এই ম্যাচও হারল বাংলাদেশ!

৫ ওভারে প্রয়োজন ৪০। হাতে ৭ উইকেট। ২ ওভারে চাই ১৪, উইকেট ৬টি। এই সময়ের বাস্তবতায় চাইলেও যেন হারা কঠিন। কিন্তু সেই অসাধ্য সাধন করেই ছাড়ল বাংলাদেশ! সহজ ম্যাচ কঠিন করে আরও একবার ভজকট পাকাল শেষে; হার মানল স্নায়ুর লড়াইয়ে। হাতের মুঠোয় থাকা জয় উপহার দিল ওয়েস্ট ইন্ডিজকে।

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 July 2018, 10:50 PM
Updated : 26 July 2018, 05:44 AM

দ্বিতীয় ওয়ানডেতে বাংলাদেশকে ৩ রানে হারিয়েছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ৩ ম্যাচের সিরিজে ফিরিয়েছে সমতা।

গায়ানায় বুধবার শিমরন হেটমায়ারের অসাধারণ সেঞ্চুরিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজ তুলেছিল ২৭১ রান। জয় নাগালে পেয়েও বাংলাদেশ শেষ পর্যন্ত থমকে গেছে ২৬৮ রানে।

ছবি: ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট

২০১৬ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বেঙ্গালুরুতে ভারতের বিপক্ষে সেই ম্যাচের ভূতই যেন চেপেছিল আবার। আবারও শেষের ট্র্যাজেডির প্রেক্ষাপটে মুশফিক ও মাহমুদউল্লাহ!

দুজনের দুর্দান্ত জুটি বাংলাদেশকে নিয়ে যাচ্ছিল জয়ের পথে। কিন্তু ৫ ওভারে যখন প্রয়োজন ৪০, অহেতুক রান নিতে গিয়ে রান আউট মাহমুদউল্লাহ।

মুশফিকের দুর্দান্ত ব্যাটিংয়ে এরপরও বাংলাদেশ পৌঁছে গিয়েছিল জয়ের দুয়ারে। শেষ দিকে সর্বনাশ দুটি ফুলটসে। ৭ বলে যখন প্রয়োজন ৮, সাব্বির রহমান ক্যাচ দিলেন ফুলটসে।

শেষ ওভারের প্রথম বলে জেসন হোল্ডারের ফুল টসে ক্যাচ দিলেন ৬৭ বলে ৬৮ রান করা মুশফিক।

ছবি: ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট

পরের দুই বলে রান নিতে পারলেন না মোসাদ্দেক হোসেন। চতুর্থ বলে হলো দুই রান, পঞ্চম বলে সিঙ্গেল। শেষ বলে মাশরাফি বিন মুর্তজা নিতে পারলেন কেবল এক রান। জয়ের কাছে গিয়েও আরও একটি হারে তখন স্তব্ধ বাংলাদেশের ড্রেসিং রুম। আর হোল্ডারের কণ্ঠে জয়ের হুঙ্কার। ইনিংসে নিজের প্রথম ওভারে দিয়েছিলেন ২০ রান। কিন্তু শেষের নায়ক ক্যারিবিয়ান অধিনায়কই।

অথচ রান তাড়ায় বাংলাদেশের শুরুটা ছিল উড়ন্ত। আগের ম্যাচে শূন্য রানে ফেরা এনামুল হক তোলেন ঝড়।

ইনিংসর প্রথম ওভার থেকে আসে ১১। দ্বিতীয় ওভারে জেসন হোল্ডারকে দুটি ছক্কা মারেন এনামুল, যার একটি আছড়ে পড়ে স্টেডিয়ামের ছাদে।

তবে নিজের রাশ টানতে না পারার খেসারত দিতে হয়েছে এনামুলকে। তৃতীয় ওভারে আবার তেঁড়েফুঁড়ে মারতে গিয়ে বোল্ড আলজারি জোসেফের বলে।

ছবি: ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট

এনামুলের ৯ বলে ২৩ রানের ইনিংসটি অবশ্য রান রেটের চিন্তা দূর করে দিয়েছিল। বাউন্ডারির স্রোত ধরে রাখেন তামিম ও সাকিবও। ৪.৪ ওভারেই বাংলাদেশ ছুঁয়ে ফেলে পঞ্চাশ, নিজেদের ওয়ানডে ইতিহাসের দ্রুততম দলীয় ফিফটি!

অফ স্পিনার অ্যাশলি নার্স আক্রমণে আসার পর দারুণ বোলিংয়ে ভুগিয়েছেন দুই ব্যাটসম্যানকেই। এরপরও দলের শতরান আসে ১৫ ওভারের আগেই।

কিন্তু সাকিব এক-দুই করে এগোলেও ধীরে ধীরে আরও খোলসে ঢুকে যান তামিম। রানের গতিতে ভাটার টান তীব্র হতে থাকে। ক্রিস গেইলের স্পিনও আরও কঠিন করে ফাঁস।

সেই অতিরিক্ত ডট বল খেলাই শেষ পর্যন্ত কাল হয়েছে। ক্রিজে দুই বাঁহাতি দেখে দীর্ঘসময় বিশুর লেগ স্পিন সরিয়ে রেখেছিলেন জেসন হোল্ডার। এক পর্যায়ে আনতে বাধ্য হন। তামিমও অস্থির হয়ে ওঠেন বড় শট খেলতে। প্রথম ওভারেই বিশুকে উপহার দেন উইকেট।

আগের ম্যচে ডাবল সেঞ্চুরি জুটি গড়া দুই ব্যাটসম্যানের জুটি এবার থামে ৯৭ রানে।

ছবি: ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট

তামিমের ৮৫ বলে ৫৪ রানের ইনিংসটির দুই ভাগ তুলে ধরে তার ব্যাটিংয়ের উল্টো যাত্রা। ১৮ বলে করেছিলেন প্রথম ২৭ রান, পরের ২৭ করেছেন ৬৭ বলে!

সাকিব অবশ্য খেলছিলেন নির্বিঘ্নে। কিন্ত শেষটা হয় তামিমের মতোই আত্মহত্যায়। নার্সকে অযথাই জায়গা বানিয়ে খেলতে গিয়ে ক্যাচ দিয়ে ফেরেন ৫৬ রানে (৭২ বল)।

বাংলাদেশ তখন প্রচণ্ড চাপে। ২৮ বলে প্রথম পঞ্চাশ করা দলের পরের দুটি পঞ্চাশে লাগে ৬১ ও ৯৯ বল। হুট করেই উইকেটে মিলতে থাকে ভয়ঙ্কর টার্ন ও বাউন্স।

দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই করে সেই সময়টা পার করে দেন মুশফিক ও মাহমুদউল্লাহ। ১৭ রানে বিশুর বলে স্লিপে গেইলের হাতে জীবন পান মাহমুদউল্লাহ। মনে হচ্ছিল, সেটিই ভোগাবে ক্যারিবিয়ানদের। তা আর হয়নি। ৩৯ রান করে মাহমুদউল্লাহ ফিরলেন রান আউট হয়ে। জুটি থামল ৮৭ রানে।

শেষ দিকে দ্রুত রান তোলার জন্যই যাকে দলে রাখা, সেই সাব্বির রহমান প্রয়োজনের সময় ব্যর্থ আরও একবার (১১ বলে ১২)।

দুর্দান্ত খেলতে থাকা মুশফিক ছিলেন বলে তবু ছিল আশা। কিন্তু আরও একবার সমাপ্তি হতাশায়।

শেষ ওভারের নায়ক হোল্ডার অবশ্য ম্যাচের সেরা নন। ওয়েস্ট ইন্ডিজকে খাদের কিনারা তুলে থেকে আনা সেঞ্চুরিতে এদিনের সেরা হেটমায়ার। ৯৩ বলে করেছেন ১২৫ রান। দলের বাকি সবাই মিলে ২০৫ বলে ১৩৭!

আগের রাতে টানা বৃষ্টি আর ঢেকে রাখা উইকেটের আর্দ্রতার কাজে লাগাতে টস জিতে আগে বোলিং নিয়েছিল বাংলাদেশ। পরিকল্পনা সফল হওয়ার পথেও ছিল। ক্যারিবিয়ানরা এগোচ্ছিল খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। প্রথম চারটি জুটিই ২০ ছুঁয়েছে, কিন্তু কোনোটিই ছাড়াতে পারেনি ৩০।

ছবি: ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট

ক্রিস গেইল ও এভিন লুইসের উদ্বোধনী জুটি ছিল ২৯ রানের। প্রথম ব্রেক থ্রু এদিনও আসে মাশরাফি বিন মুর্তজার হাত ধরে।

মাশরাফির একটি শর্ট বলে বল গ্যালারিতে ফেলেছিলেন লুইস। বাংলাদেশ অধিনায়ক শোধ তোলেন দারুণভাবে। অ্যাঙ্গেল বদলে রাউন্ড দা উইকেটে করা বল কাট করে ঢোকে ভেতরে। ১২ রানে এলবিডব্লিউ হয়ে ফেরার সময় লুইস শেষ করে যান দলের একমাত্র রিভিউটি।

৩৮ বলে ২৯ রান করা গেইলকে ফেরান মেহেদী হাসান মিরাজ। রুবেল হোসেন নিজের প্রথম ওভারেই ফেরান জেসন মোহামেদকে। ২৫ রান করা শেই হোপকে দারুণ বোলিংয়ে ফেরান সাকিব। ২৪তম ওভারে ১০২ রানে ওয়েস্ট ইন্ডিজ হারায় ৪ উইকেট।

সেখান থেকেই হেটমায়ার ও রভম্যান পাওয়েলের ১০৩ রানের জুটি। ৪৪ রান করা পাওয়েলকে ফিরিয়ে জুটি ভাঙেন রুবেল।

ওই ওভারেই ধরা দিতে পারত হেটমায়ারের কাঙ্ক্ষিত উইকেট। কিন্তু সীমানায় ক্যাচ ছাড়েন সাকিব। বল তার হাতে চুমু দিয়ে আছড়ে পড়ে সীমানার ওপারে!

শুধু এই ক্যাচ ছাড়াই নয়, এদিন বাংলাদেশের ফিল্ডিং ছিল শুরু থেকেই বাজে। বাড়তি রান গুনতে হয়েছে অনেক।

৭৯ রানে জীবন পেয়ে হেটমায়ার দ্রুতই পৌঁছে যান সেঞ্চুরিতে। এক পাশে উইকেট পড়েছে নিয়মিত। আরেক পাশে হেটমায়ার ছুটেছেন অপ্রতিরোধ্য গতিতে। সেঞ্চুরি স্পর্শ করেন ৮৪ বলে। বাংলাদেশের বিপক্ষে ক্যারিবিয়ানদের যেটি দ্বিতীয় দ্রুততম।

২১ বছর ২১১ দিন বয়সে সেঞ্চুরি করে গড়েছেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে ক্যারিবিয়ানে সবচেয়ে কম বয়সে সেঞ্চুরির রেকর্ডও। সেই ১৯৭৮ সালে ডেসমন্ড হেইন্স সেঞ্চুরি করেছিলেন ২২ বছর ৭ দিন বয়সে।

ছবি: ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট

৪২ ওভার শেষে ওয়েস্ট ইন্ডিজের রান ছিল ৪ উইকেটে ২০৫। রুবেল ও মুস্তাফিজের বোলিংয়ে সেখান থেকে রান হয়ে যায় ৯ উইকেটে ২৪২।

কিন্তু ৪৯তম ওভারে রুবেলকে বিশাল দুটি ছক্কায় ওড়ান হেটমায়ার। সেই ওভার থেকে আসে ২২ রান। শেষ ওভারেও ছক্কা মারেন মুস্তাফিজের বলে।

শেষ পর্যন্ত তার রান আউটেই ইনিংসের সমাপ্তি। ৩ চার আর ৭ ছক্কায় ১২৫ করে যখন ফিরছেন, ছুটে গিয়ে তাকে অভিনন্দন জানালেন মাশরাফি-তামিমরা।

ম্যাচ শেষেও অটুট হেটমায়ারের হাসি। হতাশার তিমিরে ডুবে মাশরাফি-তামিমরা।

সংক্ষিপ্ত স্কোর:

ওয়েস্ট ইন্ডিজ: ৪৯.৩ ওভারে ২৭১ (গেইল ২৯, লুইস ১২, হোপ ২৫, হেটমায়ার ১২৫, জেসন ১২, পাওয়েল ৪৪, হোল্ডার ৭, নার্স ৩, পল ৪, বিশু ০, জোসেফ ১*; মাশরাফি ১/৪৪, মিরাজ ১/৪০, মুস্তাফিজ ২/৪৪, মোসাদ্দেক ০/৩১, সাকিব ২/৪৫, রুবেল ৩/৬১)।

বাংলাদেশ: ৫০ ওভারে ২৬৮/৬ (তামিম ৫৪, এনামুল ২৩, সাকিব ৫৬, মুশফিক ৬৮, মাহমুদউল্লাহ ৩৯, সাব্বির ১২, মোসাদ্দেক ৩*, মাশরাফি ১*; জোসেফ ১/৫৫, হোল্ডার ১/৬৬,নার্স ১/৩৪, পল ১/৪৩, গেইল ০/২৬, বিশু ১/৩৯)।

ফল: ওয়েস্ট ইন্ডিজ ৩ রানে জয়ী

সিরিজ: ৩ ম্যাচ সিরিজে ১-১ সমতা

ম্যান অব দা ম্যাচ: শিমরন হেটমায়ার