গেইলের ব্যাটিং তাণ্ডবে চ্যাম্পিয়ন রংপুর

টর্নেডো বা হারিকেন। বিস্ফোরক কিংবা বিধ্বংসী। খুনে নয়তো দানবীয়। ক্রিস গেইলের ইনিংসের বর্ণনায় বেছে নেওয়া যায় যে কোনোটি। কিংবা সব কটিই! এক ম্যাচে আগেই এলিমিনেটরে করেছিলেন সেঞ্চুরি। ফাইনালে ছাড়িয়ে গেলেন নিজেকে। গেইলের তাণ্ডবে তছনছ ঢাকা ডায়নামাইটস। প্রথমবার বিপিএলের শিরোপা জিতল মাশরাফি বিন মুর্তজার রংপুর রাইডার্স।

ক্রীড়া প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 Dec 2017, 03:51 PM
Updated : 12 Dec 2017, 05:54 PM

তারকায় ঠাসা দুই দলের ফাইনাল ঘিরে ম্যাচের আগে ছিল উত্তেজনা। কিন্তু ম্যাচে রোমাঞ্চের সবটুকু শুধুই গেইলের ব্যাটে। একতরফা ফাইনালে মঙ্গলবার ঢাকা ডায়নামাইটসকে উড়িয়ে দিল রংপুর রাইডার্স। হারাল ৫৭ রানে।

মিরপুর শের-ই-বাংলা স্টেডিয়ামে গেইলের অপরাজিত সেঞ্চুরিতে রংপুর তোলে ২০ ওভারে ২০৬ রান। ঢাকা করতে পারে ১৪৯ রান।  

টানা দ্বিতীয় শিরোপা জেতা হলো না ঢাকা ডায়নামাইটসের। প্রথমবার বিপিএলের ফাইনালে উঠেই চ্যাম্পিয়ন রংপুর। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে সবার শেষে শেষ চার নিশ্চিত করা দলটিই তিনটি নক আউট ম্যাচে দুর্দান্ত খেলে জিতল প্রায় এক তরফাভাবে।

অধিনায়ক হিসেবে নিজেকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেলেন মাশরাফি। বিপিএলের পাঁচ আসরের চারবারই তিনি শিরোপা জয়ী অধিনায়ক!

এবারের ট্রফি জয়ে ব্যাটে-বলে-ফিল্ডিংয়ে সামনে থেকেই নেতৃত্ব দিয়েছেন মাশরাফি। তবে শেষের বাধা জয়ে রংপুর অধিনায়ক কৃতজ্ঞতার ঝাঁপি মেলে দেবেন নিশ্চয়ই গেইলের দিকে। এলিমিনেটরে ৫১ বলে অপরাজিত ১২৬ রানের ইনিংসে জিতিয়েছিলেন দলকে। আর ফাইনালে রেকর্ডের মালা গেঁথে ৬৯ বলে অপরাজিত ১৪৬!

টুর্নামেন্টের হট ফেবারিট ঢাকাকে বলতে গেলে একাই শেষ করে দিয়েছেন গেইল। একইরকম ঝড় তোলার সামর্থ্য আছে যার, সেই ব্রেন্ডন ম্যাককালামও ছিলেন স্রেফ সহযোগীর ভূমিকায়। দুজনে গড়লেন বিপিএলের রেকর্ড জুটি।

গেইল এরকম খেললে অসহায় হয়ে পড়ে বিশ্বের যে কোনো বোলিং আক্রমণই। তবে সাকিব আল হাসান খানিকটা দায় দিতে পারেন নিজেকেই। গেইলের ২২ রানে মোসাদ্দেকের বলে ঢাকা অধিনায়ক ছেড়েছেন সহজ ক্যাচ। সেটির খেসারত তাদের দিতে হয়েছে বড্ড করুণভাবে!

এমন বড় ম্যাচে টস জিতে বোলিং নেওয়ার সিদ্ধান্তটিকেই করা যায় প্রশ্নবিদ্ধ। ফাইনালের মতো ম্যাচে রান তাড়া সবসময়ই বড় চাপ।

ইনিংসের অর্ধেক জুড়ে গেইল ছিলেন আশ্চর্য রকম নীরব ও ধীরস্থির। খেলছিলেন দেখেশুনে। সুনিল নারাইন, শহিদ আফ্রিদি ও সাকিব আল হাসানকে নিয়ে গড়া স্পিন জুটিকে খেলেছেন দারুণ বুদ্ধিমত্তায়। নারাইনের বলে যেমন কোনো ঝুঁকিই নেননি। খুব একটা মারতে যাননি আফ্রিদিকেও।

আগের ম্যাচের সেঞ্চুরিয়ান জনসন চার্লসকে শুরুতেই ফিরিয়ে দেন সাকিব। ঢাকা অধিনায়ক সেই ওভারে নিয়েছেন মেডেন উইকেট।

গেইল শুরুতে ছিলেন সাবধানী, খুব একটা ছন্দ পাচ্ছিলেন না ম্যাককালামও। প্রথম ১০ ওভারে একটিই ছিল বড় ওভার। ষষ্ঠ ওভারে মোসাদ্দেকের বলে গেইলের দুই ছক্কা ও ম্যাককালামের এক ছক্কায় রান আসে ১৯। এর পরও ১০ ওভারে রংপুরের রান ছিল ১ উইকেটে ৬৩।

ঝড়ের আগে প্রকৃতি যেমন শান্ত হয়ে পড়ে, সেই রংপুরের ইনিংসের শান্ত অবস্থা ছিল আসলে সেটিরই প্রতিচ্ছবি। পরের ১০ ওভারে বল যতটা ছিল মাঠের ভেতর, তার চেয়ে বেশি ছিল সম্ভবত গ্যালারিতে!

গেইলের রান ছিল এক পর্যায়ে ৩০ বলে ৩৫। সেখান থেকে টানা দুটি ছক্কা ও একটি চারে ৩৩ বলেই ফিফটি। এরপর ক্রমেই হতে ওঠেন অপ্রতিরোধ্য। জোড়ায় জোড়ায় ছক্কা মেরেছেন প্রায় প্রতি ওভারেই।

সেঞ্চুরি করেছেন ৫৭ বলে। শেষ পর্যন্ত ৬৯ বলে অপরাজিত ১৪৬। এক ম্যাচ আগেই নিজের করা ১২৬ রানকে পেছনে ফেলে গড়লেন বিপিএলে সর্বোচ্চ ইনিংসের রেকর্ড।

৫টি চারের পাশে ইনিংসে ছক্কা মেরেছেন ১৮টি। এক ইনিংসে সবচেয়ে বেশি ছক্কার যেটি বিশ্ব রেকর্ড। এখানেও ছাড়িয়েছেন নিজের ১৭টি ছক্কার রেকর্ড।

প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে স্পর্শ করেছেন ১১ হাজার টি-টোয়েন্টি রান। প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে করেছেন বিপিএলে ছক্কার সেঞ্চুরি।

ইনিংস জুড়ে নিজের সেরা চেহারায় ছিলেন না ম্যাককালাম। তবে হাল না ছেড়ে টিকেছেন শেষ পর্যন্ত। শেষ দিকে খেলেছেন দারুণ কিছু শট। চারটি চার ও তিন ছক্কায় ৪৩ বলে অপরাজিত ৫১।

দুজনের ২০১ রানের জুটি বিপিএলের পাঁচ আসর মিলিয়ে প্রথম দুইশ রানের জুটি। প্রথম ১০ ওভারে ৬৩ রান তোলার রংপুর শেষ ১০ ওভারে তুলেছে ১৪৩ রান। শেষ ৩ ওভারেই ৬৪!

নারাইনের ৪ ওভারে এসেছে মাত্র ১৮ রান। আফ্রিদির ৪ ওভারে ২৮। বাকি বোলাররা হয়েছেন তুলোধুনো। প্রথম ২ ওভারে ৭ রান দেওয়া সাকিব শেষ ওভারে তিন ছক্কায় হজম করেছেন ১৯ রান।

এই রান তাড়া কঠিন চ্যালেঞ্জ হলেও ঢাকার ব্যাটিং শক্তি বিবেচনায় অসম্ভব ছিল না। প্রয়োজন ছিল ভালো শুরু। হলো উল্টো।

বিস্ফোরক ব্যাটিংয়ে উজ্জীবিত রংপুর বল হাতেও শুরুটা করে দুর্দান্ত। প্রথম দুই ওভারই উইকেট মেডেন!

প্রথম ওভারে মাশরাফি ফেরান মেহেদি মারুফকে। দ্বিতীয় ওভারে জো ডেনলিকে ফেরান সোহাগ। রানের খাতা খুলতে পারেননি কেউ।

এরপরও রংপুরকে বেগ দিতে পারতেন এভিন লুইস। সোহাগের বলে দুর্দান্ত ক্যাচে লুইসকে ফিরিয়ে মাশরাফি দূর করে দেন সেই বাধাও।

২৯ রানে ৪ উইকেট হারিয়ে ঢাকা ছিটকে যায় লড়াই থেকে। জহুরুল ইসলামের ৩৮ বলে ৫০ রানের ইনিংসে ম্যাচের দৈর্ঘ্য একটু বেড়েছে, কমেছে হারের ব্যবধান।

শুরুর মতো শেষটাও গেইলের হাতে। ইনিংসের শেষ ওভারে তার হাতে বল তুলে দিলেন মাশরাফি। ম্যাচের শেষ বলটি হতেই তুলে নিলেন স্মারক হিসেবে তুলে নিলেন স্টাম্পস। রংপুর মাতল শিরোপার উৎসবে।

উৎসবের মধ্যমনি দুজন। টুর্নামেন্ট জুড়ে অনুপ্রেরণার প্রতিশব্দ মাশরাফি, আর শেষের নায়ক গেইল!

সংক্ষিপ্ত স্কোর:

রংপুর রাইডার্স: ২০ ওভারে ২০৬/১(চার্লস ৩, গেইল ১৪৬*, ম্যাককালাম ৫১*; মোসাদ্দেক ০/৩২, সাকিব ১/২৬, নারাইন ০/১৮, আফ্রিদি ০/২৮, আবু হায়দার ০/২৬, খালেদ ০/৩৯, পোলার্ড ০/৩৩)।

ঢাকা ডায়নামাইটস: ২০ ওভারে ১৪৯/৯ (মারুফ ০, লুইস ১৫, ডেনলি ০, সাকিব ২৬, পোলার্ড ৫, জহুরুল ৫০, মোসাদ্দেক ১, আফ্রিদি ৮, নারাইন ১৪, আবু হায়দার , খালেদ ; মাশরাফি ১/২৫, সোহাগ ২/৩২, রুবেল ১/২৮, বোপারা ১/২১, উদানা ২/২৫, অপু ১/২৫, গেইল ০/২)।

ফল: রংপুর রাইডার্স ৫৭ রানে জয়ী

ম্যান অব দা ম্যাচ: ক্রিস গেইল