসেই অন্য প্রান্তের ব্যাটসম্যানকে স্ট্রাইক দিয়ে দায়িত্ব দিতে পারি। কিন্তু আমি আসলে সেটা চাই না। সেট ব্যাটসম্যান হিসেবে নিজেই দায়িত্ব নিতে চাই। সেটা করতে গিয়ে যখন শেষ করতে পারি না, তখনই কথা হয়।

একটা উদাহরণ দেই, গত ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে দ্বিতীয় ওয়ানডে। ৬ বলে ৮ রান তো কোনো ব্যাপার না। কিন্তু তখনই সাব্বির আউট হলো, মোসাদ্দেক নতুন ব্যাটসম্যান। সিঙ্গেল নিয়ে হয়ত মোসাদ্দেককে স্ট্রাইক দিতে পারতাম। কিন্তু সেই চাপ ওকে দিতে চাইনি। চেয়েছি দুই বা চার নিতে। প্রথম বলেই ফুল টস পেয়ে চেষ্টা করেছি কাজে লাগাতে। ছক্কা মারারই বল ছিল; হয়নি। এ রকমই, কখনও সফল হই, কখনই হই না।

আগে এভাবে আউট হওয়ার ঘটনাগুলো কি মাথায় থাকে? যেমন ২০১৬ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ভারতের বিপক্ষে শর্ট বলে আউট, গত চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে কেদার যাদবের ফুল টসে। এবার ফাইনালেও কেদারের শর্ট বলে আউট হলেন। আলগা বল বা পার্ট টাইমার পেলে কি একটু রিল্যাক্স ভাব চলে আসে, কিংবা মনে হয় যে একটা শিক্ষা দেই!

মুশফিক: দুটির কোনোটিই না আসলে। রিল্যাক্স থাকার প্রশ্নই আসে না। বরং পার্ট টাইমার এলে আমি বাড়তি সতর্ক থাকি যেন উইকেট না পায় সে। তবে এটাও তো মাথায় রাখতে হবে যেন পার্ট টাইমার চেপে না বসে। রানও করতে হবে তাদের বলে।

এবার কেদার যাদবের বলটা মারারই ছিল। আমি আসলে এতটা দূরে মারতে চাইনি। মিড উইকেটে বড় গ্যাপ ছিল, চেয়েছিলাম সেখান দিয়ে চার মারতে। ছক্কা মারতে চাইনি। বলটা পড়ে একটু দেরিতে এসেছে, এ জন্যই ব্যাটের নিচের দিকে লেগেছে।

শিক্ষার কথা বললে, শিক্ষা সবাইকে দিতে ইচ্ছে করে। সব বোলারকেই। কিন্তু আমি জানি সেই স্কিল আমার নেই। ব্যাটসম্যানদের আউট হতে এক বলই লাগে, সেটা আমার মাথায় থাকে।

৯৯ রানে আউট হলাম, অনেকেই মনে করে রিল্যাক্স হয়ে গিয়েছিলাম। এটা কি হয়? এত কষ্ট করে ৯৯ রান করলাম, ১টা রান করার আগে রিল্যাক্স হব? জান দিয়ে হলেও এক রান করতে চাই। কিন্তু ক্রিকেটে এরকম হয়।

আমরা বলি ব্যাটসম্যানদের জন্য মাথা পরিষ্কার রাখা জরুরি। বলাটা তো সহজ, আসলে কাজটা কতটা কঠিন?

মুশফিক: খুবই কঠিন। পুরো ক্যারিয়ার, গত ৪-৫ বছর, ৪-৫ মাস কিংবা গত কয়েক ঘণ্টা, সবকিছু মিলিয়েই একজন ব্যাটসম্যানের মাথা তৈরি হয়। লোকে তো স্রেফ বলে দেয়, মাথা ঠাণ্ডা করে খেললেই হলো কিংবা ওই জায়গায় ফেললেই হতো। কিন্তু করা এতটা সহজ না। স্কিলের পাশাপাশি ওই ব্যাটসম্যান মানুষ হিসেবে কেমন, ব্যক্তিত্ব কেমন, সেটার প্রভাবও খেলায় পড়ে।

আমি চেষ্টা করি সঠিক সময়ে সঠিক কাজ করার। সবসময় হয়ে ওঠে না। গত ৭-৮ মাসে খেয়াল করলে দেখবেন, আমার সেলিব্রেশন বা কোনো কমেন্ট, এসবে কোনো এক্সপ্লোশন নেই। বিয়ের পর অনেক মাথা ঠাণ্ডা হয়েছে। শুধু ক্রিকেটার নয়, মানুষ হিসেবেও উন্নতির তো শেষ নেই। আমি চেষ্টা করছি। চেষ্টা করছি আবেগ বা অতি আবেগ নিয়ন্ত্রণে আনার।

সাড়ে ১৩ বছরের ক্যারিয়ার। আপন আয়নায় তাকালে নিজেকে কিভাবে দেখেন?

মুশফিক: খুব ভালো না, খুব খারাপও না। মাঝামাঝি। গত কয়েক বছরে যেভাবে এগিয়েছি, সেটা আরও ৪-৫ বছর আগে থেকে শুরু করতে পারলে হয়ত আমার ক্যারিয়ার আরও সমৃদ্ধ থাকত। তবে সব তো চাওয়া মতো হয় না। গত কয়েক বছর যেভাবে গেছে, সেটা যদি সামনেও ধরে রাখতে পারি ৫-৭ বছর, দলে যদি অবদান রাখতে পারি, তাহলেই আমি খুশি থাকব।

ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি?

মুশফিক: ওয়ানডেতে আমরা ছয়ে উঠেছিলাম আইসিসি র‌্যাঙ্কিংয়ে। এটা অনেক বড় প্রাপ্তি। টেস্টে অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড ও শ্রীলঙ্কায় শ্রীলঙ্কাকে হারানো। সেটা ক্রিকেটার হিসেবে বলেন বা সেই সময়ের অধিনায়ক হিসেবে। দল হিসেবে আমাদের বড় অর্জন।

সবই দলের প্রাপ্তি, নিজের কিছু নেই?

মুশফিক: মানুষের ভালোবাসার কথাই বলতে হবে। সবাই তো ক্রিকেটার বা একই ধরনের সেলিব্রেটি হতে পারে না। আমি ব্যাপারটাকে যেভাবে দেখি যে, একজনও যদি ভাবে যে ছেলেটার জন্য মন থেকে দোয়া করি, সেটাই আমার প্রাপ্তি। চাই না কেউ বাজে কিছু বলুক বা বাজে ধারণা নিয়ে থাকুক আমাকে নিয়ে।

জনপ্রিয়তা কি আপনাকে টানে?

মুশফিক: কাকে না টানে? আপনার কি নিজের সুনাম শুনতে ইচ্ছে করে না? মানুষের স্বভাবই এটা। তবে আমি সেই ভাবনায় কাতরও নই। মনে হয় না যে অমুকের মতো হতে হবে। আমি চাই দায়িত্ব পালন করে যেতে। সত্যি বলতে অনেক সময় বেশি বাহবা পেলেও অস্বস্তি লাগে, কেবল দায়িত্বই তো পালন করছি। আল্লাহ সবাইকে সবকিছু দেয় না। আমি যেটুকু দিয়েছেন, সেটার প্রতি সুবিচার করার চেষ্টা করি।

আপনার নিবেদন, আপনার পরিশ্রম এসব নিয়ে অনেক প্রশংসা হয়। একটি ঐচ্ছিক অনুশীলনও মিস দিতে চান না। এটার শুরু কিভাবে?

মুশফিক: দেখুন, আমি তামিম বা সাকিবের মতো প্রতিভাবান না। বাংলাদেশের ইতিহাসে এই দুজনের মতো প্রতিভাবান ক্রিকেটার আর কেউ নেই। আশরাফুল ভাই একদিকে ছিলেন, কিন্তু নিজের প্রতিভা নিজেই নষ্ট করেছেন। প্রতিভাকে ম্যাক্সিমাইজ করার কথা যদি বলেন, সাকিব-তামিম দারুণভাবে করেছে।

আমি ভাই অত প্রতিভাবান না। অনেক আগেই সেটা বুঝেছি। একটা অপশনই আমার সামনে ছিল, কষ্ট করে নিজেকে আরও ভালো করা। কষ্ট করার ইচ্ছা বলেন বা সামর্থ্য, সেটা আল্লাহ আমাকে দিয়েছেন। সেটা শুধু খেলা নয়, পড়াশোনা বা সবদিকেই কষ্ট করতে চাই ও পারি। সৎ ভাবেই চেষ্টা করি। চেষ্টার সঙ্গে কোনো আপোস করি না।  

একা একা কষ্ট করাও কিন্তু কঠিন। আপনি রানিং করে যাচ্ছেন, জিম করছেন, কিন্তু কেউ দেখছে না, তখন নিজেকে অনুপ্রাণিত করা কঠিন। মানসিকভাবে অনেক শক্ত থাকতে হয়। চাইলে ফাঁকি দেওয়া যায়। কিন্তু আমি কখনোই নিজেকে ফাঁকি দিতে চাইনি। আমার ভেতর বোধটা ছিল। আমাদের একজন ফিজিও ছিলেন স্টুয়ার্ট কার্পিনেন। সে আমাকে বলেছিল, “তোমার একা একা কাজ করাটা আমার খুব ভালো লাগে, কারণ এটা ধরে রাখা কঠিন।”

আমি এখনও করে যাচ্ছি। চেষ্টায় কোনো ত্রুটি রাখি না। তার পরও না পারলে বা ব্যর্থ হলে আমার আফসোস থাকে না। সাধনায় কোনো ঘাটতি আমি রাখতে চাই না।

রাহুল দ্রাবিড় একবার এক মৌসুমে অনেক বেশি পরিশ্রম করেছিলেন, নিজেকে যতটা নিংড়ে বের করা যায়। কিন্তু সেই মৌসুমে তার পারফরম্যান্স ভালো হয়নি। পরে বলেছিলেন, একজনের কতটুকু পরিশ্রম করা উচিত, সেই সীমা জানাও জরুরি। পরিশ্রম ও বিশ্রামের ব্যালান্স জরুরি। আপনার কখনও এমন মনে হয়েছে?

মুশফিক: দুটি পথ আছে এখানে। একটি হলো, সঠিক পথে পরিশ্রম করা। কেউ তো সকাল ৮টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত কাজ করতে পারবে না টানা। সঠিক উপায়ে করা একটা ব্যাপার।

আরেকটা হলো, খারাপ সময়ে বেশি কাজ করতে গিয়ে অনেক সময় দেখা যায় খারাপ জিনিসটিই বেশি করে ফেলছেন। তখন আরও বাজে প্রভাব পড়ে। সেটা খেয়াল রাখতে হয়।

আমার খেলায় বড় এটা অংশ হলো প্রস্তুতি। যে কোনো সিরিজ বা ম্যাচের আগে, প্রস্তুতিটা ভালোভাবে করার চেষ্টা করি। কোথাও আটকে গেলে নাজমুল আবেদীন ফাহিম স্যার, সালাউদ্দিন স্যার কিংবা আমার বিকেএসপির কোচ মতি স্যারের কাছ থেকে পরামর্শ নেই।

ব্যালান্স করতে জানা সবচেয়ে জরুরি অবশ্যই। তবে সেটা নির্ভর করে যার যার ওপর। আমার কোথাও সমস্যা হলে চেষ্টা করি সুনির্দিষ্টভাবে সেটি নিয়েই কাজ করতে, যত সময়ই লাগুক।

আপনার কিপিং নিয়ে অনেক আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে। ছাড়তে চান না বলে কথা শোনা গেছে। কুমার সাঙ্গাকারার উদাহরণ ছিল, জোর করে কিপিং ছাড়ানোর পরই যিনি ব্যাটসম্যান হিসেবে কিংবদন্তি হওয়ার পথে যাত্রা শুরু করেন। আপনার নিজের কি মনে হতো বা হয়?

মুশফিক: এটা খুবই ভুল কথা যে আমি ছাড়তে চাইনি। এটা তো আমার নিজস্ব সম্পদ না, দলের ব্যাপার। দলই সবকিছুর আগে।

আমি এখনও বিশ্বাস করি, কিপিংটা আমার ব্যাটিংয়ে অনেক সাহায্য করে। পেছন থেকে যখন আমি দেখি, তখন তা আমার অধিনায়কত্ব ও ব্যাটিংয়ে অনেক সহায়তা করত। সব ব্যাটসম্যানেরই একটা প্রস্তুতি থাকে না? নক করা বা এমন কিছু, আমার প্রস্তুতিতে কিপিংটা বড় অংশ। এখন ওই জায়গাটাই যদি কেউ বলে…. ।

আর কিপিংয়ে কে মিস করে না বলুন? বড় বড় কিপাররাও করেছেন। খেলারই অংশ এটা। আমরা দুর্ভাগা এই ক্ষেত্রে যে অন্য দলে কেউ জীবন পেলে হয়ত অনেক সময়ই দ্রুত আউট হয়ে যায় পরে। আমাদের ক্ষেত্রে সেটা কম হয়, কারণ বোলাররা সেভাবে সুযোগ সৃষ্টিই করতে পারে না। ওই ব্যাটসম্যান যখন বড় ইনিংস খেলে ফেলে, তখন জীবন পাওয়াটা আরও চোখে লাগে। সমালোচনা বেশি হয়।

এখন টেস্টে কিপিং করছেন না, নিজেকে মানানো কতটা কঠিন ছিল?

মুশফিক: স্বাভাবিক যে কারও ততটা মনে ধরার কথা নয়। তবে এটায় তো আমার হাত নেই। জোর করে চাইলেই যে থাকতে পারব, এমন নয়। দল থেকে আমাকে পরিষ্কারভাবে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে, সেটা নিয়ে আমি খুশি। দল যদি এভাবে চায়, আমার কোনো আপত্তি নেই। আমি বরাবরই দলের প্রয়োজনে বিশ্বাসী।

কদিন আগে ইংল্যান্ডর অধিনায়ক ওয়েন মর্গ্যান বলেছেন, দলের প্রয়োজন হলে নিজেকেও দল থেকে বাদ দেবেন তিনি। আমি একই ধারায় বিশ্বাসী। চেষ্টা করব, তেমন কিছু হলে দলের জন্য যে কোনো ত্যাগ করতে। নিজের কাছে আমি পরিষ্কার।

পরিসংখ্যানে আপনি দেশের সফলতম টেস্ট অধিনায়ক। আবার আপনার নেতৃত্বের প্রবল সমালোচনাও হয়েছে দিনের পর দিন। নিজের চোখে মুশফিক কেমন অধিনায়ক?

মুশফিক: আলোচনা-সমালোচনা হবেই। আমি যে সময়টায় অধিনায়কত্ব করেছি, খুব বেশি অস্ত্র আমার হাতে ছিল না। মুস্তাফিজ-মিরাজদের পেয়েছি একেবারে শেষ দিকে। উইকেট নেওয়ার মত কেউ ছিল না। ফল আমাদের পক্ষে আনব, এরকম উইকেটেও খেলা হতো না তখন।

আমার রক্ষনাত্মক ফিল্ড প্লেসিং নিয়ে সমালোচনা হয়েছে। কোন অধিনায়ক চায় না, সব ফিল্ডার ভেতরে রাখতে, চারটা ফিল্ডার ব্যাটসম্যানের ঘাড়ের কাছে রাখতে? কিন্তু বোলারদের তো ওইভাবে ডেলিভার করতে হবে! আপনি সিলিতে চারজন ফিল্ডার রেখেছেন, বোলার বল করছে এলোমেলো, সমানে চার হচ্ছে, তখন তো হাস্যকর লাগবে। পরিকল্পনা ব্যাটসম্যানকে অফ সাইডে খেলানো, বোলার বল করছে লেগে। অধিনায়কের তো দোষ না! বোলার, অধিনায়ক, কোচ, সবারই দায় নেওয়া উচিত।

এটা বলতে পারেন, আমি হয়ত বোলারকে সেভাবে নির্দেশনা দেওয়া বা অনুপ্রাণিত করতে পারিনি অনেক সময়। যেটা মাশরাফি ভাই খুব ভালো পারেন। এই দায় দিতে পারেন। কিন্তু টেকনিক্যালি বা পরিকল্পনা বলেন, আমি সবই করার চেষ্টা করেছি। অনেক সময় হয়নি। দেখতে খারাপ লেগেছে আপনাদের, কিন্তু অতি বিলাসি হওয়ার সুযোগ আমার ছিল না।

অনেকে বলতে পারেন যে, করে দেখতেন কেমন হয়! কিন্তু মাঠে অধিনায়কের সেই বিলাসিতার সুযোগ থাকে না। আমি সত্যি বলতে অধিনায়ক হিসেবে দুর্ভাগা ছিলাম।

ক্যারিয়ার শেষে নিজেকে কোথায় দেখতে চান?

মুশফিক: আমার একটা খুব বড় স্বপ্ন, ম্যাচ জেতানো ব্যাটসম্যান হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা। আমার নাম উঠলেই যেন সবাই বলে যে এই ব্যাটসম্যান ম্যাচ জেতাত। আর টেস্ট-ওয়ানডে দুটিতেই চল্লিশের বেশি গড় নিয়ে শেষ করার ইচ্ছা আছে। জানিনা কতটা পারব। র‌্যাঙ্কিংয়ে দশের মধ্যে থাকা বলেন বা বিশ্বের সেরা ব্যাটসম্যানদের একজন হওয়া, এসব তো ইচ্ছে করেই। তবে সবচেয়ে বড় চাওয়া হলো ধারাবাহিকতা ধরে রেখে দলের জয়ে অবদান রাখা।

দেশের ক্রিকেট নিয়ে কোন স্বপ্নটা সবচেয়ে বেশি দেখেন?

মুশফিক: এতগুলো ম্যাচ আমরা শিরোপার এত কাছে গিয়ে পাইনি। হয়তো একটা বড় ট্রফি, বিশ্বকাপও আমরা জিতে যেতে পারি। স্বপ্ন তো অনেকই থাকে। সবাই যদি ফিট থাকে, আমাদের যা শক্তি, আইসিসির একটা বড় টুর্নামেন্ট আমরা জিততেই পারি। অবসরের আগে এটাই আমার স্বপ্ন।

ক্রিকেটার মুশফিকের মনোজগতের মতো ব্যক্তি মুশফিককে নিয়েও অনেকের কৌতুহল আছে। ব্যক্তিজীবন ও পারিবারিক জীবনে মুশফিক কেমন?

মুশফিক: আমি সিম্পল একজন মানুষ। পরিবার, বন্ধুবান্ধব সবার সঙ্গে ভালোভাবে থাকার চেষ্টা করি। ব্যক্তি আমার সবচেয়ে বড় চাওয়া, ভালো মানুষ হতে পারা। ক্রিকেটীয় জীবন ১৫ বা ২০ বছরে শেষ। সবাই যেন বলে মানুষ হিসেবে ভালো ছিলাম, মৃত্যুর পরও যেটা কাজে দেবে।

এমনিতে আপনাকে যতটা অন্তর্মুখী মনে হয়, নিজের জগতেও কি তেমন?

মুশফিক: সবাই হয়ত জানে না, তবে আমি কিন্তু নিজের জগতে অন্যরকম। আমার বিকেএসপির বন্ধু বলেন বা বগুড়া জেলা স্কুল কিংবা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু, ওরা জানে আমি কেমন। তবে আমি খুব ভদ্র ছেলে, এটা নিশ্চিত (হাসি)।

এবং খুব গোছানো?

মুশফিক: এটা আমার খুব ছোট থেকেই ছিল। গোছানো, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। এখনও নিজের কাজ নিজে করি, সব গুছিয়ে রাখি। স্ত্রী বলেন বা আমার ছেলে, সব কাজ নিজে গুছিয়ে করার চেষ্টা করি। ছেলেবেলা থেকেই এসব আমি খুব উপভোগ করি।

মুশফিক সবচেয়ে বেশি আনন্দ পান কিসে?

মুশফিক: এখন যদি বলেন, ছেলের সঙ্গে সময় কাটাতে সবচেয়ে ভালো লাগে। ছেলে হওয়ার আগে, আমার সবচেয়ে আনন্দ লাগত এটা ভাবলে যে কখন আমি প্র্যাকটিসে যাব। কখন ব্যাটটা ধরব, কখন নেটে যাব। ৮-১০ দিন কোনো প্র্যাকটিস করছি না, এটা আমার জন্য জেলখানায় আটকে থাকার মতো। প্র্যাকটিসের কথা ভাবলেই আমার ভেতর রোমাঞ্চ কাজ করত।