ওয়ানডেতেও মাহমুদউল্লাহকে বাদ দিতে চেয়েছিলেন কোচ!

গল টেস্ট তখনও শেষই হয়নি, শ্রীলঙ্কা থেকে দেশে একটি বার্তা পান নির্বাচক কমিটি। ওয়ানডে সিরিজের বাংলাদেশ স্কোয়াড। তালিকা দেখে স্তম্ভিত নির্বাচক কমিটি। স্কোয়াড হবে ১৪ বা ১৫ জনের। কিন্তু মাহমুদউল্লাহর নাম ১৬ নম্বরে!

ক্রীড়া প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 March 2017, 04:58 PM
Updated : 14 March 2017, 04:15 AM

দুই স্তর মিলিয়ে ছয় সদস্যের বিশাল নির্বাচক বাহিনী। তবে পাঁচ জনেরই কাজ খুব একটা নেই। স্রেফ সায় দিতে হয়। কিংবা, সায় দিতে বাধ্য হতে হয়। কারণ একজনের সিদ্ধান্তই প্রায় চূড়ান্ত। বিসিবিতে এটা মোটামুটি ‘ওপেন সিক্রেট’। নামে প্রধান নির্বাচক মিনহাজুল আবেদীন হলেও কোচ ও অন্যতম নির্বাচক চন্দিকা হাথুরুসিংহেই সর্বেসর্বা। 

মাহমুদউল্লাহকে স্কোয়াডের বাইরে রেখে ওই তালিকা নির্বাচকদের পাঠিয়েছিলেন কোচই। শুধু সেটিই নয়, মাহমুদউল্লাহকেও ডেকে নিয়ে কোচ স্পষ্ট জানিয়ে দেন, পরের টেস্টে তো বটেই, ওয়ানডে দলেও নেওয়া হবে না তাকে। তবে টি-টোয়েন্টিতে বিবেচনা করা হবে।

কোচের সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত ছিলেন না মিনহাজুলের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের নির্বাচক প্যানেল। কিন্তু সেটি নিয়ে কোচের সঙ্গে যুক্তির লড়াইয়ে যাওয়ার ‘দুঃসাহস’ তাদের হয়নি।

তবে আনুষ্ঠানিক ভাবে নির্বাচন প্রক্রিয়ার বাইরে হয়েও একজন সেই সাহস দেখিয়েছেন। বিসিবির একটি সূত্র বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে নিশ্চিত করেছে, অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা নির্বাচকদের সাফ জানিয়ে দেন, মাহমুদউল্লাহ দলে না থাকলে শ্রীলঙ্কায় যাবেন না তিনি।

টেস্ট দলে জায়গা হারানোটা সময়ের দাবি হলেও ওয়ানডেতে মাহমুদউল্লাহর বিকল্প দেখেন না অধিনায়ক। নিউ জিল্যান্ড সিরিজটায় ভালো না খেললেও আগের সিরিজেই ইংল্যান্ডের বিপক্ষে দ্বিতীয় ওয়ানডে জয়ে বড় অবদান ছিল মাহমুদউল্লাহর ৭৫ রানের ইনিংসের।

ব্যাটিং অর্ডারে থিতু জায়গা না পেলেও কখনোই অভিযোগ করেননি মাহমুদউল্লাহ। শুরুতে হোক বা পরে, বিপর্যয়ে হোক বা দ্রুত রান বাড়াতে, সব দায়িত্বই বরাবরই হাসিমুখে মেনে নেন ও পালন করেন তিনি। বোর্ডের ওই সূত্র জানিয়েছে, অধিনায়ক বারবার বুঝিয়েছেন দলে মাহমুদউল্লাহ ‘ইমপ্যাক্টের’ কথা।

অপেক্ষা ছিল বোর্ড প্রধান নাজমুল হাসানের দেশে ফেরার। তিনি ফেরার পর চলতে থাকে আলোচনা। মাহমুদউল্লাহর ব্যাপারে সিদ্ধান্তের জন্যই দল ঘোষণায় হচ্ছিলো দেরি। এর মধ্যেই সোমবার সকালে কলম্বোতে টিম ম্যানেজার খালেদ মাহমুদ জানিয়ে দেন, দেশে ফেরত পাঠানো হচ্ছে মাহমুদউল্লাহকে। যেটি অনেকটাই নিশ্চিত করে দেয় ওয়ানডেতে এই মিডলঅর্ডার ব্যাটসম্যানের না থাকা।

দেশের ক্রিকেটে মোটামুটি ভূমিকম্প হয়ে যায়। প্রবল সমালোচনার তীর ধেয়ে আসছে দেখেই বোর্ড প্রধানের হস্তক্ষেপে বদলায় সিদ্ধান্ত। ওয়ানডে স্কোয়াড ১৪-১৫ সদস্যের হয় সাধারণত। এবার কোচের তালিকায় ১৬ নম্বরে থাকা মাহমুদউল্লাহকে রেখে দেওয়া হয় ১৬ সদস্যের দল।

এতে আপাত সমাধান হলেও ক্ষতি এর মধ্যেই কম হয়নি। মাহমুদউল্লাহকে ওয়ানডেতেও বাদ দেওয়ার গুঞ্জনে বাংলাদেশের ড্রেসিং রুমও স্তম্ভিত হয় যায়। টেস্টের বাজে পারফরম্যান্সে একজন সিনিয়র ক্রিকেটারকে ওয়ানডেতেও বাদ দেয়ায় ড্রেসিং রুমেও ছড়ায় অস্থিরতা। শেষ পর্যন্ত মাহমুদউল্লাহ টিকে গেলেও অনিশ্চয়তার চোরকাঁটা ঢুকে গেছে ক্রিকেটারদের মনে। শততম টেস্টের আগে এসব আলোচনায় দলের ফোকাসও নড়ে যাওয়া স্বাভাবিক। ওয়ানডে সিরিজের আগে অধিনায়ক মাশরাফিরও চ্যালেঞ্জ হবে, নড়বড় আত্মবিশ্বাসের ড্রেসিং রুমে সুবাতাস আনা। একটি সন্ত্রস্ত ও অস্থির ড্রেসিং রুমে অধিনায়কের কাজটি সহজ হবে না। না এই টেস্টের আগে, না ওয়ানডে সিরিজে আগে।

গলে ব্যর্থতার পর মাহমুদউল্লাহ নিজেও জানতেন টেস্টে জায়গা হারাতে হবে। সেই মানসিক প্রস্তুতিও তার ছিল। কিন্তু ওয়ানডেতেও বাদ পড়ছেন, কোচের কাছ থেকে এটা শোনার পর বিমর্ষ হয় পড়েন।

শ্রীলঙ্কাতেই দলে ঘনিষ্ঠ জনদের বলেছেন, “আমার পায়ের নীচ থেকে মাটি সরিয়ে নেওয়া হলো।”

শেষ পর্যন্ত দাঁড়ানোর ভিত পেলেন। তবে সত্যিটা তো তিনি জানেন। ওয়ানডে সিরিজে তাকে খেলতে হবে এভারেস্টসম চাপ নিয়ে।

আগের সিরিজে ইমরুল কায়েসকেও প্রায় একার সিদ্ধান্তে ভারত থেকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন হাথুরুসিংহে। চোট থেকে মাত্রই সেরে ওঠা ইমরুল গিয়েছিলেন হায়দরাবাদে। ফিজিওর পরামর্শ ছিল, শুধু ব্যাটিং করার, সতর্কতা হিসেবে ফিল্ডিং নয়। কিন্তু প্রস্তুতি ম্যাচে কোচ এক প্রকার ঠেলেই ইমরুলকে ফিল্ডিংয়ে পাঠান। ঠিকই বাধে বিপত্তি। ফিল্ডিংয়ে আবার টান লাগে ইমরুলের পায়ে।

দলের একটি সূত্র জানিয়েছে, ফিজিও সেদিন বলেছিলেন, টেস্টের আগেই ঠিক হয়ে উঠবেন ইমরুল। কিন্তু তাতে কান না দিয়ে চোটের কথা বলে সেদিনই ইমরুলক দেশে পাঠিয়ে দিতে বলেন কোচ।

শ্রীলঙ্কা সফরের দল ঘোষণার আগে বিসিএলে একটি ম্যাচ খেলেন ইমরুল। বিকেএসপিতে সেই ম্যাচে ব্যাট করেন দুই ঘণ্টা, লম্বা সময় ফিল্ডিং করেন ক্লোজ ইনে। তার পরও ফিটনেস নেই বলে দলে নেওয়া হয়নি তাকে। ইমরুল বরাবরই হাল ছাড়ার পাত্র নন। বিসিএলে পরের ম্যাচে সেঞ্চুরিই করে বসেন। এর পর বাধ্য হয়েই তাকে দ্বিতীয় টেস্টের দলে মেনে নেন হাথুরুসিংহে।

একসময় লেগ স্পিনার জুবায়ের হোসেনকে নিয়ে ছিল কোচের বাড়াবাড়ি। অন্যরা শুধু টেস্টে খেলাতে চাইলেও কোচ অনেকটা জোর করেই তরুণ লেগ স্পিনারকে সব ফরম্যাটে খেলিয়েছেন। সেই কোচই আবার তাকে একেবারেই বাতিলের খাতায় ফেলে দিয়েছেন প্রকাশ্য বিবৃতি দিয়ে। নেটে দেখে পছন্দ করা তানবীর হায়দারকে দলে নিয়েছেন চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে লেগ স্পিনার লাগবে বলে। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির আগে সেই তানবীর ঢাকা লিগে দল খুঁজে মরছেন, জাতীয় কোচের ভাবনাতেও নেই।

আব্দুর রাজ্জাককে আরও অনেক দিন আগেই বাতিলের খাতায় ফেলে দিয়েছেন কোচই। যেটির খেসারত এখনও দিতে হচ্ছে দলকে। সীমিত ওভারে সাকিবের নিয়মিত একজন স্পিন সঙ্গী এখনও মেলেনি। সবশেষ নেওয়া হলো সানজামুলকে।

কোচের অতি ক্ষমতা চর্চায় বিরক্ত ও শঙ্কিত বোর্ডেরই বেশ কয়েক জন কর্তা। তাদের মতে, কোচের এত ক্ষমতা চর্চার বীজ বোনা হয়েছে তখন, যখন তার সঙ্গে কিছু মতভেদের কারণে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল সেই সময়ের ক্রিকেট পরিচালনা বিভাগের প্রধান নাঈমুর রহমান দুর্জয়কে। নির্বাচক কমিটি দুই স্তরে ভাগ করার অভিনব সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়েছিল মূলত কোচকে দল নির্বাচনে জায়গা দিতেই। নিউ জিল্যান্ডের মাইক হেসন, অস্ট্রেলিয়ার ড্যারেন লেম্যানও নির্বাচক কমিটির সদস্য। তবে হাথুরুসিংহের মতো একচ্ছত্র আধিপত্য নেই আর কোনো কোচের।

গত তিনটি বিদেশ সফরে দল নির্বাচন নিয়ে যে অস্থিরতা, সেটির প্রভাব ভালো মতোই পড়েছে পারফরম্যান্সে। একটি অনিশ্চিত ড্রেসিং রুম কখনোই মাঠে দেখাতে পারে না নিশ্চিত পারফরম্যান্স।

স্রেফ ক্রিকেট কোচ হিসেবে হাথুরুসিংহে যে দারুণ, এটায় দ্বিমত করার লোক পাওয়া যাবে না হয়ত একজনও। কিন্তু প্রবল ক্ষমতায় তিনি হয়ে উঠেছেন দলের সবকিছু। আর নিজেই সব কিছু করতে চাইলে, কিছু ভুল তো হবেই!

কোচকে তার দায়িত্বের সীমানা মনে করিয়ে দিতে পারে বিসিবিই, যদি তারা চায়!