বাংলাদেশ নিয়ে মুগ্ধতা ছুঁয়ে গেছে রানাতুঙ্গাকে

হয়ে উঠেছেন পুরোদস্তুর রাজনীতিবিদ। দায়িত্ব নিয়েছেন বন্দর ও নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের। ক্রিকেট নিয়ে বলার সময় প্রাণবন্ত হয়ে উঠলেন শ্রীলঙ্কার বিশ্বকাপ জয়ী অধিনায়ক অর্জুনা রানাতুঙ্গা।জানালেন বাংলাদেশের ক্রিকেটের উন্নতি নিয়ে মুগ্ধতার কথা। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট, আইসিসির সমালোচনা করলেন আগের মতোই।

অনীক মিশকাতঅনীক মিশকাতকলম্বো থেকে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 April 2017, 06:08 PM
Updated : 6 April 2017, 06:58 PM

শ্রীলঙ্কা বাংলাদেশের সিরিজ তো দেখছেন, সেটা নিয়েই শুরু করা যাক।

অর্জুনা রানাতুঙ্গা: আমি তো ক্রিকেট এখন দেখিই না বলা চলে। কারণ, আমার চেয়ে বেশি জানা-বোঝা লোকেরা এখন ক্রিকেট চালাচ্ছে। তাই দূরে থাকাই ভালো বলে মনে হয়েছে।

যতটুকু দেখেছি তাতে আমার মনে হয়, বাংলাদেশ প্রথম টেস্টে খুবই খারাপ খেলেছে। তবে দ্বিতীয় ম্যাচে খুব ভালোভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। এটা আসলে খেলোয়াড়দের দায়িত্ব নেওয়ার একটি ব্যাপার। দুই উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান যেভাবে ব্যাট করেছে, এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

আমি মনে করি, টেকনিকের দিক থেকে ওদের কোনো সমস্যা নেই। এটা পুরোপুরি মানসিক ব্যাপার। বাংলাদেশের এমন একজনকে লাগবে, যে ওদের মানসিকভাবে ঠিক জায়গায় রাখবে। ক্রিকেটের দিক থেকে ওরা খুব ভালো। ব্যাটসম্যানদের যথেষ্ট শট আছে, ওরা খুব প্রতিভাবান। (সমস্যাটা) পুরোপুরি এখানে (নিজের মাথার দিকে ইঙ্গিত করে)। এটা ওদের খুব দ্রুত কাটিয়ে উঠতে হবে।

শ্রীলঙ্কার সঙ্গে তুলনা করলে বাংলাদেশের ক্রিকেটকে এখন কোথায় রাখবেন?

রানাতুঙ্গা: ওরা সত্যিই অনেক উন্নতি করেছে। তিন বছর আগে আমি বলেছিলাম যে, আমাদের ক্রিকেট যেভাবে এগোচ্ছে, তাতে খুব দ্রুতই আমরা বাংলাদেশের কাছেও হারব। তা এই সিরিজে হয়েও গেল। বিশেষ করে টেস্ট সিরিজ দেখে মনে হল বড় দৈর্ঘ্যের ক্রিকেটেও ওরা বেশ উন্নতি করেছে। ওদের কমিটমেন্ট দেখে আমি মুগ্ধ। এই বাংলাদেশে গিয়ে আমিও খেলে এসেছি। ১৯৮৮ সালে প্রথম মোহামেডানের হয়ে খেলেছি। এরপর বিভিন্ন সময়ে গিয়েছি আরো বেশ কয়েকবার। সুতরাং ভাবতে ভালোই লাগে যে বাংলাদেশের ক্রিকেট উন্নয়নে শ্রীলঙ্কানদেরও অবদান আছে।

মনে আছে, ঢাকায় খেলতে গিয়ে আমি সেখানকার কর্মকর্তাদের নিয়মিতই বলতাম, উন্নতি করতে হলে স্কুল ক্রিকেটটা শুরু করুন। জুনিয়র পর্যায়ে বেশি মনোযোগ দিন। অন্যথায় আপনাদের ক্রিকেট দাঁড়াবে না। আমার ধারণা, তারা ইতিমধ্যেই কাজটি করেছে। তাছাড়া কোচরাও দুর্দান্ত কাজ করেছেন। বর্তমান কোচের কথা বলছি, আমাদের শ্রীলঙ্কা থেকে অতীতেও অনেক কোচ গিয়ে আপনাদের ক্রিকেট উন্নয়নে ভূমিকা রেখে এসেছেন। আর এখন তো চন্দিকা হাথুরুসিংহে আর থিলান সামারাবিরাও দারুণ কাজ করছে বাংলাদেশ দলের জন্য।

জানি টি-টোয়েন্টি বা আইপিএল বিরোধী লোক আপনি। তা আপনার এমন অবস্থানের ব্যাখ্যাটা কী?

রানাতুঙ্গা: ক্রিকেট দেখলে এখন দুঃখই হয়। অথচ অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড এমনকি দক্ষিণ আফ্রিকার দিকেও যদি তাকান, দেখবেন ওরা এখনও ওয়ানডে বা টি-টোয়েন্টির চেয়ে টেস্ট ক্রিকেটকেই সবচেয়ে বেশি মর্যাদাপূর্ণ মনে করে। এই অঞ্চলেও বিষয়টা তাই কিনা, আমি নিশ্চিত নই। আইপিএল শুরু হলেই টেকনিকের জায়গা নিয়ে নেয় ‘পাওয়ার’। পুরোটাই বিনোদনের ব্যাপার হয়ে যায়। আমি তাই শচিন টেন্ডুলকার, সুনিল গাভাস্কার বা অরবিন্দ ডি সিলভার মতো ব্যাটসম্যান আর দেখি না। পাওয়ার হিটিং ব্যাটসম্যানদেরই এখন যত কদর!

তবে আমি এখনও অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ড কিংবা অস্ট্রেলিয়া-দক্ষিণ আফ্রিকার টেস্ট দেখে রোমাঞ্চিত হই। ওই দেশের লোকেরা এখনও টেস্ট ম্যাচ দেখতে মাঠে আসে। আমি এখানকার অবস্থা দেখে এজন্যই আতঙ্কিত হই যে বয়সভিত্তিক দলের ক্রিকেটাররা যদি টেকনিকই না জানে, তাহলে তো টিকে থাকতে পারবে না। হ্যাঁ, টি-টোয়েন্টিতে টেকনিকের দরকার ওদের নেই। কিন্তু টি-টোয়েন্টির এই যুগে টেকনিক ছাড়াই ব্যাটসম্যান হয়ে যাচ্ছে ওরা। সৌভাগ্য যে আমাদের সময়ে এই ফরম্যাট ছিল না। আমাদের কাছে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট ‘জাঙ্ক ফুড’ ছাড়া আর কিছুই নয়। টেস্ট ক্রিকেট হলো বাসায় মায়ের হাতে রান্না করা সেই সুষম খাবার। আর টি-টোয়েন্টিকে বলব রাস্তার ধার থেকে কিনে খাওয়া নুডুলস।

কিন্তু অনেক ক্রিকেটার তো টি-টোয়েন্টি খেলার জন্য টেস্ট বা আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে আগেভাগে অবসরও নিয়ে ফেলছেন…

রানাতুঙ্গা
: আমার সময় তো দেশের হয়ে খেলা এবং জেতাকেই আমি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে এসেছি। আমি জানি না, এখন সেই মনোভাব কতটুকু আছে ক্রিকেটারদের। আমি বলব না যে সবাই একরকম। তবে বেশিরভাগ ক্রিকেটারই এখন টাকার পেছনে ছুটছে। আমার মনে হয়, বেশিরভাগেরই লক্ষ্য এখন আইপিএল, বিগব্যাশ বা সিপিএলে যাওয়া এবং কাড়িকাড়ি টাকা কামানো। সেজন্য যদি শ্রীলঙ্কায় কোনো টেস্ট ম্যাচ না খেলার সুযোগ থাকে, তাহলে ওরা সেটাই করবে। এজন্যই ১৯৯৬-র বিশ্বকাপজয়ী দলের ক্রিকেটারদের কথা আমি সবসময়ই বলি। ওরা কখনওই টাকা নিয়ে চিন্তিত ছিল না। ওরা দেশের হয়ে জেতার গৌরবকেই গুরুত্ব দিয়েছে বেশি। ওদের জন্য আমি সত্যিই গর্বিত।

দেশের হয়ে খেলার চেয়ে বড় কিছু নেই। দেশের ব্লেজার, টাই, টুপি এগুলো আমি কখনও অর্থের সঙ্গে তুলনা করতে যাই না। আপনি দেশের হয়ে খেললে টাকা পাবেন। আমি সব সময়ই বলি, দেশের জন্য খেল, স্কুলের জন্য খেল, ক্লাবের জন্য খেল- টাকা আসবে। টাকার দিকে তাকিয়ে ক্রিকেট খেলো না। বেশিরভাগ ক্রিকেটারই এটা করে। এটা একটা বড় ভুল। আমি আশা করবো, বাংলাদেশের ক্রিকেটে সেটা ঘটবে না।

চার দিনের টেস্ট ক্রিকেটের একটা প্রস্তাব আছে। অনেকে এর পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। আপনি কিভাবে দেখছেন?

রানাতুঙ্গা: আমি পুরানো ভাবনার লোক। সাদা পোশাকে লাল বলের ক্রিকেট- এটাই আসল। আমরা এমন একটা ব্যাপারে কথা বলছি, যা একশ বছরের বেশি সময় ধরে চলছে। এটা লম্বা সময়ে ঐতিহ্য বহন করছে। ওদের জন্য তো কাউবয় ক্রিকেট, টি-টোয়েন্টি আছে। রঙিন পোশাক, শর্টস, যেমন ইচ্ছে তেমন পোশাকে সেই ক্রিকেট খেলা যায়। দয়া করে ঐতিহ্যবাহী একটি ব্যাপার ধ্বংস করবেন না। আপনি হয়তো বলতে পারেন, মানুষ টেস্ট দেখতে মাঠে আসছে না। এটা কোনো অজুহাত হতে পারে না। স্কুল শিক্ষার্থীদের বিনা পয়সায় টেস্ট দেখতে দিন, ওদের জন্য গেট খোলা রাখুন। এভাবে বড় দৈর্ঘ্যের ক্রিকেটের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেন।

হয়ে উঠেছিলেন সময়ের অন্যতম সেরা অধিনায়ক। সেই সময়ের দিকে ফিরে চাইলে কেমন লাগে? ইমরান খানের সঙ্গে তুলনাটা উপভোগ করেন?

রানাতুঙ্গা:
যখন তরুণ ছিলাম, ইমরান খান-কপিল দেবকে খুব শ্রদ্ধা করতাম। আমি বিস্মিত হয়ে ভাবতাম, পাকিস্তান কিভাবে বিশ্বকাপ জিততে পারে বা ভারত কিভাবে বিশ্বকাপ জিততে পারে? ওদের কাছ থেকে আমি সেই উচ্চাকাঙ্ক্ষা পেয়েছি। এরপর আমার মনে হয়েছে, তাহলে শ্রীলঙ্কা কেন বিশ্বকাপ জিততে পারবে না? ইমরান দলকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিত। সে ছিল সেরা ক্রিকেটারদের একজন। সে সব সময় সতীর্থদের পাশে থাকতো। সে দেশের জন্যই খেলতো। আমিও ঠিক তাই করেছি। ক্রিকেটার হিসেবে ইমরান খানের মতো ভালো ছিলাম না। তবে খানিকটা ব্যাটিং, খানিকটা বোলিং আমিও পারতাম। আমার নীতি ছিল, দেশের জন্য জয়ের চেষ্টা করা এবং জেতা। শতক করার চেয়ে আমার কাছে দলের জয় ছিল বেশি গুরুত্বপূর্ণ। টেস্ট-ওয়ানডেতে আমার মাত্র চারটি করে শতক আছে। আমার রেকর্ড হয়তো খুব ভালো নয়, তবে নিজের দেশের হয়ে আমিই প্রথম বিশ্বকাপ জিতেছি।

ইংল্যান্ডে কখনও আমাদের একটা-দুইটার বেশি টেস্ট দেওয়া হতো না। আমার মনে আছে, একটা টেস্ট শেষে সংবাদ সম্মেলনে ওদের একজনের প্রশ্নের জবাবে বলেছিলাম, ইংল্যান্ড আমাদের কাছে ৩-০ ব্যবধানে হারতে চায় না। পরের বছরই আমরা তিনটা টেস্ট পেয়েছিলাম।

বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রিকেট নিয়ে কোনো স্মৃতি?

১৯৮৮ সালে যখন খেলতে গিয়েছিলাম ওরা আমার খুব যত্ন করেছিল। আমি মোহামেডানের হয়ে তিন মৌসুম খেলেছি- সব সময়ই এটা ঘটেছে। একটি পুরো মৌসুম খেলেছিলাম, অন্য দুটি হয়তো পাঁচটি করে ম্যাচ। সেখানে আমার দারুণ কিছু স্মৃতি আছে। একবার মাঠে এক উইকেটরক্ষকের সঙ্গে বচসাও হয়েছিল (হাসি), তবে এটা ছিল মজার। ঢাকায় যখন প্রথম মোহামেডানের হয়ে খেলতে গেলাম, গ্যালারি ছিল পরিপূর্ণ। আমি কখনও ঘরোয়া ক্রিকেটে এত দর্শক দেখিনি।

মোহামেডান-আবাহনী চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ছিল। আমি (মিনহাজুল আবেদীন) নান্নুর সঙ্গে অনেক ম্যাচ খেলেছি। আতাহার আলীসহ সাবেক অনেক ক্রিকেটারের সাথেই অনেক স্মৃতি আছে। অনেক দিন হল বাংলাদেশে যাইনি। ক্রিকেট নয় নিজের মন্ত্রণালয়ের কাজে হয়তো যেতে পারি।