এই সময় আসবে, জানতেন মাশরাফি

ভীষণ দুঃসময়ে তিনি এসেছিলেন ত্রাতা হয়ে। কতভাবে যে হারা যায় ২০১৪ সালে তার একেকটি উদাহরণ সৃষ্টি করে চলছিল বাংলাদেশ। সেই দুঃসময় কাটিয়ে মাশরাফি বিন মুর্তজার নেতৃত্বে দল পরিণত হয়েছে সমীহ করার মতো এক শক্তিতে। আবার যখন সময় খারাপ বাংলাদেশের, মাইলফলকে পৌঁছানো অনুপ্রেরণাদায়ী অধিনায়ক সামনে দেখছেন নতুন চ্যালেঞ্জ।

অনীক মিশকাতঅনীক মিশকাতইস্ট লন্ডন থেকে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 Oct 2017, 08:54 AM
Updated : 24 Oct 2017, 08:54 AM

দক্ষিণ আফ্রিকায় মাশরাফি দেশকে নেতৃত্ব দিলেন ৫০তম ওয়ানডেতে। ২০০৯ সালে প্রথম নেতৃত্ব পাওয়ার পর চোটের কারণে তা স্থায়ী হয় কেবল এক টেস্ট। পরের বছর আবার অধিনায়কত্ব পান, এবারও হার মানতে হয় চোটের কারণে। ২০১৪ সালে আবার নেতৃত্বে আসার পর বাংলাদেশের ক্রিকেট এগিয়ে যাচ্ছে নতুন উচ্চতায়। ইস্ট লন্ডনে দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে তৃতীয় ওয়ানডে হারের পর মাশরাফির কথায় উঠে আসে নেতৃত্ব আর দল নিয়ে ভাবনার কথা।

ক্রিকেট ক্যারিয়ার অনেক লম্বা। ওয়ানডের কথা যদি বলি, নেতৃত্ব দেওয়ার পঞ্চাশ পূর্ণ হল। এই যাত্রাটা কেমন?

মাশরাফি: অনেক উত্থান-পতন আছে। শুরু থেকে অধিনায়কত্ব করে গেলে হয়তো আরও অনেক বেশি ম্যাচ হত। উত্থান-পতন ছিল, চোটের বাধা ছিল। কয়েক দফায় নেতৃত্ব পেয়েছি। এই দফায় হয়তো অনেক দিন করতে পেরেছি। উত্থান-পতনের চেয়ে আমি মনে করি সন্তুষ্টিই বেশি।

অধিনায়ক হিসেবে একটা স্বপ্ন থাকে। ৫০ ম্যাচ পার করার পর কি মনে হয় সেই স্বপ্ন পূরণ হয়েছে? নাকি আরও ভালো অবস্থানে যাওয়া সম্ভব ছিল?

মাশরাফি:
তিনবার যে নেতৃত্ব পেয়েছি, তার মধ্যে একবার ছিল প্রত্যাশিত। (২০০৯ সালে) আমার মনে হয়েছে, ঠিক আছে আমি পেয়েছি। দ্বিতীয়বার সাকিব আল হাসান সরে যাওয়ার পর আমি পেলাম। তৃতীয়বারও অপ্রত্যাশিত ছিল। ওয়েস্ট ইন্ডিজ থেকে ফেরার পরেই হুট করেই আমাকে দেওয়া হল। তখন আমার মাথার ভেতরে এসব ছিল না।

এখনের স্বপ্নের কথা যদি বলেন, এখানে যে ব্যর্থ হয়েছি সেটা কাটিয়ে উঠাই আমার একমাত্র স্বপ্ন। বছরের শুরু আর শেষটা খারাপ হলেও মাঝামাঝি সময়ে ভালো হয়েছে।

দেশের বাইরের সিরিজ আর টু্র্নামেন্টে ভালো খেলেছি। ক্রিকেট এখন এমন হয়ে গেছে, সবাই দেশের মাটিতে জেতে, বাইরে গিয়ে হারে। আমাদের যে পরিবর্তন হয়েছে সেটা হচ্ছে, আগে আমরা দেশের মাটিতেও জিততে পারতাম না এখন জিততে পারি। এদিক থেকে সন্তুষ্টি আছে এখন। আমাদের স্বপ্ন ছিল দেশের মাটিতে ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ ম্যাচ জেতা, সেটা মোটামুটি অর্জন করতে পেরেছি।

এখন অধিনায়ক হিসেবে চ্যালেঞ্জ, দেশের বাইরে কত ম্যাচ জিততে পারি। সেদিক থেকে এখনও পর্যন্ত বলার মতো কিছু হয়নি। সাম্প্রতিক সময়ের কথা বললে তো কিছুই হয়নি। এখানে টানা তিনটি ম্যাচ হেরেছি। কিন্তু এটাই শেষ না, এখনও সুযোগ আছে। সামনে দেশের বাইরে আরও চার-পাঁচটা সিরিজ আছে। এখানে উন্নতি করা আমার লক্ষ্য বলতে পারেন।

২০১৪ সালটা বাংলাদেশের খুব খারাপ কেটেছে। টেস্ট ও ওয়ানডেতে আলাদা অধিনায়ক সেবারই প্রথম পায় বাংলাদেশ। দল খারাপ করছে, বিশ্বকাপ মাত্র ছয় মাস পর। পেছনে চোটের ইতিহাস আছে আপনার। সে সময়ে দায়িত্ব নেওয়া নিশ্চয়ই খুব চ্যালেঞ্জিং ছিল আপনার জন্য।

মাশরাফি: অবশ্যই চ্যালেঞ্জিং ছিল। এই দফা নেতৃত্বের প্রথম ম্যাচে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ৩১ রানে ৩ উইকেট পড়ে যায়। সাকিব গিয়ে সেঞ্চুরি করে। (সাব্বির রহমান) রুম্মানের অভিষেক হয়, ও শেষের দিকে অপরাজিত ৪৪ রান করে। আমার মনে হয়, চ্যালেঞ্জ প্রথম ম্যাচেই আমি অনুভব করে ফেলি।

দ্বিতীয়ত, ওই সময়ে যে চ্যালেঞ্জের আমি মুখোমুখি হতে চেয়েছি, এখনও সেই চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করতে চাই। এখানে এসে আমরা টেস্ট হেরেছি, সেটা ঠিক আছে। কিন্তু ওয়ানডেতে অবশ্যই জেতার সামর্থ্য আছে। সেবার জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে পাঁচটা ম্যাচই জিততে পেরেছিলাম। এখানে সেই একই চ্যালেঞ্জ নিয়ে এসেছি কিন্তু একটাও জিততে পারিনি। চ্যালেঞ্জ কিন্তু আমার ভেতরে সেখানেও ছিল, এখানেও ছিল।

খারাপ সময়ে দায়িত্ব নিয়ে বিশ্বকাপে সেমি-ফাইনালে খেলা। পাকিস্তান, ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকাকে পরপর সিরিজে হারানো…

মাশরাফি: এটা অনেক বেশি ভালো লাগা ছিল। কিন্তু সংবাদ সম্মেলনে আমি আপনাদের সব সময় একটা কথা বলতাম, এই (বাজে) সময়টা কখন আসবে। আজকে আপনাকে যে আমি সাক্ষাৎকার দিচ্ছি, এই সময়ের জন্য আমি অপেক্ষা করছিলাম। এটা অবধারিতই ছিল। এটা পৃথিবীর সব বড় দলের ক্ষেত্রেই দেখেছি। কিন্তু আমি এই জিনিসই দেখতে চাই, এখান থেকে আমরা কিভাবে ঘুরে দাঁড়াতে পারি। ওইটা যেমন আমার জন্য অত্যন্ত ভালো লাগা ছিল, এটা অত্যন্ত খারাপ লাগা। দুইটা দুই রকম। এখন দেখতে হবে এখান থেকে কিভাবে উতরে যাই। এখান থেকে অবশ্যই আমরা উতরে যেতে পারব। আমি নিশ্চিত যে খুব তাড়াতাড়ি পারব।

শুরুটা এত ভালো হওয়ার পর তো প্রত্যাশা অনেক বেশি ছিল…

মাশরাফি: এটা তো অস্বীকার করার সুযোগ নেই। এটা তো নিজের কাছে নিজের তৈরি হয়। এই দলকে যখন আপনি জিততে দেখবেন তখন হারটা আপনি নিজেই মেনে নিতে পারবেন না। সেটা আপনি যে কন্ডিশনেই আর যেখানে খেলেন। আমি জানি অনেকের মনে ভেতরে ভাবনা ছিল, এখানে এসে আমরা পারব না। কিন্তু ভালো খেলার প্রত্যাশা ছিল। আমি যেটায় মনোযোগ দিয়েছিলাম, এখানে একটা ম্যাচ হলেও জিততে হবে, যেটা আমি পারিনি। এখানে থেমে থাকলে তো হবে না। চেষ্টা করতে হবে, এখান থেকে কিভাবে ঘুরে দাঁড়ানো যায়। আমি নিশ্চিত এই বাজে সময় বেশি সময়ের জন্য না।

সাফল্যের জন্য সহজাত নেতৃত্ব সঙ্গে উদ্ভাবনী কিছু তো লাগে…

মাশরাফি: আপনার নিজস্বতা থাকতে হবে। আপনি যেমন তেমনই থাকবেন। আমি নেতৃত্ব পাওয়ার পর ভেবেছিলাম, আমি নিজের মতো করেই যতটুকু করতে পারি করবো। নেতৃত্ব পেয়েই সামনে ছিল জিম্বাবুয়ে সিরিজ। আমি বুঝলাম যে, আমরা পারব। এর পরপর কি? বিশ্বকাপ, পাকিস্তান, ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সিরিজ। আমি ওই সময়ে যদি তাকিয়ে দেখতাম ততদূর, আমি নিশ্চিত ততদিন বাংলাদেশ ক্রিকেটে অধিনায়কত্ব করা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। ওই সব ম্যাচ যদি আমি হেরে যেতাম তাহল সরে যেতাম। আমাকে সরিয়ে দেওয়াই হতো হয়তো তখন। একটা সিরিজ যখন এসেছে আমার চিন্তা ছিল, প্রথম ম্যাচ, দ্বিতীয় ম্যাচ, তৃতীয় ম্যাচ।

দলকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন সামনে থেকে। এবার নেতৃত্ব পাওয়ার পর ৫৮ উইকেট নিয়ে বাংলাদেশের সেরা উইকেট শিকারী আপনি। ৫৫ উইকেট নিয়ে পরের স্থানে আছে সাকিব। কিন্তু অধিনায়ক মাশরাফির ছায়ায় ঢাকা পড়ে যাচ্ছে বোলার মাশরাফি। এটা কিভাবে দেখেন?

মাশরাফি: আমি সেভাবে ভাবিনি। সত্যি কথা হল, এটা আমার মাথাতেই আসেনি। এটা এক দিকে থেকে আমার জন্য ভালোই হয়েছে। কি কারণে আমি পুরোপুরি বলতে পারব না। আলোচনা না হওয়াটা বড় কোনো ব্যাপার মনে হয়নি আমার কাছে। কিন্তু এটাই ঠিক যে, আমাকে তো মানুষ জনও কম কিছুও দেয়নি। ভালোবাসার জায়গা তো আছেই, সেটাও তো অস্বীকার করার সুযোগ আমার নাই। আমি বোলিং কি করেছি… আমি যদি শেষ তিন বছরে বোলিংয়ে কি করেছি, বাংলাদেশের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারী কি না সেটা মাথার ভেতরে আসেইনি কখনও।

আমি সব সময় একটা দিকে মনোযোগী ছিলাম, অন্তত ২০ জন খেলোয়াড় আছে ওদেরকে আমি সব সময় স্বচ্ছন্দের জায়গাটা দিতে চেয়েছি। তার পারফর্ম করার জন্য যতটা স্বচ্ছন্দের জায়গা দেওয়া যায় আমি সেই চেষ্টা করেছি। আমার জায়গা থেকে আমাকে কিছু ত্যাগ স্বীকার করেও যদি স্বচ্ছন্দের জায়গা দেওয়া যায় আমি সেই চেষ্টা করেছি।

যেমন, মুস্তাফিজের কাছে নতুন বল ছেড়ে দেওয়া?

আমার জন্য সবচেয়ে কঠিন সময় ছিল ২০১৫ সাল। যখন মুস্তাফিজ এল, আমি ওকে নতুন বল তুলে দিলাম। সেটা ছিল আমার নিজের ক্যারিয়ার শেষ করে দেওয়ার একটা বড় পদক্ষেপ। ওর যে সামর্থ্য আছে, আমার মনে হয়েছে ও নতুন বলে উইকেট পাবেই। তার ফল পেয়েছিও, পাইনি তা না। ও রোহিত শর্মাকে কয়েকবার আউট করেছে। বেশ কয়েকটা ‘ব্রেক থ্রু’ খুব তাড়াতাড়ি দিয়েছে। আমার মনে হয়েছে, এটা আমার একটা অর্জন। পরে আমার মনে হয়েছে, আমি অনেক সৎ ছিলাম সে সময়ে। আমি আমার দলের সেরা বোলারকে নতুন বল দিয়েছি। সেই কারণে, যেটা আমার শক্তির জায়গা না সেই পুরানো বলেও উইকেট পেয়েছি। আমার ওই জিনিসটা ভাবলে নিজের কাছে অনেক ভালো লাগে। আমার ওই সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছিলাম, মুস্তাফিজকে এনেই নতুন বল দিয়েছিলাম।

আপনার নেতৃত্বে খেলা ৫০ ম্যাচের ২৭টিতে জিতেছে দল। হার ২১টিতে। অনেক ভালো স্মৃতি, কিছু বাজে সময় কেটেছে নিশ্চয়ই।

মাশরাফি: অধিনায়ক হিসেবে সবচেয়ে কঠিন সময় বলতে পারেন এই সময়টাকে (দক্ষিণ আফ্রিকা সফর)। দল যেহেতু হারের ভেতরেই আছে, তিনটা ম্যাচ পরপর হেরেছে। এর আগে নিউ জিল্যান্ডে হারিনি তা না। নিউ জিল্যান্ডে অন্তত আমরা সম্ভাবনা অনুযায়ী খেলে হেরেছিলাম। কিন্তু এখানে যেটা হয়েছে আমরা সম্ভাবনা অনুযায়ী খেলতে পারিনি। অবশ্যই এই সময়টা বেশি কঠিন। এটা আবার রোমাঞ্চকরও। কারণ, এখান থেকে বের হয়ে আসতে পারলে যে শান্তিটা লাগবে, যে ভালোটা লাগবে ওই ভালো সময় চলতে থাকলে কখনও বুঝতে পারতাম না। এই জন্য সব সময় বলতাম, খারাপ সময় কখন আসবে আর সেখান থেকে কিভাবে বের হব। হঠাৎ করেই সেটা এসে পড়েছে এখন আমি নিশ্চিত সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এটাও ঠিক হয়ে যাবে।

আর ভালো স্মৃতি অসংখ্য আছে। আপনি যদি পাকিস্তানও বাদ দেন, ভারতকে আমাদের দেশে হারানো। দক্ষিণ আফ্রিকাকে আমাদের দেশে হারানো। বিশ্বকাপের কোয়ার্টার-ফাইনালে খেলা, তারপরে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সেমি-ফাইনালে খেলা।

আমার জন্য আরেকটা হতাশার সময় ছিল ইংল্যান্ডের কাছে সিরিজ হারা। আফগানিস্তানের কাছে প্রথম ওয়ানডেতে হারা। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ভারতের কাছে ১ রানে হারা। যেগুলো আমি চিন্তা করতে পারিনি যে হবে। ইংল্যান্ডের কাছে প্রথম ওয়ানডেতে তো আমরা জেতা ম্যাচ হারলাম।

সে সব কঠিন সময়ের চেয়ে আমার মনে হয়েছে, সব মিলিয়ে চারপাশে একটা আচমকা চাপ তৈরি হয়েছে এখন। আমি জানি না কেন, তবে এটা আমাকে আরও উদ্বুদ্ধ করছে। আমি এই সময়টা আরও উপভোগ করছি এই কারণে, এটাই সময়। আমি কী আর আমার দল কী দেখার এটাই সময়।

মাঠে হঠাৎ বোলিং বা ফিল্ডিং পরিবর্তন করে সাফল্য পেয়েছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে স্মরণীয় কোনটা?

মাশরাফি: অনেকগুলো আছে। ২০১৫ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে চট্টগ্রামের তৃতীয় ওয়ানডে, যেটা জিতলাম। ওই দিন দুইটা সিদ্ধান্ত ছিল। আমি প্রথম ২ ওভারে ৮ রান দিই। এরপরও বোলিংয়ে পরিবর্তন করি। আমার কেন যেন মনে হচ্ছিল, একটু স্পিন হতে পারে। তখন আমি সাথে সাথে সাকিবকে আনি, সাকিব দ্বিতীয় ওভারেই উইকেট নেয়।

ওই ম্যাচেই স্পিন দিয়ে আমার যে সময়টা পার দেওয়া দরকার ছিল সেই সময়টা আমি পার করে দিয়েছি। (মাহমুদউল্লাহ) রিয়াদ তো এখনও অনিয়মিত বোলার। আমার গাট ফিলিংস বলছিল কাজ হবে, সেই জন্য ওকে আনি। ওই ওভারেই (রাইলি) রুশো কট বিহাইন্ড হয়।

আরেকটা সিদ্ধান্ত ছিল চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে নিউ জিল্যান্ড ম্যাচে মোসাদ্দেককে ওই সময়ে আনা। (৪২তম ওভারে বোলিংয়ে আসেন মোসাদ্দেক। ৩ ওভারে ১৩ রান দিয়ে ৩ উইকেট নিয়ে ম্যাচ মোড় ঘুরিয়ে দেন)। এমন কিছু আছে।

অধিনায়ক হিসেবে নিজের দায়িত্ব নিয়ে কাউকে খেলানোর স্মৃতি…

মাশরাফি: দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সেই সিরিজেই দ্বিতীয় ওয়ানডেতে সম্ভবত এমন হয়েছে। রিয়াদকে নিয়ে। তার আগের সিরিজে ওর আঙুল ভেঙে গিয়েছিল। সেরে উঠতে অনেক দিন সময় লাগছিল। তখন কিন্তু সবাই ওকে নিয়ে দ্বিধায় ছিল। অবশ্য সেটাই স্বাভাবিক। আমি তখন ওর সঙ্গে কথা বলি। ও বলে আমি পারব। আমি তখন ওকে পুরোপুরি বিশ্বাস করি। ওর আঙুল ভাঙার ব্যাপারটা মাথা রেখেই সবাই শেষ পর্যন্ত রাজি হয়েছে, তুমি ওকে নিতে চাচ্ছ, নাও। ও খেলে আর ডেভিড মিলারের উইকেটও পায় আর ৫০ রান করে জয়ের খুব কাছে গিয়ে বোধ হয় আউট হয়। সেটা আমার জন্য খুব আনন্দদায়ক ছিল। আরও আছে, সেগুলো এখন বলা যাচ্ছে না।

২০১০ সালে ওয়ানডেতে নেতৃত্ব দেওয়ার সময় কোচ ছিলেন জেমি সিডন্স। এখন কোচ চন্দিকা হাথুরুসিংহে। তাদের সঙ্গে কাজের ক্ষেত্রে পার্থক্যটা কোথায়?

মাশরাফি: দুই জন আসলে দুই রকম। সিডন্সের সময়ে আমি যখন নেতৃত্ব পাই… ইংল্যান্ডের মাটিতে পা রাখার পরই দলের এক জন জানায়, ও নাকি বলেছে, জানি না কেন নেতৃত্ব দিয়েছে। ওইটা আমার জন্য একটা ধাক্কা ছিল। তখন আমার কাছে মনে হয়েছে, কী অধিনায়ক হলাম, কোচই জানে না। হয়তো বা ব্যাপারটা ও গ্রহণ করছে না।

এইবারেরটা তো আগেই আপনাকে বললাম, আমি হুট করেই অধিনায়ক হয়েছি। ভাবার তেমন কোনো সুযোগ পাই নি। আর আশপাশে তেমন কিছু শুনিনি। এখনের পরিস্থিতিটা সুস্থির। আমাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এখন আমার সময় পরিবর্তন করার।

ফিফটি তো হল, সেঞ্চুরির সম্ভাবনা কতটা?

মাশরাফি: আমার মনে হয় না সেঞ্চুরি হবে।

যত দিন খেলতে চান, অধিনায়ক হিসেবেই খেলবেন?

মাশরাফি: এটা একটা কঠিন প্রশ্ন। এটা আরেকটা চ্যালেঞ্জ আছে, অধিনায়কত্ব ছেড়ে খেলে দেখার ইচ্ছা আছে। এটা কখনও কখনও মনে হয়। আবার কখনও মনে হয়, যেভাবে চলছে সেভাবে চলুক। এত দিন কোনো কিছু ভাবিনি এখন এসব ভেবে কি হবে। দুই রকমই আছে। কোনো পরিকল্পনায় আমি স্থির নই। যেভাবে চলছে চলতে থাকুক।

ফিটনেসের ওপর যে আপনি মনোযোগ বাড়িয়েছেন তার সঙ্গে নেতৃত্বের কোনো সম্পর্ক আছে?

মাশরাফি: ২০১৪ সালে যখন নেতৃত্ব পাই তার আগে থেকেই আমি এটা নিয়ে কাজ করছিলাম। ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফর যদি দেখেন সেখানে আল আমিন আর আমি খুব ভালো বোলিং করি। খুব ভালো বোলিং করছিলাম তখন। তারও আগে থেকেই ফিটনেসের ওপর জোর দিই। সেটা আমার খেলা চালিয়ে যাওয়ার জন্য, অধিনায়কত্বের জন্য না। ২০০৮, ২০০৯ ও ২০১১ সালে আমার পরপর তিনটি অস্ত্রোপচার হয়। এরপর থেকে আমি জানি, আমাকে সংগ্রাম করে খেলতে হবে। প্রচুর পরিশ্রম করে খেলতে হবে। আমি তার জন্য ফিটনেসের ওপরে জোর দিই। আমি অধিনায়কত্ব করার জন্য জীবনে কোনো পদক্ষেপ নিইনি।

অনেকে আমাকে প্রশ্ন করে, অধিনায়ক হতে গেলে কী করতে হবে। আমি সব সময় একটা কথা বলি, অধিনায়ক হতে চাওয়াই একটা স্বার্থপর সিদ্ধান্ত। ক্লাসে আপনি অধিনায়ক হতে চান, সেটাও একটা স্বার্থপর সিদ্ধান্ত। যে জিনিসের চেষ্টা আমি কখনও করিনি। অধিনায়ক হতে চাওয়া মানে কি? আপনি সবার বস হতে চাচ্ছেন। এটা আমার কাছে পুরোপুরি স্বার্থপর একটা ব্যাপার মনে হয়। যদি প্রক্রিয়া ঠিক থাকে, ভাগ্য সহায়তা করে আপনি পাবেন। যখন পাবেন তখন সততার সঙ্গে এবং শতভাগ দিয়ে চেষ্টা করে যেতে হবে।

অধিনায়ক হিসেবে সর্বোচ্চ লক্ষ্য?

মাশরাফি: প্রথম লক্ষ্য যা ছিল সেটা আমি মনে করি, অনেকটাই সফল। আমার দলের সদস্যরা দেশের মাটিতে ৮০ শতাংশের বেশি ম্যাচ জিততে চায়। এই লক্ষ্য পূরণে আমি, আমরা সফল হয়েছি। তারপরে দ্বিতীয় লক্ষ্য দেশের বাইরের ম্যাচ। একটা যখন হয়েছে তখন এটা নিয়েও চেষ্টা তো করবোই। তবে দেশের বাইরের ম্যাচের ব্যাপারে এত তাড়াতাড়ি সফল হওয়া যাবে না। যেটা আমরা দেশে হতে পেরেছি। এটা আরও বড় চ্যালেঞ্জ। আপনাকে মানসিকভাবে তৈরি হতে হবে, আপনার স্কিল সেখানে নিয়ে যেতে হবে। এটার জন্য সময় দরকার, ধৈর্য দরকার।

কোনো বৈশ্বিক শিরোপা?

মাশরাফি: আমি কখনও অধিনায়কের বা ভালো দলের জন্য সেটাকে মানদণ্ড ভাবি না। সেটা হলে দক্ষিণ আফ্রিকা কখনও ভালো দল হতে পারে না। ওরা এক নম্বর দল। কিন্তু একটা চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি ছাড়া আর কোন শিরোপা নেই ওদের। কয়েকজন কিংবদন্তি ক্রিকেটার জন্ম নেওয়ার পরও ওরা একটা শিরোপা জিততে পারবে না- এটা শুধু আমার না ক্রিকেট বিশ্বেরই একটা প্রশ্ন। এরপরও ওরা টেস্টে এক নম্বরে থেকেছে, ওয়ানডেতে এক নম্বরে এখনও আছে। টি-টোয়েন্টিতে এক-দুই-তিনের ভেতরে থাকে সব সময়। তারা তো র‌্যাঙ্কিংয়ে এখনও সেরা। আমার কাছে মনে হয় না ওইটাই মানদণ্ড।

আমি সব মিলিয়ে একটা ভালো দল চাই। যারা দেশে ভালো, বাইরেও ভালো। এটা খুবই কঠিন। ক্রিকেটে এখন একটা ব্যাপার চলছে, সবাই দেশের মাটিতে জেতে, প্রতিপক্ষের মাঠে হারে। আমরা দেশে মোটামুটি ম্যাচ জিতেছি এখন মূল চ্যালেঞ্জ বলতে পারেন অ্যাওয়ে ম্যাচ।