১০ উইকেট ‘বার্ষিকীতে’ আপ্লুত কুম্বলে

“অবশ্যই সবকটা উইকেট মনে আছে। শুধু ওই ১০টি কেন, ৬০০ উইকেটের সবকটি মানে আছে আমার…।” পুরো সময়টাই গম্ভীর কণ্ঠে কথা বলছিলেন অনিল কুম্বলে। সংবাদ সম্মেলন কক্ষেও যেন একটা ‘ভাব গাম্ভীর্যপূর্ণ’ পরিবেশ। তবে ভারতীয় কোচ শেষ কথাটি বললেন হাসতে হাসতে। হাসির রোল উঠল চারপাশেও। ৬০০ উইকেটই মনে আছে!

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনিহায়দরাবাদ থেকে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 Feb 2017, 02:54 PM
Updated : 7 Feb 2017, 05:01 PM

১৩২ টেস্টের ক্যারিয়ারে ৬১৯ উইকেট নিয়েছেন। সবকটিই মানে আছে? এটি হয়ত একটু বাড়িয়েই বলেছেন কুম্বলে। তবে তার দাবির প্রথমটুকু এক বিন্দু্ও বাড়িয়ে বলার কথা নয়। ওই ১০ উইকেটের সবকটিই স্পষ্ট মনে থাকার কথা। চোখে ভাসার কথা।

কোন ১০ উইকেট, সেটি নিশ্চয়ই আর আলাদা করে বলে দিতে হবে না। কুম্বলে মানেই তো সেই ‘পারফেক্ট টেন’! পাকিস্তানের বিপক্ষে দিল্লি টেস্টে ৭৪ রানে ১০ উইকেট। টেস্ট ইতিহাসের দ্বিতীয় দশে দশ!

কুম্বলেকে নিয়ে যে কোনো আলোচনায় সেই ১০ উইকেট আসবেই। তবে এদিন একটি বিশেষ কারণও ছিল। কুম্বলের সেই কীর্তির দেড় যুগ পূর্তি ৭ ফেব্রুয়ারি। ভারতের কোচ হিসেবে বংলাদেশের বিপক্ষে টেস্ট নিয়ে রাজীব গান্ধী স্টেডিয়ামে কথা বলছেন যিনি, ১৯৯৯ সালের ঠিক এই দিনটিতেই ফিরোজ শাহ কোটলায় তিনি বিদীর্ণ করেছিলেন পাকিস্তানের হৃদয়। একাই সব কটি উইকেট নিয়ে পেয়ে গিয়েছিলেন অমরত্ব।

মঙ্গলবার দুপুরে সংবাদ সম্মেলনের শুরুতেই ভারতের মিডিয়া ম্যানেজার মনে করিয়ে দিলেন, আজ সেই কীর্তির ১৮তম বার্ষিকী। সংবাদকর্মীরা তালি দিয়ে অভিনন্দন জানালেন কুম্বলেকে। ভারতীয় কিংবদন্তি বেশ অভিভূত এমন অভিবাদন পেয়ে।

“আমরা অনেক কিছুর বার্ষিকী পালন করি। ক্রিকেটীয় অর্জনের বার্ষিকীও পালন করাটা দারুণ। এই অর্জনটি খুবই বিরল। আমি সৌভাগ্যবান যে এই ইতিহাসের অংশ হতে পেরেছি। ভালো লাগছে যে লোকে ক্রিকেটীয় অর্জনের বার্ষিকীও মনে রাখে।”

টেস্টের সেটি ছিল চতুর্থ দিন। ৪২০ রানের প্রায় অসম্ভব লক্ষ্য, কিন্তু শতরানের উদ্বোধনী জুটি গড়ে ভারতকে ভড়কে দিয়েছিলেন সাইদ আনোয়ার ও শহিদ আফ্রিদি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কুম্বলে একাই গুঁড়িয়ে দিয়েছিলেন পাকিস্তানকে।

আফ্রিদিকে ফিরিয়ে শুরু, পরের বলেই ফিরিয়েছিলেন ইজাজ আহমেদকে। এরপর একে একে ইনজামাম-উল-হক, ইউসুফ ইয়োহানা, মইন খান, সেলিম মালিক। মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়ার পর লেজটাও ছেটে দিয়েছিলেন নিজেই। জিম লেকারের ৫৩ রানে ১০ উইকেটের পর টেস্ট ইতিহাসের সেরা বোলিং কুম্বলের ৭৪ রানে ১০ উইকেট। আসলে ১০ উইকেট নিয়েছিলেন ১৮.২ ওভারের একটি স্পেলে মাত্র ৩৭ রান দিয়ে।

মালিক ছিলেন কুম্বলের সপ্তম শিকার। খানিকপর মুশতাক আহমেদ ও সাকলায়েন মুশতাককে পরপর দু বলে ফিরিয়ে ৯ উইকেট। নাটক জমল এরপর। ওভার শেষ। আরেকপ্রান্ত থেকে বোলিং করতে এলেন জাভাগাল শ্রীনাথ। কুম্বলের মতোই কর্ণাটকের সন্তান, দুজনে খুব ভালো বন্ধু। পুরো ওভার অফ স্টাম্পের বাইরে বাইরে বোলিং করে গেলেন শ্রীনাথ। এত বাইরে যে দুবার ওয়াইডও ডাকলেন আম্পায়ার! ক্রিকেট দেখল বিরল দৃশ্য। বোলারের ভয়, যদি উইকেট পেয়ে যাই!

পরের ওভারেই ইতিহাস। পাকিস্তান অধিনায়ক ওয়াসিম আকরামকে ফিরিয়ে কুম্বলে ছুঁলেন আকাশ।

শোনা যায়, সেই ম্যাচের ভারতীয় অধিনায়ক মোহাম্মদ আজহারউদ্দিন নাকি শ্রীনাথকে বলেছিলেন বাইরে বোলিং করতে। তবে পরে এক সাক্ষাৎকারে সেটি উড়িয়ে দিয়েছিলেন শ্রীনাথ, “কেউ এসে আমাকে বলেনি যে উইকেট নেওয়া যাবে না। বলার প্রয়োজন পড়েনি। অনিল রেকর্ডের দ্বারপ্রান্তে, আমি জানতাম কি করতে হবে…।”

শ্রীনাথের ওভারে হয়েছিল আরেকটি মজার ঘটনা। শ্রীনাথ যত বাইরে বল করেন, পাকিস্তানের শেষ ব্যাটসম্যান ওয়াকার ইউনিস ততই চেষ্টা করেন বলে ব্যাট ছোঁয়াতে। পারলে বল স্টেডিয়াম ছাড়া করেন। এরকমই একটি শটে বল উঠল আকাশে। ছুটে গিয়েছিলেন ফিল্ডার সদাগোপেন রমেশ। ক্রিকেট ইতিহাসে সম্ভবত সেটিই প্রথম ও একমাত্র বার, দলের সবাই চিৎকার করে ফিল্ডারকে বলেছিল ক্যাচ না নিতে! কুম্বলে হাসতে হাসতে বললেন, “সবচেয়ে জোরে চিৎকার করেছিল বোলারই, শ্রীনাথ!”

খানিকপরই উৎসবে মেতেছিল গোটা ভারত। কুম্বলে ছিলেন মধ্যমণি। কুম্বলে যে প্রান্ত থেকে বোলিং করছিলেন, সেই প্রান্তের আম্পায়ার এভি জয়প্রকাশের তিন-চারটি সিদ্ধান্ত নিয়ে অসন্তোষ জানিয়েছিল পাকিস্তান। কিন্তু ইতিহাস কী আর ওসব মনে রাখে!

কুম্বলের ১০ উইকেটের পর ইনিংসে ৯ উইকেট নিয়েছেন মুত্তিয়া মুরালিধরন ও রঙ্গনা হেরাথ। তবে দশে দশ শুধু লেকার আর কুম্বলেই। আর কোনো সঙ্গী কি পাবেন দুই স্পিনার? উত্তর দিতে গিয়ে কুম্বলে আশ্রয় নিলেন দর্শনের।

“১৮ বছর আগে দিনটির শুরুতে যখন ড্রেসিং রুমে বসে ছিলাম, আমি কি ভাবতে পেরেছিলাম যে মাঠে নেমে ১০ উইকেট পাব! এসব হয়ে যায়। কালকেও হতে পারে, ১০ বছর পর হতে পারে, আবার কখনোই নাও হতে পারে। আমার সময়ও নিশ্চয়ই কেউ ভাবেনি আমি ১০ উইকেট পাব। যে কেউ পেতে পারে, কেউ নাও পেতে পারে…।”

সেটির পর আরও অনেক অনেক কীর্তি গড়েছেন কুম্বলে। ভারতের ইতিহাসের সেরা ম্যাচ উইনার তিনিই। পরে দারুণ সফল হয়েছেন ক্রিকেট প্রশাসক হিসেবে। আইপিএলে ছিলেন পরামর্শকের ভূমিকায়। এখন ভারতের কোচ হিসেবেও শুরুটা দুর্দান্ত। তার পরও কুম্বলে মানেই সবার আগে পারফেক্ট টেন। ১৮ বছর পরও তাই তালি উপহার পান সেই কীর্তিতে!