‘হয় মারব, নয় মরব’, মাশরাফির মন্ত্রে উজ্জীবিত দল

সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য সৈনিককে হারাতে হয়েছে শুরুতেই। অভিযানে নেমে চোট-আঘাতে জর্জর আরও অনেকে। ময়দানও বন্ধুর। এসবের মধ্যেই আরেকটি বড় ধাক্কা। বাঁচা-মরার লড়াইয়ের আগে হারাতে হলো দলের সবচেয়ে বড় সম্পদকে। কিভাবে পাড়ি দেওয়া যায় এই দুর্গম গিরি, কান্তার মরু? সেনাপতি অনুভব করলেন, দলের মনোবল চূড়ায় নেওয়ার বিকল্প নেই। রক্তে নাচন জাগানো মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ করলেন সঙ্গীদের। পাকিস্তানের বিপক্ষে বাংলাদেশের লড়াইয়ে জয়ের পেছনের গল্প এটিই!

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনিদুবাই থেকে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 Sept 2018, 06:14 AM
Updated : 27 Sept 2018, 10:27 AM

ম্যাচের আগে দলকে এমনভাবে অনুপ্রাণিত করেছিলেন মাশরাফি বিন মুর্তজা যে এর পর দলে কে আছে, কে নেই, কোথায় ঘাটতি, এসব নিয়ে আর ভাবেনি দল। চেয়েছে নিজেদের উজাড় করে দিতে। মিলেছে সেটিরই ফল।

সুপার ফোরের শেষ ম্যাচে পাকিস্তানকে হারিয়ে বাংলাদেশ জায়গা করে নিয়েছে এশিয়া কাপের ফাইনালের মঞ্চে। কিন্তু ম্যাচের আগের প্রেক্ষাপটে এই ফল ছিল অনেকেরই ভাবনার বাইরে।

টুর্নামেন্টের প্রথম ম্যাচে তামিম ইকবালকে হারানোর পর থেকে টালমাটাল টপ অর্ডার দাঁড়াতে পারেনি একদিনও। পুরোনো পাঁজরের চোট মাথাচাড়া দেওয়ায় মুশফিকুর রহিমকে খেলতে হচ্ছে বুকে টেপ পেঁচিয়ে। মাশরাফি বিন মুর্তজার জন্য প্রতিটি দিনই তো অসংখ্য ঝঞ্ঝার সঙ্গে লড়াই। দুবাইয়ের প্রচণ্ড গরম ও আর্দ্রতায় টানা ম্যাচ খেলে ও রিকভারির পর্যাপ্ত সময় না পেয়ে কাহিল গোটা দলই। এর মধ্যেই যেন বজ্রপাত, খেলতে পারবেন না সাকিব আল হাসান!

আফগানিস্তানের বিপক্ষে জয়ের পর দিনই অনেকটা নিশ্চিত হয়ে যায়, টুর্নামেন্ট শেষ সাকিবের। তার চোট পাওয়া আঙুল ফুলে গেছে অনেকটাই। ভেতরে জমেছে লিকুইড। ব্যাট ধরার মতো অবস্থায় নেই। আঙুল দেখেই ফিজিও, টিম ম্যানেজমেন্ট ও অধিনায়ক যা বোঝার বুঝে ফেলেন। পরের ম্যাচ নিয়ে অধিনায়কের তৎপরতাও শুরু হয়ে যায় তখন থেকেই।

কার্যত সেমি-ফাইনালে রূপ নেওয়া পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচে সাকিবকে পাওয়া যাবে না জানলেই ভড়কে যেতে পারে দল। মাশরাফি তাই টিম ম্যানেজমেন্টকে নিয়ে ঠিক করেন, দলকে কোনোভাবেই আগেভাগে জানতে দেওয়া হবে না সাকিবের ছিটকে যাওয়ার খবর। সাকিব নেই জানলেই সেটি নিয়ে চর্চা হবে অনেক, ক্রিকেটাররা নিজেরা এটা নিয়ে অনেক ভাববে, বাইরের আলোচনা প্রভাব ফেলবে, এসব ভেবেই দলের কাছে খবরটি গোপন রাখেন অধিনায়ক।

দুই সিনিয়র ক্রিকেটার মুশফিকুর রহিম ও মাহমুদউল্লাহকে অবশ্য মোটামুটি ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছিলেন অধিনায়ক। তাদেরকে বলা হয়েছিল, সাকিবের খেলার সম্ভাবনা ৫০-৫০। কিন্তু দলের অন্যরা জানত না।

সাকিবকে না পাওয়ার খবর অধিনায়ক গোটা দলকে জানান বুধবার, ম্যাচের দিন সকালে। অনেকেই চমকে যান। শুরু হয় ফিসফিস। মাশরাফি জানতেন কি বলতে হবে। মনে করিয়ে দিলেন লড়াইয়ে নামা একজন যোদ্ধার দায়িত্ব। দলকে আবারও নাড়া দিলেন নতুন করে, উজ্জীবিত করলেন নিজেদের সবটা মাঠে ঢেলে দিতে।

দুই সিনিয়র মুশফিকুর রহিম ও মাহমুদউল্লাহর ওপর ভার ছিল একটু বাড়তি দায়িত্ব নিয়ে খেলা। দুজনই জয়ে রেখেছেন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা। দলকে বিপর্যয় থেকে উদ্ধার করা ৯৯ রানের ইনিংসে ম্যাচের সেরা মুশফিক।

ম্যাচ শেষে মুশফিকই জানালেন, সাকিব না থাকার খবর জানানোর পর দলকে কিভাবে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন মাশরাফি।

“মাশরাফি ভাই একটি কথাই বলেছিলেন যে, ‘যুদ্ধে নামলে পেছনে তাকিয়ে থাকার সুযোগ নেই। যুদ্ধের ময়দানে গা বাঁচিয়ে চললে চলবে না। হয় মারব, নয় মরব।’ মাশরাফি ভাই যে কথাটি বলেছে, এটা দারুণ অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। কারণ লড়াইয়ে নামলে আসলে দেখার সুযোগ নাই দলে কে আছে না আছে। আমাকে আমার শত ভাগ দিতে হবে। আমরা ফল নিয়ে চিন্তা না করে চেষ্টা করেছি শতভাগ দিতে। জানতাম সেটি দিতে পারলে আমরাই জিতব।”

ভবিষ্যতের জন্যও এই ম্যাচকে বড় এক পাথেয় মানছেন মুশফিক। সিনিয়র ক্রিকেটারদের বিদায় বলতে হবে একদিন। দায়িত্ব নিতে হবে উত্তরসূরিদের। সাকিব-তামিম না থাকায় সেই সময়ের আগাম মঞ্চায়ন খানিকটা হয়ে গেল বলে মনে করছেন মুশফিক।

“তামিম ও সাকিব না থাকার পরও ছেলেরা নিজেদের মানসিকতা প্রমাণ করতে পেরেছে। দেখিয়ে দিয়েছে ওরা না থাকলেও কেউ না কেউ দাঁড়িয়ে যেতে পারে। এই ধরনের ম্যাচ জয় থেকে অনুপ্রেরণাও মেলে অনেক।”

“হয়তো একদিন আমিও থাকব না। কারও জন্য কিছু থেমে থাকে না। আমরা পাঁচজনও থাকব না। এরপরও ক্রিকেট চলতে থাকবে। সবাই সেদিক থেকে অনুপ্রাণিত ছিল সত্যিই, যে কিছু করে দেখাতে হবে। মিরাজ, মুস্তাফিজ, মিঠুন, জুনিয়ররাই আজকের ম্যাচে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে।”