সেরা সাফল্য নিয়ে বাংলাদেশের ফেরা

শ্রীলঙ্কায় আগের সব দ্বিপাক্ষিক সিরিজ মিলিয়ে বাংলাদেশের প্রাপ্তি ছিল কেবল গতবারের ওয়ানডে সিরিজ ড্র। টেস্ট সিরিজগুলোতে সঙ্গী ছিল বিব্রতকর সব হার। সেখান থেকে এবার বেরিয়ে আসা গেছে। প্রথমবারের মতো কোনো সিরিজে না হেরে শ্রীলঙ্কা থেকে ফিরছে বাংলাদেশ।

ক্রীড়া প্রতিবেদক কলম্বো থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 April 2017, 06:46 AM
Updated : 7 April 2017, 08:00 AM

জয় দিয়ে শেষ হল ঘটনাবহুল শ্রীলঙ্কা সফর। প্রায় ছয় সপ্তাহের এই সফরে ঝড় তুলেছে মাঠের বাইরের ঘটনাও। তবে বরাবরের মতোই সব ভুলে মাঠে নিজেদের উজাড় করে দিয়েছেন ক্রিকেটাররা, তাতে তিন সংস্করণেই একটি করে জয় পেয়েছে বাংলাদেশ।

টেস্ট, ওয়ানডে, টি-টোয়েন্টি তিন সিরিজই শেষ ১-১ সমতায়। বাংলাদেশের ভালো সফরটি হতে পারতো আরও ভালো। অতিথিদের বিশ্বাস, দ্বিতীয় ম্যাচ পরিত্যক্ত না হলে ওয়ানডে সিরিজ জেতা সম্ভব ছিল। ৩১২ রানের লক্ষ্য তাড়া করে মাশরাফি বিন মুর্তজার দল জিততো কি না, সেটা দেখার সুযোগ দেয়নি বৃষ্টি।

মাশরাফি হঠাৎ করেই অবসর নিয়েছেন টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট থেকে। মুমিনুল হক বাদ পড়েছেন টেস্ট থেকে, ওই সংস্করণের স্কোয়াডেই জায়গা হারিয়েছেন মাহমুদউল্লাহ। টেস্ট অভিষেক হয়েছে মোসাদ্দেক হোসেনের। দেশের হয়ে প্রথমবারের মতো ওয়ানডে আর টি-টোয়েন্টি খেলেছেন মেহেদী হাসান মিরাজ। টি-টোয়েন্টিতে অভিষেক হয়েছে তরুণ অলরাউন্ডার মোহাম্মদ সাইফ উদ্দিনের।

কোনো ম্যাচ খেলার সুযোগ না পেলেও প্রথমবারের মতো ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি দলে ছিলেন বাঁহাতি স্পিনার সানজামুল হক। নিউ জিল্যান্ড সিরিজে তিন ম্যাচে সর্বোচ্চ ৭ উইকেট নেওয়ার পরও টি-টোয়েন্টি দলে জায়গা মেলেনি রুবেল হোসেনের।

মোরাটুয়ায় প্রস্তুতি ম্যাচে তামিম ইকবালের ঝকঝকে এক শতক দিয়ে সফর শুরু বাংলাদেশের। বাঁহাতি এই উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান প্রস্তুতি ম্যাচের ভালো ব্যাটিং ধরে রাখেন টেস্টেও। ভালো সঙ্গ পান সৌম্য সরকারের কাছ থেকে। তাদের ভালো শুরুর সুবিধা গল টেস্টে নিতে পারেনি বাংলাদেশ, হারে ২৫৯ রানে।

এই ম্যাচে টিম ম্যানেজমেন্টের চাওয়ায় বিশেষজ্ঞ ব্যাটসম্যান হিসেবে খেলেন অধিনায়ক মুশফিক। উইকেটের পেছনে দাঁড়ান লিটন দাস। অবশ্য তার চোটে আবার দ্বিতীয় টেস্টে কিপিংয়ে ফিরতে হয় মুশফিককে।

প্রথম ম্যাচে প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়তে না পারা বাংলাদেশ কলম্বো টেস্টের আগে আরও এলোমেলো হয়ে পড়ে মাহমুদউল্লাহকে দেশে ফেরত পাঠানোর সিদ্ধান্তে। শেষ পর্যন্ত বিসিবি সভাপতির হস্তক্ষেপে মিডল অর্ডার এই ব্যাটসম্যান থাকেন শ্রীলঙ্কাতেই। তার জায়গায় অভিষেক হয় তরুণ মোসাদ্দেকের, লিটনের চোটে শেষ মুহূর্তে একাদশে আসেন সাব্বির রহমান।

সব চাপ সামাল দিয়ে পি সারা ওভালে নিজেদের শততম টেস্টে দারুণ জয় পায় বাংলাদেশ। সেই ম্যাচের দ্বিতীয় দিনের শেষ বেলায় ক্ষ্যাপাটে ব্যাটিংয়ে ৮ বলে ১৮ রান করেন সাকিব। অন্তত তিনবার আউট হতে হতে বেঁচে যান এই অলরাউন্ডার। পড়েন প্রবল সমালোচনার মুখে। তার ব্যাটিংয়ের কোনো ব্যাখ্যা ছিল না ব্যাটিং কোচ থিলান সামারাবিরার।

পরের দিন অন্য চেহারায় দেখা যায় সাকিবকে। তার ব্যাট থেকে আসে দারুণ এক শতক। বোলিংয়েও ছিলেন দারুণ কার্যকর। মুস্তাফিজুর রহমানের দারুণ স্পেলে ম্যাচ ঘুরে যায় বাংলাদেশের দিকে। লক্ষ্য তাড়ায় সামনে থেকে পথ দেখান তামিম। নিজেদের শততম টেস্ট জয় দিয়ে রাঙায় বাংলাদেশ।        

ওয়ানডে প্রস্তুতি ম্যাচে বোর্ড সভাপতি একাদশের সঙ্গে পারেনি মাশরাফির দল। সেই ম্যাচে লঙ্কান বাঁহাতি ব্যাটসম্যানদের দেখে দেশ থেকে ডেকে পাঠানো হয় অফ স্পিনিং অলরাউন্ডার মিরাজকে।

ডাম্বুলায় প্রথম ওয়ানডেতে তামিমের শতকের ওপর ভর করে দারুণ জয় পায় অতিথিরা। বৃষ্টিতে ভেসে যাওয়া দ্বিতীয় ওয়ানডেতে হ্যাটট্রিক করেন তাসকিন আহমেদ।

ব্যাটিং আর বোলিংয়ে প্রথম ১০ ওভারের বাজে ক্রিকেটে তৃতীয় ওয়ানডেতে পারেনি বাংলাদেশ। হাতছাড়া হয়ে যায় সিরিজ জয়ের সুযোগ।

টি-টোয়েন্টি সিরিজের আগে ডাকা হয় অলরাউন্ডার সাইফকে, ফেরত পাঠানো হয় শুভাগত হোম চৌধুরী ও রুবেলকে। আগের সিরিজের সেরা বোলারের দলে না থাকাটা মেনে নিতে পারেননি মাশরাফি। অধিনায়ক মনে করেন, একাদশেই থাকা উচিত ছিল রুবেলের। 

প্রথম টি-টোয়েন্টির টসের সময় আচমকা নিজের অবসরের ঘোষণা দেন মাশরাফি। দুই ম্যাচের সিরিজ শেষে এই সংস্করণে আর দেশের হয়ে খেলবেন না অধিনায়ক।

অনুপ্রেরণাদায়ী অধিনায়কের এমন ঘোষণায় ভেঙে পড়েন দলের তরুণ সতীর্থরা। মাঠে নামার পর সব ভুলে গিয়ে খেলায় মন দিলেও সেই ম্যাচে পারেনি অতিথিরা। কুসল পেরেরার ঝড়ো ব্যাটিংয়ে মাঠ ছাড়ে হেরে।

মাশরাফিকে জয় দিয়ে বিদায় জানাতে উন্মুখ ছিলেন সতীর্থরা। সেটা পেরেছেনও তারা। কোমরের ব্যথায় খেলতে পারেননি তামিম, তার জায়গায় সুযোগ পেয়ে জ্বলে উঠেন ইমরুল কায়েস। খুনে মেজাজে ছিলেন সৌম্য। সাকিব উজ্জ্বল অলরাউন্ড নৈপুণ্যে। বোলিংয়ে চেনা ছন্দে দেখা গেছে মুস্তাফিজকে।

পি সারা ওভালে এক সন্ধ্যার সেই পাগলাটে ব্যাটিংয়ের পর অনেক বদলেছে সাকিবের খেলা। অনেক বেশি দায়িত্ব নিয়ে খেলেছেন বিশ্বের অন্যতম সেরা এই অলরাউন্ডার। তার কাছে শ্রীলঙ্কার মাটিতে তিনটি সিরিজই ড্র করতে পারা অনেক বড় ব্যাপার।

“শ্রীলঙ্কায় এসে ভালো করা দলের সংখ্যা খুব কমই। তিনটা সিরিজই আমরা ড্র করেছি, এটা আমাদের জন্য অনেক বড় পাওয়া। বিদেশ সফর যদি চিন্তা করি, দেশের বাইরে এসে এমন সাফল্য আামদের ক্রিকেটে হয়নি এর আগে।”

তৃতীয় ওয়ানডের হারটা মানতে পারছেন না সাকিব। তার বিশ্বাস, ব্যাটসম্যানরা আরেকটু দায়িত্ব নিয়ে খেললে সেই ম্যাচের চিত্রটা ভিন্ন হতে পারতো।

“ওয়ানডে আমরা অনেকদিন ধরে খেলছি। বেশ কিছু দিন ধরেই ভালো করেছিলাম, সেটার একটা ধারাবাহিকতা ছিল। তবে আমরা তৃতীয় ওয়ানডেতে ভালো করেনি। একটু ভালো ব্যাটিং করতে পারলে ওটারও ফল পক্ষে আসতো।”

সাকিব জানান, এই সফরে ক্রিকেটাররা উপলব্ধি করতে পেরেছে, টেস্ট আর টি-টোয়েন্টি ঠিক কোন মানসিকতা নিয়ে খেলতে হবে। সেই জায়গায় পৌঁছাতে পারাকে সফরের বড় প্রাপ্তি হিসেবে দেখছেন তিনি।

শ্রীলঙ্কার দুঃস্বপ্নের ভেন্যুগুলো থেকে এবার কিছু সুখস্মৃতি নিয়ে ফিরছে বাংলাদেশ। টি-টোয়েন্টি অধিনায়ক হিসেবে নিজের শেষ সংবাদ সম্মেলনে সেটাকেই বড় করে দেখতে চাইলেন মাশরাফি।

“কোনো বিতর্ক না হওয়াই ভালো। আমরা সবাই দেশের ক্রিকেটের ভালো চাই। চাই বাংলাদেশের ক্রিকেট এগিয়ে যাক। জয় দিয়ে শেষ করতে পেরেছি এটাই সবচেয়ে বড় ব্যাপার। এটা ধরে রেখে আমরা সামনের দিকে এগোতে চাই।”