নতুন দিনের স্বপ্ন দেখানো টুর্নামেন্ট

দু-একটি দেহ মাঠে অসাড় দাঁড়িয়ে। কেউ কেউ শরীরটাকে কোনোরকমে যেন টেনে নিচ্ছেন যেন মাঠের বাইরে। কারও চোখের কোনে চিকচিক করছে জল। সবার মুখে রাজ্যের অন্ধকার। ছুটে এলেন কোর্টনি ওয়ালশ। পিঠ চাপড়ে দিলেন, বুকে জড়ালেন। শেষ বলে ছক্কার পর মাঠে অনেকক্ষণ উবু হয়ে পড়ে থাকা সৌম্যকে জড়ালেন শক্ত করে। হতাশাময় শেষটাই কি সব? শেষ বলের ছক্কায় শিরোপা স্বপ্ন ভেঙেছে। কিন্তু টি-টোয়েন্টির বাংলাদেশকে নতুন দিনের স্বপ্ন দেখিয়েছে তো এই টুর্নামেন্টই।

ক্রীড়া প্রতিবেদক কলম্বো থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 March 2018, 04:16 AM
Updated : 19 March 2018, 05:40 AM

ম্যাচের ভাগ্য গড়ে দিয়েছে শেষ বল। বাংলাদেশ ও ট্রফির মাঝে ব্যবধান ছিল ওই শেষ বলই। সেটি পক্ষে আসেনি, ট্রফিও হাতে ওঠেনি। তাতে ফাইনালের বাকি সময়টুকু বাংলাদেশের লড়াই মিথ্যে হয়ে যাচ্ছে না। রোমাঞ্চকর দুটি লড়াইয়ে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে জয় মিলিয়ে যাচ্ছে না।

সবচেয়ে বড় কথা, এই টুর্নামেন্টে বাংলাদেশ যে ছাপটা রেখেছে, সেটি মুছে যাচ্ছে না। সেই ছাপ আসলে একটি প্রচেষ্টার প্রতিফলন। একটি তাড়নার বহিঃপ্রকাশ। ছাপের নাম, ‘বাংলাদেশি ব্র্যান্ড’। টি-টোয়েন্টির বাংলাদেশি ব্র্যান্ড।

না, সেই ব্র্যান্ড গড়ে ফেলেনি বাংলাদেশ। চোখধাঁধানো কিছু করে সোরগোল ফেলেনি। তবে সেই ব্র্যান্ডের আবির্ভাবের দামামা বেজেছে। মনে বিশ্বাস, বুকে বল নিয়ে পথচলা শুরু হয়েছে। এতদিন আপদ হয়ে থাকা টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটকেও এখন আপন মনে হচ্ছে।

টি-টোয়েন্টিতে এর আগে যৎসামান্য সাফল্য যা ছিল, ২০১৬ টি-টোয়েন্টি এশিয়া কাপের ফাইনালে ওঠা। তবে সেই সাফল্যের ছাপ ধরে এগিয়ে যাওয়া হয়ে ওঠেনি। টি-টোয়েন্টির বাংলাদেশ রয়ে ছিল তিমিরেই। সেই শঙ্কা এবারের সাফল্যের পরও আছে। তবে তার চেয়ে বেশি আছে সম্ভাবনা। এবার যে নিজেদের একটা দাগ রাখতে পেরেছে বাংলাদেশ!

এত দিন টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট মানেই ছিল বাংলাদশের হাহাকার। পাওয়ার হিটার নেই, ফিনিশার নেই, পেশি শক্তির ব্যাটসম্যান নেই, আরও অনেক নেই-নেই। এতদিন সেই আক্ষেপগুলোই ছিল অজুহাতের মতো। এই টুর্নামেন্ট দেখিয়েছে এত সব ঘাটতি পূরণের পথও আছে।

স্মার্ট ক্রিকেট। শক্তি নেই, কিন্তু বুদ্ধি আছে, স্কিল আছে। পরিস্থিতির দাবি বুঝে মাথা খাটানো ক্রিকেট। সবাই এক হয়ে বড় দুর্বলতা ঢেকে দেওয়ার ক্রিকেট। বাংলাদেশি ব্র্যান্ডের মূল উপকরণ এসবই। টুর্নামেন্ট জুড়ে এই কথাগুলো তামিম ইকবাল বলেছেন। মাহমুদউল্লাহ বলেছেন। মুশফিকুর রহিম বলেছেন। বলেই থামেননি, করে দেখিয়েছেন। দেখিয়ে আবার বলেছেন।

মুশফিক অবশ্যই গ্লেন ম্যাক্সওয়েল নন। তবে ২১৫ রান তাড়ায় ৩৫ বলে ৭২ রানের ম্যাচ জেতানো ইনিংস তিনি খেলতে পারেন। মাহমুদউল্লাহ নন মহেন্দ্র সিং ধোনি কিংবা ড্যারেন স্যামি। তবু ১৮ বলে ৪৩ রানের ইনিংস খেলে হতে পারেন ফিনিশার। স্মার্ট ক্রিকেট খেলে, স্কিল দিয়ে। 

অবশ্যই সেটি এখনও রপ্ত হয়নি পুরোপুরি। এখনও পথের অনেক বাকি। ব্র্যান্ড গড়ে তোলার সাফল্য-ব্যর্থতার খতিয়ান খোলার সময়ও হয়নি। তবে কাঁচামাল ও উপকরণের সন্ধান যেহেতু মিলেছে, সেটিকে আকর্ষণীয় পণ্যে রূপ দেওয়া সম্ভাবনাও প্রবল। কেবল কারখানায় প্রস্তুত হতে হবে। বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের সেই সামর্থ্য আছে, এই টুর্নামেন্টই দেখিয়েছে।

এই সবকিছুর বাইরেও, ভবিষ্যৎ সাফল্য-ব্যর্থতা না ভেবেও, টি-টোয়েন্টিতে বরাবরই ধুঁকতে থাকা বাংলাদেশ যে নিজেদের একটা ব্র্যান্ড উপহার দেওয়ার দুঃসাহস দেখিয়েছে, এটিই এই টুর্নামেন্টে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।

টুর্নামেন্ট শুরুর আগে বাংলাদেশকে নিয়ে আশার জায়গা খুব একটা ছিল না। দেশের মাটিতে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে তিন সংস্করণে হার, দলের ছন্নছাড়া শরীরী ভাষা, নিয়মিত কোচ না থাকা, নিয়মিত অধিনায়ককেও হারানো-এত বাস্তবতাকে ঠেলে বাংলাদেশ ফাইনালের মঞ্চে উঠেছে এবং একটি বলের ব্যর্থতায় ট্রফি ছোঁয়া হয়নি। বাংলাদেশি ব্র্যান্ড নিয়ে স্বপ্ন দেখার সাহসকেই জোড়ালো করছে এই টুর্নামেন্ট।

টুর্নামেন্ট শেষে চ্যাম্পিয়ন অধিনায়ক রোহিত শর্মা স্যালুট জানিয়েছেন বাংলাদেশের ভয়ডরহীন ক্রিকেটকে। প্রথম দিকে না থেকেও এই বদলের ছোঁয়া দেখেছেন সাকিব আল হাসান। শেষ দিকে দলে যোগ দিয়ে অনভুব করেছে। ফাইনাল শেষে সাকিবও দেখালেন সেই নতুন দিনের স্বপ্ন।

“আমাদের কাছ থেকে কিছু কেড়ে নেওয়া যাবে না। আমরা যেভাবে খেলেছি টুর্নামেন্ট জুড়ে, মানসিক শক্তির পরীক্ষায় যেভাবে উতরে গেছি, দলের কাছ থেকে এর চেয়ে বেশি কিছু চাইতে পারতাম না।”

“সবই ইতিবাচক দেখছি আমি। খুব বেশি নেতিবাচক দেখছি না। খুব ভালো টুর্নামেন্ট খেলেছি। দুটি ম্যাচ জিতেছি। একটু এদিক-সেদিক হলে আরও দুটি ম্যাচ জিততে পারতাম। ছোট ছোট জায়গাগুলো উন্নতি করতে পারলে হয়তো আমরা আরও ভালো করতে পারব। হয়তো এখান থেকে নতুন অধ্যায়ের শুরু হবে।”

শেষ বলটি ভালো করে বাংলাদেশ ট্রফি জিততে পারত। সেটিও হতো দারুণ কিছু। তবে চ্যাম্পিয়ন হলেও টুর্নামেন্ট থেকে বাংলাদেশের বড় প্রাপ্তি হতো আত্মবিশ্বাস। নতুন দিনের আশা, সাকিবের মতে, নতুন অধ্যায়ের সূচনা। এক বলের কারণে বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন হয়নি, তাতেও সেই প্রাপ্তি এতটুকু কমছে না। এই টুর্নামেন্ট দিয়েছে টি-টোয়েন্টিতে বহু কাঙ্ক্ষিত পথের দিশা।

সাকিবের হাত ধরেই হয়ত আরও ধারাল হয়ে উঠবে বাংলাদেশি ব্র্যান্ড। আজ থেকে অনেক বছর পর যখন লেখা হবে বাংলাদেশের টি-টোয়েন্টির ইতিহাস, এই টুর্নামেন্টই হয়তো হয়ে থাকবে পালাবদলের মাইলফলক।