বাংলাদেশের ব্যাটিং যেন বিভীষিকা

প্রয়োজন ছিল নিবেদনের। প্রয়োজন ছিল চোয়ালবদ্ধ প্রতিজ্ঞার। বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ে ফুটে উঠল উল্টো চিত্র। দেখা গেল অস্থিরতা ও উইকেটে ছটফটে উপস্থিতি। পরিস্থিতি দাবি করছিল আক্রমণ ও রক্ষণের মিশেল। কিন্তু ব্যাটিং দেখে মনে হলো, আগ্রাসন ছাড়া আর কোনো পথই নেই! শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে মিরপুর টেস্টে বাংলাদেশের ব্যাটিং হয়ে থাকল বিভীষিকার প্রতিশব্দ।

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 10 Feb 2018, 11:10 AM
Updated : 10 Feb 2018, 02:11 PM

ব্যাটিং দুঃস্বপ্নের শুরু প্রথম ইনিংসেই। ১১০ রানে গুটিয়ে গিয়ে প্রথম ইনিংসেই বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়ে ১১২ রানে। ম্যাচের ভাগ্য অনেকটা নির্ধারিত হয়ে যায় তখনই। দ্বিতীয় ইনিংসে সুযোগ ছিল লড়াই করে কিছুটা পুষিয়ে দেওয়ার। কিন্তু আরেক দফা দমকা হাওয়ায় উড়ে গেছে ব্যাটিং। এমন লো স্কোরিং ম্যাচে ২১৫ রানের পরাজয় এক অর্থে প্রায় ইনিংস পরাজয়েরই সামিল।

ব্যাটিং বিপর্যয় ক্রিকেটে নতুন নয়। বাংলাদেশের ক্রিকেটে নতুন তো নয়ই। তবে প্রশ্ন থাকছে বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ের ধরন নিয়ে। আত্মঘাতী পথে হেঁটে বাংলাদেশ যে এক রকম আলিঙ্গনই করেছে বিপর্যয়কে!

শেষ দিনের কথাই ধরা যাক। লক্ষ্য হয়তো এক রকম ধরাছোঁয়ার বাইরে। তাই বলে বুলেট ট্রেনে চেপে সেই লক্ষ্যে পৌঁছানোর চেষ্টা তো আত্মহত্যা করার মতোই। কিন্তু বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ে দেখা গেল সেটিরই প্রবণতা।

সবচেয়ে বড় ভরসা তামিম ইকবালের আউট শুরুতে আসে বড় ধাক্কা হয়ে। বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ের ধরনটা চোখে লাগতে থাকে এরপর থেকেই। ইমরুল কায়েস ও মুমিনুলের হকের জুটিতে দেখা গেল বলের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রান করার তাড়না।

প্রায় প্রতি ওভারেই বেরিয়ে এসে খেলছিলেন ইমরুল। নিয়ন্ত্রিত নয়, বেশিরভাগ সময়ই ছিল শট খেলেছেন তেড়েফুঁড়ে। জীবন পেয়েও পথ বদলাননি। সাফল্যও মেলেনি।

মুমিনল হকের ৩৩ রানের অভিযানের পুরোটুকুই ছিল ঝুঁকির সঙ্গে বসবাস। ব্যাটে নির্ভরতার ছাপ ছিল সামান্যই।

মুশফিকুর রহিম উইকেটে যাওয়ার পর তিন বল খেলেই চেষ্টা করেছেন রিভার্স সুইপের। সেটিতে না পেরে তিন বল পর আবারও করেছেন রিভার্স সুইপের চেষ্টা! লাঞ্চের পর দ্বিতীয় বলেই বেরিয়ে এসে মেরেছেন চার। ৫১ বলের উপস্থিতির বেশিরভাগ জুড়েই ছিলেন ছটফটে।

মাহমুদউল্লাহ খেলেছেন মোটে ৮ বল। স্বস্তিতে খেলতে পারেননি হয়ত একটি বলও। আউটও হয়েছেন আগে থেকেই বেরিয়ে এসে শট খেলার দোলাচলে। দায় একটু কম কেবল লিটন দাসের। আউট হয়েছেন আকিলা দনঞ্জয়ার জোরের ওপর করা বাড়তি লাফানো বলে।

দ্রুত রান তোলার ভাবনা থেকেই এই টেস্টে মোসাদ্দেক হোসেনকে বাদ দিয়ে আনা হয় সাব্বির রহমানকে। দুই ইনিংসে সাব্বির প্রতিদান দিয়েছেন শূন্য ও এক রান করে। দুই ইনিংসের আউট হওয়ার ধরন তার টেস্ট খেলার মত টেকনিক ও টেম্পারামেন্ট নিয়ে সংশয়টা জাগিয়ে তোলে আরও একবার।

এ ধরনের টার্নিং উইকেটে খেলা বাংলাদেশের জন্য এই প্রথম নয়। বরং ২০১৬ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্টে ও গত বছর অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টেস্টে এর চেয়েও বেশি টার্নিং ও অসমান বাউন্সের উইকেটে খেলেছে বাংলাদেশ। জিতেছে দুবারই। সেই দুই ম্যাচে এতটা ব্যাটিং দৈন্য ফুটে ওঠেনি।

ওই দুই টেস্টেই অসাধারণ ব্যাট করেছিলেন তামিম ইকবাল। দলের সাফল্যে যেটির ছিল বড় অবদান। কিন্তু দলের সেরা ব্যাটসম্যান ব্যর্থ এবার। তামিম দুই ইনিংসেই এতটা ব্যর্থ হয়েছেন, সাম্প্রতিক সময়ে সেটি খুবই বিরল। তার ব্যর্থতার টেস্টে নিজেকে সেই উচ্চতায় তুলে আনতে পারেননি অন্য কেউ।

এই টেস্টে ফিরে এসেছে বাংলাদেশ ক্রিকেটে একটি পুরোনো এক ভূতও। আতঙ্কের বোতামে চাপ পড়লেই দিশাহারা গোটা ড্রেসিং রুম। থামানোর যেন কেউ নেই। প্রথম ইনিংসে তাই ৩ রানে পড়েছে শেষ ৫ উইকেট। দ্বিতীয় ইনিংসে ২৩ রানে শেষ ৬টি।

ম্যাচ শেষে সংবাদ সম্মেলনে অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহ সাফাই গেয়েছেন নিজেদের বেছে নেওয়া ব্যাটিংয়ের ধরন নিয়ে। বারবারই বলেছেন, এই উইকেটে টিকে থাকতে হলে ইতিবাচক থাকা জরুরি। কিন্তু ইতিবাচক থাকা মানেই যে প্রায় প্রতি বলে শট খেলা নয়, ক্রিজ থেকে বেরিয়ে এলেই তেড়েফুড়ে খেলার বাধ্যবাধকতা নেই, রক্ষণটাও যে আগ্রাসী মানসিকতার গুরুত্বপূর্ণ অংশ, এই বার্তা হয়তো দেওয়া হয়নি ব্যাটসম্যানদের। কিংবা বার্তাটা থাকলেও ২২ গজে ফুটে ওঠেনি সেটির বাস্তবায়ন।

বাংলাদেশ শেখেনি প্রতিপক্ষকে দেখেও। মাত্র তৃতীয় টেস্ট খেলতে নামা রোশেন সিলভার দুই ইনিংসের ব্যাটিং দেখে মনে হয়নি এই উইকেটে রান করা অসম্ভব। লম্বা সময় উইকেটে থাকলেও তাকে মনে হয়নি নড়বড়ে। জোর করে শট খেলতেও দেখা যায়নি। ডিফেন্স খুব ভালো ছিল, টেম্পারামেন্টের প্রমাণ রেখেছেন আর বাজে বলকে সাজা দিয়েছেন। সাফল্যের সরল সূত্র!

প্রথম ইনিংসে কুসল মেন্ডিসও দেখিয়েছেন এই উইকেটে কিভাবে খেলা যায়। এমনকি দ্বিতীয় ইনিংসে দিমুথ করুনারত্নেও দেখিয়েছেন, এখানে চাইলে উইকেট আঁকড়ে পড়ে থাকাও সম্ভব। ৩২ রান করেছেন ১০৫ বল খেলে, কোনো বা্উন্ডারি মারেননি। খুব বড় রান হয়ত নয়। কিন্তু জুটি গড়ে তুলেছেন। সবচেয়ে বড় কথা, লড়াই করার মানসিকতা দেখিয়েছেন।

এই স্পৃহা দেখা যায়নি বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের মাঝে। দলের মানসিকতার বড় প্রমাণ আসলে এই টেস্টের একাদশেই আছে। গত টেস্টের শেষ দিনে ৫৩ বলে অপরাজিত ৮ রান করেছিলেন মোসাদ্দেক হোসেন। দলের ড্রয়ে তার ওই ব্যাটিংয়ের ছিল খানিকটা ভূমিকা। ওই সময় যদি সহজাত শট খেলতে গিয়ে আউট হতেন, বড় চাপে পড়ে যেত দল। মোসাদ্দেক নিজেকে সংযত করে খেলেছিলেন দলের প্রয়োজনে। অথচ দ্রুত রান তোলার তাগিদ থেকে সেই মোসাদ্দককেই বাদ দিয়ে ফেরানো হলো সাব্বির রহমানকে। যেটির খেসারত দিতে হলো বাজেভাবে।

টিম ম্যানেজমেন্টের সিদ্ধান্তই যখন দলকে এমন ভুল বার্তা দেয়, মাঠে ক্রিকেটারদের ধরন ও শরীরী ভাষা প্রশ্নবিদ্ধ হওয়া তখন অস্বাভাবিক নয়। মানসিকতা এরকম না হলেই যে বাংলাদেশ ম্যাচ জিতে যেত, সেটি নিশ্চিত নয় অবশ্যই। তবে এটি নিশ্চিত, অতি আগ্রাসনের পথ দলের বড় হারকেই আরও তরান্বিত করেছে।