সাকিব-তামিমের পঞ্চাশের যুগলবন্দী

একটা সময় এক নিশ্বাসেই উচ্চারিত হতো দুজনের নাম। সেই সুখের বাতাসে এখন আরও অনেক নামের ওড়াউড়ি। তবু আলাদা করে চেনা যায় সেই দুজনকে। বাংলাদেশের সেরা দুই পারফরমার, বিশ্ব ক্রিকেটে বাংলাদেশের সেরা দুই বিজ্ঞাপন। সাকিব আল হাসান ও তামিম ইকবাল, এক সঙ্গেই স্পর্শ করতে যাচ্ছেন টেস্ট খেলার হাফ সেঞ্চুরি।

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 August 2017, 02:36 PM
Updated : 26 August 2017, 04:10 PM

অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে মিরপুর টেস্ট দুজনেরই ক্যারিয়ারের ৫০তম টেস্ট। টেস্টের আঙিনায় প্রায় দেড় যুগে বাংলাদেশের হয়ে এই মাইলফলক ছোঁয়া ক্রিকেটারের সংখ্যা হতে যাচ্ছে পাঁচ। সাকিব-তামিমের আগে এই স্বাদ পেয়েছিলেন হাবিবুল বাশার, মোহাম্মদ আশরাফুল ও মুশফিকুর রহিম।

আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার শুরুর গতিপথটা দুজনেরই ছিল প্রায় একইরকম। দুজনেরই শুরু ওয়ানডে দিয়ে। ওয়ানডে অভিষেকের ৯ মাস পর সাকিব পান টেস্ট ক্যাপ। ২০০৭ সালের মে মাসে; ভারতের বিপক্ষে চট্টগ্রাম টেস্ট দিয়ে। তামিম টেস্ট ক্যাপ পান ওয়ানডে অভিষেকের ১১ মাস পর। ২০০৮ সালের জানুয়ারিতে, নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে ডানেডিন টেস্ট দিয়ে।

টেস্টের জগতে দুজনের শুরুটা অবশ্য ছিল ভিন্ন। শুরুর তিন টেস্টে উইকেটই পাননি সাকিব। ব্যাট হাতেও ছিল না বলার মত অবদান। ভারতের বিপক্ষে দুটি টেস্টের পর শ্রীলঙ্কা সফরে গিয়ে একটি টেস্ট খেললেন। পরের দুই টেস্টে বাদ। পরের বছর নিউ জিল্যান্ড সফরেও প্রথম টেস্টে একাদশের বাইরে।

নিউ জিল্যান্ড সফরে যে টেস্টে একাদশের বাইরে সাকিব, সেটি দিয়েই অভিষেক তামিমের। ডানেডিনের কঠিন কন্ডিশন ও উইকেটে প্রথম ইনিংসে করলেন ৫৩। দ্বিতীয় ইনিংসে ৮৪, আরেক অভিষিক্ত জুনায়েদ সিদ্দিকের সঙ্গে ১৬১ রানের জুটি। তামিমকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।

নিউ জিল্যান্ডে পরের টেস্টে একাদশে ফিরলেন সাকিবও। বাংলাদেশের একমাত্র বোলিং ইনিংসে দুটি উইকেট পেলেন, দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট হাতে করলেন অপরাজিত ৪১। এরপর থেকে একাদশে নিয়মিত হয়ে গেল তার জায়গাও।

একসঙ্গে এগিয়ে গেছেন দুজন। তাদের দুজনের হাত ধরে এগিয়ে গেছে বাংলাদেশের ক্রিকেটও। প্রথম ৬ টেস্টে মাত্র ৩টি উইকেট নিয়েছিলেন সাকিব। তখনও তার পরিচয় ব্যাটিং অলরাউন্ডার। ২০০৮ সালে দেশের মাটিতে নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজের আগে সেই সময়ের বাংলাদেশ কোচ হুট করেই সাকিবকে বললেন ‘স্পেশালিস্ট স্পিনার’। কোচের কথার সার্থকতা প্রমাণ করতেই যেন চট্টগ্রামে ৩৬ রানে ৭ উইকেট নিয়ে সাকিব গড়লেন বাংলাদেশের সেরা বোলিংয়ের রেকর্ড।

চট্টগ্রামে ওই টেস্টেই প্রথমবার হাফসেঞ্চুরির দেখা পান সাকিব। প্রথম ইনিংসে ৭১, পরের ইনিংসে ৪৯। কদিন পর দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে গিয়ে পরপর দুই টেস্টে ৫ ও ৬ উইকেট। সাকিব নিত্য নিজেকে নিতে থাকেন নতুন উচ্চতায়।

অভিষেকে জোড়া ফিফটির পর তামিমের রানের গ্রাফ হয়ে যায় নিম্নমুখী। টানা ১৭ ইনিংস পঞ্চাশ নেই! সেই খরা কাটে ২০০৯ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজে। সেন্ট ভিনসেন্ট টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে দারুণ সেঞ্চুরি করে গড়ে দেন দলের জয়ের ভিত।

সেই টেস্ট ছিল সাকিবের ক্যারিয়ারের নতুন মোড়। বোলিংয়ের সময় চোট পেয়ে ম্যাচের তৃতীয় দিন সকালেই ছিটকে গেলেন অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা। সহ-অধিনায়ক সাকিব নিলেন দায়িত্ব। দারুণভাবে নেতৃত্ব দিলেন দেশের বাইরে প্রথম টেস্ট জয়ে।

পরের টেস্টে অধিনায়ক হিসেবেও অভিষেক। ব্যাটে-বলে দারুণ পারফরম্যান্সে সামনে থেকে নেতৃত্বে দিলেন দেশের বাইরে প্রথম সিরিজ জয়ে। টেস্টের পর সেবার ওয়ানডেতেও সাকিবের নেতৃত্বে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হোয়াইটওয়াশ করেছিল বাংলাদেশ।

বয়স তখনও তামিমের ২০, সাকিবের ২২। কিন্তু তখনই দুজন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় দুই তারকা, সবচেয়ে বড় দুই পারফরমার, সবচেয়ে বড় দুই ভরসা। সেই বয়স থেকেই দুজন বয়ে চলেছেন দেশের ক্রিকেটের ভার।

অভিষেক থেকে বাংলাদেশের কেবল দুটি টেস্ট খেলতে পারেননি তামিম, চোটের কারণে। শুরুর দিকে কিছু টেস্টে বাদ পড়ায় আর পরে চোটের জন্য সাকিব খেলতে পারেননি সাতটি টেস্ট।

সুসময়ের পাশাপাশি দুজনের ক্যারিয়ারেই এসেছে দুঃসময়। নিয়মিত অধিনায়কের দায়িত্ব পেয়েছেন সাকিব, তামিম তার সহকারী। বিতর্কিতভাবে সেটি কেড়ে নেওয়াও হয়েছে। অনেক চড়াই-উৎড়াই পেরিয়েছে বাংলাদেশের ক্রিকেট। ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে এগিয়ে গেছেন তারা দুজনও। ক্রিকেটের চিরকালীন নিয়মেই কখনও কখনও ঢুকতে হয়েছে অন্ধকার গলিতে। তবে পরক্ষণেই দুজন আবার উদ্ভাসিত হয়েছেন আলোয়, ভাসিয়েছেন সাফল্যের বন্যায়।

আজ তিন সংস্করণেই বালাদেশের প্রায় সব রেকর্ড ভাগাভাগি করে নিয়েছেন এই দুজনই। ৫০তম টেস্টের মাইলফলকের আগে টেস্টের কঠিন পথে দুজনে পার করেছেন অনেক অনেক মাইলফলক। টেস্টে বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি রানের রেকর্ড তামিমের। ঠিক পেছনেই সাকিব। আবার তামিমের গড়া রেকর্ড ভেঙে সাকিব খেলেছেন সবচেয়ে বড় টেস্ট ইনিংস। সবচেয়ে বেশি উইকেটের রেকর্ডে সাকিবের ধারে কাছে নেই কেউ।

তবে স্রেফ পরিসংখ্যান দুজনকে বোঝাতে পারে সামান্যই। সাকিব-তামিমের হাত ধরেই দেশের ক্রিকেট পৌঁছে গেছে নতুন উচ্চতায়। সবচেয়ে বড় কথা, বাংলাদেশের ক্রিকেটকে বিশ্ব ক্রিকেটে নতুন করে পরিচয় করিয়েছেন দুজন, চিনিয়েছেন আলাদা করে। এই দুজনের সৌজন্যেই বিশ্ব ক্রিকেটে বাংলাদেশে গড়তে পেরেছে নিজস্ব ‘ব্র্যান্ড’।

তামিম বাংলাদেশের ক্রিকেটে এনে দিয়েছেন দুঃসাহস। পাল্টা জবাব দেওয়ার আগ্রাসী মানসিকতা, সব ভেঙেচুরে এগিয়ে যাওয়ার দুর্নিবার আকাঙ্ক্ষা।

সাকিব এনে দিয়েছেন আভিজাত্য। দেশের ক্রিকেটকে পৌঁছে দিয়েছেন নতুন স্তরে। অসাধারণ সব অলরাউন্ড কীর্তিতে যখন নাম লেখান অভিজাত কোনো তালিকায়, অভিজাত হয়ে ওঠে তখন দেশের ক্রিকেটও।

সবচেয়ে বড় উপহার, সাকিব দেশের ক্রিকেটকে এনে দিয়েছেন শ্রেষ্ঠত্বের স্বাদ। কোনো একটি ক্ষেত্রে টেস্টেও এক নম্বর বাংলাদেশ! টেস্টের সেরা অলরাউন্ডার হয়ে সাকিব দেশের ক্রিকেটকেও তুলেছেন শীর্ষে।

ছোট থেকে বড় হওয়া সব দেশের ইতিহাস বলে, একজন-দুজন মহানায়কের হাত ধরে পরের স্তরে পৌঁছে গেছে তাদের ক্রিকেট। বাংলাদেশ পেয়েছে সাকিব-তামিমকে। বাংলাদেশ উঠছে পরের ধাপে।

বাংলাদেশের ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় দুই নায়ক আবার এক বিন্দুতে মিলছেন ৫০তম টেস্ট খেলার মাহেন্দ্রক্ষণে। উপহার তারাই দিতে পারেন দেশকে, পেতে পারেন নিজেরাও। তাদেরকে দিতে পারে সতীর্থরা, তারা দিতে পারে সতীর্থদের। একটি জয়, অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে জয়!