বিস্ময়টিই সত্যি। রাসেলের দুবার ৪ উইকেটের যত ব্যবধান, অনেকের ক্যারিয়ারও এতটা লম্বা হয় না। ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে শনিবার লিজেন্ডস অব রুপগঞ্জের হয়ে পারটেক্স স্পোর্টিং ক্লাবের বিপক্ষে ফতুল্লায় ৩৮ রানে ৪ উইকেট নিয়েছেন রাসেল।
লিস্ট “এ’ ক্রিকেটে সবশেষ ৪ উইকেট পেয়েছিলেন এ্ই ফতুল্লায়। তবে সেই ২০০৭ সালের নভেম্বরে! জাতীয় লিগের ওয়ানডে টুর্নামেন্ট ছিল সেটি। খুলনার হয়ে সিলেটের বিপক্ষে ৪ উইকেট নিয়েছিলেন ৩৩ রানে।
বিস্ময়ের চেয়ে বেশি আছে স্বস্তি। বেড়েছে আত্মবিশ্বাস। এবারের লিগে আগেও ৫ ম্যাচ খেলেছেন। বোলিং খারাপ করেননি। কিন্তু উইকেট ছিল তিনটি। এদিন ৪ উইকেট পেয়ে তাই দারুণ খুশি রাসেল।
“বোলিং ভালোই করছিলাম। উইকেট না পেলে তো আসলে কেউ খেয়াল করে না। আজকে ৪ উইকেট পাওয়ার পর হয়ত কিছুটা আলোচনা হবে। খেয়াল করবে অনেকে যে রাসেল এখনও খেলে। নিজের আত্মবিশ্বাসও অনেক বেড়েছে আজ।”
আলোচনায় আসা, নিজেকে জানান দেওয়া, এটিই এখন রাসেলের কাছে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। দেশের ক্রিকেট থেকে যে প্রায় হারিয়েই যাচ্ছিলেন!
এবার ঢাকা লিগ খেলছেন আড়াই বছর পর। সবশেষ ২০১৪ সালের লিগেও মাত্র দুটি ম্যাচ খেলতে পেরেছিলেন। নিয়মিত সবশেষ খেলেছেন আসলে ২০১৩ সালে।
পিছু না ছাড়া এক কাঁধের চোট তাকে প্রায় শেষ করে ফেলেছিল। বিসিবি অস্ত্রোপচার করিয়ে এনেছিল। কিন্তু অস্ত্রোপচার ঠিকঠাক হয়নি। চোটও সঙ্গ ছাড়েনি। আবার অস্ত্রোপচার করানো দরকার। আবেদন করেছেন বিসিবিতে। একবার করিয়ে এবার আর সাড়া দেয়নি বোর্ড। রাসেলও থেকে গেছেন মাঠের বাইরে।
দীর্ঘ অমানিশা শেষে অবশেষে এবার মিলেছে আলোর রেখা। এক ক্রিকেটার বন্ধুই রাসেলকে দিয়েছেন চিকিৎসার খরচ। ধার হিসেবেই চেয়েছিলেন, সেই বন্ধু বলেছেন, “ফেরত দেওয়ার কথা বললে দেব না। একেবারেই নিবি।”
গত মার্চে রাসেল গিয়েছিলেন মুম্বাইয়ে অস্ত্রোপচার করাতে। গিয়ে জেনেছেন, অস্ত্রোপচার লাগবে না। খুশি হয়েছেন, সঙ্গে হারানো সময়টার জন্য বেরিয়ে এসেছে আক্ষেপ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উগড়ে দিয়েছিলেন ক্ষোভ, “বাংলাদেশের অ্যাপোলো হাসপাতালের এমআরআই রিপোর্ট বলে আমার কাঁধের ৪টি টেন্ডন ছিড়ে গেছে। আর মুম্বাইয়ে হাসপাতালের এমআরআই রিপোর্ট বলে কাঁধ একশভাগ ঠিক। শুধু একটি টেন্ডন একটু শুকিয়ে গেছে যেটা থেরাপিস্ট দিয়েই ২-৩ সপ্তাহে ঠিক করা সম্ভব। একটা ভুল রিপোর্ট কেড়ে নিল ক্রিকেট ক্যারিয়ারের ২ বছর। ব্যাপার না। ফিরব দ্রুতই।”
শুরুর কয়েকটা ম্যাচ অনুমিত ভাবেই ধুঁকতে হয়েছে ফিটনেস নিয়ে। রাসেল জানালেন, ফিটনেস নিয়ে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন।
“অনেকদিন খেলাতে ছিলাম না। ফিটনেস বাজে হওয়াই স্বাভাবিক। ৫-৬ কেজি ওজন বাড়তি। ফিটনেস নিয়ে কাজ করার সুযোগই ছিল না। এখন খেটে যাচ্ছি। জানি ফিটনেসটাই আসল। ফিটনেস ভালো হলে বোলিংও আগের জায়গায় ফিরে আসবে।”
শনিবারের ম্যাচটি্ও ছিল ফিটনেসের একটি পরীক্ষা। প্রচণ্ড গরমে মাঠে টিকে থাকাই ছিল দায়। ৪ ওভার বোলিং করেই বাইরে চলে যান রাসেল, গরমে বমিও হয়। মাঠে এদিন ভেঙে পড়েন অনেকেই।
তবে আত্মবিশ্বাসের টনিক হয়ে গেছে ৪ উইকেটেই। রাসেল জেনে গেছেন, তার ভেতরে রসদ এখনও আছে। শুধু নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে আরও।
এক সময় তাকে ছাড়া ভাবা যেত না বাংলাদেশের ওয়ানডে দল। পেসার হলেও তার বড় শক্তি ছিল পেস কম থাকা। নিখুঁত লাইন-লেংথ, গতির বৈচিত্র আর দারুণ সব কাটারে হয়ে উঠেছিলেন দলের নির্ভরযোগ্য বোলার। ২০০৭ বিশ্বকাপে ভারতের বিপক্ষে জয়ে করেছিলেন কিপটে বোলিং। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে জয়ে নিয়েছিলেন গ্রায়েম স্মিথ ও জ্যাক ক্যালিসের উইকেট। মাঠের বাইরেও ছিলেন আমুদে চরিত্র। মাশরাফি ও আব্দুর রাজ্জাকের সঙ্গে তার বন্ধুত্বের গল্প এখনও কিংবদন্তি।
২০১০ সাল থেকেই বদলে যাওয়ার শুরু। ইনজুরি তো ছিলই। সেই সময়ের কোচ জেমি সিডন্সও কোনো কারণে অপছন্দ করতে শুরু করলেন। সব এলোমেলো হয়ে গেল। ৬ টেস্ট আর ৫২ ওয়ানডেতে থমকে ক্যারিয়ার।
দু:সময়ের দিন-রাত্রি আপাতত শেষ। এখন আবার সব গুছিয়ে নিচ্ছেন। নাহ, জাতীয় দল নিয়ে ভাবছেন না। তবে ৩২ বছর বয়সী পেসার আরও কবছর খেলে যেতে চান ক্রিকেট।
“ফিটনেসটা ভালো করতে চাই দ্রুত। কাঁধের ইনজুরিটা আর ভোগাচ্ছে না। তবে অনেকদিন পর ফিরেছি, তাই টুকটাক কিছু ইনজুরি সমস্যা হচ্ছে। রিফ্লেক্স আবার স্বাভাবিক হচ্ছে, মাসলগুলো রিল্যাক্স হচ্ছে। এসব কারণেই কিছু সমস্যা হচ্ছে। সেটা দ্রুত ঠিক হয়ে যাবে।”
“ঢাকা লিগের পর বিপিএল খেলতে চাই। লক্ষ্য আরও ৫ বছর ক্রিকেট খেলা। সেভাবেই এগোতে চাই।”
দুঃস্বপ্নের চক্করে খাবি খাচ্ছিলেন। সেখান থেকে এখন স্বপ্ন দেখার সাহস পাচ্ছেন। রাসেলের গল্পটাও বন্ধু মাশরাফির মতো। সময়ই বলবে, কতটা পূর্ণতা পায় এই গল্প!