সেই কার্ডিফেই আরেকটি মহাকাব্য

বল বাউন্ডারিতে ছুটতেই মুষ্টিবদ্ধ হাত বাতাসে ছুঁড়লেন মোসাদ্দেক। ড্রেসিং রুমের দিকে তাকিয়ে মাহমুদউল্লাহর হুঙ্কার। ব্যালকনিতে তখন আর সবার সঙ্গে মাশরাফি বিন মুর্তজার বাঁধনহারা উল্লাস। ১২ বছর আগের সেই দিনটি কি মনে পড়ছিল বাংলাদেশ অধিনায়কের!

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনি কার্ডিফ থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 June 2017, 03:05 PM
Updated : 10 June 2017, 05:06 AM

২০০৫ সালে যে মাঠে রচিত হয়েছিল অস্ট্রেলিয়া-বধ কাব্য, সেই কার্ডিফেই বাংলাদেশ রচনা করল আরেকটি মহাকাব্য। এবার প্রতিপক্ষ তাসমান সাগরের অপর প্রান্তের দেশ নিউ জিল্যান্ড। পরাজয়ের কিনারা থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে অসাধারণ এক জয় ছিনিয়ে আনল বাংলাদেশ।

ধ্বংসস্তুপ থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর কত নজিরই তো দেখেছে ক্রিকেট। কিন্তু এমনটি দেখেছে কবার! ২৬৬ রানের লক্ষ্য খুব কঠিন ছিল না। কিন্তু ৩৩ রানে ৪ উইকেট হারানো দলের জন্য সেটি তো অসম্ভবের কাছাকাছি!

সেই অসম্ভবও সম্ভব হলো সাকিব আল হাসান ও মাহমুদউল্লাহর অভাবনীয় ব্যাটিংয়ে। ৫ উইকেটের জয়ে টিকে রইল সেমি-ফাইনাল স্বপ্ন।

সেঞ্চুরি করেছেন দুজনই। গড়েছেন ২২৪ রানের রেকর্ড জুটি। ওয়ানডে দেশের প্রথম দুইশ রানের জুটি। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ইতিহাসে দ্বিতীয় সেরা জুটি।

দারুণ বোলিং আর মাশরাফির দুর্দান্ত অধিনায়কত্বে নিউ জিল্যান্ডকে ২৬৫ রানে আটকে রেখেছিল বাংলাদেশ। বাতাসে তখন জয়ের গন্ধ। কিন্তু সেই গন্ধ মিলিয়ে যেতে সময় লাগেনি।

টিম সাউদি ও ট্রেন্ট বোল্টের সুইং বোলিংয়ের অসাধারণ প্রদর্শনীতে এলোমেলো বাংলাদেশের ব্যাটিং। আগের দুই ম্যাচের নায়ক তামিম ইকবাল নেই দ্বিতীয় বলেই। কয়েক মিনিটের মধ্যে নেই সাব্বির ও সৌম্যও।

সেই ধাক্কা সামাল দেওয়ার আগেই বিদায় নিলেন বড় ভরসা মুশফিকুর রহিম। ৩৩ রানে নেই ৪ উইকেট। জয়ের আশার দুলুনি নয়, বরং পরাজয়ের ব্যবধান নিয়ে শঙ্কিত তখন অনেকেই।

ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প শুরু সেখান থেকেই। প্রতি আক্রমণের শুরু মাহমুদউল্লাহর হাত ধরে। পাল্টা আক্রমণে ফিরিয়ে আনেন মনোবল। বড় কিছুর জন্য মরিয়া সাকিব এগিয়েছেন সময় নিয়ে।

আস্তে আস্তে আলগা হতে থাকে গলার ফাঁস। একেকটি শটে আবার ফিরিয়ে আনতে থাকে আশার আলো। ক্রমে কেন উইলিয়ামসনের কপালে চিন্তার ভাঁজ, নখ কামড়ানো। বাংলাদেশের ফাঁস একসময় উল্টো গিয়ে চাপে কিউইদের গলায়। সেটি থেকে আর নিস্তার মেলেনি তাদের।

অসাধারণ দয়িত্বশীল ইনিংসে সাকিবের সেঞ্চুরি ১১১ বলে। সেই ২০১৪ সালের নভেম্বরের পর তার প্রথম সেঞ্চুরি। বিশ্বকাপে জোড়া সেঞ্চুরির পর প্রথম সেঞ্চুরি করলেন মাহমুদউল্লাহ। খামতি বলতে সাকিব পারলেন না দলের জয় সঙ্গে নিয়ে ফিরতে। যেটি করলেন মাহমুদউল্লাহ। তবে তাতে কী আসে যায়! এদিন কোনো আক্ষেপের দিন নয়।

আক্ষেপ খুব একটা ছিল না প্রথম ভাগেও। বোলিং ভালো হচ্ছিলো শুরু থেকেই। শেষ দিকে সেটি হলো দুর্দান্ত। ফিল্ডিংও হলো দারুণ। দেখা গেল মাশরাফির অসাধারণ নেতৃত্ব, বল হাতে মোসাদ্দেক-বিস্ময়।

চার পেসার নিয়ে একাদশ সাজিয়েছিল বাংলাদেশ। চতুর্থ পেসার হিসেবে দলে আসা তাসকিনই চারজনের সফলতম। তবে মাশরাফি ও রুবেলও ছিলেন দারুণ। বিবর্ণ শুরুর পর শেষটা ভালো করেছেন মুস্তাফিজ। তবে ৩ ওভার বোলিংয়ে ৩ উইকেট নিয়ে ইনিংসের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার নায়ক মোসাদ্দেক।

বাংলাদেশের শুরুটা ছিল দুই পাশে দুরকম। এক পাশে দারুণ বোলিংয়ে মাশরাফি ২ ওভারে দিলেন ১ রান। আরেক পাশে আলগা বোলিংয়ে মুস্তাফিজ ২ ওভারে ১৯!

চাপটা হালকা হওয়ায় পরে মাশরাফিকেও চার-ছক্কায় ওড়ালেন গাপটিল। উদ্বোধনী জুটিতে ৭ ওভারে রান ৪৬।

ব্রেক থ্রু এনে দিলেন দলে ফেরা তাসকিন। বাড়তি গতির বলে ক্যাচ দিয়ে ফিরলেন লুক রনকি।

থিতু হওয়া গাপটিল বরাবরই যে কোনো প্রতিপক্ষের জন্য বিপজ্জনক। কিন্তু এদিন গাপটিলকেই বিপদে ফেললেন রুবেল। স্কিড করে অ্যাঙ্গেলে ভেতরে ঢোকা বলে গতিতে পরাস্ত। এলবিডব্লিউ হয়ে গাপটিল থামলেন ৩৩ রানে।

সবচেয়ে বড় ভয় ছিল যে দুজনকে নিয়ে, চেপে বসলেন তারাই। দুর্দান্ত ফর্মে থাকা কেন উইলিয়ামসন আর অভিজ্ঞ রস টেইলর মিলে গড়ে তোলেন দারুণ জুটি।

বোলিংটা এ সময় খারাপ হয়নি। রুবেল-সাকিব যথেষ্টই ভালো করেছেন। কিন্তু উইলিয়ামসন ও টেইলরের ব্যাটিং ছিল আরও ভালো। এক-দুই নিয়েছেন প্রায় বলে বলে, সুযোগ পেলে বল পাঠিয়েছেন বাউন্ডারিতে।

টুর্নামেন্টে টানা তৃতীয় ম্যাচে পঞ্চাশ পেরিয়ে গেছেন উইলিয়ামসন। জুটি এগোচ্ছিল সেঞ্চুরির পথে। বাংলাদেশের লড়াই চালিয়ে যাওয়ার পুরস্কার হিসেবেই হয়ত উপহার এলো উইকেট!

রান আউট হতে পারতেন টেলর। কাছ থেকেও সরাসরি স্টাম্পে লাগাতে পারলেন না মোসাদ্দেক। ওই ওভারেই ধরা দিল উইকেট। টানা ডট বলে দুই ব্যাটসম্যানকে একটু চাপে ফেলে দিয়েছিলেন। সেটি থেকেই হয়ত দ্রুত রান চুরির চেষ্টায় ভুল বোঝাবুঝি। এবারও মোসাদ্দেকের থ্রো খুব ভালো ছিল না। তবে বোলিং প্রান্তে সাকিব ছিলেন তৎপর। ৫৭ রানে রান আউট উইলিয়ামসন।

দুজনের জুটি ছিল ৮৩ রানের। দুজন এক সঙ্গে জুটি বেঁধে আগের ৪ ইনিংসে তুলেছেন ১০৪, ৩৭, ৯৯, ৯৫। ৪৯ ইনিংসে শতরানের জুটি আছে ১১টি। এই ইনিংসেই দুজন হয়ে গেছেন নিউ জিল্যান্ডের ইতিহাসের দ্বিতীয় সফলতম জুটি।

জুটি একটি গড়ে উঠেছে এরপরও। উইকেটে যাওয়ার পরই মাশরাফির বলে দুবার আউট হতে পারতেন নিল ব্রুম। ব্যাটের কোনায় লেগে দুবার অল্পের জন্য কাভার ফিল্ডারের কাছে যায়নি বল।

তাসকিনের বুদ্ধিদীপ্ত বোলিংয়ে ভেঙেছে এই জুটি। গতি কাজে লাগিয়ে স্কুপ করতে চেয়েছিলেন টেলর। তাসকিন বুঝতে পেরে শেষ মুহূর্তে করলেন স্লোয়ার। ৬৩ রানে বিদায় টেলর।

বাংলাদেশের সেরা সময়টারও শুরু তখন। দুইশ ছাড়িয়ে নিউ জিল্যান্ডের চোখ তখন তিনশর দিকে। অপেক্ষায় জিমি নিশাম, কোরি অ্যান্ডারসনের মতো ঝড়ো ব্যাটসম্যানরা। কিন্তু মোসাদ্দেকের স্পিন তুলতেই দিল না ঝড়।

৪১ ওভারের পর মোসাদ্দেককে এনে চমকে দিলেন মাশরাফি। কে জানত, আরও বড় চমক দেবেন মোসাদ্দেক। থিতু হওয়া নিল ব্রুম আর কোরি অ্যান্ডারসনকে ফেরালেন এক ওভারেই। পরের ওভারে দারুণ বোলিংয়ে ফেরালেন শেষ বাধা নিশামকে।

শেষ দিকেও বোলিংটা হয়েছে দারুণ। ৬ উইকেট হাতে নিয়ে শেষ ১০ ওভার শুরু করেও নিউ জিল্যান্ড তুলতে পেরেছে মাত্র ৬২।

তখন থেকেই উড়েছে যে স্বপ্নের রেণু, হারিয়ে ফেললেও তা আবার গায়ে মাখল বাংলাদেশ। কার্ডিফ মানেই বাংলাদেশের জয়। কার্ডিফ মানেই অসাধারণ কিছু। কার্ডিফ মানেই ইতিহাস!

সংক্ষিপ্ত স্কোর:

নিউ জিল্যান্ড: ৫০ ওভারে ২৬৫/৮(গাপটিল ৩৩, রনকি ১৬, উইলিয়ামসন ৫৭, টেলর ৬৩, ব্রুম ৩৬, নিশাম ২৩, অ্যান্ডারসন ০, স্যান্টনার ১৪*, মিল্ন ৭, সাউদি ১০*; মাশরাফি ০/৪৫, মুস্তাফিজ ১/৫২, তাসকিন ২/৪৩, রুবেল ১/৬০, সাকিব ০/৫২, মোসাদ্দেক ৩/১৩)।

বাংলাদেশ: ৪৭.২ ওভারে ২৬৮/৫ (তামিম ০, সৌম্য ৩, সাব্বির ৮, মুশফিক ১৪, সাকিব ১১৪, মাহমুদউল্লাহ ১০২*, মোসাদ্দেক ৭*; সাউদি ৩/৪৫, বোল্ট ১/৪৮, মিল্ন ১/৫৮, নিশাম ০/৩০, স্যান্টনার ০/৪৭, অ্যান্ডারসন ০/১৯, উইলিয়ামসন ০/১৯)।