আবারও স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় পুড়ল বাংলাদেশ

আরেকটি ফাইনাল; আবারও স্বপ্নভঙ্গের বেদনা। বোলারদের সৌজন্যে উজ্জ্বল হওয়া আশার করুণ সমাধি ব্যাটিং ব্যর্থতায়। বাংলাদেশকে হতাশায় ডুবিয়ে শের-ই-বাংলায় শ্রীলঙ্কার জয়োৎসব। ফাইনালে বাংলাদেশের ব্যর্থতার ইতিহাসে যোগ হলো আরেকটি অধ্যায়।

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 Jan 2018, 10:14 AM
Updated : 27 Jan 2018, 05:42 PM

প্রথম তিন ম্যাচেই দোর্দণ্ড প্রতাপে জয়ী বাংলাদেশ ফাইনালে পারল না লড়াই করতেও। প্রাথমিক পর্বে শেষ ম্যাচের আগে ফাইনালের শঙ্কায় থাকা লঙ্কানদের মুখেই শেষ হাসি। ত্রিদেশীয় সিরিজের ফাইনালে বাংলাদেশ ৭৯ রানে হারিয়ে শিরোপা জিতেছে শ্রীলঙ্কা।

ব্যাটিংয়ে এক সময় বড় স্কোরের পথে থাকা লঙ্কানদের ২২১ রানে আটকে দিয়েছিল বাংলাদেশের বোলাররা। ক্রমশ মন্থর ও দুই রকম গতির উইকেটেও রানটা খুব কঠিন হওয়ার কথা ছিল না। কিন্তু ব্যাটসম্যানরা পারল না সাজানো সেই মঞ্চে আলোর রোশনাই ছড়াতে।

ফিল্ডিংয়ের সময় চোট পেয়ে ব্যাটিং করতে পারলেন না সাকিব আল হাসান। মাহমুদউল্লাহ ছাড়া অন্যরা পারলেন না ২২ গজের দাবি মেটাতে। বাংলাদেশ থমকে গেল ১৪২ রানেই। শের-ই-বাংলা স্টেডিয়ামে এ নিয়ে চারটি ফাইনালে হারল বাংলাদেশ।

মন্থর উইকেটেও শর্ট বলে বাংলাদেশের টপ অর্ডারকে নাড়িয়ে দেয় লঙ্কান পেসাররা। ব্যাটসম্যানরাও যেন মেতে উঠেছিলেন বাজে শটের প্রতিযোগিতায়।

রান তাড়ার শুরু থেকেই বাংলাদেশকে লেগেছে সন্ত্রস্ত। তামিম ইকবাল ও মোহাম্মদ মিঠুনের শুরু ছিল অতি সাবধানী। প্রথম ৫ ওভারে আসে মাত্র ১১ রান। তামিমকে এলোমেলো করে দিল রানের তাড়নাই।

দুশমন্থ চামিরাকে বেরিয়ে এসে মারতে গিয়ে অল্পের জন্য ফিরতি ক্যাচ হননি। পরের বলে শর্ট বলে আবার তেড়েফুড়ে মারতে গিয়ে সহজ ক্যাচ। দারুণভাবে শুরু করা টুর্নামেন্টের শেষ ম্যাচে তামিম করলেন ১৮ বলে ৩।

তামিমের উদ্বোধনী জুটির সঙ্গী বদল হলেও চিত্র বদলায়নি। দারুণ পুলে ছক্কা মারলেও বাকি সময়টায় মিঠুন থাকলেন ঘুমিয়ে। শেষ পর্যন্ত রান চুরি করতে গিয়ে রান আউট ২৭ বলে ১০ করে।

সাকিবের চোটে তিনে সুযোগ পেয়ে আবারও কাজে লাগাতে ব্যর্থ সাব্বির। ফিরেছেন সেই শর্ট বলেই। ১০ ওভারে বাংলাদেশের রান ৩ উইকেটে ২৬।

ধ্বংসস্তুপ থেকে বেশ কবার বাংলাদেশকে টেনে তোলার দুই নায়ক এবারও বেঁধেছিলেন জুটি। মাহমুদউল্লাহ ও মুশফিকের ব্যাটে ধীরে ধীরে আশার সঞ্চার।

কিন্তু প্রিয় সুইপ শটে আবারও আত্মঘাতী মুশফিক। ৫৮ রানের জুটি ভাঙতেই আশা অনেকটা শেষ।

মিরাজ-সাইফ উদ্দিনদের নিয়ে এরপর চেষ্টা করে গেছেন মাহমুদউল্লাহ। পরিস্থিতির বিবেচনায় খেলেছেন অসাধারণ। পাননি যোগ্য কোনো সঙ্গী। সাইফউদ্দিনের রান আউটে শেষ বাংলাদেশের শেষ আশাও।

বাংলাদেশের শেষ তিন উইকেট নিজের টানা তিন বলে তুলে নিয়েছেন শেহান মাধুশাঙ্কা। অভিষিক্ত পেসারের হ্যাটট্রিকে লঙ্কান উৎসবে লেগেছে বাড়তি রঙ।

ম্যাচের শুরুটা বাংলাদেশের হয়েছিল টস হারের হতাশায়। শুরুর বোলিংও ছিল না খুব আশা জাগানিয়া। তবে ইনিংসের পরের দিকে দারুণভাবে ফিরে আসে বাংলাদেশ। পুরোনো বলে দুর্দান্ত বোলিং করেছেন রুবেল হোসেন ও মুস্তাফিজুর রহমান। শ্রীলঙ্কাকে তাই খুব বড় পুঁজি পেতে দেয়নি বাংলাদেশ।

টস হেরে এদিন বোলিংয়ে নামতে হয় বাংলাদেশকে। নাসির হোসেনকে বাদ দিয়ে মেহেদী হাসান মিরাজকে খেলানোর সিদ্ধান্ত ফল দেয় শুরুতেই। আগের ম্যাচে এক জুটিতেই জিতে যাওয়া লঙ্কান উদ্বোধনী জুটি ভাঙেন মিরাজ। উড়িয়ে মারতে গিয়ে লং অফে ধরা পড়েন দানুশকা গুনাথিলাকা।

কুসল মেন্ডিস নেমেছিলেন যেন স্রেফ আক্রমণের মন্ত্র নিয়েই। প্রথম বলেই মাশরাফিকে বাউন্ডারিতে শুরু করেছিলেন। পরের ওভারে মিরাজকে উপহার দেন চার বলের দুঃস্বপ্ন। তিন ছক্কা আর এক চার!

অতি আক্রমণাত্মক হতে গিয়েই থামতে হয় তাকে। ৯ বলে ২৮ রান করে ক্যাচ দেন মাশরাফির বলে।

মেন্ডিসের ঝড়ো ব্যাটিংয়ে রান রেটের ভাবনা থেকে খানিকটা মুক্তি পায় শ্রীলঙ্কা। উপুল থারাঙ্গা ও নিরোশান ডিকভেলা তাই সময় নিয়ে থিতু হ্য়ার সুযোগ পান।

ডিকভেলা তবু রানের সুযোগ খুঁজেছেন। কিন্তু থারাঙ্গা ছিলেন প্রায় থমকে। তৃতীয় উইকেটে দুজনের জুটির পঞ্চাশ আসে ৭২ বলে।

বাংলাদেশের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ানো ৭১ রানের জুটি ভাঙেন একাদশে ফেরা মোহাম্মদ সাইফ উদ্দিন। হঠাৎ লাফিয়ে ওঠা বল ছোবল দেয় ডিকভেলার ব্যাটে। ৫৭ বলে ৪২ রান করে ফেরেন লঙ্কান কিপার-ব্যাটসম্যান।

থারাঙ্গার ব্যাটে এরপরও আসেনি খুব বেশি গতি। দুই দফায় বেঁচেও যান ক্যাচ দিয়ে। ৩৫ রানে সাইফের বলে ক্যাচ গ্লাভসে জমাতে পারেননি মুশফিক। ৪০ রানে সাকিবের বলে লাফিয়ে ক্যাচ নিতে পারেননি অতিরিক্ত ফিল্ডার নাসির।

রুবেলকে বাউন্ডরি মেরে থারাঙ্গা পঞ্চাশ স্পর্শ করেন ৮৭ বলে। তবে দুবার জীবন পাওয়া বা সময় নিয়ে ব্যাট করা, কোনোটিই কাজে লাগিয়ে খেলতে পারেননি বড় ইনিংস। ৯৯ বলে ৫৬ রান করা ব্যাটসম্যানের বেলস ওড়ান মুস্তাফিজ।

এই উইকেট নিয়েই বাংলাদেশের হয়ে দ্রুততম ৫০ উইকেটের রেকর্ড গড়েন মুস্তাফিজ।

এই উইকেটের আগে বড় স্কোরের পথেই ছিল শ্রীলঙ্কা। রান তখন ৩ উইকেটে ১৫৮। বাংলাদেশের ফেরার শুরু থারাঙ্গার উইকেট দিয়েই।

উইকেট একটু মন্থর হয়ে আসে। বাংলাদেশের বোলিংও হতে থাকে দুর্দান্ত। রান করা হয়ে পড়ে কঠিন।

বিপজ্জনক থিসারা পেরেরাকে বাউন্সারে ফেরান রুবেল। এই পেসার ফিরিয়ে দেন আসেলা গুনারত্নেকেও। পরে দুর্দান্ত এক ইয়র্কারে ফেরান শেষ বাধা হয়ে থাকা দিনেশ চান্দিমালকে। লঙ্কান অধিনায়ক করেছেন ৭৪ বলে ৪৫।

শেষ দিকে আকিলা দনঞ্জয়ার ১৬ বলে ১৭ রানের ইনিংস লঙ্কানদের নিয়ে যায় ২২১ রানে।

১০ ওভারে ২৯ রানে ২ উইকেট নিয়েছেন মুস্তাফিজ। তবে সেরা বোলার ছিলেন রুবেল। ৯ বছর আগের জানুয়ারি মাসে এরকমই এক ত্রিদেশীয় সিরিজের ফাইনালে রুবেল হয়ে উঠেছিলেন খলনায়ক। তাকে তুলোধুনো করে শ্রীলঙ্কাকে নাটকীয়ভাবে জিতিয়ে দিয়েছিলেন মুত্তিযা মুরালিধন। এবার ৪ উইকেট নিয়ে রুবেল তৈরি করেছিলেন প্রায়শ্চিত্তের প্রেক্ষাপট।

কিন্তু হলো না প্রায়শ্চিত্ত। না রুবেলের। না বাংলাদেশ দলের!

সংক্ষিপ্ত স্কোর:
 
শ্রীলঙ্কা: ৫০ ওভারে ২২১ (গুনাথিলাকা ৬, থারাঙ্গা ৫৬, মেন্ডিস ২৮, ডিকভেলা ৪২, চান্দিমাল ৪৫, থিসারা ২, গুনারত্নে ৬, দনঞ্জয়া ১৭, মদুশঙ্কা ৭, লাকমল ২, চামিরা ১*; মিরাজ ১/৫৩, মাশরাফি ১/৩৫, মুস্তাফিজ ২/২৯, মাহমুদউল্লাহ ০/১৮, সাইফ ১/১৫, সাকিব ০/২০, রুবেল ৪/৪৬)।

বাংলাদেশ: ৪১.১ ওভারে ১৪২ (তামিম ৩, মিঠুন ১০, সাব্বির ২, মুশফিক ২২, মাহমুদউল্লাহ ৭৬, মিরাজ ৫, সাইফ ৮, মাশরাফি ৫, রুবেল ০, মুস্তাফিজ ০*; লাকমল ০/২৯, চামিরা ২/১৭, থিসারা ০/৩১, মাধুশাঙ্কা ৩/২৬, দনঞ্জয়া ২/৩০, গুনাথিলকা ০/৪)।

ফল: শ্রীলঙ্কা ৭৯ রানে জয়ী

ম্যান অব দা ম্যাচ: উপুল থারাঙ্গা

ম্যান অব দা সিরিজ: থিসারা পেরেরা