দুর্নীতি দমন বিভাগের গাফিলতি দেখছে বিসিবির তদন্ত কমিটি

যারা ভুল করেছে, তাদের শাস্তি সামান্য। ভুলের প্রতিবাদকারীদের শাস্তি ভীষণ কঠোর। দ্বিতীয় বিভাগ ক্রিকেটে শাস্তির ঘটনা নিয়ে চলছে আলোচনা-সমালোচনা। তবে নিজেদের দেওয়া শাস্তির পক্ষেই সাফাই গাইলেন বিসিবির তদন্ত কমিটির প্রধান শেখ সোহেল। তবে বিসিবির এই পরিচালককের মতে, পুরো ঘটনায় বিসিবির দুর্নীতি দমন বিভাগের (অ্যান্টি করাপশন ইউনিট) গাফিলতি ছিল।

ক্রীড়া প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 May 2017, 01:55 PM
Updated : 3 May 2017, 02:57 PM

দেশে ক্রিকেটের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার অভিযোগে দ্বিতীয় বিভাগের দুই বোলার সুজন মাহমুদ ও তাসনিম হাসানকে মঙ্গলবার ১০ বছরের জন্য নিষিদ্ধ করেছে বিসিবি। আজীবন বহিষ্কার করা হয়েছে দুই ক্লাব লালমাটিয়া ও ফিয়ার ফাইটার্সকে। দুই ক্লাবের কোচ, অধিনায়ক ও ম্যানেজার নিষিদ্ধ ৫ বছরের জন্য।

যে ঘটনার সূত্রে এত বড় শাস্তি, বিসিবি সেই ঘটনা জানতে পেরেছে দেশি-বিদেশি সংবাদ মাধ্যমে ফলাও করে প্রচারের পরই। নিজেরা জানতে বা আগেই ব্যবস্থা নিতে পারেনি। বিসিবি গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান শেখ সোহেল এই ক্ষেত্রে মেনে নিচ্ছেন বিসিবির ব্যর্থতা। মাঠে এরকম প্রতিবাদের ঘটনা যদিও সরাসরি দুর্নীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়, কিন্তু এই বিসিবি পরিচলক দায় দিলেন দুর্নীতি দমন বিভাগকেও।

“বিসিবির ব্যর্থতা আছে। আমি সেটা স্বীকার করছি। আমাদের উচিত মাঠে গিয়ে খেলা দেখা। শুধু ক্যামেরা বসালেই হবে না। একটা না পারি পরের ম্যাচে যেতে হবে।”

“আকসুর (অ্যান্টি করাপশন ইউনিট) গাফলতি আছে। আমরা পরবর্তী বোর্ড সভায় তাদের সতর্ক করব। আকসু বিসিবির একটি অংশ। তাদের কাজ আমাদের কাছে রিপোর্ট পেশ করা। তারা একটি ব্যাপার জানবে কিন্তু সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে না, আপনি ভেবেছেন আমরা ছেড়ে দেব? আকসু যদি আমাদের প্রতিবেদন দিতে না পারে, আমি পরদিনই তাদের পদ থেকে সরে যেতে বলবো।”

তবে নিজেদের ব্যর্থতা মানলেও ক্লাব ও ক্রিকেটারদের কঠোর শাস্তিটা ঠিকই আছে বলে মনে করছেন এই বিসিবি পরিচালক। কোন ধারা মেনে এত বড় শাস্তি দেওয়া হয়েছে, সেই প্রশ্ন উঠছে। শেখ হোসেলের দাবি, তারা আইন মেনেই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

“অবশ্যই এটা আইনের আওতায়ই করা হয়েছে। বোর্ড সভায়ই বলা হয়েছে শৃঙ্খলা কমিটির প্রধান যে কোন সিদ্ধান্ত দিতে পারবে। আইনের বাইরে গিয়ে আমরা কোন কিছু করতে পারি না। আমরা আইনের লোক। আইনকে শ্রদ্ধা করি। এবং তার প্রেক্ষিতেই আমরা এমন শাস্তি দিয়েছি।”  

“আমরা তদন্ত করে দেখেছি ক্লাব, খেলোয়াড় এবং কর্মকর্তা এরা সবাই দোষী। বাংলাদেশের ক্রিকেটের সুনাম ক্ষুণ্ন করতেই একটি গোষ্ঠী ষড়যন্ত্র শুরু করছে, যার ফলশ্রুতিতে আমাদের ক্রিকেটে এমন ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটেছে। সঙ্গত কারণে আমরা বাধ্য হয়েছি এমন শাস্তি দিতে যাতে করে পরবর্তীতে এমন ঘটনা না ঘটে।”

প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে এর পরও। ম্যাচ ফিক্সিংয়ের মতো গুরুতর অপরাধে মোহাম্মদ আশরাফুলকে ৩ বছরের স্থগিত নিষেধাজ্ঞা বাদ দিলে মাত্র ৫ বছর নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। আপিলের পর যেটি কমে হয়েছে তিন বছর। অথচ দ্বিতীয় বিভাগের মত ছোট পর্যায়ে ক্রিকেটীয় প্রতিবাদের কারণে এত বড় শাস্তি? শেখ সোহেল আবারও বললেন দেশে ক্রিকেটের ভাবমূর্তি নষ্টের কথা।

“তারা যে প্রতিবাদটি করল, সেটা কি ধরণের প্রতিবাদ? এমন প্রতিবাদ যে বিশ্ব অঙ্গনে আমাদের ক্রিকেট কলুষিত হল! তাদের অবশ্যই প্রতিবাদ করার অধিকার ছিল। বিসিবি ছিল, আম্পায়ার্স কমিটি ছিল, সভাপতি ছিল। তাদের কাছে অভিযোগ করতে পারত। তারা কখনও জানায়ইনি। আশরাফুলের বিষয়টি ওই সময় যারা ছিল, তাদের সিদ্ধান্ত। ভবিষ্যতে যেন এ ধরনের অন্যায় আর না হয়, সেজন্যই আমরা এই শাস্তি দিয়েছি।”

ক্রিকেটারদের শাস্তির পাশাপাশি আলোচনার জন্ম দিয়েছে দুটি ক্লাবকে আজীবন নিষিদ্ধ করা। বাংলাদেশের ক্রিকেটে এমনটি আগে আর হয়নি। নিজেদের সেই সিদ্ধান্তের পক্ষেও যুক্তি দেখালেন তদন্ত কমিটির প্রধান।

“কোন ম্যাচে একজন ফিল্ডার যখন মিস ফিল্ডিং করে বা গুরুত্বপূর্ণ ক্যাচ ছেড়ে দেয়, তখন সংশ্লিষ্ট ক্লাব কর্তৃপক্ষ তাকে চার্জ করে। ক্লাব যদি অনুমতি না দেয়, এতবড় অন্যায় কোন প্লেয়ার করতে পারে না। যে বোলারটা (সুজন) ওই ম্যাচে ৯২ রান দিল ও কয়দিন ওই ক্লাবে খেলে? ও সবশেষ বল করেছে দেড় থেকে দুই বছর আগে। বিষয়টি পূর্ব পরিকল্পিত।”         

বিসিবির দেওয়া শাস্তি নিয়ে সমালোচনার একটি বড় কারণ, যাদের স্বেচ্ছাচারিতার প্রতিবাদ করেছিল বলে দাবি করেছে ওই ক্রিকেটার ও ক্লাবগুলো, সেই আম্পায়ারদের শাস্তিই হয়েছে অতি সামান্য। তদন্ত কমিটিই বলেছে, ম্যাচ ঠিকমত পরিচালনা করতে পারেনি দুই আম্পায়ার। কিন্ত তাদের শাস্তি হয়েছে মাত্র ৬ মাসের নিষেধাজ্ঞা। যে ৬ মাস আসলে ক্রিকেটের মৌসুম নয়, খেলাই নেই তেমন। শেখ সোহেল এখানেও দায় দিলেন ক্লাবগুলোকেই।

“আজকে যখন শাস্তি হল তখন সবাই বলছে আম্পায়ারের দোষ। কই এর আগে তো কেউ আমাদের লিখিত বা মৌখিকভাবে তাদের বিপক্ষে কিছু জানায়নি। আমার প্রশ্ন হল যখন দীর্ঘ দিন আম্পায়ারিং নিয়ে এমন সমস্যা হচ্ছে, কোন ক্লাব কি আম্পায়ার্স কমিটির কাছে একটি চিঠি দিয়েছে? বিসিবি বা সভাপতির কাছে কোন চিঠি দিয়েছে? তারা জানালে আমার মনে হয় না এ ধরনের ঘটনা ঘটত।”

গত ১১ এপ্রিল সিটি ক্লাব মাঠে এক্সিওম ক্রিকেটার্সের বিপক্ষে ৪ বলে ৯২ রান দিয়ে খবরের শিরোনাম হন সুজন। ৮৯ রান তাড়ায় ওয়াইড ও নো বলের বন্যায় এক্সিওম জিতে যায় চার বলেই। পরে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে লালমাটিয়া ক্লাবের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, পক্ষপাতমূলক আম্পায়ারিংয়ের প্রতিবাদেই ক্রিকেটাররা অমন করেছে।

৪ বলে ৯২ রান দেওয়ার খবর দেশি-বিদেশি সংবাদমাধ্যমে প্রচার হয়। আকসুকে তদন্তের দায়িত্ব দেয় বিসিবি। আকসুর রিপোর্ট পাওয়ার পর আরও তদন্ত করতে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করে বিসিবি।

ওই তদন্তের সূত্রেই বেরিয়ে আসে, আলোচিত ম্যাচটির আগের দিন আরেক ম্যাচে ইন্দিরা রোড ক্রীড়া চক্রের বিপক্ষে ১.১ ওভারে ৬৯ রান দেন ফিয়ার ফাইটার্সের তাসনিম। তদন্ত হয় সেই ম্যাচ নিয়েও। এপরই আসে শাস্তির ঘটনা।

শেখ সোহেল জানালেন, শাস্তি পাওয়া ক্লাব ও ক্রিকেটাররা আপিল করলে “একটা ব্যবস্থা করা যেতে পারে।”