অনেক পথ পেরিয়ে অবশেষে ফজলে রাব্বি

চুল ছিল কাঁধ পর্যন্ত। চলনে বলনে স্টাইলিশ। ব্যাটিংয়েও দেখনদারির রূপটা ছিল প্রবল। বড় বড় ছক্কা মারতে পারতেন। শুধু ছক্কাই মারতে চাইতেন! সতীর্থ অনেকে মজা করে ডাকতেন, ‘বাংলার গেইল’। কিন্তু সময় ধীরে ধীরে শিক্ষা দিয়েছে বাস্তবতার। গেইল হওয়ার চেষ্টা ছেড়ে একসময় খুঁজে ফিরেছেন নিজেকে। ছোট হয়েছে চুল, বদলে ফেলেছেন নিজেকে। সবচেয়ে বেশি বদলেছে ব্যাটিং ও মানসিকতা। পরিবর্তনের সেই পথচলাতেই মিলল স্বপ্নের ঠিকানা। অনেক পথ ঘুরে, অপেক্ষার অনেক প্রহর পেরিয়ে অবশেষে জাতীয় দলে ফজলে মাহমুদ রাব্বি।

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 11 Oct 2018, 05:10 PM
Updated : 11 Oct 2018, 05:10 PM

জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে বাংলাদেশের ওয়ানডে দলে একমাত্র নতুন মুখ ব্যাটসম্যান ফজলে রাব্বি। তবে বাংলাদেশের ক্রিকেটে তিনি নতুন নয় মোটেও। লিস্ট ‘এ’ ক্রিকেটে অভিষেক সেই ২০০৪ সালের জানুয়োরিতে।

গত ১৫ বছরে অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়েছেন, অনেকবার পথ হারিয়ে আবার পথে ফিরেছেন। জাতীয় পর্যায়ে বয়সভিত্তিক দলগুলোতে ছিলেন অপাংক্তেয়। ঘরোয়া ক্রিকেটেও ধারাবাহিকতা পেতে লড়েছেন। পড়াশোনায় মন দিয়েছেন, ফোন কোম্পানিতে চাকরি করেছেন। কয়েক বছর আগে ক্রিকেটই ছেড়ে দিতে চেয়েছিলেন। সেই তিনিই আজ জাতীয় দলে। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরকে নিজের ঘটনাবহুল ক্যারিয়ারের গল্প শোনালেন ফজলে রাব্বি। 

স্বপ্ন পূরণের প্রহর

জাতীয় দলে ডাক পাওয়ার খবর যখন শুনলেন, খুলনায় জাতীয় লিগের ম্যাচ খেলে ফজলে রাব্বি তখন বরিশালের পথে। টিম ম্যানেজমেন্ট বা নির্বাচকদের কাছ থেকে আগে ইঙ্গিত পাননি কোনো। অবশ্য আগের রাতেই খানিকটা ইঙ্গিত পেয়েছিলেন অন্য একটা মাধ্যমে। আশা-নিরাশার দোলাচল শেষে সত্যিই যখন স্বপ্ন পূরণের চূড়ান্ত খবর পেলেন, রাব্বি তখন আনন্দ ফুটিয়ে তোলার উপযুক্ত ভাষা হাতড়ে ফিরছেন।

“বুঝতে পারছি না কী বলা উচিত, কী বলব। বুঝে উঠতে সময় লাগছে। এত দিন ধরে খেলে যাচ্ছি তো এই স্বপ্ন নিয়েই! খেলা যখন শুরু করেছি, তখন থেকে জাতীয় দলই ছিল লক্ষ্য। অনেক সময় লেগেছে। তবে স্বপ্ন পূরণ হয়েছে, এই আনন্দ ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়।”

নতুন মুখ হলেও খুব অপ্রত্যাশিত নয় তার ডাক পাওয়া। এশিয়া কাপের প্রাথমিক দলে ছিলেন, মূল স্কোয়াডের ভাবনাতেও ছিলেন। প্রাথমিক দলে জায়গা মিলেছিল আগের কিছুদিনের পারফরম্যান্সে।

গত ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে ছিলেন চতুর্থ সর্বোচ্চ রান স্কোরার। প্রাইম দোলেশ্বরের হয়ে ৪৭.২০ গড়ে করেছিলেন ৭০৮ রান। সেই পারফরম্যান্স তাকে জায়গা করে দেয় শ্রীলঙ্কা ‘এ’ দলের বিপক্ষে বাংলাদেশ ‘এ’ দলে। একটি ম্যাচে ব্যাটিংয়ের সুযোগ পেয়ে করেন ৬৩ বলে ৫৯ রান।

ছিলেন আয়ারল্যান্ড সফরের বাংলাদেশ ‘এ’ দলেও। সেই সফরে সুযোগ মিলেছে আরেকটু বেশি, পারফরম্যান্সও আরেকটু উজ্জ্বল। তিনটি ম্যাচে ব্যাটিং করে দুটিতে করেছেন ৪১ বলে ৫৩ ও ৬৩ বলে ৭৪। বাঁহাতি স্পিনে উইকেটও মিলেছে টুকটাক।

সেই ধারাবাহিকতা ধরে রেখে এবার জাতীয় লিগের প্রথম রাউন্ডে বরিশালের হয়ে রংপুরের বিপক্ষে ১৯৫ রানের ইনিংস। তার পর থেকেই রাব্বির মনের কোণে বাসা বেধেছিল ছোট্ট একটু আশা।

“বাংলাদেশ ‘এ’ দলের হয়ে ভালো করার পর থেকে আত্মবিশ্বাস অনেক বেড়ে গিয়েছে। জাতীয় লিগে ডাবল সেঞ্চুরি মিস করে খারাপ লাগছিল। কিন্তু অনেকেই বলছিল, এবার ডাক পেতে পারি। নিজের মনেও তাই একটু আশা ছিল। নিজেকে এটাও বুঝিয়েছিলাম, আলোচনা যখন হচ্ছে, তার মানে ঠিক পথেই আছি। এবার না হলেও সামনে হবে। ভাগ্য ভালো, এবারই হয়ে গেল।”

পেছন ফিরে

জন্ম পিরোজপুরে, তবে বাবার চাকরির সুবাদে বোধ হওয়ার পর থেকেই বেড়ে ওঠা বরিশালে। সেখানেই টেপ টেনিস দিয়ে ক্রিকেটের শুরু। তার হাতে অনেক শট ও প্রচণ্ড জোর দেখে এলাকার বড় ভাইরা নিয়ে গেলেন সত্যিকারের ক্রিকেটে। শহরের একটি একাডেমিতেও ঠাঁই পেয়ে গেলেন।

এরপর এগিয়ে চলা। বরিশালে দ্বিতীয় বিভাগ খেললেন। জেলা অনূর্ধ্ব-১৯ দলের হয়ে সর্বোচ্চ রান করলেন। বিভাগীয় পর্যায়েও আলো ছড়িয়ে পথ ধরলেন জাতীয় পর্যায়ের। কিন্তু জাতীয় পর্যায়ের বয়সভিত্তিক দলগুলোর মূল স্কোয়াডে জায়গা হচ্ছিল না। বারবারই ছিলেন স্ট্যান্ড বাই।

ততদিনে এইচএসসি পাশ করে চলে এসেছেন ঢাকায়। পরিবার ক্রিকেট খেলার স্বাধীনতা দিলেও পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার বাধ্যবাধকতাও দিয়েছে। তাই ভর্তি হয়েছেন তিতুমীর কলেজে। ঢাকার ক্রিকেটের মূল স্রোতে সামিল হওয়ার শুরু অবশ্য তার আগেই। ঢাকায় চলে আসার পর আরও পোক্ত হয় ক্রিকেটের সঙ্গে সম্পর্ক।

এরপর পায়ের নিচে জমিন খুঁজে পেতে সময় লেগেছে অনেকটা। ঢাকার ক্লাব ক্রিকেটে অবস্থান পাকা করতে লড়াই করতে হয়েছে। বরিশাল বিভাগীয় দলে সুযোগ নিয়মিত মিললেও ছিলেন না ধারাবাহিক। হাতে শট ছিল বরাবরই, ছিল না টেম্পারামেন্ট। বোলিংও ছিল না খুব ধারাল। বাংলাদেশের ক্রিকেটকে সম্ভবত প্রথমবার একটু জোর নাড়া দিতে পারেন ২০১০ সালে। জাতীয় লিগের ওয়ানডে সংস্করণের একটি ম্যাচে ধানমণ্ডির আবাহনী মাঠে বিশাল সব ছক্কায় করেছিলেন ১৪৮ রান।

কিন্তু ধারাবাহিকতা ছিল না, তাই ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ ছিল অন্ধকার। এক পর্যায়ে আশাই ছেড়ে দিয়েছিলেন জাতীয় দলের।

“পড়াশোনাটা শেষ করে রেখেছিলাম, তিতুমীর কলেজ থেকে মার্কেটিংয়ে অনার্স-মাস্টার্স করেছি। ক্রিকেটে হচ্ছে না বলে একসময় একটি মোবাইল ফোন কোম্পানিতে চাকরি শুরু করলাম। কিন্তু কিছুদিন করার পর ভালো লাগছিল না। মনে হলো, আমাকে দিয়ে এসব হবে না। ক্রিকেটই খেলতে হবে।”

“আবার ক্রিকেটে ফিরলাম। কখনও ভালো করতে পারিনি, কখনও ভালো করলেও সেভোবে সুযোগ মেলেনি একাডেমি বা অন্যান্য দলে। কিংবা দলে থাকলেও ম্যাচ খেলার সুযোগ মিলেছে কম। সব মিলিয়ে তিন-বছর আগে ঠিক করেছিলাম ক্রিকেটই ছেড়ে দেব।”

সেখান থেকে ফজলে রাব্বির ফিরে আসার গল্পটাও দারুণ বেশ চমকপ্রদ।

ঘুরে দাঁড়ানো

২০১৪-১৫ মৌসুমের জাতীয় লিগের আগে ঠিক করলেন এবারই শেষ, মৌসুম শেষে ক্রিকেট ছেড়ে ক্যারিয়ার গড়বেন নতুন করে। ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা মৌসুম কাটালেন সেবারই! জাতীয় লিগে ৫৩.৯০ গড়ে করলেন ৫৯৩ রান। এখন পেছন ফিরে তাকিয়ে সেই পারফরম্যান্সকে ক্যারিয়ারের অন্যতম টার্নিং পয়েন্ট মনে হয় রাব্বির।

“খেলাই ছেড়ে দেব, সেবার তাই চাপ ছিল না। একদম নির্ভার হয়ে খেললাম। খুব ভালো খেললাম। শুধু রানের কারণে নয়, ব্যাটিংও খুব ভালো করেছিলাম। তখন আবার সিদ্ধান্ত বদলে ফেললাম। মনে হলো, ভালো যখন খেলছি, তাহলে চালিয়ে যাই। যা থাকে কপালে।”

সেই মৌসুমের পরও পেরিয়ে গেছে অনেকটা দিন। বয়স পেরিয়েছে ৩০, যে বয়সে বাংলাদেশের বাস্তবতায় জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়া কঠিন। বয়সের প্রসঙ্গে রাব্বি অবশ্যই একটা ব্যাপার স্পষ্ট করে দিলেন নিজে থেকেই, “আমার বয়স কিন্তু সত্যিই ৩০। বাংলাদেশে তো অনেকেই বয়স কমায়, বন্ধু-বান্ধব অনেকের বয়স অফিসিয়ালি ২৬-২৭ । কিন্তু আমার রেজিস্ট্রেশনের সময় বাবা আসল বয়সই রেখেছেন।”

বয়স বাড়ার সঙ্গে তার আশাও ছিল কমতির দিকে। তবে ক্রিকেট ছাড়ার ভাবনা আর মাথায় আসেনি।

“ওই মৌসুমের পর যখন মত বদলে আবার খেলব ঠিক করলাম, তখন থেকেই আমি জাতীয় দলের ভাবনা দূরে রাখতে শুরু করেছি। ঠিক করেছি প্রফেশনালি ক্রিকেট খেলব, যে লেভেলেই খেলি। জাতীয় লিগ, ঢাকা লিগই আনন্দ নিয়ে খেলেছি।”

বদলে যাওয়ার গল্প

ফিটনেস নিয়ে একসময় সচেতন ছিলেন না ততটা। তবে গত বছর দুয়েকে বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রিকেটেও ফিটনেস নিয়ে সচেতনতা যতটা বেড়েছে, তার ছোঁয়া পেয়েছেন রাব্বিও। কাজ করেছেন ফিটনেস নিয়ে। গত ঢাকা লিগে সাতশ বেশি রান করার পর ভালো কিছুর আশায় আরও জোর দিয়েছেন ফিটনেসে। ওজন কমিয়েছেন ৬-৭ কেজি। ‘এ’ দলের হয়ে সাফল্যে ফিটনেসের উন্নতির ছিল বড় ভূমিকা। জাতীয় দলের টিকিট পেলেন সেটির হাত ধরেই।

সময়ের সঙ্গে শৃঙ্খলা বেড়েছে জীবনে ও ক্যারিয়ারে। অনেকটাই বদলে ফেলেছেন নিজেকে ও নিজের ব্যাটিং। এক সময় স্রেফ ধুমধাড়াক্কা ব্যাটিং করতে চাইতেন। সেসব দিন এখন তার কাছে অতীত।

“বদলটা আসলে হয়েছে মানসিকতায়। একসময় লোকে যখন গেইল বলে ডাকত, খুব ভালো লাগত। আশাও ছিল বড়। কিন্তু পরে বুঝেছি ক্রিকেট এত সহজ নয়। বয়স আর অভিজ্ঞতায় অনেক কিছু বুঝতে শিখেছি। একসময় প্রথম ১০ ওভারে খুব মেরে খেলতাম। তার পর আটকে যেতাম। এখন এক-দুই করে নিয়ে খেলতে পারি।”

“এখনও ছক্কা মারতে পারি। ইচ্ছেও করে খুব। সোজা ব্যাটে ছক্কা মারতে খুব ভালো লাগে। কিন্তু ইচ্ছেটাকে দমিয়ে রাখি। বুঝতে শিখেছি, ব্যাটিং মানে শুধু ছক্কা মারা নয়। ইনিংস গড়ে তোলা শিখেছি। এখনও শিখছি।”

এই উন্নতির ধারায় যেটা হয়েছে, তার ব্যাটসম্যানশিপের ব্যপ্তি বেড়েছে। একসময় ছিলেন ওপেনার, খেলেছেন তিনে। সম্প্রতি ‘এ’ দলের হয়ে ভালো করেছেন চার নম্বরে, ছয় নম্বরে খেলে। হাসতে হাসতেই বললেন, “এখন আমার কোনো পজিশন নেই। এক থেকে ছয়, সব পজিশনে ব্যাট করতে পারি। একটা সময় ছোট্ট গণ্ডির ভেতর ছিলাম। আমার মনে হয়েছে, ব্যাটসম্যান হিসেবে সব চেষ্টাই করা উচিত।”

সমুখ পানে

জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়ার স্বপ্ন পূরণ হলো। এবার? পোড় খাওয়া ক্যারিয়ারের কারণেই হয়ত বাস্তবতা খুব ভালো বোঝেন রাব্বি।

“অপেক্ষায় থাকব সুযোগ পাওয়ার। সুযোগ পেলে চেষ্টা করব কাজে লাগানোর। সেঞ্চুরি-ফিফটি ভাবছি না, দলের অবদান রাখতে চাই যেভাবে হোক।”

সাকিব আল হাসান নেই বলেই মূলত তার দিকে নজর পড়েছে এবার। সাকিবের বিকল্প নেই, তবে বিভিন্ন পজিশনে ব্যাট করতে পারা আর বোলিং মিলিয়ে রাব্বি কার্যকর হতে পারেন বলে মনে করছে টিম ম্যানেজমেন্ট। দলের প্রয়োজেনে নিজেকে উজার করে দেবেন, রাব্বি জানালেন প্রত্যয়ী কণ্ঠে।

“আমি কিন্তু মোটেও অলরাউন্ডার নই। ব্যাটিংই আমার কাছে আগে। তবে গত কিছুদিনে বোলিংটায় একটু উন্নতি হয়েছে। যদি প্রয়োজন হয়, অবশ্যই সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করব।”

“দলের দুইজন সিনিয়র ক্রিকেটার নেই বলেই হয়তো আমার সুযোগ হয়েছে। আমার চাওয়া থাকবে, তারা যখন ফিরবে, তখনও যেন আমার জায়গা থাকে দলে। সুযোগ পেলে চেষ্টা করব সেটি নিশ্চিত করার।”