রোমাঞ্চ আর উত্তেজনার চূড়ান্ত পসরা সাজানো ম্যাচে শ্রীলঙ্কাকে ২ উইকেটে হারিয়ে ফাইনালে উঠেছে বাংলাদেশ। প্রেমাদাসা স্টেডিয়ামে শুক্রবার সেমি-ফাইনালে রূপ নেওয়া ম্যাচে শ্রীলঙ্কার ১৫৯ রান তাড়ায় বাংলাদেশ জিতেছে ১ বল বাকি থাকতে।
শেষ ওভারে জয়ের জন্য দরকার ছিল ১২ রান। প্রথম দুই বলে রান হয়নি, দ্বিতীয় বলে রান আউট মুস্তাফিজ। বাংলাদেশের আশা তখন কফিনে, কেবল পেরেক ঠোকার অপেক্ষা। রান-বলের টানাপোড়েনের বাইরে ম্যাচে তখন ছড়াল অন্য উত্তেজনা।
শেষ ওভারের প্রথম বলটি ছিল বাউন্সার। পরের বলটিও বাউন্সার। মুস্তাফিজ রান আউট হলেও দ্বিতীয় বাউন্সারের কারণে লেগ আম্পায়ার সংকেত দেন নো বলের। কিন্তু লঙ্কানদের প্রতিবাদের মুখে আবার নো-বল তুলে নেন আম্পায়ার।
এরপর শুরু হয় বাংলাদেশের প্রতিবাদ। মাঠে উত্তেজনার ঝড়। মাঠের বাইরে চতুর্থ আম্পায়ারের সঙ্গে তর্কে লিপ্ত সাকিব আল হাসান, যিনি আগের দিন দলে যোগ দিয়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন দলকে। প্রতিবাদী অধিনায়ক মাঠ থেকে চলে আসতে বলেন ব্যাটসম্যানদের। শেষ মুহূর্তে ব্যাটসম্যানদের থামান ম্যানেজার খালেদ মাহমুদ। মেনে নেয় বাংলাদেশ।
সেই ত্যাগেই যেন লুকিয়ে ছিল অনেক বড় প্রাপ্তি। ৪ বলে তখন দরকার ১২ রান। মাহমুদউল্লাহর বাউন্ডারিতে নতুন আশা। পরের বলে দুই। দুই বলে যখন প্রয়োজন ৬ রান, মাহমুদউল্লাহর অবিস্মরণীয় ফ্লিকে ছক্কা।
বেঙ্গালুরুতে ২ বলে ২ রানের প্রয়োজনে ছক্কা মারতে গিয়ে দলকে ডুবিয়েছিলেন যিনি, এদিন তিনিই নায়ক। ১৮ বলে ৪৩ রানের অসাধারণ অপরাজিত ইনিংসটায় হয়তো তাড়ান গেল বেঙ্গালুরুর ভূত।
মুশফিকের বিদায়ে এই জুটি ভাঙা দিয়ে পথ হারানোর শুরু। দুই বছর পর টি-টোয়েন্টি ফিফটি পেয়েই বিদায় নিলেন তামিম। সৌম্য সরকার আর সাকিব পারলেন না সময়ের দাবি মেটাতে। এদিন সব তোলা ছিল যেমন মাহমুদউল্লাহর জন্য।
অথচ শেষে এত নাটক হতো না, যদি বাংলাদেশের বোলিংয়ের শেষটা হতো শুরুর মতো। লক্ষ্যই তো হওয়ার কথা নয় এত বড়!
৪১ রানে ৫ উইকেট হারিয়ে ফেলেছিল শ্রীলঙ্কা। সেখান থেকে দুই পেরেরা, কুসল ও থিসারা দলকে এনে দেন লড়ার মত রান।
টস জয়ের পর সাকিব বেঁধে দিয়েছিলেন শুরুর সুর। দারুণ প্রথম ওভারে দেন মাত্র তিন রান। পরের ওভারে দলকে প্রথম উইকেটও এনে দেন দেন তিনিই। সাব্বিরের দারুণ ক্যাচে ফেরেন বিপজ্জনক দানুশকা গুনাথিলাকা।
ম্যাচের আগে মুস্তাফিজকে জ্বলে ওঠার ডাক দিয়েছিলেন কোর্টনি ওয়ালশ। কোচের ডাকে মুস্তাফিজ সাড়া দেন দারুণভাবে। বল হাতে নিয়ে ছড়ান বারুদ। প্রথম ওভারে মেডেন উইকেট। বাংলাদেশের বিপক্ষে আগের তিন ম্যাচেই ফিফটি করা কুসল মেন্ডিস এবার ১৪ বলে ১১।
মুস্তাফিজ এ দিন ছিলেন গতিময় ও আগ্রাসী। নিয়মিত বল করেছেন ১৪০ কিলোমিটারের আশেপাশে। কাটারগুলোও তাই ব্যাটসম্যানদের ভোগায় বেশি। নিজের পরের ওভারে ১৪২ কিলোমিটার গতির দুর্দান্ত ডেলিভারিতে ফিরিয়ে দেন দাসুন শানাকাকে।
ডুবতে থাকা সেই তরীকেই শক্ত হাতে হাল ধরে নতুন দিশায় এগিয়ে নিলেন কুসল পেরেরা। ত্রয়োদশ ওভারে মুস্তাফিজকে তুলোধুনো করে ইনিংসের পালা বদলের শুরু। টানা দুই বলে চার-ছক্কা মারেন কুসল। থিসারা পেরেরাও পান প্রথম বাউন্ডারি। এরপর দুজনের আর থামাথামি নেই।
জুটি গড়ে উঠল। রান বাড়তে থাকল। দুই বাঁহাতি ব্যাটসম্যান দেখে বিস্ময়করভাবে বাঁহাতি স্পিনার নাজমুল অপুকে বোলিংয়েই আনলেন না সাকিব। প্রথম দুই ওভার দারুণ বোলিং করার পরও আর বল হাতে নিলেন না নিজেও।
৬১ বলে ৯৭ রানের দুর্দান্ত জুটি গড়লেন দুজন। ষষ্ঠ উইকেটে যা শ্রীলঙ্কার সর্বোচ্চ, সব দল মিলিয়ে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ জুটি।
বাংলাদেশের বিপক্ষে আগের ম্যাচে ৭৪ রান করা কুসল পেরেরা এবার ৪০ বলে করলেন ৬১। বাংলাদেশকে অনেকবার ভোগানো থিসারা পেরেরার ব্যাটে তিনটি করে চার ও ছক্কায় ৩৭ বলে ৫৮।
রানটা তবু ছিল না বাংলাদেশের ধরাছোঁয়ার বাইরে। শেষ পর্যন্ত ছোঁয়াও হলো। তবে প্রেমাদাসা সাক্ষী হয়ে রইল টি-টোয়েন্টি ইতিহাসের অন্যতম আবেগময়, উত্তেজনাপূর্ণ ম্যাচের। বীরোচিত ব্যাটিংয়ে নাটকীয় সে ম্যাচের শেষাঙ্কের নায়ক মাহমুদল্লাহ।
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
শ্রীলঙ্কা: ২০ ওভারে ১৫৯/৭ (গুনাথিলাকা ৪, কুসল মেন্ডিস ১১, কুসল পেরেরা ৬১, থারাঙ্গা ৫, শানাকা ০, জিবন ৩, থিসারা ৫৮, উদানা ৭,* দনঞ্জয়া ১*; সাকিব ১/৯, রুবেল ০/৪১, মুস্তাফিজ ২/৩৯, মিরাজ ১/১৬, মাহমুদউল্লাহ ০/২৯, সৌম্য ১/২১)।
বাংলাদেশ: ১৯.৫ ওভারে ১৬০/৮ (তামিম ৫০, লিটন ০, সাব্বির ১৩, মুশফিক ২৮, সৌম্য ১০, মাহমুদউল্লাহ ৪৩*, সাকিব ৭, মিরাজ ০, মুস্তাফিজ ০, রুবেল ০*; প্রদিপ ১/১০, দনঞ্জয়া ২/৩৭, আপোন্সো ১/১৯, থিসারা ০/২০, গুনাথিলাকা ১/২৪, জিবন ১/২৪, উদানা ১/২৬)
ফল: বাংলাদেশ ২ উইকেটে জয়ী
ম্যান অব দা ম্যাচ: মাহমুদউল্লাহ