যেমন বিপিএল চান মাশরাফি-সাকিব-মুশফিকরা

প্রথম দুই বছরে বিপিএল মানেই ছিল বিতর্ক। অগোছালো আয়োজন, ফিক্সিং কেলেঙ্কারি, ক্রিকেটারদের পারিশ্রমিক না দেওয়া ইত্যাদি মিলিয়ে ছিল অভিযোগ, প্রশ্ন, সংশয়ের পাহাড়।

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 Nov 2017, 02:04 PM
Updated : 3 Nov 2017, 02:08 PM

বিতর্ক দূর করতেই পরে এক মৌসুমের বিরতি দেওয়া হয় বিপিএলে। এরপর গত দুই মৌসুমে অনেকটা কমে এসেছে বিতর্ক। আগের চেয়ে খানিকটা গোছানোও হয়েছে আয়োজন। তারপরও উন্নতির জায়গা ও সুযোগ আছে অনেক। দেশের ৫ সিনিয়র ক্রিকেটার কথা বললেন সেসব নিয়েই। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে শোনালেন, বিপিএলকে তারা যেমন দেখতে চান।

মাশরাফি বিন মুর্তজা

প্রথমত, এবারের বিপিএল খুব ভালো সময়ে শুরু হচ্ছে। দক্ষিণ আফ্রিকা সফরের হতাশায় খুব বেশি সময় ডুবে থাকতে হবে না। আশা করি, বিপিএল দিয়ে খারাপ সময়টা বদলানোর শুরু হবে। দক্ষিণ আফ্রিকায় যেহেতু টি-টোয়েন্টিই শেষে হয়েছে, সেখানকার ভুলগুলি দ্রুত শোধরানোর সুযোগ হবে বিপিএলে।

আমার মনে হয়, এ বছর বিপিএল আরও ভালো হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। ভালো মানে, ক্রিকেটারদের দিক থেকে ভালো। বিদেশি বড় বড় ক্রিকেটার যারা আছে, তাদের কাছ থেকে আমাদের ছেলেরা যদি শিখতে পারে, তাহলে দারুণ হয়।

শেখার অনেক কিছু আছে। তবে টি-টোয়েন্টিতে আমি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে করি, পরিস্থিতি বুঝে খেলা। যেটায় আমাদের ঘাটতি আছে। ছেলেরা বড় বড় ক্রিকেটারদের দেখে শিখতে পারে।

যেমন কুমার সাঙ্গাকারা আছেন। আমার তো মনে হয় শুধু ঢাকা দল নয়, সব দলেরই ক্রিকেটারদের উচিত, যতটা সুযোগ হয়, ওর সঙ্গে যেন কথা বলে, সময় কাটায়। বিভিন্ন সংস্করণে কিভাবে মানিয়ে নেয়, এত এত রান করার রহস্য, এগুলো নিয়ে সময় নিয়ে কথা বলতে পারে। ওকে দেখেও শিখতে পারে। ক্রিকেটটাকে কিভাবে নেয়, কিভাবে অনুশীলন করে, নিজেকে মেইনটেইন করে, তার দর্শন, ভাবনা, এসব।

মাঠের বাইরের বিতর্ক অনেকটাই কমে এসেছে। গত বছর অনেকটাই কম হয়েছে। তবে উন্নতির জায়গা আরও আছে অবশ্যই। তবে একদিনে সম্ভব না। আগের চেয়ে অনেকটা গুছিয়ে তোলা সম্ভব হয়েছে। এবার আরও ভালো হবে আশা করি।

মুশফিকুর রহিম

আমাদের দেশের নানা বাস্তবতায় বিপিএল পুরো সুষ্ঠুভাবে আয়োজন করা কঠিন। তার পরও বেশ ভালোভাবে হচ্ছে। যেমন দেখুন, গতবার দুটি মাঠে খেলেছি। এবার তিনটি মাঠে খেলা হচ্ছে।

এবার সিলেট হোম ভেন্যুতে খেলতে পারছে। অন্যরকম একটা ভালো লাগা ও রোমাঞ্চ কাজ করে। ভবিষ্যতে আমিও চাইব রাজশাহীর মাঠে খেলতে। সবাই যদি যার যার ঘরের মাঠে খেলতে পারে, তাহলে দর্শকদের জন্য, টুর্নামেন্টের জন্য দারুণ হয়। এখন কঠিন মনে হলেও একদিন নিশ্চয়ই হবে।

এবার মাঠের পাশে ইলেকট্রনিক বিজ্ঞাপনী বোর্ড আছে। আরও কিছু নতুন সংযোজন আছে। দিনে দিনে আশা করি আরও উন্নতি হবে।

সবচেয়ে জরুরি যেটা দরকার, আমরা স্থানীয় ক্রিকেটাররা যদি ভালো খেলতে পারি, ভালো কিছু শিখতে পারি, তাহলে দেশের ক্রিকেটের জন্য খুব ভালো হবে। অনেক বড় বড় ক্রিকেটার আসে বিপিএলে। তদের সঙ্গে খেলে তরুণ ক্রিকেটারদের মতো আমরা সিনিয়ররাও অনেক শিখতে পারি। ভালো খেললে আত্মবিশ্বাস বাড়ে।

আরেকটা ব্যাপার আমি বলতে চাই। পারিশ্রমিকের ব্যাপারটিতে আরেকটু পেশাদারিত্ব প্রয়োজন। আমরা ক্রিকেটাররা শুধু ক্রিকেট নিয়েই ভাবব। আমাদের যদি টাকা-পয়সা নিয়ে দুর্ভাবনায় থাকতে হয়, তাহলে কাজটা কঠিন। আগের চেয়ে অনেক ভালো হয়েছে অবশ্যই। তবে আরও পেশাদারিত্ব এলে ভালো হয়। শুধু বিপিএল নয়, ঘরোয়া সব টুর্নামেন্ট নিয়েই এটি আমার চাওয়া।

সাকিব আল হাসান

প্রতিবারই কিন্তু বিপিএলে আগের বারের চেয়ে উন্নতি হচ্ছে। অনেক জায়গায় উন্নতি হচ্ছে। আরও উন্নতির সুযোগ আছে।

এবার যেমন তিনটি ভেন্যু হলো। পরেরবার আমি আশা করব, পাঁচটি ভেন্যু হবে। ভেন্যু বেশি হলে যেটা হয়, টুর্নামেন্টে আলাদা মজা, রোমাঞ্চ থাকে। প্রতিদ্বন্দ্বিতা বেশি হয়। দর্শকের আগ্রহ বেশি থাকে। মাঠ আর উইকেটগুলোও ভালো থাকে। আজকে এই দেখুন, এতগুলো দল একসঙ্গে অনুশীলন করছে। কেউই ঠিকমত করতে পারছে না। এই সুযোগ-সুবিধাগুলো তখন আরও ভালো হবে।

আরেকটি ব্যাপার হলো, একই দিন একই মাঠে পরপর দুটি ম্যাচ না হয়ে দুটি ভিন্ন শহরে হলে ভালো হয়। একটি মাঠে টানা কয়েকদিন দুটি করে ম্যাচ মাঠের ফ্যাসিলিটিজের জন্য ভালো হয় না। ভেন্যু তিন-চারটা থেকেও যদি দিনের দুটি ম্যাচ দুই জায়গায় হয়, তাহলে ভালো হয়। জানি এটির জন্য অনেক কিছু লাগবে। ব্যয় বেড়ে যাবে। তবে করতে পারলে টুর্নামেন্টের জন্য ভালো হবে।

বেশি মাঠে খেলা হলে সবচেয়ে ভালো সমর্থকদের জন্য। এ বছর সিলেটে টিকিট নিয়ে তুমুল উন্মাদনা ছিল। আরও অনেক শহরেই এরকম হতে পারে যদি সুযোগ সুবিধা বাড়িয়ে খেলা আয়েজন করা যায়। এমনকি ফতুল্লায়ও কিছু ম্যাচ আয়োজন করা যায়। টুর্নামেন্টের জন্য এসব ভালো হবে।

তামিম ইকবাল

আমার চাওয়া নিয়ে অনেকের ভ্রূ কুঁচকে যেতে পারে। তবে যেটা মনে করি, সৎভাবেই সেটি বলছি। বিপিএলে ৬টির বেশি ফ্র্যাঞ্চাইজি থাকা উচিত নয়। আইপিএলে ১৩০ কোটি মানুষের দেশে ৮টি দল। আমাদের ১৭ কোটি মানুষের দেশেই ৮টি দল ছিল। ফ্র্যাঞ্চাইজি বাতিল হওয়ায় এখন ৭টি হয়েছে।

কেন আমি এমনটি চাই, সেটি ব্যাখ্যা করি। দল কমালে হয়ত দেশের কিছু ক্রিকেটারের জন্য দল পাওয়া কঠিন হবে। কিন্তু টুর্নামেন্টের প্রতিদ্বন্দ্বিতা অনেক বাড়বে। সবচেয়ে বড় কথা, জায়গার জন্য প্রতিযোগিতা বাড়বে। অন্যান্য ঘরোয়া টুর্নামেন্টগুলোকেও ভালো পারফরম্যান্সে তাগিদ বাড়বে ক্রিকেটারদের। জাতীয় দল তো অবশ্যই সবচেয়ে বড় লক্ষ্য। তার পর বিপিএলে দলে জায়গা করে নেওয়াও একটা লক্ষ্য হয়ে দাঁড়াবে।

একাদশে বিদেশি ক্রিকেটার কমিয়ে তাই দলও কমানো উচিত। এবার দেখুন, বেশিরভাগ দলেই প্রথম চার ব্যাটসম্যানের তিনজনই হয়তো বিদেশি হবে। আবার শুরুতে ও শেষে বোলিংয়ের জন্যও দলগুলি বিদেশিদের ওপরই বেশি নির্ভর করবে। আমার দলে আমি হয়ত হাসান আলিকে আনব বোলিংয়ে। রিয়াদ ভাই কাইল অ্যাবটকে আনবে। মাশরাফি ভাই লাসিথ মালিঙ্গাকে আনবে। এভাবেই চলবে। গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোয় এবং কঠিন পরিস্থিতিতে আমাদের ক্রিকেটারদের শেখার সুযোগ কম থাকবে।

আয়োজনগত দিক থেকে আগের চেয়ে অনেক উন্নতি হয়েছে। উন্নতির তো শেষ নেই। আরও উন্নতির সুযোগ আছে। তবে দিন দিন ভালো হচ্ছে। এখন এই বিষয়গুলোয় নজর দেওয়া প্রয়োজন। বিপিএল এমনিতে দারুণ টুর্নামেন্ট। দল কমিয়ে একটু আঁটসাঁট করলে প্রতিদ্বন্দ্বিতা, আগ্রহ, আকর্ষণ বাড়বে।

মাহমুদউল্লাহ

আমি চাইব, স্থানীয় ক্রিকেটাররা দারুণ পারফর্ম করুক। অন্তত আমার দলের স্থানীয় ক্রিকেটাররা। বিদেশিরাও আছে। তাদের পারফরম্যান্সও দরকার আছে। কিন্তু আমি চাই দেশি ক্রিকেটাররা টুর্নামেন্টের সেরা পারফরমার হোক, জয়ের নায়ক হোক। দেশি ক্রিকেটারদের শক্তিতে জিততে চাই আমরা।

এই ধরনের টুর্নামেন্টের অনেক ভালো দিক আছে। আশা করি, সেই ইতিবাচক দিকগুলি আমরা কাজে লাগাতে পারব। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে আমাদের অনেক শেখার আছে। বিপিএল সেসব শেখার আদর্শ মাধ্যম। এরকম একটি টুর্নামেন্ট আমরা নিয়মিত আয়োজন করছি, বড় বড় কোচ, ক্রিকেটাররা আসছেন। আমি চাই তাদের কাছ থেকে যতটা সম্ভব শেখার ও নেওয়ার, আমরা যেন তা নিতে পারি।