প্রাপ্যটুকুও পেলেন না মুমিনুল

সংবাদ সম্মেলনে ১৯টি প্রশ্ন করা হয়েছে প্রধান নির্বাচক মিনহাজুল আবেদীনকে। ১৩টিই ছিল একজনকে নিয়ে। কোচ চন্দিকা হাথুরুসিংহের কাছে প্রশ্ন ছিল ১৩টি। ১০টি সেই একজনকে নিয়েই। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে প্রথম টেস্টের দলে নেই মুমিনুল হক। কিন্তু ছিলেন দল ঘোষণার সংবাদ সম্মেলনের প্রায় পুরোটা জুড়েই!

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 August 2017, 03:39 PM
Updated : 19 August 2017, 04:12 PM

মুমিনুল যে থাকছেন না, এই গুঞ্জন গত কয়েকদিন ধরেই ভাসছিল বাতাসে। বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার ম্যাচ পরিস্থিতির মতো করে সেন্টার উইকেটে অনুশীলন করেছে দল। সেখানে রাখা হয়নি মুমিনুলকে। তার পরও অনেকে ভাবছিলেন, হয়ত রাখা হবে মুমিনুলকে। অন্তত স্কোয়াড থেকে বাদ পড়ার মত বাজে ফর্ম তো নয়।

কিন্তু সত্যিই যখন রাখা হলো না মুমিনুলকে, সংবাদ সম্মেলন কক্ষে উঠল আলোড়ন। এরকম সিদ্ধান্তের মানসিক প্রস্তুতি থাকার পরও উঠল বিস্ময়ের ঢেউ। দল ঘোষণা শেষ হতেই প্রধান নির্বাচকের কাছে ছুটে যেতে থাকল একের পর এক প্রশ্ন। শরবিদ্ধ যখন দেশের সেরা টেস্ট গড়ের ব্যাটসম্যান, প্রশ্নের তীর তো ছুটবেই!

নির্বাচকদের বিস্ময়কর যুক্তি

প্রধান নির্বাচক মিনহাজুল আবেদীনের মূল যুক্তি, মুমিনুলের সাম্প্রতিক ফর্ম ভালো নয়। বললেন, সবশেষ ৬ ইনিংসে ১টি ফিফটি। বললেন না, সেই ফিফটি ছিল মাত্র দুই টেস্ট আগেই; ওয়েলিংটনের মতো প্রতিকূল কন্ডিশনে নিউ জিল্যান্ডের শক্তিশালী বোলিং আক্রমণের সামনে।

প্রধান নির্বাচক বললেন, এ বছরে মুমিনুলের গড় আটাশে নেমে এসেছে। বললেন না, এ বছর মাত্র তিনটি টেস্ট খেলেছেন মুমিনুল। বললেন না, খুব বেশি দিন হয়নি, টানা ১১ টেস্টে পঞ্চাশ ছোঁয়া ইনিংসের রেকর্ড গড়েছিলেন এই ব্যাটসম্যানই!

মুমিনুলের ফর্ম যে শুরুর মত নেই, সেটি বললেন প্রধান নির্বাচক। বললেন না, চার নম্বরে ভালো করতে থাকার পরও বদলে ফেলা হয়েছিল মুমিনুলের ব্যাটিং পজিশন। চার নম্বর পজিশনে তার ব্যাটিং গড় এখনও ৬২.৬৪। তিন নম্বরে ব্যাটিং গড় ৩৬.৮৬। অথচ ব্যাটিং পজিশন ফিরিয়ে না দিয়ে কেড়ে নেওয়া হলো দলে তার জায়গা!

কোচের ভূমিকা

প্রধান নির্বাচকের অনেক উত্তরই ছিল অগোছালো। সেটির কারণ হতে পারে দল নির্বাচনে প্রধান নির্বাচক বা অন্য নির্বাচকদের ভূমিকা সামান্য থাকা। কোচ তীব্রভাবে চাইছিলেন বলেই নাকি মুমিনুল নেই দলে। সেই ইঙ্গিতও সংবাদ সম্মেলনে বারবার দিয়েছেন প্রধান নির্বাচক। মুমিনুলকে বাদ দেওযার প্রশ্নে অন্তত পাঁচবার নিজ থেকেই টেনেছেন কোচের কথা, “দল নির্বাচনে কোচও ছিলেন” বা “কোচকেও জিজ্ঞেস করতে পারেন।”

টিম ম্যানেজমেন্টের চাওয়ার কথা প্রধান নির্বাচক বলেছেন বারবার। এখন পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়া সিরিজের ম্যানেজারের নাম জানানো হয়নি। অধিনায়ক মুশফিকুর রহিমের ভুমিকা বরাবরই থাকে সামান্য। টিম ম্যানেজমেন্ট বলতে বাকি থাকলেন তো কেবল কোচই। টিম ম্যানেজমেন্টের চাওয়া বলতে কি তবে কোচের চাওয়াই?

এমনিতে যুক্তিতে বেশ স্বচ্ছ হলেও এদিন মুমিনুল প্রসঙ্গে কোচ চন্দিকা হাথুরুসিংহের কিছু কথাও ছিল অগোছালো। মুমিনুলের সমস্যাটি কোথায়, প্রশ্নে কোচ বললেন, “সমস্যা হলো সে রান করছে না। সব ক্রিকেটারের এই সময় আসে।”

পাল্টা যখন মনে করিয়ে দেওয়া হলো, দুই টেস্ট আগেই ওয়েলিংটনে ৬৪, কদিন আগে চট্টগ্রামে প্রস্তুতি ম্যাচে দুই দল মিলিয়ে সর্বোচ্চ ৭৩ রান, কোচের কণ্ঠে তখন আবার উল্টো সুর, “সে সম্ভব সব কিছুই করছে। সে রান করেছে, দারুণ ব্যাট করেছে প্রস্তুতি ম্যাচে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে দলে যারা আছে, তারাও রান করছে।”

নিজের যুক্তিতে অটল থাকতে না পারাও মুমিনুলের বাদ পড়ায় কোচের ভূমিকার গুঞ্জনের পালে দিচ্ছে জোর হাওয়া।

সাম্প্রতিক ফর্ম, অতীত রেকর্ড, পরিসংখ্যান-সবকিছুর বাইরেও আছে কিছু বাস্তবতা। টেস্টে জায়গা হারানো মুমিনুল এমন একজন, হাথুরুসিংহের জমানাতেই তাকে তকমা দেওয়া হয়েছিল ‘টেস্ট স্পেশালিস্ট’ বলে। সেটি নিয়েও তখন সমালোচনা হয়েছিল বিস্তর। তবু মেনে নিতে হয়েছিল। কিন্তু সেই টেস্ট স্পেশালিস্টকে বাদ দেওয়া হলো দুটি টেস্টের ব্যর্থতায়!

মুমিনুলের কঠিন সময়ের শুরুটাও হাথুরুসিংহে জমানার শুরুর দিকে। ২০১৪ সালের ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে আচমকাই ছড়ানো হয়েছিল, “শর্ট বলে মুমিনুল দুর্বল!” দেশের ক্রিকেটে সেটি তুলেছিল বিস্ময়ের ঝড়। মুমিনুলের ক্রিকেট গুরু কোচ মোহাম্মদ সালাউদ্দিন আকাশ থেকে পড়েছিলেন। কারণ মুমিনুল শর্ট বল বেশ ভালো সামলাতে পারেন বলেই জানত সবাই!

নিজের দলের একজন ক্রিকেটারের প্রতি কোচের দৃষ্টিভঙ্গি সেসময় যেমন হয়েছিল প্রশ্নবিদ্ধ, তেমনি মুমিনুলের আত্মবিশ্বাসেও সেটি ছিল বড় ধাক্কা।

মুমিনুলের কাজটি পরে কঠিন হয়ে ওঠে আরও, যখন তাকে টেস্ট স্পেশালিস্টের তকমা দিয়ে ব্রাত্য করা হয় ওয়ানডেতে। বাংলাদেশের বাস্তবতায় শুধু টেস্ট খেলে নিজেকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ধরে রাখা কঠিন। ঘরোয়া ক্রিকেটের মান বা অনুশীলনের সুবিধা, কোনোটিই তো আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের কাছাকাছি নয়!

একজন অ্যালেস্টার কুক বা চেতেশ্বর পুজারা বছরে ১০-১২টি টেস্ট খেলার সুযোগ পান। বাংলাদেশের অত টেস্ট খেলার সুযোগ কোথায়? বিস্ময়কর হলেও সত্যি, টেস্ট স্পেশালিস্টের তকমা পাওয়া মুমিনুল গত বছর টেস্ট খেলতে পেরেছেন মাত্র দুটি, এ বছর তিনটি। কার্যত তাই খুব বেশি টেস্ট খেলার সুযোগ না পেলেও বাদ দেওয়া হলো বাংলাদেশের টেস্ট স্পেশালিস্টকে!

সবশেষ মুমিনুলের আত্মবিশ্বাসে আরেক দফা চোট লাগে শ্রীলঙ্কায়। গলে দুই ইনিংসে দিলরুয়ান পেরেরা অফ স্পিনে এলবিডব্লিউ হওয়ার পর আবার কোচ বললেন, অফ স্পিনে সমস্যা আাছে মুমিনুলের। অথচ স্পিনটা বরাবরই দারুণ খেলেন বলেন জানা দেশের ক্রিকেটের প্রায় সবার।

একাদশ থেকে বাদ পড়ার সেই ধাক্কা সামলে মুমিনুল চট্টগ্রামে প্রস্তুতি ম্যাচে খেললেন ৭৩ রানের ইনিংস। তবু তাকে বাদ পড়তে হলো স্কোয়াড থেকেই।

হাথুরুসিংহে কোচ হওয়ার আগে মুমিনুলের টেস্ট গড় ছিল ৭৫.৫০। হাথুরুসিংহে জমানায় গড় ৩৫.৮৮। একজন ক্রিকেটার ভালো খেলেছেন মানে তার প্রতিভা ও সামর্থ্য আছে এই পর্যায়ে ভালো করার। হুট করে ফর্ম হারালে বা ভুল করতে থাকলে সেটি শোধরানোর মূল দায়িত্ব কোচের। আগে সফল ক্রিকেটার কারও জমানায় কম সফল হলে সেটি কোচেরও ব্যর্থতা। হাথুরুসিংহে সেই দায়ের সামান্য নিলেন নিজে, বেশিরভাগটা চাপিয়ে দিলেন মুমিনুলকেই।

মুমিনুলের বাদ পড়ার ঘটনায় ফিরে যেতে হয় বছরখানেক আগে। কোচকে নির্বাচক প্যানেলে অন্তর্ভুক্ত করা নিয়ে যখন সমালোচনার ঝড় উঠেছিল দেশের ক্রিকেটে। এখন ক্রিকেট বিশ্বের সবচেয়ে বড় নির্বাচক প্যানেল নিয়েও দল নির্বাচনে প্রায় সব সিদ্ধান্ত যে কোচ একাই নেন, ক্রিকেট আঙিনায় সেটি প্রায় ‘ওপেন সিক্রেট’।

অতীত-বর্তমানের আয়নায় মিনহাজুল

মুমিনুলকে নিয়ে প্রশ্নের তোড়ে জর্জরিত প্রধান নির্বাচক মিনহাজুল আবেদীন এক পর্যায়ে সংবাদকর্মীদের উদ্দেশে বললেন, “আপনারা যদি নিয়ে যদি এভাবে জিজ্ঞেস করেন, তাহলে কিন্তু উত্তর দিতে পারব না…একজনকে নিয়ে এভাবে জিজ্ঞেস করতে পারবেন না।” প্রধান নির্বাচক হয়ত ভুলে গিয়েছিলেন, একজনকে নিয়ে এভাবে প্রশ্নের ঝড় না তুললে বিশ্বকাপ খেলা হতো না তার নিজেরই!

১৯৯৯ বিশ্বকাপের বাংলাদেশ স্কোয়াডে শুরুতে ছিলেন না মিনহাজুল। দেশের সংবাদমাধ্যমের তীব্র সমালোচনার মুখে পরে সেই সিদ্ধান্ত বদলে যায়। আগে ঘোষিত দল থেকে উইকেটকিপার ব্যাটসম্যান জাহাঙ্গির আলমকে বাইরে রেখে মিনহাজুলকে দলে আনা হয়। মিনহাজুল পরে সেটির প্রতিদান দিয়েছিলেন বিশ্বকাপে বাংলাদেশের প্রথম জয়ে ম্যাচ সেরা হয়ে। পরে অর্ধশত করেছিলেন অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষেও।

কিন্তু নিজে যখন নির্বাচকের ভূমিকায়, ১৮ বছর আগের প্রাপ্তির প্রতিদান কতটুকু ফিরিযে দিতে পারলেন মিনহাজুল? কোচের শক্ত ভূমিকা যদি থেকেও থাকে, প্রধান নির্বাচন পারতেন পাল্টা যুক্তি ও দাবিতে শক্ত থাকতে।

নির্বাচক প্যানেলে কোচের অন্তর্ভুক্তি ও অনেকটা ‘পুতুল’ হয়ে থাকতে হবে বলে প্রতিবাদ করে পদত্যাগ করেছিলেন আগের প্রধান নির্বাচক ফারুক আহমেদ। খেলোয়াড়ী জীবনে দারুণ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ও দাপুটে ছিলেন মিনহাজুল। এখন আয়নার সামনে দাঁড়ালে প্রধান নির্বাচক মিনহাজুল কি নিজেকে দেখতে পাবেন একই চেহারায়?

এবং অধিনায়ক

খুব বেশিদিন আগের কথা নয়, শ্রীলঙ্কা সফর থেকে ফেরত পাঠানো হচ্ছিলো মাহমুদউল্লাহকে। টেস্টের পর ওয়ানডে থেকেও বাদ দেওয়ার আয়োজন করা হয়েছিল। সে সময় জোর লড়াই করেছিলেন অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা। গো ধরেছিলেন, মাহমুদউল্লাহ দলে না থাকলে যাবেন না শ্রীলঙ্কায়।

শুধু শ্রীলঙ্কা সফরই নয়, মাশরাফির ভাবনায় ছিল চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিও। ওয়ানডেতে এমন একজনের অভিজ্ঞতা হারাতে চাননি অধিনায়ক। সেই প্রতিদান মিলেছে আয়ারল্যান্ডে ত্রিদেশীয় সিরিজে, প্রতিদান মিলেছে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে। মুমিনুলের জন্য টেস্ট অধিনায়ক মুশফিকুর রহিম কি ততটা লড়াই করেছেন? নির্বাচক প্যানেল বা কোচ যতোই চান, অধিনায়ক কাউকে প্রবলভাবে চাইলে পেতে পারেন, সেই নজির মাশরাফি আগেও রেখেছেন। মুশফিক কি রাখতে পারছেন?

সংবাদ সম্মেলনের শেষ দিকে কোচ জোর দাবি করেছেন, সবাইকেই সমান পাল্লায় মাপা হয়। প্রশ্ন তোলা যায় এই দাবি ও দর্শন নিয়েও। গোটা ক্রিকেট দুনিয়াকেই কখনও কখনও কারও কারও জন্য থাকে আলাদা কিছু। বাংলাদেশ দলে আগেও ছিল সেই ব্যবস্থা, ছিল হাথুরুসিংহের সময়ও। সেটা যৌক্তিকও। বিশেষ প্রতিভার জন্য থাকে বিশেষ ব্যবস্থা। তাদের পরিচর্যা হতে হয় নিবিড়। বাংলাদেশের জন্য টেস্টে সেই বিশেষ প্রতিভা মুমিনুল। টেস্ট স্পেশালিস্টের তকমা এই কোচই দিয়েছিলেন। কিন্তু কী পেলেন?

বিশেষ ব্যবস্থা তো অনেক দূর, মুমিনুল পেলেন না প্রাপ্যটিই!