‘কিভাবে ৩০০ উইকেট হয়ে গেল, নিজেও বুঝলাম না’

মাত্র পঞ্চম বোলার হিসেবে টি-টোয়েন্টিতে ৩০০ উইকেটের মাইলফলক ছুঁয়েছেন মঙ্গলবার রাতে। ৪ হাজার রান হয়ে গিয়েছিল আগেই। এই দুইয়ের ‘ডাবল’ কীর্তি এতদিন ছিল মাত্র আর এক জন ক্রিকেটারের। অসাধারণ ডাবল অর্জনের পরদিন মুম্বাই থেকে হায়দরাবাদে ফেরার পথে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে কথা বললেন সাকিব আল হাসান। জানালেন তার অর্জনের অনুভূতি; নতুন ফ্র্যাঞ্চাইজির হয়ে এবারের আইপিএল অভিযান নিয়ে অনেক কিছু।

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 April 2018, 01:05 PM
Updated : 25 April 2018, 02:20 PM

অভিনন্দন, টি-টোয়েন্টিতে ৩০০ উইকেট মানে তো অনেক বড় অর্জন!

সাকিব আল হাসান: আমারও কাল থেকে এটিই মনে হচ্ছে। টি-টোয়েন্টিতে উইকেট তো বেশি পাওয়া যায় না। চার ওভার বোলিংয়ের ক্রিকেটে ৩০০ উইকেট মানে অনেক উইকেট। ভালো লাগছে তো বটেই। অবাকও লাগছে। নিজেও বুঝলাম না কিভাবে ৩০০ উইকেট হয়ে গেল!

তিনশর কাছে গিয়ে একটি উইকেটের অপেক্ষায় দুই ম্যাচ কেটেছে উইকেটশূন্য। একটু অস্থিরতা কাজ করছিল ভেতরে?

সাকিব: নাহ, আমি তো এসব এত ভাবিই না। লোকজনই মনে করিয়ে দিচ্ছিল। অনেকের ম্যাসেজ পাচ্ছিলাম। আমি তো জানতাম, আজ হোক বা কাল, এটি তো হবেই। মজার ব্যাপার হলো, আগের দুই ম্যাচের আগে অনেক ম্যাসেজ পেয়েছি, আগাম অভিনন্দন পেয়েছি। সেই দুই দিন হয়নি। যেদিন ম্যাসেজ পাইনি, সেদিনই ৩০০ হলো।

৩০০ ছোঁয়ার হওয়ার পর ঠিক ওই মুহূর্তের অনুভূতি কেমন ছিল?

সাকিব: বোলিংয়ের আগে ৩০০ উইকেটের কথা মাথায় ছিল না। দলের জয়ের জন্য উইকেট দরকার, সেটিই ছিল ভাবনায়। উইকেট পেয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই অবশ্য মনে পড়েছে। ভালো না লাগার তো কোনো কারণ নেই। ৩০০ উইকেট খুব বেশি জনের নেই। যেটা বললাম আগে, নিজের কাছেই বারবার মনে হচ্ছে, এতগুলো উইকেট! কিভাবে কিভাবে যেন হয়ে গেল ৩০০।

৩০০তম উইকেটও বেশ বড় শিকার, রোহিত শর্মা…

ছবি: বিসিসিআই

সাকিব:
বড় উইকেট, তবে আরও বড় হয়ে উঠেছিল আসলে ম্যাচের পরিস্থিতির কারণে। আমাদের রান কম ছিল, রোহিত সেট হয়ে গেলে ম্যাচ হাতছাড়া হয়ে যেত। আমাকে বোলিংয়ে আনাই হয়েছিল উইকেট নেওয়ার জন্য। দ্রুতই দলকে সেই উইকেট এনে দেওয়া ছিল বেশি তৃপ্তির।

৩০০ উইকেট ও ৪ হাজার রানের ডাবলও পূরণ করেছেন এই ম্যাচে। যদিও সব সময় বলে আসছেন, ব্যক্তিগত অর্জন কখনোই আপনাকে খুব আন্দোলিত করে না। এরপরও এত বড় অর্জনের রোমাঞ্চ কি খানিকটা স্পর্শ করছে না?

সাকিব: করছে না বললে ভুল হবে। হয়ত প্রকাশের ধরনে খুব উচ্ছ্বাস নেই। সেটা আমার কখনোই থাকে না। তবে ভালোলাগা তো আছেই। এই ডাবল তো কেবল আর একজনের আছে। আমি জানি এটা অনেক বড় অর্জন।

যে দলের হয়ে যেখানে খেলি না কেন, আমি চেয়েছি প্রতিটি ম্যাচেই ভালো করতে। সেই চেষ্টায় একটু একটু করে এগিয়েই এসব অর্জন। এই মাইলফলকগুলো মনে করিয়ে দেয়, নিজের কাজটা মনে হয় খুব খারাপ করিনি।

তবে সত্যি বলতে, এখন হয়তো এসবের মাহাত্ম্য পুরো বুঝতেও পারব না। আশা করি আরও অনেক দিন খেলব। সব ঠিক থাকলে হয়তো আরও রান করব, উইকেট নেব। ক্যারিয়ার শেষে হয়ত যখন পেছন ফিরে তাকাব, তখন এইসব অর্জনের ওজন আরও ভালো করে বুঝতে পারব। তখন আরও বেশি গর্ব হবে।

দলের দারুণ জয়টাও নিশ্চয়ই নিজের অর্জনের দিনকে পূর্ণতা দিয়েছে?

সাকিব: তা তো বটেই। ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটে দলের জয়ই আসল। সেটা অবশ্য সব ক্রিকেটেই গুরুত্বপূর্ণ। দেশের হয়ে খেলতে নামলে যেমন দেশের জয়ের চেয়ে বড় কিছু আর নেই। এরপরও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ব্যক্তিগত পারফরমারদের আলাদা জায়গা থাকে। কিন্তু ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটে দল না জিতলে ব্যক্তিগত অর্জনের মূল্য থাকে সামান্যই। দল জিতেছে বলেই বেশি ভালো লেগেছে।

ছবি: বিসিসিআই

আপনার ক্যারিয়ারে রেকর্ড তো কম নেই। এই ডাবলকে কোথায় রাখবেন?

সাকিব: শুরুর দিকেই রাখব। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের অনেক অর্জন অবশ্যই অনেক বড়। তবে এটিও বড়। বারবার যেটি বলছি, নিজেরই অবাক লাগছে। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে ৩০০ উইকেট বা ৪ হাজার রান আলাদা করেই বড় ব্যাপার। দুটি একসঙ্গে করা অবশ্যই দারুণ কিছু।

যদি কোনো একটি পারফরম্যান্সকে বেছে নিতে বলা হয়, ঘরোয়া-আন্তর্জাতিক মিলিয়ে নিজের সেরা টি-টোয়েন্টি পারফরম্যান্স কোনটিকে বলবেন?

সাকিব: দেশের হয়ে যে কোনো ভালো পারফরম্যান্সই সবকিছুর আগে। ছোটখাটো অনেক পারফরম্যান্স বা অবদান অনেক সময় বাংলাদেশকে জেতাতে সাহায্য করেছে, সবই ভালো লাগার। তবু একটি বেছে নিতে বললে, পাকিস্তানের বিপক্ষে ইনিংসটি এখন মনে পড়ছে (২০১২ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে পাল্লেকেলেতে ৫৪ বলে ৮৪)।

জাতীয় দলের বাইরে বললে, দুইবার ৬ উইকেট নিয়েছি। তার মধ্যে প্রথমটি ৬ রানে ৬ উইকেট (২০১৩ ক্যারিবিয়ান প্রিমিয়ার লিগে), সেটি তো আসলে স্বপ্নের বোলিং ফিগার। আর কে কবে এমন কিছু করতে পারবে, কে জানে! আর সব মিলিয়ে যদি বলেন, এবারের এই ডাবল হওয়ার পর সত্যিই ভালো লাগছে।

আইপিএলে এবার নতুন ফ্র্যাঞ্চাইজিতে খেলছেন। কতটা মানিয়ে নিতে পারলেন?

সাকিব: পুরোটাই! ম্যানেজমেন্ট, টিমমেট সবার সঙ্গেই মানিয়ে নিয়েছি। বেশ ভালো আছি। বলছি না যে কলকাতায় ভালো ছিলাম না, তবে হায়দরাবাদে একটু বেশি কমফরটেবল লাগছে এখনও পর্যন্ত।

সানরাইজার্স হায়দরাবাদ আপনাকে ব্যবহারও করছে খুব ভালোভাবে। গুরুত্বপূর্ণ সময়ে বোলিং করানো, ব্যাটিং অর্ডারে নিয়মিত পাঁচে খেলানো, কলকাতায় এতগুলো বছরেও এত ওপরে ব্যাটিং নিয়মিত পাননি…

সাকিব: এভাবে কাজে লাগাবে বলেই আমাকে নিয়েছে ওরা। দলে নেওয়ার পরই আমাকে নিয়ে ওদের পরিকল্পনা বিস্তারিত সব বলেছিল। মানসিক প্রস্তুতি তাই ছিল। এখানে আসার পরও সেই গুরুত্বটা আমি পাচ্ছি। দল এভাবে প্রাধান্য দিলে ভালো করার বাড়তি তাড়নাও থাকে।

কেন উইলিয়ামসন তো আপনাকে অনেক দিন থেকেই জানেন ভালো করে। নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে আপনার অতিমানবীয় সব পারফরম্যান্স আছে। উইলিয়ামসন অধিনায়ক বলেই কি আপনাকে ভালোভাবে কাজে লাগাতে পারছে?

সাকিব: দল থেকে আগেই পরিকল্পনা ছিল আমাকে নিয়ে, সেটা তো বললামই। ওরা অনেক গুছিয়ে কাজ করে। আর উইলিয়ামসন তো আমাকে জানেই ভালো করে। তবে এমনিতেই ও অনেক ভালো অধিনায়ক। খুব ঠাণ্ডা মাথার, কিন্তু ক্যাপ্টেন্সিতে আগ্রাসী। খেলা খুব ভালো বোঝে। কোন পরিস্থিতিতে কি করতে হবে, দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারে। গেম রিডিং ভালো।

সবচেয়ে ভালো যেটি, দলের সবার সঙ্গে দ্রুত মিশে গিয়েছে এবং মানিয়ে নিয়েছে। এই ধরনের বহুজাতীয় ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটে অধিনায়কত্বের জন্য যে খুব জরুরি। সবার কথা শোনে ও। মাঠের-ভেতরে বাইরে কেউ কিছু বললে বা পরামর্শ দিলে সেটি গুরুত্ব দিয়ে নেয়।

এই দলের কোচ টম মুডিকে তো বিগ ব্যাশেও কোচ হিসেবে পেয়েছিলেন। বিপিএলে আপনার দলের না হলেও কোচিং করিয়ে গেছেন রংপুর রাইডার্সকে। তার সঙ্গে কতটা জমছে?

সাকিব: আগের পরিচয় সাহায্য করেছে অবশ্যই। তবে মুডি এমনিতে সবাইকে বেশ দ্রুত কমফরটেবল করে নেয়। সবসময় ক্রিকেট নিয়ে ভাবে, কথা বলে। তার কাজের ধরনও দারুণ। খুব সাহায্য করে। ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটে তার সাফল্যই বলে দিচ্ছে সে কতটা কার্যকর। 

এখনও পর্যন্ত নিজের পারফরম্যান্সে কতটা সন্তুষ্ট? ব্যাটিংয়ে যেমন কয়েকটি ম্যাচে ভালো শুরু করেও বড় করতে পারেনি। দল যেহেতু বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে, ভালো করার চাপও নিশ্চয়ই বেশি?

সাকিব: নিয়মিত যেহেতু পাঁচে সুযোগ পাচ্ছি, সেটা অবশ্যই কাজে লাগানো উচিত। কয়েকটি ম্যাচে ইনিংস বড় করার সুযোগ পেয়েছিলাম। কিংবা শেষ করে আসতে পারতাম। নিজেও বুঝতে পারছি বড় ইনিংস খেলা উচিত। সামনে অবশ্যই চেষ্টা করব।

একটা ইতিবাচক হলো যে একেবারে খারাপ করছি না। রান করছি নিয়মিতই। দলে অবদান রাখতে পারছি, যেটা আমার সবসময়ই প্রথম লক্ষ্য। আমাকে যে জন্য নিয়েছে দলে, মনে হয় সেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারছি ব্যাটিং-বোলিং মিলিয়ে। শুধু বড় ইনিংসই হচ্ছে না। সেটিও হয়ে যাবে আশা করি। টুর্নামেন্টে এখনও অনেক ম্যাচ বাকি। অনেক কিছু করে দেখানোর সুযোগ আসবে।

মুস্তাফিজদের তো দুটি ম্যাচেই হারিয়ে দিলেন, কি কথা হলো তার সঙ্গে?

সাকিব: সব কথা তো বলা যাবে না! এমনিতে শুধু ম্যাচে নয়, কথা নিয়মিতই হয়। আমাদের সঙ্গে দুটি ম্যাচে ও খারাপ করেনি। মুস্তাফিজ ভালো করেছে, আমরা জিতেছি, এর চেয়ে ভালো কিছু তো হতে পারে না!

আপনার মতো মুস্তাফিজও এবার নতুন ফ্র্যাঞ্চাইজিতে, মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সের মতো বড় দল। কেমন দেখছেন ওর পারফরম্যান্স?

সাকিব: খারাপ করেনি। তবে আরও ভালো করতে পারত। সময় অবশ্য আছে, আরেকটু আত্মবিশ্বাস পেলে আরও ভালো করবে।

একটা ব্যাপার হলো, জাতীয় দলে মুস্তাফিজ বেশি ভালো বল করে কারণ এখানে সবকিছু ওর চেনা। সবাই ওকে চেনে, ও সবার সঙ্গে কমফরটেবল। ওর ধরন সবার জানা। মুম্বাই ওর নতুন দল। ওর যেমন সবকিছু সামলে নিতে একটু সময় লাগবে, দলেরও ওকে বুঝতে সময় লাগতে পারে। ধরুন ও কোন সময় কিভাবে ভাবে, ওর মানসিকতা, ওর বোলিংয়ে ফিল্ড প্লেসিং, এসব মানিয়ে নিতে দুই পক্ষেরই একটু সময় লাগবে।

তবে এটাই মুস্তাফিজের চ্যালেঞ্জ, একই সঙ্গে শেখার সুযোগও। এভাবে ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিলেই না শিখবে! যেহেতু এখন লিগগুলোয় খেলতে শুরু করেছে, এসবের সঙ্গে যত দ্রুত মানিয়ে নেবে, তত শিখবে।

ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগগুলোর মধ্যে সব দিক মিলিয়ে আইপিএলকে এমনিতেই সেরা বলা হয়। এবার মনে হচ্ছে আরও গোছানো। অন্য লিগগুলোয় তুলনায় আসলে কোন জায়গায় কতটা এগিয়ে আইপিএল?

সাকিব: দেখুন, অনেকে আসলে টাকার কথা বলে। তবে এত টাকা বা মালিকপক্ষ সবাই এত বড় বড় গ্রুপের বলেই নয়, আইপিএলের পেশাদারিত্ব, আয়োজনের বিশালত্ব, যতটা গোছানো, ক্রিকেটীয় প্রতিদ্বন্দ্বিতা, ব্রডকাস্টের মান, সব কিছু মিলিয়েই আইপিএল সেরা। আসলে অনেক বলেও আমি বোঝাতে পারব না। এখানে এলেই কেবল বোঝা যাবে কতটা এগিয়ে।