‘জীবন আমাকে মুরালিধরন দিয়েছে, আমি হেরাথ হয়েছি’

রঙিন পোশাক ছেড়েছেন বেশ আগে। ত্রিদেশীয় সিরিজের মাঝে তবু প্রেমাদাসা স্টেডিয়ামে দেখা গেল রঙ্গনা হেরাথকে। সামনের ঘরোয়া টুর্নামেন্টের জন্য প্রস্তুত রাখছেন নিজেকে। তার নিবেদনের সামান্য নমুনা এটি। নিবেদন, পরিশ্রম ও প্রতিজ্ঞা দিয়েই হেরাথ উঠে এসেছেন আজকের উচ্চতায়। তার পায়ে লুটাচ্ছে রেকর্ডের পর রেকর্ড। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে লঙ্কান স্পিনার শোনালেন তার চড়াই-উৎরাইয়ের পথচলা ও লড়াই জয়ের গল্প আর ভবিষ্যৎ ভাবনা।

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনিকলম্বো থেকে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 March 2018, 01:04 PM
Updated : 9 March 2018, 01:17 PM

বাংলাদেশ থেকে টেস্ট সিরিজ খেলার পর আর কোনো ম্যাচ খেলেননি। সময় কাটছে কিভাবে?

রঙ্গনা হেরাথ: এই যে, আজকে যেমন অনুশীলন করলাম, এভাবেই চলছে। ঘরোয়া ক্রিকেটে সম্প্রতি টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট হয়ে গেল। আমি তো এখন আর খেলি না এসব। সামনে ঘরোয়া ক্রিকেটে বড় দৈর্ঘ্যের ম্যাচ আছে, সেটির জন্যই নিজেকে প্রস্তুত রাখছি।

২০-২১ বছর ধরে প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলছেন, এখনও ঘরোয়া ক্রিকেট খেলে যাওয়ার উদ্যম ধরে রাখছেন কিভাবে?

হেরাথ: রাখতেই হবে, কারণ এটিই আমার নিজেকে প্রস্তুত রাখার জায়গা। যেহেতু সীমিত ওভারের ক্রিকেট খেলছি না, টেস্ট ম্যাচের জন্য নিজেকে ফিট রাখতে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট ছাড়া উপায় নেই। শুধু ট্রেনিং করে যাওয়া যথেষ্ট নয়, ম্যাচ অনুশীলনও জরুরি।

এক সময় আপনার ক্যারিয়ার ছিল অপূর্ণতার গল্প। সেটিই এখন প্রাপ্তি আর অর্জনে টইটম্বুর। ৪০০ উইকেট, এত এত রেকর্ড, কেমন লাগে ভাবলে?

হেরাথ: গর্ববোধ করি। দেশকে কিছু দিতে পেরেছি বলে ভালো লাগে। সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে, বছরের পর বছর ধরে যে পরিশ্রম, ঘাম ঝরিয়ে যাওয়া, ধৈর্য ধরে লেগে থাকা, সেটির প্রতিদান মিলেছে। আমি তাই বিশ্বাস করি, নিষ্ঠার সঙ্গে কিছু চাইলে সবই সম্ভব।

ধৈর্যের কথা বলছিলেন। এই যে মুত্তিয়া মুরালিরধরনের জমানায় দিনের পর দিন বাইরে বসে থাকা, ক্যারিয়ারের প্রথম ১০-১১ বছরে মাত্র ২২টি টেস্ট খেলতে পারা, আপনি আগেও বলেছেন হাল না ছাড়ার কথা। কিন্তু কিভাবে সেটি সম্ভব হলো?

ছবি: শ্রীলঙ্কা ক্রিকেট

হেরাথ:
ধৈর্য দিয়েই সম্ভব হয়েছে! আমি আমার সময়ের জন্য অপেক্ষা করেছি। শেষ দেখতে চেয়েছি, সুযোগের প্রতীক্ষায় থেকেছি। দেখুন, আমার টেস্ট অভিষেক ২১ বছর বয়সে। কজন এই বয়সে টেস্ট খেলতে পারে! ওই বয়সেই দেশের হয়ে খেলতে পারায় আমি ভাগ্যবান ছিলাম। তাই পরে যখন ভাগ্য আমার পক্ষে ছিল না, আমি সৌভাগ্যের জন্য অপেক্ষা করেছি।

২১ বছর বয়সে দেশের হয়ে খেলেছি, তার মানে আমার নিশ্চয়ই সেই প্রতিভা ছিল। আমি চেষ্টা করে গেছি আরও ধারাল হয়ে উঠতে। আমার জন্য কাজটা সহজ করে দিয়েছিল বাস্তবতার উপলব্ধি। মুরালিধরনের মতো একজন, সর্বকালের সেরা বোলার আমাদের দলে, আমার সুযোগ কমই থাকবে। খুব দ্রুত নিজেকে এটা বোঝাতে পেরেছিলাম বলে আক্ষেপ-হতাশা আমাকে ততটা পেয়ে বসেনি।

এরপরও, মাঝে মধ্যে কি হতাশা পেয়ে বসত না?

হেরাথ: অনেকেই বিশ্বাস করতে চায় না। কিন্তু সত্যি বলতে, আমি হতাশ হইনি। বিশ্বাস ছিল, আমার সময় আসবেই। ২০০৫ পর্যন্ত তো টুকটাক টেস্ট খেলেছি। এরপর সত্যিকারের কঠিন সময়ের শুরু। ২০০৮ পর্যন্ত আর সুযোগ পাইনি। তবু নিজেকে অনুপ্রাণিত করে গেছি যে একদিন সুসময় ফিরবে।

আরেকটা ব্যাপার ছিল, শ্রীলঙ্কা ‘এ’ দলে মোটামুটি নিয়মিতই খেলেছি ওই বছরগুলোয়। তাই জানতাম, আমি হয়ত বিবেচনার বাইরে নই। আমি আমার মতো করে চেষ্টা করে গেছি।

আপনার ক্যারিয়ার এখন আরও অনেক ক্রিকেটারের জন্য অনুপ্রেরণার গল্প। সুযোগ না পেয়ে হতাশ হওয়া বা ভেঙে পড়াদের সামনে আদর্শ উদাহরণ…

হেরাথ: বেশ কিছুদিন আগে আমি কোথাও পড়েছিলাম, “রঙ্গনা হেরাথের সামনে মুরালিধরনের মত একজন এসেছে, কিন্তু সে ঠিকই হেরাথ হয়েছে।” কথাটি আমার খুব ভালো লেগেছিল। আগে কখনও এভাবে ভাবিনি। সত্যিই তো, আমার জীবনে মুরালিধরন এসেছে, কিন্তু আমি হেরাথ হতে পেরেছি। অন্যরাও কেন পারবে না? নিজের প্রতি সৎ থেকে চেষ্টা করে গেলে অবশ্যই সম্ভব।

আপনার ক্যারিয়ারের সাফল্যমধয় অধ্যায়ের শুরু আসলে মুরালিধরন অবসর নেওয়ার একটু আগে থেকেই। তার চোটে ডাক পেয়ে গল টেস্টে পাকিস্তানের বিপক্ষে দলকে জেতালেন…

হেরাথ: তার কয়েক মাস আগে বাংলাদেশে গিয়ে একটি টেস্টে ভালো করতে পারেনি। বাদ পড়েছিলাম। ২০০৯ সালের ইংলিশ গ্রীষ্মে আমি গিয়েছিলাম ইংল্যান্ডে ক্লাব ক্রিকেট খেলতে। হঠাৎ সাঙ্গার (কুমার সাঙ্গাকারা) ফোন পেলাম। জানাল যে মুরালির চোট, আমি খেলার মত ফিট কিনা। আমি বলেছিলাম, ‘অবশ্যই।’

তাড়াহুড়ো করে অনেক চেষ্টায় পরের ফ্লাইট ধরে চলে আসি। প্রথম ইনিংসে খুব ভালো করতে পারিনি। শেষ ইনিংসে পাকিস্তানের লক্ষ্য ছিল ১৬৮। আমি ভেবেছিলাম আমরা পারব না। নিজেকে নিয়েও একটু হতাশ ছিলাম যে ভালো করতে পারব না। তখন চন্দিকা (হাথুরুসিংহে, তখনকার সহকারী কোচ) দারুণ উৎসাহ দিয়েছিল। বলেছিল যে আমাকে দিয়েই সম্ভব। আমি ৪ উইকেট নিলfম, আমরা ৫০ রানে জিতলাম।

আমার বিশ্বাস, ভাগ্যই লিখে রেখেছিল যে আমি ফিরব ও দলকে জেতাব। আমার এত দিন ধরে চালিয়ে যাওয়া লড়াই, আমার বিশ্বাসে নতুন দম দিয়েছিল ওই টেস্ট।

মুরালিধরনের পর তো আপনারই রাজত্ব। আগের ২২ টেস্টে ছিল ৭১ উইকেট, মুরালির অবসরের পর ৬৭ টেস্টে ৩৪৪টি। অবিশ্বাস্য সব সংখ্যা। মুরালিধরনের সঙ্গে কথা হয়েছে এসব নিয়ে?

হেরাথ: অনেক বার। খেলা ছাড়ার পর তো বটেই, মুরালিধরন যখন খেলেছেন, তখনও আমাকে সবসময় উৎসাহ দিয়ে গেছেন। ফোন-টেক্সট, কিংবা দেখা হলে সবসময় অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন। মুরালির এটা অসাধারণ গুণ। শুধু আমাকে নয়, অনেক ক্রিকেটারকেই সে এভাবে উৎসাহ জোগায় সবসময়।

৩০০ উইকেট পাওয়ার পর বলেছিলেন যে আর কোনো লক্ষ্য নেই। সেখান থেকে প্রথম বাঁহাতি স্পিনার হিসেবে ছাড়িয়ে গেছেন চারশ। নিজের কাছে অবিশ্বাস্য লাগে না?

হেরাথ: অবিশ্বাস্য লাগলে আমি এটা অর্জন করতে পারতাম না। ৪০০ উইকেট অবশ্যই ভাবিনি, তবে জানতাম দলকে দেওয়ার অনেক কিছু আছে। তাই নিবেদনে কমতি রাখিনি। ৪০০ উইকেট অনেক বড় অর্জন, বিশেষ কিছু।

এখন তো আপনার ঝুলিতে রেকর্ড-অর্জনের শেষ নেই। ইতিহাসের সফলতম বাঁহাতি টেস্ট বোলার, প্রথম বাঁহাতি হিসেবে ইনিংসে ৯ উইকেট, টেস্ট হ্যাটট্রিক, প্রতিটি দেশের বিপক্ষে ৫ উইকেট, চতুর্থ ইনিংসে সবচেয়ে বেশিবার ৫ উইকেট, আরও অনেক অনেক। রেকর্ডের মানে আপনার কাছে কি?

হেরাথ: আগে পরিসংখ্যান আমাকে খুব ভাবাত না। তবে এখন বড় বড় অর্জনগুলোতে ভালোই লাগে। পরিশ্রমের স্বীকৃতি বলে মনে হয়। ওয়াসিম আকরামকে ছাড়িয়ে সফলতম বাঁহাতি বোলার হওয়া অনেক বড় ব্যাপার, কারণ আকরাম ছিলেন অসাধারণ। প্রতিটি দেশের বিপক্ষে ৫ উইকেটে প্রমান মেলে ধারাবাহিকতার। আমরা ক্রিকেটাররা রেকর্ডের জন্য খেলি না। দলকে জেতানোই সবচেয়ে বড় পুরস্কার। তবে ভালো লাগে এসব অর্জন।

নিজের সবচেয়ে স্মরণীয় পারফরম্যান্স বলবেন কোনটিকে?

হেরাথ: ওই ৯ উইকেট (পাকিস্তানের বিপক্ষে) অবশ্যই স্মরণীয়। দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে প্রথম টেস্ট জয়ে ম্যান অব দা ম্যাচ (২০১১ সালে ডারবানে), ইংল্যান্ডের মাটিতে সিরিজ জয় (২০১৪) ভোলার নয় কখনোই। গলে ভারতের বিপক্ষে ৭ উইকেটও স্মরণীয় (৭/৪৮, ২০১৫ সালে), কারণ ভারতীয়রা স্পিন সবসময়ই ভালো খেলে। এমনকি বাংলাদেশের বিপক্ষে সবশেষ টেস্টে ৪ উইকেট, দলের জয়ে অবদান রাখা এ রকম প্রতিটি টেস্টই আমার কাছে স্পেশাল।

বাংলাদেশের মাটিতে আরেকটি পারফরম্যান্সও নিশ্চয়ই আলাদা করে মনে থাকবে, ২০১৪ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে ৩ রানে ৫ উইকেট!

হেরাথ: সীমিত ওভারের ক্রিকেটে সেটিই আমার সেরা সাফল্য, মনে তো থাকবেই। আমরা খুব কম রান করেছিলাম (১১৯), জিতে তাই দারুণ কিছুর দরকার ছিল। গাপটিলকে আমি রান আউট করলাম, এরপর থেকেই খেলার মোড় পাল্টে গেল। ৫ উইকেটের সঙ্গে দুটি রান আউটও করেছিলাম।

শুধু ওই ম্যাচ নয়, বিশ্বকাপ জয়টাও ছিল বিশেষ কিছু। সাঙ্গা, মাহেলা (জয়াবর্ধনে), লাসিথ (মালিঙ্গা), আমাদের প্রজন্মের সবাই একটি বিশ্বকাপ জিততে মরিয়া ছিলাম। বাংলাদেশ তাই সবার হৃদয়েই আলাদা জায়গা নিয়ে থাকবে।

সাঙ্গাকারা-জয়াবর্ধনেদের ক্যারিয়ারের বেশিরভাগ সময় একসঙ্গে খেলতে পারেননি। তবে শেষ কয়েক বছরে খেলেছেন। কেমন ছিল সেই অভিজ্ঞতা?

হেরাথ: আমি ভাগ্যবান যে কয়েকটি প্রজন্মের সঙ্গে খেলেছি। যখন শুরু করেছিলাম, অর্জুনা (রানাতুঙ্গা), অরবিন্দ (ডি সিলভা), সনাৎ (জয়াসুরিয়া), চামিন্দা (ভাস), মারভানদের (আতাপাত্তু) সঙ্গে খেলেছি। অসাধারণ সব ক্রিকেটার ওরা। পরে সাঙ্গা-মাহেলা। সাঙ্গার সঙ্গে আমার চেনাজানা সেই ১৪-১৫ বছর বয়স থেকেই। স্কুল ক্রিকেটে অনেক খেলেছি। আমার ক্যারিয়ার পুনরুজ্জীবনে অনেক বড় ভূমিকা ওর। মুরালিরও বড় ভুমিকা ছিল। মাহেলাকে দেখে অনেক শিখেছি। সব মিলিয়ে আমি সত্যিই ভাগ্যবান।

মুরালিধরনের সঙ্গে ভাসের জুটি ছিল দারুণ। ভাসের নিয়ন্ত্রিত বোলিং অনেক সময়ই মুরালিধরনকে উইকেট পেতে সাহায্য করেছে। আপনার সময়ে বেশিরভাগ সময় আপনাকে একাই শিকার ধরতে হয়েছে। খানিকটা দুর্ভাগা মনে হয়?

হেরাথ: এভাবে বলা ঠিক নয়। আমার সময়ও আরেক পাশে যারা বোলিং করেছে, তারা চেষ্টা করেছে। এখন লাকমল, প্রদীপরা বেশ ভালো করছে। দিলরুয়ান পেরেরা টেস্টে নিয়মিতই ভালো করছে। আকিলা (দনঞ্জয়া) ভালো করতে শুরু করেছে। আমি শুধু একাই ভালো করিনি।

যাদের বিপক্ষে বল করেছেন, কঠিনতম ব্যাটসম্যান কে?

হেরাথ: এভাবে বলা কঠিন। অনেকেই অনেক ভালো। এবি ডি ভিলিয়ার্স ও বিরাট কোহলির বিপক্ষে বল করা কঠিন। পায়ের কাজ দারুণ। চিন্তাভাবনায় ওরা বোলারের চেয়ে এগিয়ে থাকতে চায়, ওদের শক্তির জায়গায় বল করতে বাধ্য করে।

দিন দশেক পর বয়স ৪০ পূর্ণ হবে। ভবিষ্যৎ ভাবনা কি? ১০০ টেস্ট খেলা (এখন ৮৯টি) বা ৫০০ উইকেটের ঠিকানায় নিজেকে দেখতে পান?

হেরাথ: ওসব কিছুই ভাবছি না। আমি এখন প্রতিটি সিরিজ ধরে এগোতে চাই। হাঁটুর চোট মাঝেমধ্যেই ভোগায়। নিয়মিত ইনজেকশন নিতে হয়। দূর ভবিষ্যৎ ভাবা তাই কঠিন। আপাতত সামনে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করছি। ফিট থাকলে খেলে যাব। তবে দলের বোঝা হয়ে একদিনও থাকব না।