কতটা খারাপ লাগা নিয়ে ফিরছি, কেবল আমিই জানি: তামিম

এশিয়া কাপের প্রথম ম্যাচে এক হাতে ব্যাটিংয়ের বীরোচিত কীর্তি নিয়ে আলোচনা চলছে এখনও। তবে সেই চোটেই শেষ হয়ে গেছে সফর, মঙ্গলবার সকালে রওনা হচ্ছেন দেশের পথে। যাওয়ার আগে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তামিম ইকবাল বলে গেলেন, কতটা বিষন্ন মনে ফিরছেন দেশে। শোনালেন সেদিনের ব্যাটিং বীরত্বের নানা বাঁকের গল্প, চারপাশের প্রতিক্রিয়া নিয়ে তার অনুভূতি আর সামনের কঠিন সময় নিয়ে প্রতিজ্ঞা আর চ্যালেঞ্জের কথা।

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনিদুবাই থেকে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 18 Sept 2018, 05:50 AM
Updated : 18 Sept 2018, 06:39 AM

গত কয়েকদিনে তুমুল প্রশংসার বৃষ্টিতে সিক্ত হলেন। এখন টুর্নামেন্ট ছেড়ে দেশে ফিরে যেতে হচ্ছে। বিপরীতমুখী অনুভূতি, কোনটির দোলা বেশি?

তামিম ইকবাল: প্রশংসা বলুন বা যা কিছু, আমি আসলে ওসবের মাঝে খুব বেশি সময় ছিলাম না। এখন আমিই একমাত্র জানি, আমার কতটা খারাপ লাগছে। আমি যে চলে যাচ্ছি, খেলতে পারব না, কেবল আমিই বুঝতে পারছি আমার কেমন লাগছে। যদি বুঝিয়ে বলতে পারতাম, তাহলে নিজেও হয়ত হালকা হতে পারতাম। কিন্তু না পারছি বুঝিয়ে বলতে, না পারছি সইতে।

একজন ক্রিকেটারের ভালো সময় সব সময় থাকে না। আমি খুব ভালো খেলছিলাম এ বছর। অনেক পরিশ্রম, অনেক ত্যাগ, অনেক কষ্ট করে এই জায়গায় আনতে হয় নিজেকে। এই সময় ইনজুরির জন্য বিরতি নিতে হচ্ছে, আমার সেটি মানতে কষ্ট হচ্ছে। আমার ক্যারিয়ার যদি দেখেন, আগেও এমন হয়েছে, যখন খুব ভালো খেলছি, তখনই ইনজুরিতে পড়ে গেছি। জানি না, কেন আমার সঙ্গেই এমন হয়।

দেশ বিদেশের সংবাদমাধ্যমে স্তুতির ঝড় উঠেছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় পাচ্ছেন বীরের সম্মান। অনেক ভালো ব্যাটিং পারফরম্যান্সেও তো মনে হয় আগে এতটা পাননি। এটাও কি কিছুটা সান্ত্বনা নয়?

তামিম: নাহ, আগে কখনোই এতটা সাড়া পাইনি। ডাবল সেঞ্চুরির পরও দেখিনি এতটা। তবে সত্যি বলতে, এত প্রশংসা, এত ভালো কথা, এসব আমি উপভোগ করতে পারিনি। কিভাবে উপভোগ করব? দল এখানে, আমি তো দেশে ফিরে যাচ্ছি!

যারা আমার প্রশংসা করেছেন, ভালো কথা বলেছেন, সবার প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। দলের জন্য কিছু করতে পেরেছি, দলের জয়ে সেটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল, এটা ভেবে ভালো লেগেছে। কিন্তু এটুকুতেই যে আমি তৃপ্তি পাব, খুশি মনে ফিরে যাব, সেটা সম্ভব নয়। আমি আর খেলতেই পারছি না! যদি এমন হতো যে এটা করার পর আমি পরের ম্যাচে খেলতে পারব, তাহলে অবশ্যই অনেক খুশি থাকতাম।

কিন্তু এই যে ছাপ রেখে যাওয়া, দাগ কেটে দেওয়া, একটা উদাহরণ হয়ে থাকা, এটা কি তৃপ্তি দিচ্ছে না?

তামিম: এসব আপনারা বিচার করবেন। লোকে করবে। আমি সত্যি বলতে কিছুই ভাবিনি। এসব ভেবে ব্যাটিংয়ে নামিনি। পরেও এসব ভাবিনি। ওই সময়ে দলের যা দরকার ছিল, সেটিই কেবল করতে চেয়েছি।

শুধু সেদিন নয়, সব সময়ই এভাবে ভাবতে চেষ্টা করি। এই দেশ আমাকে অনেক দিয়েছে। আমি সামান্য কিছু করতে পারলেও আমার জন্য অনেক বড় পাওয়া মনে হয়। যাদের কাছে হাজার হাজার কোটি টাকা আছে, তাদের জীবনেও অপ্রাপ্তি থাকে। যার কাছে কিছু নেই, তারও থাকে। আমার জীবনেও অনেক অভিযোগ, আক্ষেপ আছে। কিন্তু যখন ভাবি আমার এই বয়সেই এই দেশ আমাকে অনেক নাম, খ্যাতি, অর্থ, জনপ্রিয়তা সম্ভব সবকিছু দিয়েছে। কজন এতটা পায়? তো আমি যদি দেশের প্রয়োজনের সময় এতটুকু না পারি, তাহলে আমার খেলোয়াড় হয়ে লাভ কী!

 

এখনকার উল্টো সময়ও দেখেছেন। বিশেষ করে ২০১৪-১৫ সময়টায় প্রবল সমালোচনা, তাচ্ছিল্যের শিকার হতে হয়েছে। পেছন ফিরে তাকিয়ে তুলনার ছবি আঁকেন?

তামিম: নাহ, আমি আসলে এখন এসব ভাবিই না। শুধু বলার জন্য বলছি না। আমাকে যারা কাছ থেকে দেখেন বা জানেন, সবাই জানেন যে আমি এসব কথা বানিয়ে বলি না। ইন্টারভিউ বলেই দেশপ্রেম বা দল নিয়ে ভালো ভালো কথা বানিয়ে বলি না। যা সত্যিই মনে করি বা ভাবি, সেটিই বলি। যেটি বলি, সেটি বিশ্বাস করি বলেই বলি।

হ্যাঁ, বাজে সময়টায় চারপাশের আলোচনা আমাকে প্রভাবিত করেছিল। খারাপভাবেই করেছিল। ওই সময়ই আমাকে শিখিয়েছে যে তাচ্ছিল্য বা প্রশংসা, কোনোটাই মাথায় চড়ে বসতে দেওয়া যাবে না। গা ঝাড়া দিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে হবে। পরের ম্যাচে আবার আমাকে শূন্য থেকে শুরু করতে হবে। এখনকার ভালো সময় শেষে খারাপ সময় আসলে আবার লড়াই করতে হবে।

এখন যেভাবে প্রশংসা হচ্ছে, এটা নিয়ে বেশি ভাবলে আমার ভেতর অহংকার চলে আসতে পারে। মনে হতে পারে, গোটা বাংলাদেশ আমাকে নিয়ে কথা বলছে। এই ভাবনা আমি মাথায় ঢোকাতে চাই না। লোকে আমাকে ভালো বলছে, আমি বিনয়ের সঙ্গে গ্রহণ করছি। কিন্তু এই গর্ব নিয়ে পথ চলতে চাই না। আমি কেবল আমার কতর্ব্যই করেছি। দ্যাটস মাই জব। আমার কাছে এখানেই শেষ।

আবারও যদি কখনও প্রয়োজন নয়, এ রকম এক হাতে ব্যাট করতে নেমে যাবেন?

তামিম: দেখুন, আমাকে নিয়ে অনেকে অনেক রকম ভাবে। অনেক সময়ই অনেকে অনেক কিছু বলেছে। কিন্তু আমি জানি, আমি সবসময় শতভাগ দিয়েছি।

আমি হয়তো দলের সবচেয়ে জোরে দৌড়াই না, আমার চেয়ে ফিটনেস হয়ত অনেকের ভালো, আমি হয়তো দলের সেরা ফিল্ডার নই, এমনকি হয়তো দলের সেরা ব্যাটসম্যানও নই। কিন্তু আমার সামর্থ্যে যতটা আছে, আমি সব সময় পুরোটা দেওয়ার চেষ্টা করি। ক্রিকেটের প্রতি আমার নিবেদন নিয়ে কেউ প্রশ্ন করলে আমার মাথা খারাপ হয়ে যায়।

আমার পারফরম্যান্স ভালো-খারাপ হতে পারে। কোনোদিন খুব বাজেও খেলতে পারি। কিন্তু কেউ যদি বলে উইকেটে বা মাঠে গা ছাড়া ছিলাম, কেউ যদি বলে চেষ্টা করি নাই, আমি সহ্য করতে পারি না। লোকে তো আর পারসেন্টেজ দেখে না যে আমি কত পারসেন্টেজে ব্যাট করছি। গ্রাফ তো দেখা যায় না যে আজ ৮০ ভাগ দিচ্ছে বা ৫০ ভাগ দিচ্ছে। আমি জানি, আমি সব সময় শতভাগ দেওয়ার চেষ্টা করি।

আবারও যদি এ রকম পরিস্থিতি আসে, আবারও এক হাতে ব্যাট করব। বা অন্য রকম কিছু দরকার হলে করব। শুধু আমি না, আমার বিশ্বাস, আমাদের আরও অনেক ক্রিকেটারই করতে প্রস্তুত থাকবেন।

হাতের অবস্থা এখন কেমন?

তামিম: প্রথম দুই সপ্তাহ একটু ক্রিটিকাল। আজকেও ডাক্তার দেখিয়েছি। তিনি বলেছেন, এই মুহূর্তে অপারেশনের দরকার নেই। স্ক্যান রিপোর্ট আমরা ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ায় বিশেষজ্ঞের কাছে পাঠিয়েছি। তারাও বলেছেন, আপাতত অপারেশন দরকার নেই। তবে এক সপ্তাহ পর আরেকবার স্ক্যান করতে হবে। পরের সপ্তাহে আরেকবার। দেখতে হবে ঠিকমত জোড়া লাগছে কিনা।

যদি ঠিকভাবে জোড়া লাগে, তাহলে আর অপারেশন লাগবে না। কিন্তু এক বা দুই সপ্তাহ পর যদি দেখা যায় যে একটু বাঁকাভাবে জোড়া লাগছে, তাহলে অপারেশন লাগবে। অপারেশন হলে এর পর থেকে ৫-৬ সপ্তাহ লাগবে ঠিক হতে। এখন প্রথম ১০-১২ দিনই গুরুত্বপূর্ণ। ঠিকভাবে জোড়া লাগলে অপারেশন লাগবে না। সেক্ষেত্রে আগেই ফিরতে পারব আশা করি।

আপনার ফিটনেস ট্রেনিং, ওয়ার্ক এথিকস, আপনার ডায়েট, ত্যাগ, গত কিছুদিনে যেভাবে নিজেকে সামলেছেন, সামনের সময়টা কিভাবে সামলাবেন?

তামিম: এটিই আমার সামনে এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। আমার ফিটনেস ট্রেনিংয়ের একটা বড় অংশ রানিং। বাসায় ট্রেডমিলে, কিংবা বাসার সামনের রাস্থায়, মাঠে এসে দৌড়াই। কিন্তু এখন অন্তত ২-৩ সপ্তাহ রানিং করাই যাবে না। নিজেকে ফিট রাখা তাই বড় চ্যালেঞ্জ। সাইক্লিং করা যাবে এই সময়, যেহেতু হাত নাড়াতে হচ্ছে না। কিন্তু এটা আমি ঠিক উপভোগ করি না। আর আমি এসন একজন মানুষ, কোনো কিছু উপভোগ না করলে তা করতে ভালো লাগে না। এখন সাইক্লিংকে যে করেই হোক ভালো লাগাতে হবে।

ডায়েট নিয়ে আগে যদি ৫০ ভাগ সতর্ক থাকি, এখন ৮০ ভাগ সতর্ক থাকতে হবে। আমার শরীরটাই এরকম যে অল্প একটু খেলেও দ্রুত শরীরে লেগে যায়। সব মিলিয়ে চ্যালেঞ্জিং অনেক।

শারীরিক চ্যালেঞ্জের চেয়ে মানসিক চ্যালেঞ্জটাই বড়। ক্লান্তিকর, একঘেয়ে সময়!

তামিম: তা তো বটেই। এই যেমন দেশে ফিরে যাচ্ছি। দলের অনেকেই বলেছে যেন আরও দুই-চার দিন থেকে যাই। অনেক অনুরোধ করেছে। কিন্তু আমি পারব না। ওরা প্র্যাকটিস করবে, ম্যাচ খেলবে, আমি বসে বসে দেখব, এটা আমি পারব না। স্রেফ সহ্য করতে পারব না।

এমনিতে দুবাই আমার ভালো লাগে। চাইলে পরিবার, বন্ধু বান্ধবদের এনে, অন্য হোটেলেও থাকতে পারি। আর তো কিছু করার নেই। কিন্তু আমি দুবাইয়ের আশেপাশেও আর থাকতে চাই না। যত দ্রুত সম্ভব চলে যেতে চাই। কারণ এখানেই আমার দল খেলছে, আমি পারছি না, এটা মানতে পারব না।

চোট কাটিয়ে ফেরার পরের সময়টা নিয়ে শঙ্কা, সংশয় কাজ করছে?

তামিম: ইনজুরি থেকে ফেরার পর আমি জানি না, তখন আমি কেমন খেলব। অনেকটা শূন্য থেকে শুরু করার মতো ব্যাপার। ১০ দিন ব্যাটিং না করলেও পরে মনে হয় সব ভুলে গেছি। সেখানে ৫-৬ সপ্তাহ করতে পারব না। তার পর আবার ফিরে আসা, আবার প্রক্রিয়াগুলো করা এবং এর পরও সেটি সাফল্যের গ্যারান্টি দেয় না। এমনিতে ইনজুরি আমাদের হতেই পারে। কিন্তু এমন ভালো সময়ের মধ্যে ইনজুরি হলে খুব খারাপ লাগে।

আমি যখন আবার মাঠে ফিরব, এখনকার চেয়ে ভালো খেলতে পারি, আবার খারাপও খেলতে পারি। ভালো সময়ে অনেক কিছুই পক্ষে আসে, খারাপ সময়ে দেখা যায় অনেক কিছুই পক্ষে আসে না। তাই জানি না ৬ সপ্তাহ পর আমি কোন অবস্থায় শুরু করতে পারব। একটা প্রশ্ন থাকছেই। এ কারণেই সবচেয়ে হতাশ যে ভালো সময়ে এমন ইনজুরি হলো। আমি চাইছিলাম এই ভালো সময়কে সম্ভব সর্বোচ্চটা কাজে লাগাতে।

এই ম্যাচের আগে এ বছর ৮ ওয়ানডেতে আপনার রান ছিল ৫৩৯; গড় ৯০। ইনজুরি না হলে বছরে হাজার রান করা খুবই সম্ভব ছিল। এখন যে অবস্থা, এশিয়া কাপের পর জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজও মিস হতে পারে। হাজার রানের হাতছানি কি মিলিয়ে গেল?

তামিম: হতাশার কথা বলছিলাম না? এসব কারণেই বেশি হতাশ। এমনিতে আমি কখনও কোনো লক্ষ্যের কথা প্রকাশ্যে বলি না। তবে নিজের মাথায় তো লক্ষ্য থাকেই। নিজের রান, পরিসংখ্যান এসব খুব ভালো জানা থাকে আমার। প্রতিটি সংখ্যা জানি আমি। হতে পারত অনেক কিছুই। বলতে ইচ্ছে করে অনেক কিছু। কিন্তু বলে কি হবে। পারছি না, এটাই কঠিন সত্যি।

ডান হাতের অনামিকায় চোট নিয়ে দুবাই এলেন। ওখানে আবার চোট পাওয়া নিয়ে ছিল শঙ্কা। কিন্তু লাগল বাঁ হাতের তর্জনিতে। দুর্ভাগ্য এমন ছায়াসঙ্গী হয়ে গেল!

তামিম: আমি জানি না কেন...আমার কাছে শকিং মনে হয়েছে। যেভাবে বলটা লাগল, সেটিই ছিল খুব দুর্ভাগ্যজনক। একটা গ্লাভসে অনেক প্রটেকশন থাকে। কিন্তু যে জায়গায় একটু প্রটেকশন কম, ঠিক সেই জায়গায় বলটি লাগল। কপাল খারাপ ছাড়া আর কী বলতে পারি!

লাগার পরই কি বুঝেছিলেন যে বাজে কিছু?

তামিম: লাগার পর আপনারা খেয়াল করেছিলেন কিনা, শুরুতে কিন্তু তেমন কিছু মনে হয়নি। আমি শটটি আবার শ্যাডো করছিলাম। বুঝিনি এত বাজেভাবে লেগেছে। ৫-১০ সেকেন্ড পর মনে হলো, ‘এত ব্যথা করছে কেন!’ গ্লাভস খুলে আঙুলের চেহারা দেখে চমকে গেছি।

মুশফিকও তখন আঙুল দেখে যা বোঝার বুঝে গেছে। আঙুলের অবস্থা ভয়ঙ্কর ছিল। আঙুলের ‘নাকল’ যেটিকে বলে, সেটিকে মনে হচ্ছিল এক দিক থেকে ঢুকে গেছে। আমি যা বোঝার বুঝে গেছি। ফিজিও বুঝেছে। শান্ত এসেছিল মাঠে, ও বলছিল, ‘ভাই, আঙুলের অবস্থা দেখে ভয়ে আমি চোখ সরিয়ে নিয়েছি।’

হাত দেখার পরই আমি বুঝে গেছি যে চিড় ধরেছে। ফিজিও মাঠে যাওয়ার পর কিন্তু খুব দ্রুতই মাঠ ছেড়েছি। এমনিতে অন্য ক্ষেত্রে হয়ত একটু গ্লাভস পরে দেখা, হাত বাঁকিয়ে, নাড়িয়ে দেখা, একটু শ্যাডো করা, ওসব করে বোঝার চেষ্টা করতাম অবস্থা। কিন্তু এটা চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছিল, সব শেষ।

অধিক শোকে পাথরের অবস্থা হয়েছিল। এত বেশি ব্যথা ছিল, এক পর্যায়ে জায়গা অবশ হয়ে গিয়েছিল যেন। কিছু অনুভব করছিলাম না। হাসপাতাল থেকে ফিরে যখন হাত স্লিংয়ে ঝোলানো, তখন থেকে আবার ব্যথাটা বুঝতে শুরু করেছি।

ছবি: আইসিসি

 

হাসপাতালে যাওয়ার সময় বা চিকিৎসার সময়টুকুতে দলের কথা মনে পড়েনি? আপনি মাঠ ছাড়ার সময় খুব বিপদে ছিল দল...

তামিম: আমি স্কোরে চোখ রাখছিলাম। হাসপাতালে যাওয়ার পর দেখলাম অবস্থা ভালোই। মুশফিক ও মিঠুনের জুটি যখন ছিল। হাসপাতাল থেকে ফেরার পথে দেখলাম যে দ্রুত কয়েকটি উইকেট পড়ে গেছে। খারাপ লাগছিল যে হেরে না যাই আবার! যখন ড্রেসিং রুমে ঢুকলাম, মিরাজ তখন আউট হয়ে ফিরছে। তখন থেকেই মাশরাফি ভাইয়ের নাটক শুরু।

কেমন নাটক?

তামিম: আমি ড্রেসিং রুমে ফেরা মাত্র, হাতের অবস্থা কিছু জিজ্ঞেস না করেই তার প্রথম কথা, ‘তামিম, তোকে কিন্তু ব্যাট করতে হবে। মুশফিক টিকে থাকলে তু্ই ব্যাটিংয়ে নামবি।’

আমি ভেবেছি, উনি ফাজলামো করছেন। উনি তো দেখছেন যে আমার হাতে এতবড় ব্যান্ডেজ করা। আমিও মজা করে ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ’ করে গেছি। কিন্তু উনি দেখি একটু পরপরই আমাকে বলছেন যে, তোকে নামতে হবে। তিনি সত্যিই চাইছেন বোঝার পর আমিও ঠিক করলাম যাব।

তখন অনেক ধরনের আলোচনা হচ্ছিল ওখানে। মাশরাফি ভাই, সুজন ভাই (ম্যানেজার খালেদ মাহমুদ), কোচ, আমরা সবাই কথা বলছিলাম কোন অবস্থায় নামা যাবে। ঠিক হলো যে শেষ ওভার পর্যন্ত গেলে আর মুশফিক স্ট্রাইকে থাকলে আমি নামব।

ফিজিওর পরামর্শ কি ছিল?

তামিম: একদম ‘শুরু থেকেই সে ‘না’ করে আসছিল। হাতের যে অবস্থা, এখানে ঝাঁকি লাগানো যাবে না। কাজেই দৌড়ানো যাবেই না। স্ট্রাইক নিয়ে বল খেলা তো বহুদূর। মাশরাফি ভাই সেটি কানে তোলেননি। রুবেল যখন ব্যাট করছিল, ততক্ষণে মাশরাফি ভাই কাঁচি দিয়ে গ্লাভস কাটা শুরু করেছেন। কাউকে কিছু বলার সুযোগ দেননি। আমি বলতে চাইছিলাম যেন নতুনটা না কেটে পুরোনো গ্লাভস কাটেন। সেটির অপেক্ষাও করেননি। নতুনটিই কেটেছেন। তার এক কথা, নামতেই হবে।

ততক্ষণে একজন এসে প্যাড পরানো শুরু করল। আরেকজন আরেক প্যাড। কেউ এসে জুতা বেধে দিচ্ছে। লজ্জার কথা কি বলব, মাশরাফি ভাই এসে অ্যাবডমিনাল গার্ড পরিয়ে দিলেন। ক্রিকেট ইতিহাসে মনে হয় প্রথমবার, অধিনায়ক নিজ হাতে দলের কারও গার্ড পরিয়ে দিলেন।

এরপর রুবেল আউট হলো। মুস্তাফিজও আউট হলো। আমার ব্যাটিংয়ে নামলে স্ট্রাইক নিতে হবে। ফিজিও সমানে না করছেন। কিন্তু মাশরাফি ভাইয়ের ক্রমাগত কথার পর আমার মনেও গেঁথে গেছে যে আমি পারব। নেমে গেলাম।

মাঠে ঢোকার মুখে কোচ বললেন, ‘তামিম, যেও না।’ আমি বললাম, ‘পারব।’ কোচ বললেন, ‘শিওর?’, আমি বললাম, ‘অবশ্যই।’ কোচ আবার বললেন, ‘দেন ইটস ইওর কল।’ আমি হাঁটতে হাঁটতে বললাম, ‘অফকোর্স মাই কল।’

আমি তখন আসলে অন্য একটা জগতে চলে গিয়েছিলাম। ঘোরের মধ্যে ছিলাম যেন। গ্যালারিতে যেভাবে চিৎকার করেছে লোকে, সেটিও আমাকে সাহস জুগিয়েছে।

শুধু অধিনায়ক চেয়েছেন বলেই নিশ্চয়ই যাননি! নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া কিভাবে করলেন?

তামিম: আমি ততক্ষণে জেনে গেছি আমার এশিয়া কাপ শেষ। অনেক আশা নিয়ে যে টুর্নামেন্টে এসেছিলাম, সেটি আর নেই। হুট করে যখন আরও কিছু করার সুযোগ এলো, আমার মনে হলো করা উচিত। আর একটি বলও যদি খেলি, আরেকটু যদি দলে অবদান রাখতে পারি, তাহলেও তো কিছু করা হলো। আমার মনে হচ্ছিল, আর ৫টা রান যোগ করলেও অনেক কিছু। ভাবতেও পারিনি ৩২ রান হবে। দলও এতটা ভাবতে পারেনি। মুশফিক যা করেছে, তা অসাধারণ।

আমার জন্য ব্যাপারটি ছিল খুবই ইমোশনাল ও প্যাশনেট। দুটি মিলিয়েই ছিল অনুভূতি। উইকেটে গিয়ে আমি যখন দাঁড়ালাম, বোলার যখন আসছিল, আমার মাথায় ছিল না যে হাতে ব্যান্ডেজ বা ব্যথা। একটাই ভাবনা ছিল যে কোনোভাবে বলটা আটকাতে হবে।

আপনি একহাতে ব্যাট করলেও বিস্ময়কর ছিল যে আপনার স্টান্স, বডি শেপ, হেড পজিশন, সব একদম নিখুঁত ছিল...

তামিম: এসবই শুধু নয়, খেয়াল করেছেন কিনা, আমার ফ্রন্টফুট প্রেসও পারফেক্ট ছিল। কারণ আমি প্রচণ্ড ফোকাসড ছিলাম। চিন্তা করেছি, আমার যতটা সাধ্য আছে, সবটা দিয়ে হলেও বলটা ঠেকাতে হবে।

আপনার জন্য লেগ গালিতে ফিল্ডার রাখা হয়েছিল তখন। যেটি ইঙ্গিত দেয় বাউন্সারের। আবার অনেক সময় ব্যাটসম্যানকে বিভ্রান্ত করতেও ওই পজিশনে ফিল্ডার রাখা হয়। বাউন্সারের ধারণা দিয়ে আসলে ফুল লেংথ করা হয়। আপনি কি ভাবছিলেন?

তামিম: আমিও দুটিই ভাবছিলাম। তবে মানসিকভাবে বেশি প্রস্তুত ছিলাম ফুল লেংথ বা ইয়র্কারের জন্য। কারণ সেটিকেই আমার বেশি বিপজ্জনক মনে হচ্ছিল। এক হাতে তো দ্রুত ব্যাট নামানো যায় না। উইকেট সোজা ভালো ইয়র্ক বা ফুল লেংথ হলে এক হাতে ঠেকানো কঠিন হতো।

বাউন্সার নিয়ে ভয় বেশি ছিল না। কারণ জানতাম, ব্যাট দিয়ে বা হাতে-গায়ে লাগিয়ে হলেও ঠেকাব। তবে সত্যি বলতে, এখন যেভাবে গুছিয়ে বলছি, তখন এতটা গুছিয়ে ভাবিনি। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে মাথায় এসব খেলে গেছে, এই আর কী।

দ্রুত একের পর এক সঙ্গী হারানোয় মুশফিককে খুব বিচলিত মনে হচ্ছিল। আপনি যাওয়ার পর আবার তাকে মনে হয়েছে দারুণ উজ্জীবিত...

তামিম: আমি যে নামছি, এটা তো বুঝতে পারছিল। তবে মুশফিক ভাবতে পারেনি যে আমি এক হাতে ব্যাট করব। খেলার সময় দেখে চমকে গেছে। এটাই হয়ত ওকে অনুপ্রাণিত করেছে। আর নিজের কাজটাও বুঝে গেছে তখন সে। জানত ওকে কি করতে হবে। যতটা দারুণভাবে তা করেছে, এতটা আমরা ভাবতে পারিনি।

আমি তখন এমন ঘোরে ছিলাম, মুশফিক কি কি শট খেলেছে, সেটাও মাথায় ঢোকেনি। পরে যখন হাইলাইটস দেখেছি, তখন মনে হলো, ‘এই রিভার্স ফ্লিক কখন খেলল?’ আমি শুধু ভাবছিলাম আমার ওখানে থাকতে হবে। ৫ বা ৬ নম্বর বলে দৌড়াতে হবে। ব্যস।

যদি আরও বল খেলতে হতো?

তামিম: খেলতে হলে খেলতাম! আমাকে তো দৌড়াতেও নিষেধ করেছিল। দৌড়েছি না? মুশফিকের সঙ্গে দুটি সিঙ্গেল নিয়েছি। মাঠে নামার পর যা করতে হতো, করতাম।

শ্রীলঙ্কানদের কাছ থেকেও তো তুমুল প্রশংসা পেয়েছেন। অ্যাঞ্জেলো ম্যাথিউসের একটি ছবি নিয়ে অবশ্য বিভ্রান্তি ছড়িয়েছে। ছবিতে দেখা যাচ্ছে শ্রীলঙ্কান অধিনায়ক হাঁটু গেড়ে বসে আপনার সামনে!

তামিম: ওটা আসলে তেমন কিছু ছিল না। জুতার ফিতা খুলে গিয়েছিল আমার। ও বেঁধে দিয়েছিল। তার পর ওঠার সময় হাত দিয়ে পায়ে চাপড়ে বাহবা দিয়েছে। এমনিতে অবশ্য ওদের অনেকেই ভালো ভালো কথা বলেছে। তবে হোটেলে ফেরার পর মজা করে ওরা কয়েকজন বলছিল, ‘কি দরকার ছিল নামার আমাদের হারিয়ে দিলে!’

ড্রেসিং রুমে ফেরার পর অধিনায়ক ও সতীর্থদের প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল?

তামিম: অবশ্যই সবার জন্য ইমোশনাল মুহূর্ত ছিল। বিশেষ করে মুশফিক ও রকমভাবে শেষ করতে পারায় সবাই আরও খুশি ছিল। আর মাশরাফি ভাইয়ের কথা কি বলব। শুধু এদিনই তো নয়, আগেও উনি আমার জন্য যা করেছেন, মনে হয় না বিশ্বের কোনো অধিনায়ক তা করেন।

অন্য অধিনায়কেরা শুধু ভালো খেলাটাই নিশ্চিত করেন। কিন্তু মাশরাফি ভাই আমার মানসিক শান্তি নিশ্চিত করতে চেয়েছেন। আমার কিভাবে চলা উচিত, নিজেকে কিভাবে গড়া উচিত, গোছানো উচিত, উপস্থাপন করা উচিত, সব দেখিয়ে দিয়েছেন। এমনিতে আমার খুব একটা বাজে অভ্যাস নেই। পার্টি করি না, ড্রিংক করিনি কখনও, এসবে আগ্রহ নেই। কিন্তু এর বাইরেও আরও অনেক ব্যাপার আছে। কোন ব্যাপারগুলো আমাকে খোঁচায়, ভোগায়, অস্বস্তি হয়, কিভাবে সেসব দূর করা উচিত, সব পরামর্শ উনি দিয়েছেন। আমার জীবনে তিনি অনেক গুরুত্বপূর্ণ একজন।

অনেকের কাছ থেকে অনেক বার্তা পেয়েছেন, প্রশংসা পেয়েছেন, কিছু কিছু কি ভাগাভাগি করা যায় পাঠকেদর সঙ্গে?

তামিম: সেদিনই তো সাঙ্গাকারা, লক্ষনের মতো কিংবদন্তিরা দাঁড়িয়ে তালি দিয়েছে। আরও অনেকেই ম্যাসেজ পাঠিয়েছে। ফোন করেছে। সবার কথায়ই আমার প্রতি ভালোবাসা ছিল। সবাইকেই আমি সম্মান জানাই।

তবে আমাকে সবচেয়ে বেশি স্পর্শ করেছে একজনের লেখা। আমার ফাদার ফিগারের মতো, আমার অনেক সিনিয়র কিন্তু আবার বন্ধুও, উনার সঙ্গে অনেক সময় কাটাই। নাম ইয়াসির মাহমুদ। জীবনের সবকিছু নিয়ে উনার কাছ থেকে আমি অনেক পরামর্শ নেই। উনার লেখাটি আমার জন্য এটি ছিল দারুণ ইমোশনাল। তার লেখাটি দেখে আমার চোখে পানি চলে এসেছিল।