বাংলাদেশের পারফরম্যান্স ফুটিয়ে তুলছে প্রস্তুতির ঘাটতি

সিরিজটি যখন চূড়ান্ত হলো, শঙ্কার ঘণ্টাও তখন থেকে বাজছিল। অসাধারণ স্কিলের রশিদ খান, রহস্য ঘেরা বৈচিত্রে ভরা মুজিব উর রহমান। শাহজাদ-শেনওয়ারির পাওয়ার হিটিং, নবি-স্টানিকজাইয়ের অভিজ্ঞতা। সবকিছু সামলাতে কতটা প্রস্তুত বাংলাদেশ? সিরিজের আগে ছিল সংশয়। ছিল প্রশ্ন। সিরিজ শেষে প্রশ্নগুলিই আরও উচ্চকিত। সত্যিই কতটা প্রস্তুতি নিয়ে মাঠে নেমেছিল বাংলাদেশ?

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 June 2018, 11:29 AM
Updated : 8 June 2018, 11:37 AM

একটু পেছন ফিরে তাকালে, প্রশ্নগুলো জড়িয়ে আছে আফগানিস্তানের বিপক্ষে এই সিরিজের জন্মপ্রক্রিয়া থেকেই। হওয়ার কথা ছিল ওয়ানডে সিরিজে। ২০১৯ বিশ্বকাপের আগে সেটিই ছিল হয়ত বেশি যৌক্তিক। কিন্তু বিস্ময়কর এক যুক্তিতে হুট করেই সেটি বদলে গেল টি-টোয়েন্টি সিরিজে। বিসিবি সভাপতি বললেন, “টি-টোয়েন্টি আমরা কম খেলি, তাই টি-টোয়েন্টি সিরিজ।” অথচ পরের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ হবে ওয়ানডে বিশ্বকাপেরও দেড় বছর পর!

টি-টোয়েন্টি সিরিজ হওয়ায় চ্যালেঞ্জও ছিল অনেক বেশি। এই সংস্করণটায় এখনও পায়ের নীচে জমি খুঁজে ফিরছে বাংলাদেশ। আবার এই সংস্করণেই সবচেয়ে বেশি বিপজ্জনক আফগানিস্তান। র‌্যাঙ্কিংয়েও যেটির প্রতিচ্ছবি। বাংলাদেশের দুই ধাপ ওপরে আফগানিস্তান।

আফগানরা বিপজ্জনক কিংবা টি-টোয়েন্টি র‌্যাঙ্কিংয়ে এগিয়ে বলে তাদের বিপক্ষে সিরিজ খেলা যাবে না, এমনটি অবশ্যই নয়। তবে টি-টোয়েন্টি হওয়ায় চ্যালেঞ্জ বেড়ে গিয়েছিল অনেক। প্রস্তুতিও তাই হওয়া প্রয়োজন ছিল আরও নিবিড় ও যথাযথ। সংশয় সেখানেই।

প্রস্তুতির মৌলিক দুটি দিক, মনস্তাত্ত্বিক ও টেকনিক্যাল। আফগানিস্তান সিরিজের পারফরম্যান্স বলছে, ঘাটতি ছিল দুই দিকেই।

প্রথম ম্যাচে রান তাড়ার প্রথম বলে তামিম ইকবালের আউট মনে করা যাক। মুজিবের প্রথম বলটিই সুইপ করতে গিয়ে শেষ মুহূর্তে মত বদলে ডিফেন্স করার চেষ্টা এবং ব্যর্থ হওয়া। ইনিংসের প্রথম বলেই এই ধরণের দ্বিধায় আসলে ফুটে ওঠে মানসিক অস্থিরতাই। হয়তো তামিম ভাবছিলেন অনেক কিছু, অনেক বেশি। ছিল না ভাবনার স্থিরতা।

সেই ম্যাচেই তিনে নেমে সাকিব আল হাসানের প্রায় সব বলে তেড়েফুঁড়ে খেলার চেষ্টা এবং মুশফিকুর রহিমের আউটেও ছিল একইরকম চিত্র। কুইক আর্ম অ্যাকশন ও বলের গতির কারণেই মূলত রশিদকে খেলা কঠিন। আরও কঠিন, এমন একজনকে শুরুতেই রিভার্স সুইপ কিংবা সুইচ হিট খেলা। মুশফিক সেই চেষ্টা করতে গিয়েই বোল্ড রশিদের বলে।

হয়তো শুরুতেই রশিদকে নাড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন। মানসিক চাপে ফেলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মনস্তাত্ত্বিক লড়াইয়ে হেরে ফল হয়েছে উল্টো।

এরকম টুকরো টুকরো ছবি আছে সিরিজ জুড়েই। দ্বিতীয় ম্যাচে প্রথম ১০ ওভারে বাংলাদেশ ছুটছিল দারুণ গতিতে। রশিদ বোলিংয়ে আসার পরই ভোজভাজির মতো পাল্টে গেল চিত্র। উইকেট পতনের স্রোতে বাঁধ দিতে পারলেন না কেউ। মনের ভেতর যে সংশয়ের চোরাস্রোত!  

রশিদের মতো এত বেশি উইকেট নেই বলে মুজিবকে নিয়ে আলোচনা হয়তো কম। কিন্তু তিন ম্যাচেই নতুন বলে ভুগিয়েছেন তিনি। শুরুতে মুজিব, শেষে রশিদ, বাংলাদেশের এই মানসিক ভোগান্তি ছিল শেষ ম্যাচেও।

মনে দ্বিধা আর সংশয় থাকলে, মনের কোণে চেপে বসা আতঙ্কের টুটি চেপে না ধরে উল্টো প্রশ্রয় দিলে, সেটি গ্রাস করে সহজাত ক্ষমতাকেও। আফগানিস্তান সিরিজে বনের বাঘের আগেই হয়তো বাংলাদেশকে খেয়েছে মনের বাঘ!

মানসিক অস্থিরতাকে থিতু করে দিতে পারত টেকনিক্যাল সামর্থ্য। ব্যাটে-বলে পরিস্থিতি সাময়িকভাবে সামাল দিতে পারলে মাঠে মানসিক ভাবেও আস্তে আস্তে চাঙা হয়ে ওঠা যায়। এই সিরিজে হয়েছে উল্টো। মানসিক চাপ আরও বাড়িয়েছে টেকনিক্যাল ব্যর্থতা। কিংবা, হয়তো টেকনিক্যাল প্রস্তুতির ঘাটতিই ছিল মানসিক অস্থিরতার মূল কারণ!

সিরিজ শুরুর আগে রশিদ-মুজিবদের নিয়ে অতি আলোচনায় বেশ বিরক্ত হয়েছিলেন তামিম, সাকিবরা। হয়তো বিরক্ত হওয়ার যৌক্তিক কারণও ছিল। কিন্তু পেশাদার হিসেবে সেই বিরক্তিকে পাশ কাটিয়ে যথাযথ প্রস্তুতি ছিল জরুরি। পারফরম্যান্স বলছে, দল যথেষ্ট প্রস্তুত ছিল না। হয়তো ক্রিকেটাররা নিজেরা পারেননি, হয়তো পারেনি টিম ম্যানেজমেন্ট।

“হোমওয়ার্ক”-এর ঘাটতি প্রবল ভাবে ফুটে উঠেছে প্রতিটি ম্যাচেই। আফগান স্পিন সামলানো কিংবা ওদের পাওয়ার হিটিংকে বশে আনা, কোনো ক্ষেত্রেই ছিল না পরিষ্কার পরিকল্পনার ছাপ।

বাংলাদেশ দলের পারফরম্যান্স অ্যানালিস্ট শ্রিনিবাস চন্দ্রশেখরনকে মনে করা হয় বিশ্বের অন্যতম সেরা অ্যানালিস্ট। সানরাইজার্স হায়দরাবাদেরও অ্যানালিস্ট তিনি, রশিদ খানকে জানেন খুব ভালো করেই। তার বিশ্লেষণে তাই ঘাটতি থাকার কারণ নেই। ভার্চুয়াল কাঁটাছেড়ার পর প্রয়োজন প্রতিপক্ষের শক্তি-দুর্বলতা নিয়ে পরিকল্পনা সাজানো, সেটির বাস্তবায়নের জন্য ট্রেনিংয়ে কাজ করা। মাঠের ক্রিকেটে সেসবের প্রতিফলন ফেলা। বাংলাদেশ সেই প্রস্তুতিটুকু নিয়েছিল, এমন কিছুর প্রমাণ মেলেনি সিরিজে।

রশিদ-মুজিবের স্কিল নিয়ে সংশয় নেই। কিন্তু এমন নয়, তাদের খেলাই যায় না। কিন্তু তিনটি ম্যাচেই বাংলাদেশের ব্যাটিং যেন জানত না কোনো জবাব। স্রেফ রিভার্স সুইপ বা সুইচ হিটের চেষ্টা ছিল মাঝেমধ্যে। এছাড়া দেখা যায়নি আর কোনো পরিকল্পনা।

‘হোমওয়ার্ক’-এর দৈন্য সবচেয়ে বেশি ফুটে উঠেছে রশিদের মুখোমুখি নতুন ব্যাটসম্যানের ক্ষেত্রে। একটি উইকেট নেওয়ার পর নতুন ব্যাটসম্যানকে প্রায়ই গুগলি করেন রশিদ। গতি একটু বেশি বলে তার গুগলি সবসময়ই কঠিন। নতুন ব্যাটসম্যানের জন্য আরও কঠিন। সেই প্রস্তুতি থাকা চাই। বাংলাদেশের কি ছিল?

প্রথম ম্যাচে প্রথম বলেই সুইট হিট খেলতে গিয়ে বোল্ড হলেন মুশফিক। পরের বল, নতুন ব্যাটসম্যান সাব্বির রহমান এলবিডব্লিউ গুগলিতে। রশিদের গুগলি অসাধারণ বলে তাকে শাফল করে খেলা সবসময়ই বিপজ্জনক। সাব্বির সেই ঝুঁকির পথ বেছে নিয়েছিলেন প্রথম বলেই।

পরের ম্যাচেও একই চিত্র। রানের জন্য হাঁসফাঁস করতে থাকা তামিম স্লগ করার জন্য বেছে নিলেন রশিদকেই। খেসারত দিলেন বোল্ড হয়ে। পরের বল, নতুন ব্যাটসম্যান মোসাদ্দেক হোসেন। যথারীতি গুগলি, একেবারেই অপ্রস্তুত মোসাদ্দেক এলবিডব্লিউ। ব্যাট ছিল না বলের ধারে কাছে। প্রস্তত থাকা কিংবা আগের ম্যাচ থেকে শেখার প্রমাণ কোথায়?

রশিদ-মুজিব ও অভিজ্ঞ নবি, তিনটি ম্যাচেই ভুগিয়ে গেলেন বাংলাদেশের ব্যাটিং। একটি দিনও মিলল না সমাধান। কিংবা সমাধানের চেষ্টা।

এই সিরিজের আগে সবশেষ ম্যাচটিতেই, নিদাহাস ট্রফির ফাইনালে ভারতের বিপক্ষে তিনে নেমে ৫০ বলে ৭৭ রানের দুর্দান্ত ইনিংস খেলেছিলেন সাব্বির। অথচ পরের ম্যাচেই, এই সিরিজের শুরুতে সাব্বিরকে নামিয়ে দেওয়া হলো ছয়ে।

দ্বিতীয় ম্যাচেই আবার ওলট-পালট। তিন থেকে এক ধাক্কায় ছয়ে সাকিব, সাতে সৌম্য সরকার। রশিদকে সামলাতে পরের দিকে বাঁহাতি ব্যাটসম্যান রাখার চেষ্টা। যেটিতেও আসলে ফুটে ওঠে হুট করে কিছু করার মরিয়া প্রচেষ্টা। অভাব পূর্বপ্রস্তুতির। টি-টোয়েন্টিতে ছয়-সাত নম্বরে নেমে যদি কাউকে সামলানোর ভাবনা থাকে, ম্যাচ হারার আয়োজন তো তখন হয়েই গেছে!

বলাই বাহুল্য, সেই ফাটকা কাজে লাগেনি। সেদিন রশিদের চার উইকেটের তিনটিই ছিল বাঁহাতি। সাকিব, সৌম্য ও তামিম।

কাঠগড়ায় থাকবে বোলিংও। তিনটি ম্যাচেই আফগানিস্তানকে ভালো শুরু এনে দিয়েছেন মোহাম্মদ শাহজাদ। বরাবরই তিনি আক্রমণাত্মক। তবে তার টেকনিক্যাল ঘাটতি অনেক। শটও সীমিত, কেবল নিজের শক্তির জায়গা কিংবা জোনে পেলেই মারতে পারেন। বাংলাদেশ তার দুর্বলতা কাজে লাগানো বহুদূর, বল করে গেছে শক্তির জায়গায়।

প্রথম ম্যাচে শফিকউল্লাহ যখন ঝড় তুলছেন শেষে, বোলারদের মনে হয়েছে অসহায়। এই ব্যাটসম্যানকে কোথায় বল করতে হবে, রুবেল-আবু জায়েদরা জানতেন বলে মনে হয়নি।

যে আবুল হাসান মূল স্কোয়াডেই ছিলেন না, পরে সুযোগ পেলেন চোট পাওয়া মুস্তাফিজুর রহমানের বদলি হিসেবে, সেই আবুল হাসান ঢুকে গেলেন প্রথম ম্যাচের একাদশেও। প্রস্তুতি পর্বে যে নিজেদের নিয়ে নিশ্চিত ছিল না দল, সেটির আরেকটি প্রমাণ।

ড্রাইভ খেলা বা প্লেস করা কঠিন, এমন মন্থর উইকেটে প্রয়োজন দু-একজন এমন ব্যাটসম্যান, যারা গায়ের জোরে সীমানা ছাড়া করতে পারে মাঠ। আফগানদের এমন ব্যাটসম্যান অনেক, সুফলও তারা পেয়েছে। বাংলাদেশে এটি করতে পারতেন যিনি, সেই আরিফুল হক খেলার সুযোগ পেয়েছেন সিরিজ হারার পর। শেষ ম্যাচে তবুও শেষ মুহূর্তে নায়ক প্রায় হয়েই উঠেছিলেন আরিফুল।

দলে নিয়মিত প্রধান কোচ নেই প্রায় ৮ মাস। ব্যাটিং কোচ নেই। ভারপ্রাপ্ত প্রধান কোচ হিসেবে কোর্টনি ওয়ালশের নাম জানানো হয় দল দেশ ছাড়ার আগের দিন। সত্যিকার প্রধান কোচ হিসেবে দায়িত্বের চর্চা তিনি কতটা করতে পারছেন, সেটি নিয়েও আছে সংশয়। প্রস্তুতির ঘাটতি থাকা তাই খুব অস্বাভাবিকও নয়। আবার হতে পারে, মুখে বলা হলেও বাস্তবে যথেষ্ট গুরুত্বই দেওয়া হয়নি সিরিজটিকে।

তবে ঘাটতির কারণ যেসবই হোক, ঘাটতি যে তীব্র ছিল, সেটি স্পষ্ট পারফরম্যান্সেই। সিরিজ আয়োজন থেকে শুরু করে সিরিজের শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশকে ঘিরে যত প্রশ্ন, সবকিছুর মৌলিক উত্তর হয়তো একটিই, প্রস্তুতিপর্বই ছিল ছন্নছাড়া!