সবুজ উইকেটে প্রকট বাংলাদেশের স্কিলের দৈন্য

“দুর্ভাবনার কিছু নেই, স্রেফ নিজেদের সহজাত খেলাটা খেলতে হবে”, টেস্ট শুরুর আগের দিন উইকেট দেখে বলেছিলেন সাকিব আল হাসান। অ্যান্টিগায় ব্যাটিং দুর্দশার পর চাইলে বলা যায়, সহজাত ব্যাটিংই করেছে বাংলাদেশ। সবুজ উইকেটে বাংলাদেশের ব্যাটিং তো বরাবরই এমন বিবর্ণ!

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 July 2018, 12:28 PM
Updated : 7 July 2018, 12:51 PM

প্রথম ইনিংসে ৪৩, দ্বিতীয় ইনিংসে ৬৩ রানে ৭ উইকেট হারানোর পর ১৪৪। দুই ইনিংসে বাংলাদেশের রান সংখ্যাই হয়ে আছে ব্যাটিং ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি। তবে সত্যি বলতে, এমন রুগ্ন স্কোরকার্ডও ফুটিয়ে তুলতে পারছে না বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ের সত্যিকারের চিত্র। ক্যারিবিয়ান পেসারদের গতি, সুইং আর বাউন্সের কোনো জবাবই ছিল না বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের। সবুজ উইকেটে ব্যাটসম্যানদের স্কিলের দৈন্য আবারও ফুটে উঠেছে প্রকটভাবে।

দলের সেরা দুই ব্যাটসম্যানকে দিয়েই ফুটিয়ে তোলা যায় গোটা দলের চিত্র। দেশের সফলতম ব্যাটসম্যান তামিম ইকবাল প্রথম ইনিংসে জানতেন না তার অফ স্টাম্প কোথায়। কেমার রোচের বল অফ স্টাম্পের বাইরে পিচ করে বেরিয়ে যাচ্ছিল আরেকটু। তামিম ছুঁইয়ে দিয়েছেন ব্যাট।

তামিমের হয়ে তবু বলা যায়, ডেলিভারিটি দারুণ ছিল। কিন্তু দ্বিতীয় ইনিংসে ফরোয়ার্ড ডিফেন্স খেলেছেন এমন এক বলে, যেটি পিচ করে উঠছিল লাফিয়ে। ফ্রন্টফুটে ছিলেন যেন সমর্পিত, পা ছিল সেখানেই আটকে। প্রয়োজন ছিল আলগা করে খেলার, তামিম খেলেছিলেন শক্ত হাতে। ক্যাচ গেছে গালিতে।

বাংলাদেশ দলে টেকনিক্যালি সবচেয়ে পরিপূর্ণ ব্যাটসম্যান মনে করা হয় মুশফিকুর রহিমকে। দুই ইনিংসেই তিনি আউট হয়েছেন ভেতরে ঢোকা বলে। তামিমের মতোই প্রথম ইনিংসে রোচের বলে, দ্বিতীয় ইনিংসে গ্যাব্রিয়েলের।

রোচ বোলিং করেছিলেন স্টাম্পের অনেকটা দূর থেকে, অ্যাঙ্গেলে বল ঢুকেছে ভেতরে। ডিফেন্স খেলার চেষ্টায় মুশফিকের ব্যাট এসেছে দূর থেকে, ব্যাট-প্যাডের মাঝে ছিল ফাঁক। অবশ্য ফাঁক না থাকলেও বিপদ হতোই, কারণ ব্যাট নামিয়েছেন একটু দেরিতে, এলবিডব্লিউ।

দ্বিতীয় ইনিংসের আউট তার মতো ব্যাটসম্যানের জন্য হওয়ার কথা আরও বিব্রতকর। দুটি শর্ট বলে মুশফিককে পেছনে ঠেলে দিয়েছিলেন গ্যাব্রিয়েল। পরিকল্পনায় সফল ক্যারিবিয়ান ফাস্ট বোলার। পরের বলটি লেংথ থেকে কাট করালেন ভেতরে। শর্ট বলের অপেক্ষায় মুশফিক ছিলেন জায়গায় দাঁড়িয়ে। পা দুটো নড়েনি, যায়নি বলের কাছে। ব্যাট-প্যাডের মাঝে বিশাল ফাঁক দিয়ে বল ছোবল দিয়েছে স্টাম্পে।

দলের সবচেয়ে নির্ভর করার মতো দুই ব্যাটসম্যানই যখন অসহায় উইকেটের চ্যালেঞ্জের কাছে, বাকিদের কাঁটাছেড়ায় বেরিয়ে আসবে আরও রুগ্নদশা।

আলাদা করে তবু বলা যায় মুমিনুল হকের কথা। টেস্টে তার কাছেও দলের প্রত্যাশা অনেক। এই উইকেটে শরীর থেকে দূরে ড্রাইভ করা মানে আত্মহত্যার সামিল। প্রথম ইনিংসে সেটিই করেছেন বাঁহাতি ব্যাটসম্যান। দ্বিতীয় ইনিংসে হয়ত ভাগ্য একটু খারাপ ছিল, বোল্ড হয়েছেন একটু নিচু হওয়া ও স্কিড করা বলে। তবু তাকে দায়মুক্তি দেওয়া যাচ্ছে না, তার তো খেলা উচিত ছিল ফ্রন্টফুটে!

বিদেশের মাটিতে যে বাংলাদেশ কখনোই ভালো করেনি, তা নয়। বাউন্সি উইকেটে কিছু ভালো পারফরম্যান্সও আছে। কিন্তু অ্যান্টিগার মতো যখন বাউন্সের সঙ্গে থাকে মুভমেন্ট, বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ের কঙ্কাল বেরিয়ে পড়ে প্রতিবারই।

এবারের আগে বাংলাদেশ সবশেষ সত্যিকারের ঘাসের উইকেটে খেলেছিল দেশের মাটিতেই, ২০১৪ সালের জুনে ভারতের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজে। সেবারও ছিল করুণ দশা। দ্বিতীয় ওয়ানডেতে স্টুয়ার্ট বিনিকে ৬ উইকেট দিয়ে বাংলাদেশ গুটিয়ে গিয়েছিল ৫৮ রানে।

ব্যাটসম্যানদের পারফরম্যান্স ছিল বেশি দৃষ্টিকটু, নইলে অ্যান্টিগার পারফরম্যান্সে কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হয় পেসারদেরও। ব্যাটিংয়ে চূড়ান্ত হতাশার পর প্রথম দিনে যখন বোলিংয়ে নামল বাংলাদেশ, উইকেট তখনও প্রাণবন্ত। আর্দ্রতা তখনও আছে টিকে। পেসাররা কাজে লাগাতে পারেনি এতটুকুও। পারেনি পরের দিনও। পেস সহায়ক উইকেটেও বাংলাদেশ পরে বোলিংয়ে খানিকটা ঘুরে দাঁড়িয়েছিল স্পিনারদের পারফরম্যান্সে।

টেস্ট বোলিংয়ে বাংলাদেশের পেসারদের স্কিল বরাবরই প্রশ্নবিদ্ধ। তবে এই উইকটে নিজেদের খুব কারিকুরির প্রয়োজন ছিল না। ভালো জায়গায় টানা বল ফেলতে পারলে, উইকেট থেকে পাওয়া সহায়তায়ই ব্যাটসম্যানদের বিপাকে ফেলা যেত। পেসাররা ধারাবাহিকভাবে ভালো লাইন-লেংথে বোলিংয়ের মৌলিক কাজটুকুও করতে পারেনি।

সমস্যা পুরোনো, সমাধানের সম্ভাব্য পথও জানা ও বহু আলোচিত। সমাধান হয়নি। তাই ধুঁকতে হচ্ছে এখনও। বাংলাদেশ টেস্টে ব্যর্থ বলেই আলোচনায় উঠে আসে দেড় যুগ ধরে টেস্ট খেলার পরও ব্যর্থতার কথা। কিন্তু এই জায়গাটায় উন্নতিতে দেড় যুগে তো একটি পদক্ষেপও নেওয়া হয়নি!

ঘরোয়া ক্রিকেটে অন্তত কিছু উইকেট সবুজ ও বাউন্সি তৈরি করার প্রতিশ্রুতি বছরের পর বছর ধরেই দেওয়া হচ্ছে। বাস্তবায়ন হয়নি কখনোই। একাডেমি বা হাই পারফরম্যান্স দল, বাংলাদেশ ‘এ’ দলকে নিয়মিত দেশের বাইরে সফরে পাঠানোও শুধু প্রতিশ্রুতি হয়েই আছে। এমন পারফরম্যান্স তাই অস্বাভাবিক নয়।

৪৩ রানে গুটিয়ে যাওয়ার অজুহাত অবশ্যই এসব নয়। ব্যর্থতার দায় দলের অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যানদের ওপরই বেশি বর্তায়। তবে দিনশেষে ভাবনার গভীরে গেলে, ঘরোযা ক্রিকেটে উইকেটের চরিত্র না বদলালে আর ‘এ’ দলের সফর নিয়মিত না হলে, এমন ব্যর্থতায় ভরা দিনই বেশিরভাগ সময় আসার শঙ্কা থাকে।

সেসবই অবশ্য দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার ব্যাপার। আপাতত প্রয়োজন আশু সমাধান। বাংলাদেশের পরের টেস্ট জ্যামাইকায়। স্যাবাইনা পার্কের ২২ গজেও যে যত্ন করে সবুজ ঘাস গজিয়ে তোলা হচ্ছে, সেটি অনুমান করে নিতে খুব বেশি ঝুঁকি নেই। দ্বিতীয় টেস্টের আগের ৫ দিনে কতটা উন্নতি সম্ভব?

ম্যাচ শেষে পুরস্কার বিতরণীতে এই প্রশ্ন ছিল সাকিব আল হাসানের কাছেও। বাংলাদেশ অধিনায়ক জানিয়েছেন মানিসকতার উন্নতির তাগিদ। আপাতত এটিই হয়ত সবচেয়ে বাস্তব সমাধান।

এক টেস্ট খেলেই স্কিলের রাতারাতি উন্নতি সম্ভব নয় এমনিতেও। তার ওপর নুরুল হাসান সোহান ছাড়া ব্যাটসম্যানদের কেউ অ্যান্টিগার উইকেটে সময় কাটাতেই পারেননি। স্কিলের নাটকীয় উন্নতি দেখতে চাওয়া হবে তাই বাড়াবাড়িই। তবে চাওয়া যায় মানসিক দৃঢ়তা। চোয়ালবদ্ধ প্রতিজ্ঞা। লড়াইয়ের মানসিকতা। আত্মসমর্পণ না করা।

ক্রিকেটে যাবতীয় দুঃসময়ে সবচেয়ে বড় আশ্রয় সবসময়ই মৌলিকতা। মৌলিকত্বে ফিরে যেতে পারলে লড়াইয়ের পথ মেলেই। বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের নিজেদের কাজটুকু করতে হবে ঠিকঠাক।

সাকিব, তামিম, মুশফিকরা খেলে ফেলেছেন ৫০টির বেশি টেস্ট। সবুজ উইকেটে খেলার অভিজ্ঞতা বেশি নেই কিন্তু এতগুলো টেস্টের অভিজ্ঞতা তো আছে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এক যুগের পথচলা, ১০-১১ হাজার রান, এসবের ওজন আছে। তাই কিভাবে মানিয়ে নিতে হয়, এটুকু তারা নিশ্চয়ই জানে। ক্রিকেটীয় পরিভাষায় যাকে বলে ‘অ্যাডজাস্টমেন্ট’। প্রয়োজন হলে নিজেদের সহজাত প্রবণতার সঙ্গে আপোস করে, কিংবা টুকটাক কিছু টেকনিক্যাল ‘অ্যাডজাস্টমেন্ট’ করে কিভাবে সবুজ উইকেটে মানিয়ে নেওয়া যায়, সদিচ্ছা আর লড়াই দিয়ে টেকনিক্যাল ঘাটতি কিভাবে কিছুটা পুষিয়ে দেওয়া যায়, সেটির পথ খুঁজতে হবে সাকিব-তামিম-মাহমুদউল্লাহ-মুশফিকদের। পরিস্থিতি যখন প্রতিকূল, এগিয়ে আসতে হবে সিনিয়র ও অভিজ্ঞদেরই।

নতুন কোচ স্টিভ রোডসের জন্যও কাজটা কঠিন। দায়িত্ব নেওয়ার পর এই কদিনে কয়েকবার বলেছেন দলের অভিজ্ঞদের ওপর তার ভরসার কথা। কিন্তু প্রদীপের নিচে অন্ধকারটুকুই প্রথমে দেখতে পেলেন। বাংলাদেশের ক্রিকেটের একটা কঠিন বাস্তবতার সঙ্গে পরিচয় হলো। জ্যামাইকায় ভালো করার ত্বরিত সমাধান যেমন তাকে খুঁজতে হবে, তেমনি ভবিষ্যতে দেশের বাইরে উন্নতি করার পথরেখাও আঁকতে হবে তাকে।

এই দফায় টেস্ট নেতৃত্ব পাওয়ার পর সাকিব বলেছিলেন, এবার তার লক্ষ্য দেশের বাইরে বাংলাদেশের উন্নতিতে নেতৃত্ব দেওয়া। প্রথম টেস্টে বাস্তবতার জমিনের স্পর্শ অধিনায়কও পেয়েছেন। পরের টেস্টে উন্নতি, সামনের পথচলায় আরও বেশি উন্নতি করতে হলে, সত্যিই লক্ষ্য পূরণ করতে চাইলে অধিনায়ক সাকিবের সামনেও কঠিন চ্যালেঞ্জ।

সাকিবকে নেতৃত্ব দিতে হবে সামনে থেকে। মাঠের ভেতর যেমন, তেমনি ড্রেসিং রুমেও। প্রতি দিন একটু একটু করে বদল আনার চেষ্টা করতে হবে সতীর্থদের মানসিকতায়। সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ, তাকে লড়তে হবে দেশের ক্রিকেট সংস্কৃতির সঙ্গেও। বিদেশের মাটিতে উন্নতির পথ মিলবে কেবল তখনই।

আপাতত, সাকিব যেমন বলেছেন, পরের টেস্টে প্রয়োজন দলের মানসিকতার উন্নতি। হারার আগেই না হারা, লড়াইয়ে ছাড় না দেওয়া।