ম্যাচের আগের দিন সকালে আচমকাই জানানো হয়, দলের সঙ্গে যোগ দিচ্ছেন সাকিব। বিকেলেই কলম্বো এসে পৌঁছান। বিসিবি প্রধানের অনুরোধ চাইলে খুব সহজেই এড়াতে পারতেন। চোট কাটিয়ে ফিরে মাত্রই একদিন অনুশীলন করেছেন। গত কিছুদিনে ব্যাংকক-ঢাকা-কলম্বো-মেলবোর্ন ছুটোছুটি করে মানসিকভাবেও ক্লান্ত ছিলেন। কিন্তু সাকিবকে টানল চ্যালেঞ্জ। ভাবলেন দেশের সম্মানের কথা। শুনলেন দলের ডাক।
সাকিব দলে থাকা মানেই আত্মবিশ্বাসের বড় জ্বালানি। সেই চালিকাশক্তির ছোঁয়া পাওয়া গেল ম্যাচের আগে। বাঁচা-মরার ম্যাচে প্রতিপক্ষ স্বাগতিক দল, যাদের হয়ে গ্যালারিতে গলা ফাটাতে প্রস্তুত ৩০ হাজারের বেশি দর্শক। চ্যালেঞ্জ কঠিন। ম্যাচের আগে দলের সামনে দাঁড়ালেন সাকিব। বললেন, আমরা জিতব!
অধিনায়ক এখানেও সামনে। এতদিন পর মাঠে নেমে নিজেই বল হাতে নিলেন প্রথম ওভার। দারুণ বোলিংয়ে বেঁধে দিলেন সুর। দলের উদ্দীপ্ত হওয়ার আরও রসদ!
মুস্তাফিজুর রহমানের হারিয়ে যাওয়া গতি ফিরল। কাটার তাতে আরও ধারাল হলো। মেডেন উইকেটে শুরু। ১৪২ কিলোমিটারের শেল ছুঁড়ে আরও এক শিকার। আরেক প্রান্তেও একই প্রাণের জোয়ার। টি-টোয়েন্টির দশম ওভারে মাঠ সাজানো মনে করিয়ে দিল টেস্ট ক্রিকেটকে। তেজোদীপ্ত বাংলাদেশ!
তবে প্রতিপক্ষের জন্যও তো অনেক কিছু পাওয়ার লড়াই। নিজেদের উৎসবের টুর্নামেন্টে ফাইনালে খেলার সম্মানের লড়াই। দুই পেরেরার ব্যাটে সেই তাড়নার প্রতিফলন। লঙ্কানদের ঘুরে দাঁড়ানো। কে জানত, সবই ছিল আসলে শ্বাসরুদ্ধকর কিছু মুহূর্ত উপহার দেওয়ার আয়োজন!
লঙ্কান ইনিংস শেষ হলো। বাংলাদেশের রান তাড়া কখনও ছুটল, কখনও ধুঁকল। নানা অলিগলি পার হয়ে ম্যাচ সাজাল ধ্রুপদি টি—টোয়েন্টির প্রেক্ষাপট। আবেগের তারে উঠল প্রবল ঝংকার। ক্রিকেটের লড়াই, মাঠে কথার লড়াই, ম্যাচ জয়ের লড়াইয়ের পথে ছোট ছোট লড়াই, এসব আরও চাপিয়ে দেয় জেদ, জিততেই হবে!
সাকিবের ক্যাচ ধরে আকিলা দনঞ্জয়ার ‘স্নেইক ডান্স’ যেন কাঁটা হয়ে বিঁধে বুকে। জবাব দিতেই হবে!
উইকেট পড়ার বিরতিতে বোতল হাতে মাঠে ঢোকেন নুরুল হাসান। তার দিকে ছুটে আসে থিসারা পেরেরার মুখ নি:সৃত অমিয় সুধা। নুরুল কেন ছেড়ে কথা বলবেন। আঙুল উঁচিয়ে তেড়ে যান। থিসারাও এগিয়ে আসেন। সঙ্গে উপুল থারাঙ্গাসহ আরও দু-একজন। অতিরিক্ত একজনের জন্য এত শক্তি ক্ষয়? জয়ের তেষ্টা আরও বাড়ে। জবাব দিতেই হবে।
দুটি বাউন্সার তো হয়েই গেল, আম্পায়ার নো দেবেন না? মাহমু্দল্লাহ এগিয়ে যান, আম্পায়ারের এক হাত প্রসারিত হয়। এমন গুরুত্বপূর্ণ সময়ে নো বলের ধাক্কা! লঙ্কানরা এগিয়ে যায়। তাদের দাবির হাওয়ায় নো বল হয় বাতিল। এই ম্যাচের জন্য আশার ডানায় ভেসে আসা এখানে। সাকিব এদিন তাই অগ্নিগর্ভ। মাঠের বাইরে থেকেই সোচ্চার আম্পায়ারের এই সিদ্ধান্তের।
নিজেদের এক তরুণ অফ স্পিনারকে চাকিংয়ের অপরাধে নো বল ডাকায় অস্ট্রেলিয়ার মতো জায়গায় দলবল নিয়ে মাঠ ছেড়েছিলেন যিনি, সেই অর্জুনা রানাতুঙ্গার ভূমিতে আরেক নো বলের বিতর্কে ব্যাটসম্যানদের বাইরে ডেকে পাঠান সাকিব। দুঃসাহস নাকি স্বেচ্ছাচারিতা? কিংবা ক্রিকেটীয় চেতনাকে বুড়ো আঙুল দেখানো; অনেকের চোখে অনেক কিছু। সাকিব দেখেন, জয়ের তাড়না। এই লড়াই যে জিততেই হবে!
সময়ের শব্দ শুনলেন মাহমুদউল্লাহ। বাতাসের ভাষা পড়লেন। লড়াই তাকেই জেতাতে হবে।
তার ব্যাট থেকে আসে চার। মাঠের বাইরে গর্জন করেন নুরুল। যেন তিনিই ব্যাটসম্যান। লড়াইটি যেন তারই জিততেই হবে! গ্যালারির গর্জন তখন গেছে থেমে।
খানিকপর সেই নিস্তব্ধতাকে বিদীর্ণ করে মাহমুদউল্লাহর হুংকার। জাদুকরী কবজির মোচড়ে প্রেমাদাসার কৃত্রিম আলোয় সাদা বল উড়ে যায় রঙিন স্বপ্ন হয়ে। লাফিয়ে যেন আকাশ ছুঁতে চান মাহমুদউল্লাহ। বাংলাদেশের ক্রিকেই তো স্পর্শ করল সেই নতুন উচ্চতা!
ততক্ষণে মাঠে কিলবিল করছে একদল ‘সর্প’। মেতে উঠেছে স্নেইক ডান্সে। কোনো মুদ্রার ধার ধারা নয়। বুনো, খ্যাপাটে, উন্মত্ত। ব্যাকরণহীন এই সর্পিল নৃত্যও যেন কত সৌন্দর্যময়! বয়স-বাস্তবতা ভুলে ম্যানেজার খালেদ মাহমুদও এই দলেরই একজন। জয়টার এমনই মহিমা। ভালোলাগাটুকুর এতটাই তীব্রতা।
‘সর্পরাজ’ ততক্ষণে খোলস খুলে ফেলেছেন। আদুল গায়ে মাঠের কেন্দ্রে সাকিব আল হাসান। চকিতে অনেককে ফিরিয়ে নিয়ে যায় প্রায় ১৬ বছর আগে, লর্ডসের ব্যালকনিতে। নাহ, সৌরভ গাঙ্গুলির মত জার্সি খুলে মাথার ওপর ঘোরাননি। হাতেই রেখেছিলেন। তবে শিষ্টাচারকে ক্ষনিকের তরে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে যেন একই দুঃসাহসের প্রতিফলন। প্রতিপক্ষের মাঠে যাবতীয় প্রতিকূলতাকে জয় করে মাথা তুলে দাঁড়ানোর স্পর্ধা।
টিভি পর্দায় মুহূর্ত কয়েকের জন্য ধরা পড়ল ব্রেট লির মুখায়ব। ধারাভাষ্যকক্ষে আক্ষরিক অর্থেই ঝুলে গেছে সাবেক গতি তারকার চোয়াল। বিস্ময়মাখা দৃষ্টি আর মুগ্ধতা মেশানো কণ্ঠে বললেন, “আমি বিশ্বাস করতে পারছিনা…কী অবিশ্বাস্য ম্যাচ জেতানো শট!”
অবিশ্বাস্য শট, অবিশ্বাস্য ইনিংস। রুদ্ধশ্বাস ম্যাচ, অসাধারণ জয়। দুর্বিনীত চাওয়াগুলো বুঝি এমনই হয়।