ব্যাটসম্যানরা পারেননি ‘রাব্বি’ হয়ে উঠতে!

“ডিফেন্স করে কখনোই ম্যাচ বাঁচানো যায় না। দিন শেষে একজন ব্যাটসম্যানকে রান করতেই হবে। আজকে রাব্বি অনেক বল খেলেছে। কিন্তু সে তো বোলার, ব্যাটসম্যান নয়।”

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনিহায়দরাবাদ থেকে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 Feb 2017, 02:48 PM
Updated : 13 Feb 2017, 02:55 PM

মুশফিকুর রহিম কথাটি বললেন শেষ দিকে। হাসতে হাসতে। তবে শেষের কথাটিতেই শুরু বিস্ময়ের। জন্ম দিল ভাবনার খোরাক। বোলার হয়েও রাব্বি যদি টিকে থাকতে পারেন, ব্যাটসম্যানরা কেন নয়!

মুশফিক হয়ত বোঝাতে চাইছিলেন, বোলার বলেই ব্যাটসম্যানের মত ভাবতে পারেননি কামরুল ইসলাম রাব্বি। ব্যাটসম্যান হলে হয়ত উইকেট আঁকড়ে না রেখে রানের পেছনে ছুটতেন!

যেটা ভেবেই বলুন না কেন, অধিনায়কের কথাতেই ফুটে উঠছে টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের বাস্তবতা। টেস্ট খেলার কমতি, ক্রিকেটীয় স্কিলের যতটা সমস্যা, তার চেয়ে বড় সমস্যা মানসিকতায়। ঘণ্টা ধরে বা সেশন বাই সেশন ব্যাট করা, ম্যাচ বা সময়ের চাহিদা মিটিয়ে ব্যাট করার ব্যাপারগুলো মানসিকভাবেই মেনে নিতে পারেনি বাংলাদেশ। আত্মস্থ করতে পারেনি হৃদয়ে। ব্যাটিং মানেই তাদের কাছে রান করা। যেন উইকেট আঁকড়ে রাখা ব্যাটিং নয়!

টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাস বলবে, ব্যাট হাতে শৌয্য-বীর্যের গল্প এখানে দু ভাবে লেখা হয়। পাল্টা আক্রমণ করে। আঘাতের জবাবে পাল্টা আঘাত হেনে। প্রতিপক্ষকে চমকে দিয়ে। আবার উল্টোটাও আছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে শুধু আক্রমণ সামলে যাওয়াও বীরত্ব। ব্যাটে কিংবা বুকে-গায়ে-পিঠে আঘাত সহ্য করা, কোনো অবস্থাতেই উইকেট না ছেড়ে যাওয়া, সব প্রলোভন, সব হাতছানি উপেক্ষা করে মাথা নীচু করে থাকাও বীরত্ব। কারণ শেষ মুহূর্তটা পর্যন্ত এভাবে টিকে থাকতে পারলেই জয়। যেমন এই টেস্ট ড্র করতে পারলেই সেটি হতো জয়ের সমান!

ভারতের মাটিতে শেষ দিনে ৭ উইকেট হাতে নিয়ে আস্ত একটা দিন কাটিয়ে দেওয়া কঠিন। তবে যে কারণে কঠিন, সেটিই এখানে ছিল সহজ। রাজীব গান্ধী স্টেডিয়ামের ২২ গজ হয়ে ওঠেনি মাইনফিল্ড কিংবা স্পিন স্বর্গ। প্রথম ইনিংসে রিভার্স সুইংয়ের জাদু দেখানো উমেশ যাদবও ছিলেন না ততটা কার্যকর। একবার বল পাল্টেও ভারত ততটা কথা বলাতে পারেনি এসজি টেস্ট বলকে। তারপরও বাংলাদেশ শেষ হয়ে গেছে প্রায় ২৫ ওভার আগে।

দিনের শুরুটায় অন্য কিছুর ইঙ্গিত ছিল। ফুট মার্কে ফেলা জাদেজার আচমকা লাফানো বলে কিছুই করার ছিল না সাকিব আল হাসানের। এরপর সারাদিনে আর তেমন কিছু হয়নি। তবে সেই জুজুটাই বুঝি পেয়ে বসেছিল। মুশফিকদের মনে হলো, এখানে টিকে থাকা যাবে না। রান করতে হবে। শট খেলে এগিয়ে যেতে হবে। কিন্তু একজন রাব্বি ঠিকই রান না করেও টিকে থাকতে পারলেন!

অধিনায়কের যুক্তি মেনে নিলেও তার আউট মেনে নেওয়ার মত নয়। অশ্বিনের ওই ওভারেই বেরিয়ে এসে চার মেরেছেন। এক বল পরই কি তুলে মারা প্রয়োজন ছিল টিকে থাকার স্বার্থে?

ম্যাচ শেষে সংবাদ সম্মেলনে অধিনায়ক বলেছেন, তিনি চেয়েছিলেন চার মেরে অশ্বিনকে থিতু হতে না দিতে। বৃত্তের ভেতরে থাকা ফিল্ডার সীমানায় পাঠাতে। এখানেও প্রতিফলন ব্যাটসম্যানদের মানসিকতার। ফিল্ডার সীমানায় পাঠিয়ে সিঙ্গেল নেওয়ার ভাবনা থাকবে ওয়ানডেতে। টেস্টে সেটির কেন প্রয়োজন পড়বে, যেখানে প্রয়োজন স্রেফ সময় কাটানো!

অধিনায়ক অবশ্যই স্বীকার করতে চাইবেন না, তবে মানসিক অবসাদও না থেকে পারেই না। এই টেস্টের প্রথম ইনিংসে ১৬৬ ওভার কিপিং করেছেন মুশফিক। এরপর ব্যাট করেছেন ৩৮১ মিনিট। শেষ ব্যাটসম্যান হিসেবে আউট হওয়ার পরই আবার মাঠ ছাড়তে হয়েছে দৌড়ে। কারণ আবার কিপিং প্যাড পড়ে নামতে হবে! যথারীতি কিপিং করেছেন। শেষ দিনে আবার চাপের মধ্যে ব্যাটিং। শরীর যতোই ফিট থাকুক, মানসিক অবসাদ না হয়ে পারেই না। অবচেতন মনে সেটিই প্রভাব ফেলে থাকতে পারে। ভাবনার গোলমালটাও হতে পারে সেখান থেকে।

মাহমুদউল্লাহর জন্য ফিল্ডার আনা হলো লং লেগে। অনেকটা সময় নিয়েই। মাঠের প্রায় সবাই বুঝতে পারছেন কি বল আসতে যাচ্ছে। মাহমুদউল্লাহর না বোঝার কারণ নেই। অনুমিতভাবেই এলো শর্ট বল, ৬৪ রান করা ব্যাটসম্যান তুলে দিলেন লং লেগে সেই ফিল্ডারের হাতে। ওই দল ম্যাচ বাঁচাবে কি করে?

বাংলাদেশ-ইংল্যান্ড সিরিজে যে ধরনের টার্নিং উইকেট ছিল, সেখানে হয়ত ‘ডিফেন্স’ করে টিকে থাকা যায় না। এখানে তো তেমন কোনো ব্যাপারই ছিল না। ভারতে পঞ্চম দিনেও এরকম ব্যাটিং উপযোগী উইকেট পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। বিরাট কোহলি যেমন বলেছেন। স্রেফ ‘বেসিক’ মেনে চললেই এখানে টিকে থাকা যায়। লোকে অনেক সময় ভাগ্য পায়ে মাড়ায়। মাহমুদউল্লাহ-মুশফিকরা হাওয়ায় উড়িয়েছেন।

হাশিম আমলা-এবি ডি ভিলিয়ার্সরা এর চেয়েও বেশি টার্নিং উইকেটে দিল্লিতে ১৪৩ ওভার কাটিয়ে ১৪৩ করেছেন। সেবার ম্যাচ বাঁচাতে পারেননি, তবে বাংলাদেশের প্রয়োজন ছিল স্রেফ ৯০ ওভার খেলা। মুশফিক বলছেন, ডিফেন্স করে ম্যাচ বাঁচানো যায় না। ডি ভিলিয়ার্সরা সেটিও করে দেখিয়েছেন। ২২০ বলে ৩৩ করেছিলেন ডি ভিলিয়ার্স, ৩৭৬ বলে ১১০ করেছিলেন ফাফ দু প্লেসি। অ্যাডিলেডে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ম্যাচ বাঁচিয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকা।

কোহলির মন্তব্যের উত্তরে মুশফিক বলেছেন, বাংলাদেশে কোনো কোহলি নেই। দক্ষিণ আফ্রিকার কথা শুনলে বলতে পারেন, আমাদের কোনো ডি ভিলিয়ার্স নেই। তা নেই, কিন্তু কামরুল ইসলাম রাব্বি তো আছে!

ব্যাপারটি মানসিকতার। ডি ভিলিয়ার্সের মত প্রতিজ্ঞায়ই উইকেটে পড়ে ছিলেন রাব্বি। শেষ পর্যন্ত আউট হননি।

মুশফিক বলেছেন, রাব্বি তো বোলার, ব্যাটসম্যান নন। অধিনায়কের কথায়ই ফুটে উঠেছে সত্য। বোলার হয়েও ব্যাটসম্যানের মতোই ভেবেছেন রাব্বি। মুশফিক-মাহমুদউল্লাহরা পারেননি ব্যাটসম্যান হয়েও সেভাবে ভাবতে!