গুরুর ছোঁয়ায় শাণিত মুমিনুল

বিপিএল শেষে যখন ছুটি কাটাচ্ছিলেন ক্রিকেটারদের অনেকে, মুমিনুল হক চলে গিয়েছিলেন বিকেএসপিতে। ভাবনায় ছিল সামনের টেস্ট সিরিজ। মনে অস্বস্তির কাঁটা স্পিনে ভোগান্তি। ক্রিকেটে যে কোনো সমস্যায় সবার আগে তার মনে পড়ে ‘মেন্টর’ মোহাম্মদ সালাউদ্দিনের কথা। বিকেএসপিতে গিয়ে কোচের সঙ্গে কাজ করলেন ‘ফুটওয়ার্ক’ নিয়ে। উন্নতির ছাপ দেখালেন বিসিএলে। বাড়ল আত্মবিশ্বাস। সেটির প্রতিফলনই পড়ল শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে চট্টগ্রাম টেস্টের প্রথম দিনে।

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 31 Jan 2018, 02:39 PM
Updated : 31 Jan 2018, 04:05 PM

গত কিছুদিনে স্পিন হয়ে উঠেছিল তার পথের কাঁটা। বুধবার প্রথম দিন স্পিনকেই করে নিলেন পাথেয়। আলিঙ্গন করলেন চ্যালেঞ্জটাকে, জবাব দিলেন মুগ্ধতা ছড়িয়ে। স্পিনারদের হুলকেই ফুল বানিয়ে গাঁথলেন ১৭৫ রানের নান্দনিক মালা। ২০৩ বলে ১৭৫ রানের অপরাজিত ইনিংসে স্পিনের বিপক্ষেই মুমিনুল করেছেন ১৪৭ রান!

অথচ এক বছরও হয়নি, চন্দিকা হাথুরুসিংহের সময়ে প্রথমবার টেস্ট দল থেকে বাদ পড়েছিলেন মুমিনুল। সেই সময়ের কোচের মতে, ‘অফ স্পিনে দুর্বল মুমিনুল।’ শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে গল টেস্টে দুই ইনিংসেই দিলরুয়ান পেরেরার অফ স্পিনে আউট হয়েছিলেন পেছনের পায়ে খেলে। খেসারত দিতে হয়েছিল শততম টেস্টে জায়গা হারিয়ে।

পরের টেস্ট খেলার সুযোগ পেলেন অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে চট্টগ্রামে, গত সেপ্টেম্বরে। এবারও দুই ইনিংসে আউট অফ স্পিনার নাথান লায়নের বলে। প্রথম ইনিংসে আবার পেছনে পায়ে খেলে। দ্বিতীয় ইনিংসে টার্নের বিপক্ষে সুইপ করে।

দক্ষিণ আফ্রিকায় গিয়ে প্রথম ইনিংসে রান পেলেন। কিন্তু ৭৭ করে আউট সেই স্পিনেই। এবার কেশভ মহারাজের বাঁহাতি অর্থোডক্স স্পিন। পেছনে খেলবেন না সামনে, আউট হলেন এই দ্বিধায়ই।

মনে দুর্ভাবনার চোরকাঁটা নিয়ে মুমিনুল গেলেন সালাউদ্দিনের কাছে। যার মূল পরিচয় ঘরোয়া ক্রিকেটের সফলতম কোচ। কিন্তু মুমিনুলের কাছে আরও বেশি কিছু। সালাউদ্দিন তার শৈশব, কৈশোর, বড় বেলা, সব সময়েরই কোচ। যার কাছে মেলে যে কোনো সমস্যার সমাধান।

সালাউদ্দিন মুমিনুলকে বললেন ছোট্ট একটি সমস্যার কথা। বলে দিলেন সমাধানও। সেটি নিয়ে কাজ করলেন মুমিনুল। বিকেএসপি থেকে ফিরে চালিয়ে গেলেন কোচের পরামর্শ মেনেই। বিসিএলের প্রথম রাউন্ডেই খেললেন ২৫৮ রানের ইনিংস। কোচকে বললেন, বদলটা দারুণ কাজে দিয়েছে। বিসিএলের পরের রাউন্ডে আবারও সেঞ্চুরি। সেই একই পথে হেঁটে সাফল্য এবার টেস্টেও।

বদলটা কোথায় করেছিলেন মুমিনুল? প্রথম দিনের খেলা শেষে ফোনে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে সেই গল্প শোনালেন সালাউদ্দিন।

“স্পিনে কিন্তু মুমিনুল সবসময়ই সাবলীল ছিল। গত কিছুদিনে আমি স্রেফ একটি জায়গায় একটু সমস্যা দেখেছিলাম। ওর ‘ইনিশিয়াল ফুট মুভমেন্ট।’ শটের সময় একটি স্টেপ নিচ্ছিল ও। স্পিনাররা বেশির ভাগ সময়ই বল করে সামনে। একটি স্টেপে থমকে যাওয়ায় ওর শটের বিকল্প কমে গিয়েছিল।”

“স্পিনার এটা বুঝেই ওকে ফাঁদে ফেলেছে। আমি ওর ইনিশিয়াল মুভমেন্ট নিয়ে একটু কাজ করেছি। ও সেটি প্র্যাকটিস করেছে। বিসিএলের প্রথম ম্যাচে সেটি কাজে লাগার পর খুব খুশি ছিল। আরও কাজ করেছে। ফল পেয়েছে।”

গত কিছুদিনের মুমিনুলের সঙ্গে এদিনের মুমিনুলের পার্থক্যটাও বুঝিয়ে দিলেন সালাউদ্দিন।

“আজ দেখেছেন, ও সামনে খেলেছে, পেছনে খেলেছে, বেরিয়ে এসেছে, পুরো ক্রিজ দারুণভাবে ব্যবহার করেছে। পায়ের কাজ দিয়ে স্পিনারদের থিতু হতে দেয়নি, স্পিনাররা ওর মুভমেন্ট অনুমানও করতে পারেনি।”

যে পেরেরার বলে আউট হয়ে দল থেকে বাদ পড়েছিলেন, এদিন সেই পেরেরার ৬২ বলে মুমিনুল নিয়েছেন ৫১। লঙ্কানদের সেরা স্পিনার রঙ্গনা হেরাথের ৪৮ বলে ৪৭। চায়নাম্যান লাকশান সান্দাকানের ৩৪ বলে ৪০। ধনঞ্জয়া ডি সিলভার ১২ বলে ৯।

সাদা চোখে দেখলে মনে হতে পারে, স্রেফ এইটুকু বদলেই এত পরিবর্তন কিভাবে সম্ভব! কিন্তু সর্বোচ্চ পর্যায়ে ব্যবধান গড়ে দেয় এই ছোট ছোট ব্যাপারগুলিই। বরাবরই বিনয়ী সালাউদ্দিন যদিও বলছেন, আসল কাজ মুমিনুলই করেছেন। তবে ক্রিকেটীয় বাস্তবতায় এটিও ভীষণ সত্যি, টুকটাক কিছু টেকনিক্যাল দিক শাণিত করলেই অনেক সময় বদলে যায় চিত্র।

প্রতিষ্ঠিত ব্যাটসম্যানরা অনেক সময়ই অনেক কিছুতে বদল আনতে চান না। তবে সালাউদ্দিনের প্রতি আস্থা চূড়ায় বলেই হয়ত বদলটুকু আনতে কোনো দ্বিধা করেননি মুমিনুল।

“দেখুন, মুমিনুলের মাঝে এই ব্যাপারটা বরাবরই আছে। কখনোই নিজের ওপর পুরো খুশি হয় না। সবসময়ই কিছু না কিছু জিজ্ঞেস করে। উন্নতি করতে চায়। তামিমের মাঝেও এটা আছে। অনেক কিছু জানতে চায়। নিজেদের আরও সমৃদ্ধ করার তাড়না ওদের তীব্র।”

প্রশ্ন জাগতে পারে, যখন স্পিনে আউট হচ্ছিলেন মুমিনুল, জাতীয় দলের সেই সময়ের কোচিং স্টাফদের চোখে কি এই গলদটুকু ধরা পড়েনি? প্রশ্নটা সালাউদ্দিনেরও।

“আগে একবার বলা হয়েছিল, মুমিনুল শর্ট বলে দুর্বল। অবাক হয়েছিলাম। আবার যখন শুনলাম মুমিনুল স্পিনে দুর্বল, আমি স্তম্ভিত হয়ে পড়েছিলাম। স্পিনে মুমিনুলের চেয়ে ভালো বাংলাদেশে কজন আছে!”

“মুমিনুলের যা একটু সমস্যা হয়েছিল, পুরোটাই টেকনিক্যাল। এমন নয় যে মুমিনুল আগে রান করেনি। একজন ব্যাটসম্যানের সমস্যা হতেই পারে। অনেক গ্রেট ব্যাটসম্যানেরও মাঝেমধ্যে এরকম হয়। খেলার মধ্যে থাকে বলে তারা নিজেরা সেটা হয়ত ধরতে পারে না। তখন কোচের দায়িত্ব সেই সমস্যা চিহ্নিত করে কাজ করা। ছুঁড়ে ফেলা সহজ, কিন্তু সেটি তো সমাধান নয়!” 

এবারের সেঞ্চুরিটি করলেন মুমিনুল ১৩ টেস্টের অপেক্ষার পর। অথচ প্রথম ১২ টেস্টেই করেছিলেন ৪ সেঞ্চুরি। মাঝের এই খরার একটি ব্যখ্যাও আছে সালাউদ্দিনের।

“খেয়াল করে দেখুন, ওয়ানডে দল থেকে বাদ পড়ার পর এটির আগে আর টেস্ট সেঞ্চুরি করতে পারেনি মুমিনুল। বাংলাদেশের বাস্তবতায় শুধু টেস্ট খেলে নিজেকে ধরে রাখা কঠিন। টেস্ট আমরা কম খেলি। অন্য সময়টায় দলের সঙ্গে না খেলে একা একা কাজ করা কঠিন। আমি নিশ্চিত, যথেষ্ট সুযোগ দিলে ওয়ানডেতেই মুমিনুল এমরকম ইনিংস খেলবে।”

“এটি কোনো অজুহাত নয়। শুধু ব্যাটিং নিয়ে কাজ করাই নয়, এত বিরতি পড়লে মানসিকতায় অনেক সমস্যা হয়। নিজেকে অনুপ্রাণিত করাও কঠিন। আমি তো বলব, মুমিনুল বলেই নিজেকে ধরে রাখতে পেরেছে। কারণ মানসিকভাবে অনেক শক্ত ও। অন্য কেউ হলে হয়ত ঝরে পড়ত। বাংলাদেশের ক্রিকেটে সে রকম উদাহরণ আছে বেশ কিছু।”

নিজেকে ফিরে পাওয়া ইনিংসে এখনও থামেননি মুমিনুল। প্রথম দিন শেষ করেছেন ১৭৫ রানে। শিষ্যকে নিয়ে দ্বিতীয় দিনে আরও বড় স্বপ্ন দেখছেন গুরু।

“আউট তো হতেই পারে যে কোনো সময়। তবে যেভাবে খেলছে, আমি অনেক বড় কিছু আশা করছি। এভাবে খেলতে থাকলে তিনশ করাও অসম্ভব নয়।”