ভারতের রেকর্ডে পিষ্ট বাংলাদেশ

মুখরোচক কোনো বুফে মেন্যুতে কী কী থাকতে পারে? রেস্তোরাঁ নয়, বলা হচ্ছে ২২ গজের কথা। ব্যাটসম্যানদের কাঙ্ক্ষিত তালিকায় থাকতে পারে শর্ট বল, বাইরে বল, হাফ ভলিসহ আলগা বোলিংয়ের সব পদ; বাজে ফিল্ডিং, ক্যাচ ছাড়া, স্টাম্পিং মিস, ম্যাড়মেড়ে শরীরী ভাষা, একঘেয়ে ও কল্পনাশক্তিহীন নেতৃত্ব। অতিথি হয়ে এসে বাংলাদেশই অতিথি-সেবা করল এই সব দিয়ে। সুস্বাদু সব খাবার পেয়ে গোগ্রাসে গিলল ভারতীয় ব্যাটসম্যানরা।

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনিহায়দরাবাদ থেকে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 10 Feb 2017, 12:23 PM
Updated : 10 Feb 2017, 03:30 PM

একটি ডাবল সেঞ্চুরি, আরও দুটি সেঞ্চুরি। দুটি আশি, আরও একটি অর্ধশতক। দেড়শর বেশি রান গুণেছেন দুজন, আরও তিন বোলারের রান দেওয়ার সেঞ্চুরি। ব্যক্তিগত অনেক রেকর্ডের ফুলে গাঁথা হলো দলীয় রেকর্ডের মালা। ইতিহাসের প্রথম দল হিসেবে টানা তিন ইনিংসে ভারতের ছয়শ!

দ্বিতীয় দিন চা-বিরতির ৪৫ মিনিট পর যখন ইনিংস ছাড়লেন বিরাট কোহলি, বাংলাদেশের ফিল্ডারদের তখন যেন মাঠ ছাড়ার শক্তিও নেই। ভারতের রান ৬ উইকেটে ৬৮৭। ২০১৪ সালে চট্টগ্রামে শ্রীলঙ্কার ৬ উইকেটে ৭৩০ রানের পর এটিই বাংলাদেশের বিপক্ষে সর্বোচ্চ রান।

আগের দিন বাংলাদেশের বোলিং, ফিল্ডিং ও শরীরী ভাষা ছিল বাজে, শুক্রবার তা জঘন্য। উইকেট ব্যাটিংয়ের জন্য দারুণ অবশ্যই। প্রতিপক্ষের ব্যাটিং লাইন আপও দুর্দান্ত। কিন্তু উইকেট নিতে না পারলে অন্তত রান আটকানোর বোলিং তো করা যায়! টানা কয়েকটি বল ভালো জায়গায় ফেলতেই পারলেন না বোলাররা। সকাল থেকেই ছুটল রানের বান, বয়ে চলল ইনিংস ঘোষণার বাধ পর্যন্ত।

বিশ্বের সব বোলিং আক্রমণের জন্যই কোহলি এখন এক বিভীষিকার নাম। বাংলাদেশের এমন উপহারেও বিমুখ করবেন কেন? সকাল থেকেই কচুকাটা করলেন বোলারদের। দুপুর নাগাদ নাম লিখিয়ে ফেললেন ইতিহাসে। আরও একবার!

একসময় ভারতের সব স্টেডিয়ামেই গ্যালারিতে শোনা যেত পরিচিত এক রোল, “শচীন…শ..চী..ন।”  টেন্ডুলকার ক্রিকেট ছেড়েছেন, তবে ভারতীয় দর্শকের গলা ফাটানোর আরেকজন নায়কের আর্বিভাব হতে দেরি খুব একটা হয়নি। গতকিছু দিন ধরেই শোনা যাচ্ছে সেটি। এদিনও রাজীব গান্ধী স্টেডিয়ামের গ্যালারির ১৩ হাজার দর্শকের চিৎকার “কোহলি…কোহলি।”

সেই ধ্বনির মাঝেই ব্যাট উঁচিয়ে ধরলেন সময়ের নায়ক। মাত্র ২৩৯ বলে ডাবল সেঞ্চুরি! ক্যারিয়ারের চতুর্থ, সবকটিই অধিনায়ক হিসেবে; মাত্র ২৩ টেস্টে। ভারতের ইতিহাসে বাকি সব অধিনায়ক মিলে চারটি দ্বিশতক করেছেন ৪৮৫ টেস্টে!

আরেকটি জায়গায় পেছনে ফেলেছেন নিজেদের এক কিংবদন্তি ও সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যানকে। টানা তিন সিরিজে ডাবল সেঞ্চুরির রেকর্ড ছিল রাহুল দ্রাবিড় ও ডন ব্র্যাডম্যানের। কোহলি করলেন টানা চার সিরিজে!

চতুর্থ উইকেটে ২২২ রানের জুটিতে অজিঙ্কা রাহানেও বুঝিয়ে দিয়েছেন, কেন তাকে পেয়ে ট্রিপল সেঞ্চুরিয়ানকে বাদ দিতেও বাধেনি দলের। সেঞ্চুরিটা (৮২) পেলেন না কেবল মেহেদী হাসান মিরাজের অসাধারণ এক ক্যাচে। ছন্নছাড়া ফিল্ডিংয়ের দুটি দিনে মিরাজের অসাধারণ ডাইভিং ক্যাচটি যেন ঘন কালো মেঘ ফুঁড়ে হঠাৎই একটু রোদের ঝিলিক।

তবে সেই ঝিলিক মিলিয়ে গেছে দ্রুতই। ‘ক্যাচ ও স্টাম্পিং মিস করার যত উপায়’ নামে মুশফিক যে সম্ভাব্য বইটি বের করতে পারেন, সেখানে যোগ হলো নতুন অধ্যায়। নিশ্চিত স্টাম্পিং হওয়া থেকে ৪ রানে বেঁচে গিয়ে ঋদ্ধিমান সাহাও শাসন করলেন বাংলাদেশকে।

তার চোটের সুযোগে এসে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে দারুণ করেছিলেন পার্থিব প্যাটেল। কিন্তু তবু বাংলার এই উইককেটকিপার ব্যাটসম্যানেই আস্থা রেখেছিলেন কোহলি। রাহানের মত সাহাও আস্থার প্রতিদান দিলেন দারুণভাবে। তাইজুলকে মাথার ওপর দিয়ে উড়িয়ে নিজের ব্যাট উঁচিয়ে ধরেছেন মাথার ওপরে। ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় সেঞ্চুরি ১৫২ বলে।

আম্পায়ারের ভুল সিদ্ধান্ত আর সঙ্গীর ভুল বোঝায় কোহলি থেমেছেন দুইশর পরই। এলবিডব্লিউ হলেও বেঁচে যেতে পারতেন রিভিউ নিলে। তবে কোহলি ফিরলেও বাংলাদেশ বাঁচেনি। রবিচন্দ্রন অশ্বিন ও রবিন্দ্র জাদেজা ছড়ি ঘুরিয়েছেন। আবারও ব্যাটকে তরবারি বানিয়েছেন জাদেজা, অর্ধশতকের পর ইদানিং যেটি হয়ে উঠেছে তার নিয়মিত উদযাপন।

ভারতের স্কোরকার্ডের মত বাংলাদেশের বোলারদের বোলিং ফিগারও তখন বেশ দর্শনীয়। পাঁচজন করেছেন রান দেওয়ার সেঞ্চুরি! ৪২ ওভারে মেডেন পাননি মিরাজ। ৪৭ ওভারে ১৫৬ রান দিলেও তাইজুলই যা একটু করেছেন ভালো। দিনের প্রথম পাঁচ ওভারেই ৭টি চার দিয়েছিলেন তাসকিন। দুই পেসারই ছিলেন ধারহীন। বিস্ময়করভাবে সাকিব করেছেন মাত্র ২৪ ওভার। যদিও সেগুলোও দারুণ কিছু ছিল না।

আগের টেস্টেই ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ৭৫৯ করেছিল ভারত। এদিন আরেকটু ব্যাট করলে টানা দুই টেস্টে সাতশ ছোঁয়ার নতুন কীর্তি হতো। তবে হ্যাটট্রিক ছয়শর রেকর্ডও বা কম কী!

একটু আগে ছাড়ার পুরস্কার মিলেছে দিন শেষের একটু আগে সৌম্য সরকারের উইকেট।

উইকেট ব্যাটিংয়ের জন্য এখনও বেশ ভালো। তবে তৃতীয় দিনে টার্ন মিলতে পারে। তার চেয়েও বড় চাপ কাঁধে রানের পাহাড়। ফলো অন এড়ানোই তো বহু দূরের পথ!

রাজীব গান্ধী স্টেডিয়ামের ২২ গজ হয়ত ‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু’ নয়। তবে সেটিকে ‘লঙ্ঘিতে’ হলে ব্যাটসম্যানদের ‘হুশিয়ার’ হতেই হবে!

সংক্ষিপ্ত স্কোর:

ভারত ১ম ইনিংস: ১৬৬ ওভারে ৬৮৭/৬ (ইনিংস ঘোষণা) (আগের দিন ৩৫৬/৩) (কোহলি ২০৪, রাহানে ৮২, ঋদ্ধিমান ১০৬*, অশ্বিন ৩৪, জাদেজা ৬০, তাসকিন ১/১২৭, রাব্বি ০/১০০, সৌম্য ০/৪, মিরাজ ১/১৬৫, সাকিব ০/১০৪, তাইজুল ৩/১৫৬, সাব্বির ০/১০, মাহমুদউল্লাহ ০/১৬)।

বাংলাদেশ ১ম ইনিংস: ১৪ ওভারে ৪১/১ (তামিম ২৪*, সৌম্য ১৫, মুমিনুল ১*; ভুবনেশ্বর ০/৭, ইশান্ত ০/৩০, অশ্বিন ০/১, উমেশ ১/২)