এই সিরিজ থেকেই বিশ্বকাপের প্রস্তুতি শুরু: মাশরাফি

স্ত্রীর অসুস্থতায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে তার যাওয়া নিয়ে ছিল শঙ্কা। শেষ পর্যন্ত স্ত্রী একটু সুস্থ হওয়ায় যেতে পারছেন মাশরাফি বিন মুর্তজা। মঙ্গলবার প্রথম প্রহরেই উঠবেন বিমানে। যাওয়ার আগে একান্তে সময় দিলেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে। দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশের ওয়ানডে অধিনায়ক কথা বললেন গত কয়েক দিনে নিজের কঠিন সময়, বাংলাদেশ ক্রিকেটের সাম্প্রতিক ব্যর্থতা, ২০১৯ বিশ্বকাপ নিয়ে তার ভাবনা ও পরিকল্পনা এবং প্রাসঙ্গিক আরও অনেক কিছু নিয়ে।

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 July 2018, 04:28 PM
Updated : 16 July 2018, 05:45 PM

আপনার জীবনে কঠিন সময় কম আসেনি। স্ত্রী একবার প্রায় ক্লিনিক্যালি ডেড ছিলেন, ২০১৫ বিশ্বকাপের সময় হাসপাতালে ছিল ছেলে, গত বছর ইংল্যান্ড থেকে দেশে ফিরেছিলেন স্ত্রীর অসুস্থতায়। এবার গুরুতর অসুস্থ স্ত্রীকে রেখে যাচ্ছেন, কতটা কঠিন ছিল সিদ্ধান্ত নেওয়া?

মাশরাফি: সুমিই (মাশরাফির স্ত্রী) আমাকে তাড়া দিয়েছে। আমাদের ওয়ানডে গ্রুপ তো গত শুক্রবার রাতে গেল। সুমি যখন শুনল যে আমি যাচ্ছি না, প্রায় লাফ দিয়ে বিছানা থেকে উঠল। ব্যাগ গুছানো শুরু করল। আমাকে যেতেই হবে, তার নাকি কিছু হবে না।

রোববার ওর একটা চেকআপ ছিল। আমি সেটার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। ও বলছিল যে নিজেই ম্যানেজ করে নেবে, তবু যেন আমি শুক্রবারই যাই। আমি অনেক কষ্টে বুঝিয়েছি। কিন্তু কালকে ডাক্তার যখন বলল যে সামান্য ভালোর দিকে, তখন আর ওকে থামাতে পারিনি।

স্ত্রী অসুস্থ, মেয়েও অসুস্থ আপনার। এই অবস্থায় গিয়ে ক্রিকেটে কতটা মনোযোগ দেওয়া সম্ভব? শুধু তো নিজের খেলাই নয়, এই দুঃসময়ে দল গোছানো, নতুন কোচ, অনেক কিছু দেখতে হবে….

মাশরাফি: দেখুন, গত কিছুদিন আমি শুধু একটি কাজই করেছি। ডাক্তার আর হাসপাতালে ছোটাছুটি। স্ত্রীর পাশে থাকা। ডানে-বাঁয়ে অন্য কিছুতে তাকাইনি। আজ আমি ফ্লাইটে উঠব, তখন থেকে একটি কথাই ভাবব, আমার ক্রিকেট। আমার দল। এখানেও ডানে-বাঁয়ে আর কিছু ভাবব না। না গেলে অন্য কথা ছিল। কিন্তু সিদ্ধান্ত যখন নিয়েছি যাব, তখন আর কোনো কিছুকেই অজুহাত হিসেবে দাঁড় করানোর সুযোগ নেই। ওখানে যাওয়া মানে, ইটস অল অ্যাবাউট ক্রিকেট।

আপনার নিজের প্রস্তুতি তো ঠিকমতো হয়নি, বিশেষ করে বোলিংয়ের ক্ষেত্রে।

মাশরাফি:
প্রস্তুতি আদর্শ হয়নি। এপ্রিলে ঢাকা লিগ হয়েছে, ওই মাসেই বিসিএলের একটি ম্যাচ খেলেছি। তার পর বোলিং নেই। রোজার মাসে তো শুধু জিম করেছি। কদিন আগে বোলিং প্র্যাকটিস শুরু করেছিলাম মাত্র, তার পর তো পারলাম না। অন্তত যাওয়ার আগে কয়েকদিন প্র্যাকটিস করতে পারলে ভালো হতো। তবে যেটা বললাম, মাঠে নেমে পারিবারিক সমস্যা বা কোনো কিছুকে অজুহাত দেখানোর সুযোগ নেই। সাফল্য যেমন আমার, ব্যর্থ হলে দায়ও আমার।

প্রস্তুতি ম্যাচটা খেলতে পারব ১৯ তারিখ, এটা একটা স্বস্তির ব্যাপার। তার পর দেখা যাক, কতটা প্রস্তুত হতে পারি।

যাওয়ার পর অধিনায়ক মাশরাফির প্রথম কাজ কি হবে?

মাশরাফি: সবাইকে নিয়ে বসতে হবে। অনেক দিন পর আমি একটি সিরিজে যাচ্ছি। সবশেষ ওয়ানডে খেলেছি আমরা জানুয়ারিতে। ৬ মাস হয়ে গেছে। এরপর ট্রেনিং-ক্যাম্প হলেও সিরিজ তো ভিন্ন ব্যাপার। তো সবাইকে নিয়ে বসব, কথা বলব। কারও সঙ্গে যদি আলাদা করে কথা বলা প্রয়োজন হয়, সেটিও করতে হবে।

সেটি কি শুধু লম্বা বিরতির কারণে, নাকি দল খারাপ করছে বলেও?

মাশরাফি: সব মিলিয়ে বলতে হবে। দেখুন, এই পর্যায়ে অনুশীলন কেউ কম করে না। মানে কম-বেশি একটা ন্যূনতম পর্যায়ে থাকেই। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে, মানসিকতায় একটু বদল দরকার।

কেমন বদল?

মাশরাফি: কঠিন সময় আসবেই। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে কঠিন সময় অনবরতই আসবে। আমাদেরও যে আগে কঠিন সময় আসেনি, তা নয়। তবে সেই কঠিন সময়টার মোকবেলা কিভাবে করছি, সেটা গুরুত্বপূর্ণ। ভয় নিয়ে আমি কঠিন সময়ের মুখোমুখি হচ্ছি, নাকি সাহস নিয়ে।

আমার কাছে মনে হচ্ছে না, এখন আমরা সাহস নিয়ে মোকাবেলা করছি। আমি চেষ্টা করব যেন দল সাহস নিয়ে এই সময়টার সঙ্গে লড়াই করতে পারে। ব্যর্থতা আসতেই পারে। তিনটি ওয়ানডেই হারতে পারি। ক্রিকেটে হার-জিত আসবেই। কিন্তু আমার কথা হলো, অফেন্স ইজ দা বেস্ট ডিফেন্স। অফেন্স দিয়েই ডিফেন্সকে শক্ত করতে চাই।

মানসিকতার সমস্যা কি টেস্ট সিরিজ দেখার পর মনে হলো?

মাশরাফি:
নাহ, শুধু এই টেস্ট সিরিজ নয়। সত্যি করে বললে, জানুয়রিতে ত্রিদেশীয় ওয়ানডে সিরিজের পর থেকেই এটা ভাবছি। ওই টুর্নামেন্টের ফাইনাল থেকেই আমি ভয়টা দেখতে পাচ্ছি। সাকিব ইনজুরির জন্য ফাইনালে ব্যাট করতে পারল না। আমার মনে হয়, এটা অনেকের মনে প্রভাব ফেলেছিল। ভড়কে গিয়েছিল। ফাইনালে ওই উইকেটে ২২০ রান করতে আমাদের সাকিবকে কেন লাগবে?

ওখান থেকেই দেখছি। এর পর আফগানিস্তানকে সিরিজে রশিদ খানকে নিয়ে ভয়। রশিদ বোলিংয়ে এলেই কেন আউট হব? উইকেট আদায় করে নিক সে! তো এসব নিয়েই কথা বলা দরকার যে ভয় আসলে কতটা। সবাইকে সৎ হতে হবে, আয়নার সামনে দাঁড়াতে হবে। নিজেকে প্রশ্ন করতে হবে।

হতে পারে, কেউ খুব বাজে সময়ে যাচ্ছে। স্কিল বলেন বা মানসিকভাবে হয়ত খুব বাজে অবস্থায় আছে। কিন্তু সেটা ধরে বসে থাকলে চলবে না। প্রকাশ করতে হবে, মোকাবেলা করতে হবে। আমি কিংবা অন্য কেউ না কেউ তো তাকে সাহায্য করতে পারে। সেই উপলব্ধিটা করানো প্রয়োজন।

এমনিতে টেস্ট সিরিজ দেখে আপনার কি মনে হলো, সমস্যা কোথায় ছিল?

মাশরাফি: খুব বেশি দেখতে পারিনি, স্ত্রী অসুস্থ, মেয়ে অসুস্থ। বিস্তারিত মন্তব্যে তাই যাব না। তবে এটুকু বলতে পারি, যেমন ব্যাটিং হয়েছে, ততটা বাজে আমরা নই। এখন জোর গলায় দাবি করলে হয়ত লোকে নেতিবাচকভাবে নেবে। তবে সত্যিটা হলো, আমরা টানা একশ-দেড়শতে আটকে থাকার দল নই।

স্কিল একটা বড় ব্যাপার অবশ্যই। প্রথম টেস্ট যে উইকেটে হয়েছে, সে সব উইকেটে খেলার অভিজ্ঞতা সিনিয়র ব্যাটসম্যানদেরও ততটা নেই। তবে স্কিলের ঘাটতি ক্রিকেটে অনেকভাবেই পুষিয়ে দেওয়া যায়। আমার মনে হয়ে, মানসিকতায় আমরা পিছিয়ে ছিলাম।

দেখুন, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সবচেয়ে জরুরি হলো নিজেকে খুব ভালো করে জানা। প্রতিপক্ষের চেয়েও বেশি জরুরি নিজেকে নিয়ে ভাবা। একজন বোলারের বল হয়তো আপনি অনেক খেলেছেন। তার মানে এই নয়, তার সবকিছু আপনি জেনে ফেলেছেন। খুব ভালো একটি বলে আউট হতেই পারেন। কিন্তু আপনি নিজেকে জানলে ওই ব্যাপারগুলোর নিয়ন্ত্রণ আপনার হাতে থাকবে।

সাকিব, তামিম নিজেদের খুব ভালো চেনে। এই সিরিজটা হয়ত ভালো যায়নি। কোনো কিছুই পক্ষে আসছে না। ভালো সময়ের পর খারাপ সময় যেমন আসবেই, তেমনি খারাপের পর সুসময় আসাও অবধারিত। মানসিকতার কথা বারবার এই কারণে বলছি যে, মানসিকভাবে শক্ত থাকলে খারাপ সময়টা বেশি স্থায়ী হবে না।

মানসিকভাবে এ রকম বিধ্বস্ত একটা দলকে চাঙা করার কাজ তো সহজ নয়!

মাশরাফি:
কঠিন ভাবলে কঠিন। বলতে পারেন যে দার্শনিকের মতো কথা বলছি, কিন্তু সত্যিটা তো হলো এই যে দুনিয়ায় বেঁচে থাকাই অনেক কঠিন! তো এই খারাপ সময়কে এত কঠিন ভাবার কিছু নেই।

আমার কাছে মনে হয়, সবকিছু বদলানো স্রেফ একটি মুহূর্ত বা একটি ঘটনার ব্যাপার। মনে করুন, প্রথম ওয়ানডেতে যদি আমরা আগে ব্যাট করি, যদি একশ রানের উদ্বোধনী জুটি হয়, কিংবা আগে বল করলাম, ১০০ রানের মধ্যে ৩-৪ উইকেট তুলে নিলাম, দেখা যাবে সবাই চাঙা হয়ে উঠবে।

আমি ব্যাপারগুলো এভাবেই দেখি। একটা ঘটনাই অনেক সময় মানুষের জীবনই বদলে দেয়। একটা দলের বদলে যাওয়া সেই তুলনায় কিছুই না। তবে হ্যাঁ, সেই ঘটনা আমাদেরই ঘটাতে হবে। হয়তো নাও হতে পারে। কিন্তু সেই বিশ্বাসটা রাখতে হবে।

নতুন কোচের সঙ্গে খুব বেশি সময় তো কাটাতে পারেননি। তার ধরনের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়াটাও তো গুরুত্বপূর্ণ?

মাশরাফি: এখনও খুব বেশি মেশা হয়নি। আমি এমনিতে কমফোরটেবল মানুষ। কারও সঙ্গে আমার মিশতে, কিংবা কারও আমার সঙ্গে মিশতে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। ওখান যাওয়ার পর কোচের সঙ্গে কথা হবে। ওর ভাবনা, চিন্তা, পরিকল্পনা নিশ্চয়ই আছে। তার সঙ্গে আমার আর সাকিবের ভাবনার সমন্বয় করতে হবে।

জানুয়ারিতে দেশের মাটিতে ত্রিদেশীয় সিরিজের শেষ ভাগ থেকে শুরু করে গত কিছুদিনে যত ব্যর্থতা, লম্বা সময় ধরে প্রধান কোচ না থাকাও কি একটা বড় কারণ?

মাশরাফি: সেটা বললে অজুহাত দেখানো হবে। আমি এসব অজুহাত দাঁড় করাতে চাই না। সিম্পলি আমাদের ব্যর্থতা। আমরা পারিনি, যেটা পারা উচিত ছিল।

হ্যাঁ, কোচ একটা বড় ব্যাপার অবশ্যই। কিন্তু দিন শেষে খেলতে তো আমাদেরই হবে। ওই ক্রিকেটাররাই আছে। কোচ থাকলে উনিশ-বিশ হতে পারে। কিন্তু ত্রিদেশীয় সিরিজে ফাইনালের আগে ৮৪ রানে অলআউট বা এবার ৪৩ করা, দেড়শ করত না পারা, এসব তো কোচের ব্যাপার নয়। আমরাই পারিনি।

ত্রিদেশীয় সিরিজে প্রথম তিন ম্যাচে আমরা দারুণ খেলেছি, শ্রীলঙ্কাকে দেড়শ রানে হারিয়েছি। তখন তো হাথুরুসিংহে আমাদের কোচ নয়। আমরা পেরেছিলাম। এরপর আমরাই পারিনি। ৮৪ রানে অলআউট থেকে খারাপের শুরু হলো। আমি মানসিকতার ব্যাপারটিকেই মূল সমস্যা মনে করি। সংশয়ের বীজ ঢুকে গেছে হয়ত, সেটা বের করতে হবে।

বিশ্বকাপের আর এক বছরও নেই। দল গুছিয়ে নেওয়া, ঘাটতিগুলো পূরণ করা, প্রস্তুত হওয়ার শুরু কি এই ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজ থেকেই?

মাশরাফি: বিশ্বকাপে আমিই থাকব কিনা কে জানে! ২০১১ বিশ্বকাপেও তো থাকতে পারিনি, (হাসি)!

তবে সিরিয়াসলি বললে, বিশ্বকাপ নিয়ে তো অবশ্যই ভাবতে হবে এখন থেকে। এখান থেকেই প্রস্তুতি শুরু। প্রতিটি সিরিজ এখন থেকে গুরুত্বপূর্ণ।

কিছু সুনির্দিষ্ট জায়গা আছে, যেখানে কিছু ক্রিকেটারকে নিয়ে এখন থেকেই গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হবে। বিশ্বকাপে যাকে আমরা চাই, তাকেও তো পর্যাপ্ত সময় আমাদের দিতে হবে। ১ বছর সময় আছে। কিছু জায়গা আছে, তারা পারফর্ম না করলেও বিশ্বকাপের আগে তাদের বদলের সুযোগ নেই। ফর্ম না থাকলে ফেরানোর চেষ্টা করতে হবে। আর কিছু জায়গা নিয়ে কাজ করতে হবে।

আলাদা করে যদি বলা হয়, বিশ্বকাপে ওপেনিং জুটিতে তামিমের সঙ্গী কাকে দেখছেন?

মাশরাফি:
এই মুহূর্তে বিজয়ের (এনামুল হক) ওপর পুরো বিশ্বাস রাখতে চাই। ত্রিদেশীয় সিরিজে দলে ছিল, এই সিরিজে আছে। যেহেতু তাকে দলে নেওয়া হয়েছে, আমি দ্বিতীয় কাউকে নিয়ে চিন্তা করতে চাই না। চাইব, সে সুযোগটা লুফে নিক। বিশ্বকাপ আসতে আসতে যেন শুধু জায়গা পাকা করাই নয়, দলের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে ওঠে।

ব্যাটিং অর্ডারে তিন নম্বর পজিশনের সমাধান তো এখনও মিলল না!

মাশরাফি: সবচেয়ে বড় ভাবনা তিন নম্বর নিয়েই। এই সিরিজের দলে আছে লিটন, সাব্বির ও শান্ত। তিনজনের সুযোগ আসতে পারে। এই সিরিজে শুরুতে একজনের সুযোগ আসবে। সে খারাপ করলে এই সিরিজে বা পরে অন্য কারও সুযোগ আসবে। ওপেনিংয়ের মতো এখানেও চাইব, কেউ একজন জায়গাটা নিজের করে নিক। সেটা যত দ্রুত সম্ভব। বিশ্বকাপের কাছাকাছি গিয়েও যদি আমরা না জানি যে তিন নম্বরে থিতু কে, তাহলে সেটা দলের জন্য বিপদ হবে।

নতুন কোচ এসেছেন। তারও নিশ্চয়ই ভাবনা আছে। আমি যা চিন্তা করছি, সেটাই যে ঠিক, তা আমি কখনোই বিশ্বাস করি না। কোচের সঙ্গে কথা বলতে হবে। সাকিবের সঙ্গে কথা বলতে হবে। সবার মত নিয়েই সিদ্ধান্ত হবে। তবে যেটা বললাম, এই সিদ্ধান্তগুলো নেওয়ার সময় এখন দরজায় কড়া নাড়ছে। দ্রুত সমাধানে আসতে হবে।

চার-পাঁচ-ছয়ে তো মুশফিক, রিয়াদ, সাকিব আছেই, যে যেখানেই ব্যাট করুক। ওদেরই থাকবে জায়গা।

সাত-আট?

মাশরাফি: সাত-আটেও ভাবনার ব্যাপার আছে। এই সিরিজে হয়তো সাতে মোসাদ্দেক, আটে মিরাজকে ভাবছি আমরা। পেস বোলিং অলরাউন্ডার থাকলে খুব ভালো হতো, কিন্তু তেমন কাউকে তো পাচ্ছি না।

সাইফ উদ্দিন খেলেছেন, আরিফুল আছেন…

মাশরাফি: আমরা যে পজিশনের জন্য পেস বোলিং অলরাউন্ডার চাই, সেখানে তাকে আগে হতে হবে ভালো বোলার। মানে বোলিং প্রধান অলরাউন্ডার। ব্যাটিংয়ে পরিস্থিতি অনুযায়ী ৩০-৩৫ করলেই হবে, বোলিংটা খুব ভালো হতে হবে।

সাইফ উদ্দিনের সম্ভাবনা আছে ভালো। তবে এখনও পুরো প্রস্তুত নয় মনে হয়। যদি উন্নতি করতে তাকে, তাহলে তো আমাদের চেয়ে খুশি কেউ হবে না। কিন্তু তাকে সেই জায়গাটায় যেতে হবে। ‘এ’ দলের খেলা হচ্ছে, সামনে আরও আছে। সাইফ বলেন বা আরিফুল, বা অন্য কেউ, তাদের সুযোগ আছে।

ওপেনিংয়ে যদি এনামুল জায়গাটা নিজের করে না নিতে পারে?

মাশরাফি: লিটন এখানেও বিকল্প হতে পরে। ইমরুলকে ছুঁড়ে ফেলা হয়নি। খুব করে চাইব, ‘এ’ দলের হয়ে সৌম্য রান করুক। সুযোগ তাই অনেকেরই আছে। তবে প্রথম চাওয়া, বিজয় যেহেতু এখন দলে আছে, মনে-প্রাণে চাই সে যেন ক্লিক করে।

বিজয়ের একটা বড় গুণ সে বড় ইনিংস খেলতে পারে। হাতে শটও আছে অনেক। কিছু সুনির্দিষ্ট কারণে সে দলের বাইরে ছিল। আশা করব সেই জায়গাগুলায় উন্নতির প্রমাণ দিতে পারবে। ওকে সেই বিশ্বাস, সেই ভরসা দল দেবে। সেটা আমরা সৌম্য, লিটন, ইমরুলদেরও দিয়েছি। ওকেও সেই মানসিক সাপোর্ট দেওয়া হবে। এখন বাকিটা তার ওপর।

এখন যেহেতু সুযোগ পাচ্ছে, তাহলে জানুয়ারিতে ত্রিদেশীয় সিরিজের ফাইনালে এনামুলকে বাদ দেওয়া কতটা যৌক্তিক ছিল?

মাশরাফি: সেটা ভুল ছিল। আমারই ভুল ছিল। কারণ, বলতে গেলে আমার একার সিদ্ধান্তেই ফাইনালে মিঠুনকে খেলিয়েছিলাম। বিজয় আগের ম্যাচগুলো ভালো করেনি, মনে হয়েছিল মিঠুন ক্লিক করতে পারে।

সেটা বিজয়ের প্রতি অন্যায় ছিল, হুট করে ফাইনালে মিঠুনকে খেলানো মিঠুনের প্রতিও অন্যায় ছিল। আমার পরে মনে হয়েছে, আমার জীবনের অন্যতম ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। ক্রিকেটে সব সিদ্ধান্ত সব সময় ক্লিক করবে না, সেটাও মানতে হবে। সেই ভুলই এখন শোধরাতে চাই। বিজয় এবার আবার সুযোগ পাবে খেলার। সে কাজে লাগালে দলের খুব ভালো হয়।

পেস বোলিংয়ের কথা বললে, মুস্তাফিজের একের পর এক চোট তো বড় দুর্ভাবনার জায়গা…

মাশরাফি: এটা ওকেই সবচেয়ে বেশি বুঝতে হবে। নিজের শরীরকে নিজের বোঝাটা জরুরি। ওর শরীর কতটা নিতে পারবে, সেটা ওকেই বুঝতে হবে। ওর যদি মনে হয়, পরের বছর আইপিএল খেললে ইনজুরড হতে পারে, তাহলে আমি বলব বিশ্বকাপের আগে আইপিএল না খেলতে। যদি ওর মনে হয়, আইপিএলসহ সব খেলেও ফিট থকতে পারবে, তাহলে খেলুক। আমি বা আমরা পরামর্শ দিতে পারি, সিদ্ধান্ত ওকেই নিতে হবে। আমি যেটা বলতে পারি, ওর ফিট থাকা আমাদের জন্য খুব জরুরি। তাহলে একটা জায়গা নিয়ে আমাদের চিন্তা থাকে না।

আপনি আর মুস্তাফিজ ফিট থাকলে, সম্ভাব্য তৃতীয় পেসার কে?

মাশরাফি: রুবেল অবশ্যই আমার প্রথম পছন্দ। জানি, ওর টেস্ট পারফরম্যান্স নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। টি-টোয়েন্টিতে শেষ দুটি সিরিজে শেষের ওভারে মার খেয়েছে। কিন্তু ওয়ানডে অধিনায়ক হিসেবে আমি বলতে পারি, ওয়ানডেতে তাকে আমার লাগবেই।

নিদাহাস ট্রফির ফাইনালে আর আফগানিস্তানের সঙ্গে মোহাম্মদ নবিকে অনেক রান দিয়েছে। কিন্তু ওয়ানডেতে ওর এমন সময় কমই এসেছে। ব্যর্থতার পর ওর অবদানগুলো অনেকেই ভুলে গেছে। ২০১৫ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ওর দুটি বল বাংলাদেশ ক্রিকেটের গতিপথ বদলে দিয়েছে।

শুধু ওটা ধরেই আমি বসে নেই। তার পরও ভালো বোলিং করেছে। সবশেষ ওয়ানডেতেই দেখেন, ৪ উইকেট নিয়েছিল। স্লগ ওভারেই ২-৩ উইকেট নিয়েছে, চান্দিমালকে আউট করেছিল দারুণ ইয়র্কারে। তাছাড়া ওয়ানডেতে স্লগে বল করার মতো আর বিকল্প কে আছে আমাদের? আমি ওর শেষটা দেখতে চাই।

মূল পেসারদের বাইরে বিকল্প আর কে কে আছে ভাবনায়?

মাশরাফি: আবু হায়দার রনি এসেছে এবার। রাহি (আবু জায়েদ) লাল বলে দারুণ করল। ওয়ানডেতে জানি না। ভালো করলে ভালো, কিংবা শুধু টেস্টের জন্য রেখে দিলেও আপত্তি নেই। টেস্টেও তো ভালো পেসার লাগবে। তাসকিন এখন ইনজুরিতে। আশা করব বিশ্বকাপ আসতে আসতে নিজেকে আগের জায়গায় নিতে পারবে।

আরেকজন পেসারকে নিয়ে আমার আশা ছিল, এখনও আছে। আমি মনে করি, ছন্দ থাকলে সে পার্থক্য গড়ে দিতে পারে। আল আমিন। কিন্তু তার নিজেকে সেটা বুঝতে হবে। ওকে আমি অনেকবার বুঝিয়েছি এসব। অনেক ভুল ছিল ওর। কিন্তু ভুল তো শোধরানো যায়। আমি মনে করি শোধরানোর সময় এখনও আছে। কিন্তু আমরা কেবল বোঝাতেই পারি। সবার আগে বুঝতে হবে তাকেই।

সত্যি বলতে, পেসারদের সবার প্রতিই আমার চাওয়া আছে, আশা আছে। পাশাপাশি অভিযোগও আছে। ওদের কাউকে সুনির্দিষ্ট স্কিল ট্রেনিং করতে কমই দেখি। ফিটনেস আরও ভালো করা, স্কিল আরও ভালো করা, এসবে জেদ কম দেখি। বা জেদ থাকলেও সেটা দীর্ঘস্থায়ী হয় না। এটা তো একটা চলমান ব্যপার। প্রতিনিয়ত শুধু কষ্ট করে গেলেই হবে না, পরিশ্রম আর ত্যাগ সময়ের সঙ্গে বাড়াতে হবে। সেটা উল্টো কমালে তো বিপদ।

আমরা এসব বলি নিয়মিতই। কিন্তু সেসব ওদেরকে বুঝতে হবে। নিজেকে সেই পর্যায়ে নিতে হবে।

ইংল্যান্ডে এখন যেমন ব্যাটিং উইকেটে খেলা হয়, সঙ্গে ছোট মাঠ, দ্রুত আউটফিল্ড, বাংলাদেশের পেসারদের ভালো করার সম্ভাবনা আসলে কতটা?

মাশরাফি: খুব স্কিলফুল না হলে পেসারদের জন্য কাজটা খুব কঠিন। বিশ্বকাপে মনে করুন, ৯টি ম্যাচের মধ্যে ৩-৪টা ম্যাচে অসাধারণ পারফর্ম করে যদি ভালো করতে পারে তো ভালো।

ইংল্যান্ডে নিশ্চিতভাবেই সাড়ে তিনশ-চারশ রানের উইকেট থাকবে। আমাদের পেসারদের কেউ তো স্কিলে একদম পরিপূর্ণ নয়। আমাদের যেটা করতে হবে, জুটি বেঁধে গ্রুপ হিসেবে বল করতে হবে। কোনো পরিকল্পনা নিয়ে নেমে সেটা বাস্তবায়ন করে চাপ সৃষ্টি করতে হবে। বোলিং গ্রুপ হিসেবে ডিসিপ্লিনড হতে হবে। সেভাবে উইকেট মিলতে পারে।

কিন্তু উইকেট নেওয়ার মতো দু-একজন অন্তত লাগবে। ফিট থাকলে মুস্তাফিজ তেমন একজন। আর একজন রিস্ট স্পিনার থাকলে খুব ভালো হয়।

আইডিয়ালি ইংল্যান্ডে এমন উইকেট থাকলে একজন রিস্ট স্পিনার লাগেই। আমাদের তেমন কেউ নই। এখনও খুঁজছি। যদি কেউ শুধু জায়গায় বল ফেলতে পারে, টার্ন বা অন্য কিছু দরকার নাই, শুধু ধারাবাহিকভাবে জায়গায় বল ফেলতে পারে, এমন কোনো রিস্ট স্পিনার পেলেও নিয়ে নেব।

ব্যাটিং লাইন আপ? সাড়ে তিনশ রান করা বা তাড়া করার সম্ভব এই ব্যাটিং লাইন আপের?

মাশরাফি: সত্যি বলতে, এই মুহূর্তে সম্ভব নয়। যদি সৌম্য নিজের সেরা চেহারায় থাকত, যদি সাব্বির সম্ভাবনার পুরোটা দেখাতে পারত, তাহলে হয়ত সেই জায়গাটায় যাওয়া যেত। আপাতত, ৩০০-৩২০ রান সম্ভব। বিশ্বকাপে ৯টি ম্যাচ, আমরা যদি পাঁচ ম্যাচে এই রানটা করতে পারি, তাহলে আমি মনে করি আমাদের বোলাররা সেই রানে প্রতিপক্ষকে আটকাতে পারবে। আর মনে করুন, ২টি ম্যাচে খুব ভালো বোলিং করে জিতলাম। তাহলেই সেমি-ফাইনালে ওঠার ভালো সুযোগ থাকবে।

তার মনে সেমি-ফাইনাল দৃষ্টি সীমানায় আছে?

মাশরাফি: স্বপ্ন দেখতে তো দোষ নেই। স্বপ্ন দেখতে না শিখলে কোনো কিছু অর্জনও করা যায় না। যেভাবে বললাম, সেভাবে আলাদা করে চিন্তা করে দেখলে অসম্ভব তো নয়। সবাইকে আমার মতো করেই ভাবতে হবে, তা জরুরি নয়। তবে স্বপ্নটা সবার থাকতে হবে।